Jinn Satan – শয়তান জ্বীন এবং রুক্বিয়াঃ কুরআন এবং হাদীসের আলোকে আলোচনা

Jinn Satan – শয়তান জ্বীন এবং রুক্বিয়াঃ কুরআন এবং হাদীসের আলোকে আলোচনা – পর্ব ০১

‘Exorcism’ বা ‘রুক্বিয়া’ নিয়ে লিখতে গেলে প্রথমেই জ্বীন জাতির উপরে মৌলিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। আমাদের মাঝে অনেকেই আছেন যাঁরা জ্বীন এর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে রাজী নন। প্রথম পর্বে তাই জ্বীন জাতির মৌলিক তথ্যগুলো নিয়ে শুরু করছি। আমি মহান আল্লাহর নিকট বিতাড়িত শয়তান হ’তে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

জ্বীন: সত্য না দৃষ্টিভ্রম

ইসলাম ধর্মে ‘অদৃশ্যে’ বিশ্বাস স্থাপন করা অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পবিত্র কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে-

“এ সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী পরহেযগারদের জন্য। যারা অদেখা বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং নামায প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি তাদেরকে যে রুযী দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে।” (সূরা আল-বাকারা, ২-৩)

বুঝতেই পারছেন- অদেখা বিষয় বা অদৃশ্যে বিশ্বাস করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ বা বাধ্যতামূলক। জ্বীন এই অদৃশ্য বিষয়গুলোর মধ্যে একটি। পবিত্র কুরআনে বেশ কয়েকবার জ্বীনদেরকে মানুষদের সাথে সম্বোধন করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কাছে জ্বীনদের আগমন নিয়ে ‘সূরা জ্বীন’ নামে একটি সম্পূর্ণ সূরা অবতরণ করা হয়েছে।
জ্বীনদের অস্তিত্ব নিয়ে যাঁরা সন্দিহান, তাদের জন্য আমি পবিত্র কুরআন মাজীদে থেকে কয়েকটি আয়াত নিচে উল্লেখ করছি-

▪”যখন আমি একদল জ্বীনকে আপনার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম, তারা কোরআন পাঠ শুনছিল। তারা যখন কোরআন পাঠের জায়গায় উপস্থিত হল, তখন পরস্পর বলল, চুপ থাক। অতঃপর যখন পাঠ সমাপ্ত হল, তখন তারা তাদের সম্প্রদায়ের কাছে (জ্বীন সম্প্রদায়) সতর্ককারীরূপে ফিরে গেল।” (সূরা আল-আহক্বাফ, ২৯)
▪”হে জ্বীন ও মানব সম্প্রদায়, তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে পয়গম্বরগণ আগমন করেনি? যাঁরা তোমাদেরকে আমার বিধানাবলী বর্ণনা করতেন এবং তোমাদেরকে আজকের এ দিনের সাক্ষাতের ভীতি প্রদর্শন করতেন? তারা বলবেঃ আমরা স্বীয় গোনাহ স্বীকার করে নিলাম। পার্থিব জীবন তাদেরকে প্রতারিত করেছে। তারা নিজেদের বিরুদ্ধে স্বীকার করে নিয়েছে যে, তারা কাফের ছিল।” (সূরা আল-আনআ’ম, ১৩০)
▪“আমি জ্বীন ও মানুষকে কেবলমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি” (সূরা আয্-যারিয়াত, ৫৬)
▪”হে জ্বীন ও মানবকূল, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের প্রান্ত অতিক্রম করা যদি তোমাদের সাধ্যে কুলায়, তবে অতিক্রম কর। কিন্তু ছাড়পত্র ব্যতীত তোমরা তা অতিক্রম করতে পারবে না।” (সূরা আর-রহমান, ৩৩)
▪”বলুনঃ আমার প্রতি ওহী নাযিল করা হয়েছে যে, জ্বীনদের একটি দল কোরআন শ্রবণ করেছে, অতঃপর তারা বলেছেঃ আমরা বিস্ময়কর কোরআন শ্রবণ করেছি।” (সূরা জ্বীন, ১)
▪”আর এই যে মানুষের মধ্যের কিছু লোক জ্বীন জাতির কিছু লোকের আশ্রয় নিত, ফলে ওরা তাদের পাপাচার বাড়িয়ে দিত।” (সূরা জ্বীন, ৬)

জ্বীনের অস্তিত্ব পবিত্র কুরআন মাজীদ ও হাদীস দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। অসংখ্য সহীহ হাদিস রয়েছে যেগুলোতে জ্বীন জাতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আমি পবিত্র কুরআন মাজীদের রেফারেন্স দিয়েই শেষ করছি, হাদীসগুলোর রেফারেন্স দেয়ার প্রয়োজন মনে করছি না।

জ্বীন: কিসের তৈরী?

পবিত্র কুরআন এবং হাদীসের মাধ্যমে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় যে, জ্বীন জাতি আগুনের তৈরী।
“আর তিনি জ্বীনকে সৃষ্টি করেছেন আগুনের শিখা দিয়ে।” (সূরা আর-রহমান, ১৫)
“আর আমি এর আগে জ্বীন সৃষ্টি করেছি প্রখর আগুন দিয়ে।” (সূরা আল-হিজর, ২৭)
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সঃ) বলেছেন- “ফেরেশতারা আলোর তৈরী, জ্বীনরা আগুনের স্ফুলিংগ থেকে তৈরী এবং আদমকে যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে তার বর্ণনা (মাটি থেকে) পবিত্র কুরআনে রয়েছে।” (মুসলিম শরীফ ১৮/১২৩ – তাফসীর আন নববী)

জ্বীনের প্রকার

সা’লাবা আল খাসানি থেকে বর্ণিত, রাসুল (সঃ) বলেছেন- “তিন ধরনের জ্বীন আছে- এক প্রকারের জ্বীন পাখার মাধ্যমে বাতাসে ওড়ে, এক প্রকারের জ্বীন সাপ এবং মাকড়শার আকারে থাকে, শেষ প্রকারের জ্বীনরা সাধারনভাবে থাকে এবং চলাচল করে।” (আত তাবারানী, আল হাকিম ৩৭০২, বায়হাক্বী এবং সহীহ আল জামে’ ৩১১৪)

জ্বীনদের বাসস্থান

মানুষের পরিত্যক্ত স্থানগুলোতে জ্বীনরা থাকতে পছন্দ করে। তাদের অধিকাংশই লোকালয় থেকে দুরে নিরব কোন এলাকায় থাকে। তবে কিছু জ্বীন মানুষদের সাথে লোকালয়ে থাকে।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ সহীহ হাদিস থেকে জানা যায়, জ্বীনরা নোংরা ও গন্ধময় জায়গায় থাকতে পছন্দ করে যেখানে মানুষরা ময়লা এবং খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ ফেলে রাখে। মানুষের খাবারের উচ্ছিষ্ট জ্বীনদের খাবার। আমাদের ফেলে দেয়া মাংসের হাড়গুলো আল্লাহর কৃপায় মাংসসহ খাবার হয়ে যায় জ্বীনদের জন্য। রাসুল (সঃ) একারণেই রাস্তার পাশে পড়ে থাকা কোন হাড়ের ওপর প্রস্রাব করা কিংবা মাটি মিশ্রিত হাড়কে ঢিলা হিসেবে ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন।

টয়লেট এবং প্রস্রাব করার জায়গাগুলোতেও জ্বীনদের অবাধ বিচরণ থাকে। জায়েদ বিন আরকাম (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সঃ) বলেছেন- “এই জায়গাগুলোতে (টয়লেট এবং প্রস্রাব করার জায়গা) জ্বীন এবং শয়তানরা অবাধে বিচরণ করে। তোমাদের মধ্যে যেই এই স্থানগুলোতে যাবে, সে যেন বলে- ‘আমি আল্লাহর কাছে পুরুষ এবং মহিলা শয়তানের থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি’।” (আহমেদ ইবনে হাম্বল, ‘পবিত্রতা’ খন্ড, ৪/৩৬৯)

পুরুষ এবং মহিলা জ্বীন

উপরের হাদিস থেকেই স্পষ্ট বুঝতে পারা যায় যে জ্বীনদের মধ্যে পুরুষ এবং স্ত্রী জাতি রয়েছে। আয়াতুল কুরসী (সূরা বাক্বারা, ২৫৫) এর ফজিলতের বিষয়ে আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ একটি হাদিসের শেষ অংশে উল্লেখ করা হয়েছে- “যে এই আয়াত পড়বে, আল্লাহ তা’আলা তার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত করে দিবেন এবং কোন পুরুষ এবং নারী জ্বীন-শয়তান তার কাছে আসতে পারবে না।” (সহিহ বুখারী, ৫০১০)

ইবলিশ শয়তান এবং জ্বীনের সম্পর্ক

পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট উল্লখ করা হয়েছে যে ইবলিশ শয়তান জ্বীনদের একজন।

“যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললামঃ আদমকে সেজদা কর, তখন সবাই সেজদা করল ইবলিশ ব্যতীত। সে ছিল জিনদের একজন। সে তার পালনকর্তার আদেশ অমান্য করল। অতএব তোমরা কি আমার পরিবর্তে তাকে এবং তার বংশধরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করছ? অথচ তারা তোমাদের শত্রু। এটা জালেমদের জন্যে খুবই নিকৃষ্ট বদল।” (সূরা আল-কাহফ, ৫০)

জ্বীনদের ধর্ম

আমাদের মতো জ্বীনদের মধ্যেও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী রয়েছে। তাঁদের কেউ মুসলমান, কেউ খ্রিষ্টান, কেউ হিন্দু, কেউ বৌদ্ধ। নিচের আয়াতটি নিশ্চিত করে যে আমাদের মতো জ্বীনদেরও ঈমানী বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাদেরও কিয়ামতের পরে আল্লাহ পাকের কাছে আমাদের মতো বিচারের জন্য দাঁড়াতে হবে।

“হে জ্বীন ও মানব সম্প্রদায়, তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে পয়গম্বরগণ আগমন করেনি? যাঁরা তোমাদেরকে আমার বিধানাবলী বর্ণনা করতেন এবং তোমাদেরকে আজকের এ দিনের সাক্ষাতের ভীতি প্রদর্শন করতেন? তারা বলবেঃ আমরা স্বীয় গোনাহ স্বীকার করে নিলাম। পার্থিব জীবন তাদেরকে প্রতারিত করেছে। তারা নিজেদের বিরুদ্ধে স্বীকার করে নিয়েছে যে, তারা কাফের ছিল।” (সূরা আল-আনআ’ম, ১৩০)

জ্বীন জাতির খাবার

মানুষের মতো জ্বীন জাতিও খাবার গ্রহণ করে। মানুষের উচ্ছিষ্ট খাবার জ্বীনদের জন্য আল্লাহর রহমতে নতুন খাবার হয়ে যায়।

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সঃ) বলেছেন- “হাড় এবং গোবর জ্বীনদের খাবার। নসীবাঈন শহরের জ্বীনদের একটি দল আমার সাথে দেখা করতে আসে। কত বিনয়ী ছিল তাঁরা। তাঁরা আমার কাছে মানুষের খাবারের উচ্ছিষ্ট সম্পর্কে জানতে চায়। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যে তাঁরা এমন কোন হাড় কিংবা গোবর অতিক্রম করবে না যা তাঁদের জন্য খাবার না হয়ে যাবে।” (বুখারী, ৩৫৭১)

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সঃ) বলেছেন- “জ্বীনদের একজন আমাকে একদিন ডাকলে আমি তাঁর সাথে যাই। সেখানে আরো জ্বীন ছিল এবং আমি তাদের জন্য পবিত্র কুরআন পাঠ করি। তারা তাদের খাবারের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে আমি বলি- আল্লাহর নাম পড়ে খাওয়া হয়েছে এমন যে কোন হাড় তোমাদের সামনে এলে তা মাংসে পরিনত হয়ে যাবে। একইভাবে গোবর তোমাদের পশুদের খাবার হয়ে যাবে। তাই, ভারমুক্ত (টয়লেট করার পরে) হওয়ার পরে তোমাদের কেউ যাতে এই বস্তুগুলোকে (শুকনো হাড়, গোবর) দিয়ে নিজেকে পরিষ্কার না করে। কারণ তা হলো তোমাদের ভাইদের খাবার। (মুসলিম, ৪৫০)

জ্বীনদের চলাচলের সময়

জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সঃ) বলেছেন- “যখন রাত নামে (সন্ধ্যার শুরুতে) তোমাদের সন্তানদের ঘরের বাইরে যেতে বারণ কর। কারণ শয়তান এই সময়ে বের হয়। এক ঘন্টা পার হলে সন্তানদের যেতে দিও এবং আল্লাহর নাম নিয়ে ঘরের দরজাগুলো বন্ধ কর। কারণ শয়তান বন্ধ দরজা খুলতে পারে না। তারপর আল্লাহর নাম নিয়ে পানির পাত্রের মুখ বন্ধ কর। এরপরে আল্লাহর নাম নিয়ে খাবারের পাত্রগুলো ঢেকে রাখো। যদি ঢেকে রাখার কিছু না পাওয়া যায়, তবে অন্তত অন্য কিছু উপরে দিয়ে রাখো (কাঠ/বই ইত্যাদি)। এবং রাতে শোবার সময়ে কুপি বাতি নিভিয়ে শুতে যেও।” (বুখারী, ১০/৮৮. মুসলিম ১৩/১৮৫)

কিছু প্রাণী জ্বীনদের দেখতে পায়

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সঃ) বলেছেন- “যখন তোমরা গাধার চিত্কার শুনতে পাও, তখন আল্লাহর কাছে শয়তানের থেকে আশ্রয় প্রার্থনা কর. কারণ শয়তানকে দেখতে পাবার কারণেই তারা চিত্কার করে।” (বুখারী, ৬/৩৫০. মুসলিম ১৭/৪৭)

জ্বীনদের চেয়ে আল্লাহর কাছে মানুষ বেশি মর্যাদাপূর্ণ

জ্বীনদের থেকে আল্লাহর দৃষ্টিতে মানুষদের মর্যদা বেশি। পবিত্র কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে-
“নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” (সূরা বনী ইসরাইল, ৭০)

তারপরেও অজ্ঞতার কারণে অনেক মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে জ্বীনদের সহায়তা চায়। এই রকম অযৌক্তিক কাজ শিরকের অন্তর্ভুক্ত। জ্বীন তখন মানুষকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসতে চায়। কারণ শ্রেষ্ঠত্ব থাকা স্বত্তেও মানব সন্তান তার কাছে সাহায্য চেয়ে শিরক করেছে! পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- “আর এই যে মানুষের মধ্যের কিছু লোক জ্বীন জাতির কিছু লোকের আশ্রয় নিত, ফলে ওরা তাদের পাপাচার বাড়িয়ে দিত।” (সূরা জ্বীন, ৬)

জ্বীন মানুষ কিংবা প্রাণীর আকার ধারণ করতে পারে

মহান আল্লাহ পাকের দেয়া শক্তি ব্যবহার করে শয়তান জ্বীন মানুষ কিংবা প্রাণীর আকার বা রূপ ধারণ করতে পারে। সহীহ হাদীসের মাধ্যমে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত।

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ একটি হাদীসে এক দুষ্ট লোকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রতি রাতে যাকাতের মাল চুরি করতে আসতো। আবু হুরায়রা (রাঃ) প্রতি রাতেই তাকে ধরে ফেলতেন। কিন্তু লোকটি বিভিন্ন অনুরোধ করে মাফ নিয়ে চলে যেত এবং পরের রাতে আবার চুরি করতে আসতো। পরপর তিন রাতে সেই মানুষটিকে ধরার পরে রাসুল (সঃ) কে ঘটনা অবহিত করলে তিনি আবু হুরায়রা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করেন, “ওহে আবু হুরায়রা, তুমি কি জানো তুমি এই তিন রাতে কার সাথে কথা বলেছ? ওটা শয়তান ছিল।” (বুখারী, ৩২৭৫)

বদরের যুদ্ধের সময় ইবলিশ শয়তান মক্কার কুরাইশদের কাছে বনু কিনানাহর সর্দার সূরাক্বা ইবনে যুশাম এর আকার ধরে গিয়ে তাদেরকে রাসুল (সঃ) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্ররোচনা দিয়েছিল। (ইবনে কাসীর, আল বিদায়া ওয়াল নিহায়া, ৫/৬২)

আবু সাইদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সঃ) বলেছেন- “মদিনার কিছু সংখ্যক জ্বীন মুসলমান হয়েছে। এদেরকে (প্রাণী হিসেবে) যদি কেউ দেখো, তাহলে তিনবার সাবধান করবে। তারপরেও আবার এলে সেই প্রাণীকে হত্যা করবে।” (মুসলিম, ২২৩৬)

জ্বলন্ত উল্কাপিন্ড শয়তান জ্বীনকে ধাওয়া করে

শেষ নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর নবুওয়তের আগ পর্যন্ত জ্বীন জাতি আকাশে প্রান্ত সীমা পর্যন্ত গিয়ে ঘাপটি মেরে সংবাদ সংগ্রহের জন্য লুকিয়ে থাকত। আল্লাহ তা’আলা যখন কোন আদেশ করতেন ফেরেশতাদের, তখন ফেরেশতারা সেই আদেশ মুখে মুখে ছড়িয়ে দিত। শয়তান জ্বীন তখন টুকরো টুকরো কিছু খবর চুরি করে পৃথিবীতে এসে সেগুলোর সাথে বিভিন্ন মিথ্যা মিশিয়ে ভাগ্য গণনাকারীদের কাছে বলত, যার কিছু কিছু পরবর্তীতে সত্য হিসেবে প্রকাশ পেত।

রাসুল (সঃ) এর নবুওয়তের পরে আল্লাহ তা’আলা উর্ধ্বাকাশ এবং নিচের আকাশের মাঝে একটি পর্দা দিয়ে দিলেন। ফলে শয়তান জ্বীনরা আর কোন আদেশ শুনতে পেত না। বরং চুরি করে খবর শুনতে নিলেই জ্বলন্ত উল্কাপিন্ড তাদের পিছু নিত।

হঠাত করেই এই রকম পরিবর্তনে অবাক হয়ে শয়তান তার অধীনস্থ সকল জ্বীনদের পৃথিবীর আনাচে-কোনাচে পাঠিয়ে দিল মূল খবর বের করার জন্য- কি এমন ঘটনা ঘটেছে যার কারণে উর্ধ্বাকাশ থেকে কোন খবর আনা যাচ্ছে না? খবরের সন্ধানে জ্বীনদের একদল যখন নাখালা নামের জায়গা দিয়ে যাচ্ছিল, রাসুল (সঃ) তখন সেই পথে ‘উকাজ’ নামের বাজারে ইসলামের দাওয়াতের জন্য যাচ্ছিলেন। জ্বীনদের দল যখন সেখানে পৌঁছল, রাসুল (সঃ) তখন সাহাবীদের নিয়ে ফজরের নামাজ পড়ছিলেন। রাসুল (সঃ) এর মুখে কুরআনের তেলাওয়াত শুনেই জ্বীনদের সেই দল বুঝতে পারল কি কারণে তাদেরকে উর্ধ্বাকাশে যেতে বাধা দেয়া হচ্ছিল। তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং নিজ সম্প্রদায়ের কাছে সংবাদ নিয়ে ফেরত যায়।

“বলুনঃ আমার প্রতি ওহী নাযিল করা হয়েছে যে, জিনদের একটি দল কোরআন শ্রবণ করেছে, অতঃপর তারা বলেছেঃ আমরা বিস্ময়কর কোরআন শ্রবণ করেছি; যা সৎপথ প্রদর্শন করে। ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনও আমাদের পালনকর্তার সাথে কাউকে শরীক করব না। এবং আরও বিশ্বাস করি যে, আমাদের পালনকর্তার মহান মর্যাদা সবার উর্ধ্বে। তিনি কোন পত্নী গ্রহণ করেননি এবং তাঁর কোন সন্তান নেই। আমাদের মধ্যে নির্বোধেরা আল্লাহ তা’আলা সম্পর্কে বাড়াবাড়ির কথাবার্তা বলত।” (সূরা জ্বীন ১-৪)

“আমরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করছি, অতঃপর দেখতে পেয়েছি যে, কঠোর প্রহরী ও উল্কাপিন্ড দ্বারা আকাশ পরিপূর্ণ। আমরা আকাশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে সংবাদ শ্রবণার্থে বসতাম। এখন কেউ সংবাদ শুনতে চাইলে সে জলন্ত উল্কাপিন্ড ওঁৎ পেতে থাকতে দেখে।” (সূরা জ্বীন, ৮-৯)

“নিশ্চয় আমি নিকটবর্তী আকাশকে তারকারাজির দ্বারা সুশোভিত করেছি। এবং তাকে সংরক্ষিত করেছি প্রত্যেক অবাধ্য শয়তান থেকে। ওরা উর্ধ্ব জগতের কোন কিছু শ্রবণ করতে পারে না এবং চার দিক থেকে তাদের প্রতি উল্কা নিক্ষেপ করা হয়। ওদেরকে বিতাড়নের উদ্দেশে। ওদের জন্যে রয়েছে বিরামহীন শাস্তি। তবে কেউ ছোঁ মেরে কিছু শুনে ফেললে জ্বলন্ত উল্কাপিন্ড তার পশ্চাদ্ধাবন করে।” (সূরা আস-সাফফাত, ৬-১০)

জ্বীন কি মানুষের ওপর ভর করতে পারে?

জ্বীনের মানুষের ওপর ভর করা কিংবা মানুষের যাদুগ্রস্থ হওয়াকে সাধারনভাবে আরবীতে ‘সাহর’ বলে। এটি এমন একটি অবস্থা যখন মানুষের নিজের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এবং সাময়িক স্মৃতি বিভ্রম ঘটে। পবিত্র কুরআন এবং হাদীসের আলোকে ‘সাহর’ একটি নিশ্চিত বিষয়।

“যারা সুদ খায়, তারা কিয়ামতে দন্ডায়মান হবে, যেভাবে দন্ডায়মান হয় ঐ ব্যক্তি, যাকে শয়তান আসর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়।” (সূরা বাক্বারা, ২৭৫)

শয়তানের আসরে মানুষ মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ে- এই বিষয়টি নিশ্চিত। ইমাম কুরতুবী, তাবারী, ইবনে-কাসীর সহ অধিকাংশ তাফসীরবিদ এই আয়াতকে জ্বীনের মানুষের ওপর ভর করার সুনির্দিষ্ট প্রমান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। (তাফসীর আল কুরতুবী ৩/৩৫৫, তাফসীর আল তাবারী ৩/১০১, তাফসীর ইবনে কাসীর ১/৩২৬)

সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে- রাসুল (সঃ) বলেছেন, “শয়তান আদম সন্তানের শরীরে প্রবাহিত হয়, যেমন রক্ত শরীরে প্রবাহিত।” (বুখারী, ৩৩/২৫১। মুসলিম, ২১৭৫)

ইমাম আহমদের ছেলে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, “আমি আমার বাবা (ইমাম আহমাদ) কে বললাম- কিছু মানুষ মানুষের শরীরে জ্বীনের ভর করাকে বিশ্বাস করে না। তিনি বলেন- ও আমার সন্তান, তারা মিথ্যা বলছে। আসর করা অবস্থায় অসুস্থ লোকের মুখ দিয়ে জ্বীন কথাও বলতে পারে।” (মাজমু ফতোয়া- ইবনে তাইমিয়াহ ১৯/১২)

ইমাম আহমদ এবং ইমাম বায়হাকী কর্তৃক লিপিবদ্ধ সহীহ হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, রাসুল (সঃ) একবার একটি অসুস্থ বালকের সাক্ষাত পেয়েছিলেন যার ওপর জ্বীনের ভর ছিল। রাসুল (সঃ) ছেলেটির দিকে ফিরে জোরে বলেন- “ও আল্লাহর শত্রু, বের হয়ে আসো। ও আল্লাহর শত্রু, বের হয়ে আসো। ছেলেটি দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে।” (ইবনে মাজাহ, ৩৫৪৮। আহমদ ৪/১৭১, ১৭২)

এছাড়াও বিভিন্ন সাহাবীদের থেকে অসংখ্য সহীহ হাদিস বর্ণনা করা হয়েছে এই প্রসঙ্গে যেখানে রাসুল (সঃ) সাহরগ্রস্থ রোগীর ওপরে দোআ করে সাহর মুক্ত করেছেন। সাহাবীদের মধ্যে ইয়ালা ইবনে মুররাহ (রাঃ), জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ), আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:), আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ), আবু আল ইয়ুসর (রাঃ), সাফিয়া বিনতে হুয়াই (রাঃ), উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ), উসমান বিন আল’আস (রাঃ) উল্লেখযোগ্য। সময়ের অভাবে সবগুলো ঘটনা উল্লেখ করা সম্ভব হলো না।

 

শয়তান জ্বীন এবং রুক্বিয়াঃ কুরআন এবং হাদীসের আলোকে আলোচনা – পর্ব ০২

 

জ্বীন কি মানুষের ওপর ভর করার সম্ভাব্য কারণ

ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহিমাহুল্লাহ) বিভিন্ন সহীহ হাদিস, নিজ চোখে দেখা ঘটনা এবং রুক্বিয়ার ভিত্তিতে প্রাপ্ত তথ্য থেকে মানুষের ওপর জ্বীনের ভর করার সম্ভাব্য কারণগুলো উল্লেখ করেছেন। কারণগুলোর স্বপক্ষের হাদীসগুলো গত পর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। নিচে কারণগুলো উল্লেখ করছি-

১. পুরুষ কিংবা মহিলা জ্বীনের বিপরীত লিঙ্গের মানুষের প্রতি স্বভাবজাত মুগ্ধতা।

২. জ্ঞানত কিংবা নিজের অজান্তে মানুষের মাধ্যমে কোন জ্বীনের ক্ষতি সাধিত হলে। (গরম পানি ফেলা, প্রস্রাব করা, ইটের টুকরা নিক্ষেপ করা, জ্বীনদের খাবার হাড়/গোবরকে নষ্ট করা, প্রাণীর আকার নেয়া অবস্থায় মারা ইত্যাদি)

৩. শুধুমাত্র অনিষ্টের উদ্দেশ্যে ভর করা। সাধারণত মানুষের তিনটি অবস্থায় শয়তান জ্বীন এই সুযোগ গ্রহণ করে: তীব্র রাগের সময়ে, তীব্র ভয়ের সময়ে এবং মন্দ কোন কিছুর জন্য তীব্র আকাংখার সময়ে। একটু লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন, এই তিনটি পর্যায়ে মানুষের নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ খুব কম থাকে এবং আল্লাহর বিশ্বাসের পথ থেকে দুরে থাকে।

৪. যাদু-টোনার/কু-নজরের কারণে। (যাদু এবং কু-নজরের বিষয়টি ইসলামে অকাট্যভাবে প্রমানিত। রাসুল (সঃ) এর চুল নিয়ে জনৈক ইহুদী কর্তৃক যাদু করা এবং ‘সূরা নাস’ এবং ‘সূরা ফালাক’ এর অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট এবং সহীহ বুখারীর অসংখ্য হাদীস (সহীহ বুখারী ৭১/৬৩৪, ৭৮৪, ৮২৭। ৭/৬৫৮। ৭৫/৪০০। ৬৬/৩৭৮। ৫৪/৪৯০। ৫৩/৪০০) এর প্রমান। কিছু যৌক্তিক কারণে এই বিষয়টি নিয়ে কোন কিছু বিস্তারিত লেখা থেকে নিজেকে বিরত রাখছি। বিস্তারিত জানতে চাইলে নিজে তাফসীর পড়তে পারেন কিংবা কোন মুফতির সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।

মানুষের ওপর জ্বীন ভর করার সম্ভাব্য লক্ষণ সমূহ

সবার প্রথমে একটি বিষয় নিশ্চিত করতে চাই. পবিত্র কুরআন এবং হাদীসের আলোকে জ্বীন আসর করার লক্ষণ সমূহের বিষয়ে “মোহাবিষ্ট”, “উদভ্রান্ত” ইত্যাদি ছাড়া বিস্তারিত কিছু বলা হয় নি। ইবনে তাইমিয়াহ(রহিমাহুল্লাহ), ইবনে কাসীর(রহিমাহুল্লাহ), জালালুদ্দিন সুয়ুতি(রহিমাহুল্লাহ), আব্দুল খালিক আল-আত্তার (রহিমাহুল্লাহ) প্রমুখ প্রখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্বের লিখিত বইয়ের ভিত্তিতে প্রসিদ্ধ মিশরীয় আলিম ওয়াহিদ আব্দুল সালাম (রহিমাহুল্লাহ) নিচের লক্ষনগুলো বর্ণনা করেছেন। মদিনা ইউনিভার্সিটির সম্মানিত শিক্ষক, বিশিষ্ট ফকীহ এবং আলিম আবু বকর জাবির আল-জাজাইরি (শাইখ আব্দুল আজীজ বিন বাজ এর স্নেহধন্য) এই লক্ষনগুলো নিশ্চিত করেছেন।

রুক্বিয়া বিষয়ে আমার দীর্ঘ পড়াশুনায় যতগুলো বইয়ে সাহর এর “লক্ষণ” এর কথা লেখা দেখেছি প্রায় সব জায়গায় একটি বিষয় প্রথমে নিশ্চিত করা হয়েছে, তাহলো- কারো ওপরে শয়তান জ্বীনের আসরের কারণে লক্ষনগুলো দেখা দিতে পারে। কিন্তু এই লক্ষণ থাকা মানেই কেউ শয়তান জ্বীনের দ্বারা আক্রান্ত, এটা ভাবার কোন যৌক্তিকতা নেই। বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক উন্নত। প্রথমেই একজন ভালো ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত হবে।

রুক্বিয়া “অল্টারনেটিভ মেডিসিন” হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চিকিত্সা বিজ্ঞানের কোন বিরোধ নেই এই প্রক্রিয়ার সাথে। উপরন্তু, একজন যোগ্য এবং রুক্বিয়ার বিষয়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আলিম ছাড়া জ্বীনের আসর করার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া এবং রুক্বিয়া শুরু করা “তীব্রভাবে নিরুৎসাহিত” করা হয়েছে।

দুই ধরনের লক্ষণের কথা আলোচনা করা হয়েছে- ক) ঘুমন্ত অবস্থায় লক্ষণ, খ) জাগ্রত অবস্থায় লক্ষণ।

ক) ঘুমন্ত অবস্থায় লক্ষণসমূহঃ

১. উদ্বেগ জনিত অনিদ্রা।
২. দুঃস্বপ্ন।
৩. ক্রমাগত স্বপ্নে ভয়ংকর প্রাণী দেখা।
৪. ঘুমের মধ্যে অতিরিক্ত হাসি, কান্না, চিত্কার, গোঙানি।
৫. নিয়মিত ঘুমের ঘোরে হাঁটা ইত্যাদি

খ) জাগ্রত অবস্থায় লক্ষণসমূহঃ

১. কোন শারীরিক সমস্যা ছাড়াই তীব্র মাথা ব্যথা।
২. আল্লাহ, রাসুল (সঃ) এবং ইসলাম ধর্মের নিয়ম-কানুন গুলোর উপরে তীব্র বিতৃষ্ণা।
৩. সবসময় প্রচন্ড অমনোযোগী, অলস এবং মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত থাকা।
৪. কোন শারীরিক সমস্যা ছাড়াই প্রায়ই তীব্র খিঁচুনি।
৫. কোন শারীরিক সমস্যা ছাড়াই শরীরের বিশেষ কোন একটি অঙ্গে তীব্র ব্যথা ইত্যাদি।

মানুষের ওপর জ্বীন ভর করার প্রকার

তিন ধরনের আসর হতে পারে শয়তান জ্বীনের মাধ্যমে-

১. সামগ্রিক: পুরোপুরি ভর করা. প্রায়ই খিঁচুনি সামগ্রিক ভর নিশ্চিত করে।
২. আংশিক: শরীরের কোন একটি নির্দিষ্ট অঙ্গে ভর করা যেমন- পা, হাত, জিহ্বা ইত্যাদি।
৩. স্বল্পস্থায়ী: এই ধরনের আসরে রোগী মিনিট দুইয়েকের জন্য অজ্ঞান হয়ে যায় সাধারণত। অনেকটা দুঃস্বপ্ন দেখার মতো অভিজ্ঞতা হয় রোগীর।

রুক্বিয়া সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া

অত্যন্ত যৌক্তিক কিছু কারণে রুক্বিয়া পরিচালনার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ করব না। ইবলিশ এবং শয়তান জ্বীন মানুষের আজন্ম শত্রু। এদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে নামলে পাল্টা আক্রমন খুবই স্বাভাবিক। নিজেকে প্রস্তুত না করে এই যুদ্ধে নামা নিছক বোকামী এবং বিপদজনক।
একজন পরিপূর্ণ মুসলিম যিনি রুক্বিয়া পরিচালনা করার দায়িত্ব নিতে চান, তাঁর নিচের গুনাবলী থাকা অত্যাবশ্যক। নিচের উল্লেখিত গুনাবলী যাচাই করে আমরা নিজেরাই বিবেচনা করতে পারি, আমাদের মধ্যে কে কতটুকু যোগ্য এই কাজের জন্য।

রুক্বিয়া পরিচালনাকারীর আবশ্যক গুনাবলী:

১. তাঁর ঈমানের ভিত অত্যন্ত মজবুত হতে হবে. ঈমানের সকল শাখা-প্রশাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ এবং পূর্ণ দখল থাকতে হবে।

২. ইসলামের একত্ববাদের (তাওহিদ) শক্ত কান্ডারী হতে হবে তাঁকে।

৩. “আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তা’আলা কথা পবিত্র কুরআন মাজীদের আয়াত শয়তান জ্বীনদের উপরে ভয়ংকর কার্যকারী”- এই ধ্রুব সত্যে বিশ্বাসী এবং যে কোন পরিস্থিতে এই সত্যের ওপরে পর্বত প্রমান স্থির থাকতে হবে।

৪. ইবলিশ এবং শয়তান জ্বীনদের আচরণ, জীবন যাপন থেকে শুরু করে তাদের কর্মকান্ডের বিষয়ে যতদুর সম্ভব স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। আমার আগের পর্বগুলোতে আমি গুটিকয়েক হাদীস বর্ণনা করেছি মাত্র। এ সংক্রান্ত অসংখ্য হাদীস এবং নামকরা তাবেঈ’ন, তাবে তাবেঈ’নদের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ বই রয়েছে।

৫. কারো ওপরে ভর করার পরে শয়তান জ্বীনদের ধূর্ত আচরণ এবং ফাঁদ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।

[এ প্রসঙ্গে ইবনে তাইমিয়াহ (রহিমাহুল্লাহ) এর একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। জ্বীনের আসর করা এক রোগীর ওপরে রুক্বিয়া পরিচালনা করার এক পর্যায়ে শয়তান জ্বীন জানায় যে সে ইবনে তাইমিয়াহ (রঃ) এর সম্মানে রোগীকে ছেড়ে চলে যাবে। ইবনে তাইমিয়াহ (রহিমাহুল্লাহ) সেই মুহুর্তেই পাল্টা জবাব দিয়ে বলেন যে তাঁর সম্মানে চলে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই জ্বীনের। শুধুমাত্র আল্লাহকে ভয় এবং সম্মান করার কারণে সে রোগীকে ছেড়ে যেতে পারে। ইবনে তাইমিয়াহ (রহিমাহুল্লাহ) এর জন্য এটি ফাঁদ ছিল। তিনি যদি তাঁর সম্মানে জ্বীনের চলে যাওয়াতে রাজী হতেন, তাহলে আল্লাহর উপরে তাঁর অবস্থানের কথাতে (নাউজুবিল্লাহ) প্রকারন্তে সম্মতি জানানো হতো। রুক্বিয়া পরিচালনা করার সময় শয়তান জ্বীন এরকম অসংখ্য উপায়ে পরিচালনাকারীকে ফাঁদে ফেলতে চায়।]

৬. রুক্বিয়া পরিচালনাকারী একজন বিবাহিত মানুষ হলে উত্তম।

৭. ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ যাবতীয় কাজ থেকে তাকে অবশ্যই দুরে থাকতে হবে।

৮. শুধুমাত্র রাসুলুল্লাহ (সঃ) কর্তৃক শিক্ষা দেয়া দোআ এবং পবিত্র কুরআনের আয়াত দিয়ে রুক্বিয়া পরিচালনার অভ্যাস থাকতে হবে। কোন প্রকার বিদআ’ত/কুফরী কর্মকান্ডের অনুসারী হওয়া যাবে না- সেটা যত খারাপ অবস্থাতেই হোক না কেন।

৯. রুক্বিয়ার মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করা ছাড়া তাঁর অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকা যাবে না।

১০. তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে, যেহেতু তিনি আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল, সেহেতু আল্লাহ তা’আলা তাকে শয়তান জ্বিনের ওপরে জয়ী অবশ্যই করবেন ইন শা আল্লাহ।

উপরের আবশ্যক গুনাবলী থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারা যায় সবার পক্ষে রুক্বিয়া পরিচালনা করা সম্ভবপর নয় এবং উচিতও হবে না।

শয়তান জ্বীনের আসরযাদু এবং বদ নজর থেকে বেঁচে থাকার উপায়

ইবলিশ এবং ইবলিশের অনুগত শয়তান জ্বীন মানুষের আজন্ম শত্রু। তারা সবসময় মানুষদের পেছনে পথভ্রষ্ট করার জন্য কাজ করে। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তা’আলা অভয় দিয়েছেন যে যারা আল্লাহর দেখানো পথে চলবে, তাদের ওপর শয়তান কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারবে না।

পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন বিষয়ে এই সম্পর্কে স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে-

“শয়তান তোমাদের শত্রু; অতএব তাকে শত্রু রূপেই গ্রহণ কর। সে তার দলবলকে আহবান করে যেন তারা জাহান্নামী হয়।” (সূরা ফাতির, ৬)

“হে বনী-আদম! আমি কি তোমাদেরকে বলে রাখিনি যে, শয়তানের এবাদত করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু?” (সূরা ইয়া সীন, ৬০)

“সে (ইবলিশ) বললঃ আমাকে কেয়ামত দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন। আল্লাহ বললেনঃ তোকে সময় দেয়া হল। সে বললঃ আপনি আমাকে যেমন উদভ্রান্ত করেছেন, আমিও অবশ্য তাদের জন্যে আপনার সরল পথে বসে থাকবো। এরপর তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে এবং বাম দিক থেকে। আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না। আল্লাহ বললেনঃ বের হয়ে যা এখান থেকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে। তাদের যে কেউ তোর পথেচলবে, নিশ্চয় আমি তোদের সবার দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করে দিব।” (সূরা আল-আ’রাফ, ১৪-১৮)

“সে (ইবলিশ) বললঃ আমার প্রভু! তুমি যেমনি আমাকে বিপথে যেতে দিয়েছ, আমিও তেমনি নিশ্চয়ই তাদের নিকট চিত্তাকর্ষক করব এই পৃথিবীতে, আর অবশ্যই তাদের একসাথে বিপথগামী করব তাদের মধ্যে তোমার খাস বান্দাদের ব্যতীত। তিনি (আল্লাহ) বললেনঃ এটিই হচ্ছে আমার দিকে সহজ-সঠিক পথ। নিঃসন্দেহ আমার দাসদের সন্বন্ধে তাদের উপরে তোমার কোনো আধিপত্য নেই, বিপথগামীদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করে তাদের ব্যতীত।” (সূরা আল-হিজর, ৩৯-৪২)

“নিঃসন্দেহ আমার বান্দাদের সন্বন্ধে, তাদের উপরে তোমার কোনো প্রভাব নেই। আর কর্ণধাররূপে তোমার প্রভুই যথেষ্ট।” (সূরা বনী ইসরাঈল, ৬৫)

উপরের আয়াতগুলোর মাধ্যমে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে মহান আল্লাহ পাকের দেখানো পথে যারা চলবেন, তাদেরকে ইবলিশ এবং তার জ্বীনবাহিনী কোনভাবেই কাবু করতে পারবে না। আলহামদুলিল্লাহ।

সুতরাং শয়তান জ্বীনের আসর, যাদু এবং বদ নজর থেকে বেঁচে থাকার সর্বোত্তম এবং শ্রেষ্ঠ উপায় হলো “সীরাতুল মুস্তাকিম” এর পথে চলা। সহজ কথায়- আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল (সঃ) এর প্রকৃত আনুগত্য এবং প্রদর্শিত উপায়ে শান্তির ধর্ম ইসলামের বিধানসমূহ মোতাবেক জীবন যাপন করা।

এর বাইরেও সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে কিছু কিছু বিষয়ে অবশ্যই সতর্কতা অনুসরণ করা উচিত সবার। এছাড়া পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং রাসুলে করীম (সঃ) এর নিজের শেখানো এবং পড়া কিছু দোআও রয়েছে, যেগুলো নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট কিছু সময়ে পড়লে শয়তান জ্বীনের আসর, যাদু এবং বদ নজর থেকে নিজেকে যথাসম্ভব রক্ষা করা যায়।

হাদীসগুলোর বিষয়ে পূর্বেই বিস্তারিত উল্লেখ করেছি। তাই নিচে বিষয়গুলো পয়েন্ট আকারে উল্লেখ করছি।

১. খাবার খাওয়া, পানি খাওয়া থেকে শুরু করে যে কোন কাজ মহান আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তা’আলা নাম নিয়ে শুরু করা।

২. উঁচু কোন জায়গা থেকে লাফ দেয়ার আগে মহান আল্লাহ পাকের নাম স্মরণ করা/পড়া।

৩. কোন অন্ধকার রুমে প্রবেশ করার আগে মহান আল্লাহ পাকের নাম স্মরণ করা/পড়া।

৪. কোথাও গরম পানি ফেলা/ঢালার আগে মহান আল্লাহ পাকের নাম স্মরণ করা/পড়া।

৫. কোন কারণ ছাড়া কোন প্রাণীকে আঘাত না করা।

৬. কোন যৌক্তিক কারণ ছাড়াই একাকী রুমে না ঘুমানো। পরিস্থিতির কারণে যদি একাকী রুমে ঘুমাতে হয়- তাহলে ওজু করে মহান আল্লাহ পাকের নাম স্মরণ করে ঘুমাতে যাওয়া।

৭. কোন গর্ত কিংবা গুহায় প্রস্রাব না করা।

৮. বাসা-বাড়ির ভেতরে কোন সাপ দেখলে সাথে সাথে তাকে হত্যা না করা। বরং তাকে মহান আল্লাহর ওয়াস্তে চলে যেতে বলা উচিত। তিনদিনে তিনবার আল্লহর ওয়াস্তে চলে যাবার কথা বলার পরেও চতুর্থ দিন সাপটিকে হত্যা করা যেতে পারে। (তিনদিন কিংবা তিনবার বলার বিষয়ে আগেই বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।)

৯. সূর্যের আলো এবং কোন কিছুর ছায়ার মিলনরেখায় না বসা।

১০. টয়লেটে প্রবেশের আগে রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর শেখানো দোআ পড়ে নেয়া। দোআটি পরে উল্লেখ করছি।

১১. যৌক্তিক কারণ ছাড়া বাথরুমে অতিরিক্ত সময় না কাটানো। গোসলের সময় পুরোপুরি নগ্ন না হয়ে গোসল করা।

১২. কোন কারণ ছাড়া গভীর রাতে একাকী রাস্তা, বন-মরুভূমিতে ঘুরাঘুরি না করা।

১৩. উঁচু কোন জায়গা থেকে কোন কিছু নিচে নিক্ষেপ করার আগে মহান আল্লাহ তা’আলার নাম স্মরণ করা/পড়া।

১৪. গোবর কিংবা হাড় মেশানো মাটির চাকাকে ঢিলা হিসেবে ব্যবহার না করা।

১৫. হাসি, কান্না, রাগ, ক্ষোভ কোন কিছুতেই তীব্রভাবে আচরণ করা। সব কিছুতেই মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা উত্তম।

১৬. সব সময়, বিশেষ করে রাগের সময় অশ্লীল কথা থেকে নিজেকে বিরত রাখা।

১৭. ইসলামের বিধান মোতাবেক পর্দা প্রথা মেনে চলা।

১৮. কোন কারণে শয়তান জ্বীনদের আক্রমনের শিকার হচ্ছেন বুঝতে পারলে কিংবা ধারণা হলে উচ্চ স্বরে আযান দেয়া।

১৯. সর্ব অবস্থায় নিজেকে ওজুর মধ্যে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ শয়তান জ্বীনদের বিরুদ্ধে খুবই কার্যকর একটি অস্ত্র।

২০. দিনের শুরুতে এবং ঘুমানোর আগে পবিত্র কুরআনের কিছু নির্দিষ্ট সূরা/আয়াত এবং রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর শেখানো দোআ পড়ে নেয়া।

শয়তান জ্বীনের আসরযাদু এবং বদ নজর থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য দোআ

পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং মুহাম্মদ (সঃ) এর নিজের শেখানো এবং পড়া কিছু দোআও রয়েছে যেগুলো নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট কিছু সময়ে পড়লে শয়তান জ্বীনের আসর, যাদু এবং বদ নজর থেকে নিজেকে যথাসম্ভব রক্ষা করা যায়। আমি সেই আয়াতগুলোর বিষয়ে নিচে উল্লেখ করছি। উচ্চারণ এবং অর্থ কুরআন মাজিদ থেকে জেনে নিতে পারবেন।

১. সূরা আল ফাতিহা
২. সূরা আল বাক্বারা (১-৫)
৩. সূরা আল বাক্বারা (১৬৩-১৬৪)
৪. সূরা আল বাক্বারা (২৫৫) [আয়াতুল কুরসী)
৫. সূরা আল বাক্বারা (২৮৫-২৮৬) [শেষ দুই আয়াত]
৬. সূরা আল ইমরান (১৮-১৯)
৭. সূরা আল আ’রাফ (৫৪-৫৬)
৮. সূরা আল মু’মিনুন (১১৫-১১৮) [শেষ চার আয়াত]
৯. সূরা আস সাফফাত (১-১০)
১০. সূরা আল আহক্বাফ (২৯-৩২)
১১. সূরা আর রাহমান (৩৩-৩৬)
১২. সূরা আল হাশর (২১-২৪) [শেষ চার আয়াত]
১৩. সূরা আল-জ্বীন (১-৯)
১৪. সূরা আল ইখলাস
১৫. সূরা আল ফালাক্ব
১৬. সূরা অন নাস

বিশেষ কয়েকটি দোআঃ

এছাড়া “হিসনুল মুসলিম” নামক দোয়ার বই থেকে রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর শেখানো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দোআ’র আরবী উচ্চারণ বাংলা অর্থসহ নিচে থেকে উল্লেখ করছি।

১. ঘুমাতে যাবার আগের বিশেষ দোআঃ

«بِاسْمِكَ اللَّهُمَّ أَمُوتُ وَأَحْيَا»

(বিস্‌মিকাল্লা-হুম্মা আমূতু ওয়া আহ্ইয়া) | অর্থ: “হে আল্লাহ! আপনার নাম নিয়েই আমি মরছি (ঘুমাচ্ছি) এবং আপনার নাম নিয়েই জীবিত (জাগ্রত) হবো।” [বুখারী, (ফাতহুল বারীসহ) ১১/১১৩, নং ৬৩২৪; মুসলিম ৪/২০৮৩, নং ২৭১১।]

২. ঘুম থেকে জাগার পরের বিশেষ দোআঃ

«الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِيْ أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا، وَإِلَيْهِ النُّشُوْرُ»

(আলহামদু লিল্লা-হিল্লাযী আহ্ইয়া-না- বা‘দা মা- আমা-তানা- ওয়া ইলাইহিন্ নুশূর) | অর্থ: “হামদ-প্রশংসা আল্লাহ্‌র জন্য, যিনি (নিদ্রারূপ) মৃত্যুর পর আমাদেরকে জীবিত করলেন, আর তাঁরই নিকট সকলের পুনরুত্থান।” [বুখারী ফাতহুল বারী ১১/১১৩, নং ৬৩১৪; মুসলিম ৪/২০৮৩, নং ২৭১১]

৩. ঘর থেকে বের হওয়ার সময়ের বিশেষ দোআঃ

«بِسْمِ اللَّهِ، تَوَكَّلْتُ عَلَى اللَّهِ، وَلَاَ حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ»

(বিসমিল্লাহি, তাওয়াককালতু ‘আলাল্লা-হি, ওয়ালা হাওয়া ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ) | অর্থ: “আল্লাহ্‌র নামে (বের হচ্ছি)। আল্লাহর উপর ভরসা করলাম। আর আল্লাহর সাহায্য ছাড়া (পাপ কাজ থেকে দূরে থাকার) কোনো উপায় এবং (সৎকাজ করার) কোনো শক্তি কারো নেই।” [আবূ দাউদ ৪/৩২৫, নং ৫০৯৫; তিরমিযী ৫/৪৯০, ৩৪২৬। আরও দেখুন, সহীহুত তিরমিযী, ৩/১৫১।]

৪. টয়লেট/বাথরুমে ঢোকার আগের বিশেষ দোআঃ

«[بِسْمِ اللَّهِ] اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْخُبْثِ وَالْخَبائِث»

([বিসমিল্লাহি] আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ‘ঊযু বিকা মিনাল খুব্‌সি ওয়াল খাবা-ইসি) | অর্থ: “[আল্লাহ্‌র নামে।] হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট অপবিত্র নর জিন্ ও নারী জিন্ থেকে আশ্রয় চাই।” [বুখারী ১/৪৫, নং ১৪২; মুসলিম ১/২৮৩, নং ৩৭৫। শুরুতে অতিরিক্ত ‘বিসমিল্লাহ্‌’ উদ্ধৃত করেছেন সা‘ঈদ ইবন মানসূর। দেখুন, ফাতহুল বারী, ১/২৪৪।]

৫. টয়লেট/বাথরুম থেকে বের হবার পরের বিশেষ দোআঃ

«غُفْرَانَكَ»

(গুফরা-নাকা) | অর্থ: “আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।” [হাদীসটি নাসাঈ ব্যতীত সকল সুনান গ্রন্থকারই উদ্ধৃত করেছেন; তবে নাসাঈ তার ‘আমালুল ইয়াওমি ওয়াললাইলাহ’ গ্রন্থে (নং ৭৯) তা উদ্ধৃত করেছেন। আবূ দাউদ, নং ৩০; তিরমিযী, নং ৭; ইবন মাজাহ্‌, নং ৩০০। আর শাইখ আলবানী সহীহ সুনান আবি দাউদে ১/১৯ একে সহীহ বলেছেন।]

শেষ কথা

ইবলিশ এবং শয়তান জ্বীনের ভর করা এবং রুক্বিয়া নিয়ে আমার দীর্ঘ পড়াশুনা লব্ধ জ্ঞান আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম। যেহেতু বিষয়টি প্রথাগত কিছু নয় এবং বাংলা ভাষায় এই বিষয় নিয়ে খুব কম লেখালেখি হয়েছে তাই আমি নিজেও বেশ কিছুটা চিন্তিত ছিলাম বিষয়টি নিয়ে লিখব, কি লিখব না? কারণ ভুল বুঝার অসংখ্য সুযোগ থাকে এই সব অপ্রথাগত বিষয়ে। অতি প্রয়োজনীয় কিন্তু অতি স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে যেহেতু বাংলা ভাষায় খুব কম লেখালেখি হয়েছে, তাই এই বিষয়ে আমাদের অধিকাংশের ধারণা অস্বচ্ছ। সেই কারণে, আমরা ইবলিশ এবং শয়তান জ্বীনের আসর থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হই। পাশাপাশি পরিষ্কার ধারণা না থাকার কারণে অনেক বিদআ’ত কাজও করে ফেলি নিজের অজান্তে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম- ‘আমি লিখব ইন শা আল্লাহ’। সেই লেখা আজকের পর্বের মাধ্যমে শেষ করার সৌভাগ্য হল, আলহামদুলিল্লাহ।

নিশ্চয়ই উপকারী জ্ঞান নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য নয়।

“আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম।” (সূরা আল ইমরান, ১০৪)

“যে কেউ কাউকে একটি ভালো কাজের দিকে আহবান করে, সে ভালো কাজটি করা মানুষটির সমপরিমাণ পুণ্য অর্জন করে।” (মুসলিম শরীফ)”আমার শিক্ষা প্রচার কর, এমনকি একটি মাত্র বাক্য হলেও।” (বুখারী, ৫৬/৬৬৭)

“যেই জ্ঞানের দ্বারা কোন উপকার হয় না, তা সেই অনর্থক সম্পদের মতো যা থেকে আল্লাহর পথে ব্যয় করা হয় না।” (তিরমিযী, ১০৮)

সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহ্‌র জন্য, যিনি আমাকে এই বিষয়টি নিয়ে লেখার তৌফিক দান করেছেন। শান্তি বর্ষিত হোক রাসুলুল্লাহ (সঃ), তাঁর পরিবার এবং সাথীদের ওপর।


গ্রন্থ সহায়িকাঃ

 “Protect yourself from the Jinn and Shaytan by Waheed Abdussalam Baly

 “The World of the Jinn and Devils” by Dr. Umar Sulaiman al-Ashqar

▪ “The Jinn and Human Sickness (Remedies in the light of the Qur’aan and Sunnah)”by Dr. Abul-Mundhir Khaleel ibn Ibraheem Ameen

সন্তান হারানোর কষ্টকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সবরের মাধ্যমে মোকাবেলার পুরস্কার

পূর্বকথাঃ

নিশ্চয়ই সকল সন্তানহারা বাবা-মায়ের জন্য উপকারী জ্ঞান রয়েছে এই লেখাটিতে। আশা করা যায়, এই লেখার মাধ্যমে তাদের সবর করতে কিছুটা সুবিধা হবে। নিদারুণ সেই শোক সামাল দিয়ে মহান আল্লাহর উপরে ভরসা রাখতে সাহায্য করবে তাদের – ইনশা আল্লাহ।

উপকারী মনে হলে পরিচিত ভাইবোন যারা এই শোককে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন, তাদের কল্যাণের জন্য শেয়ার করতে পারেন।

বিনীত –

মোহাম্মদ জাভেদ কায়সার।

পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ তায়ালার নামে শুরু করছি।

নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা ও স্তুতি একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালার জন্য।

পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এমন অনেক বর্ণনা আছে যাতে ধৈর্যশীলদের পুরস্কারের বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। যে কেউ তার বিপদ ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করবেন, তিনিই এই বিশেষ পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবেন।

নিঃসন্দেহে সন্তানের মৃত্যু আমাদের জন্য একটি অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষা। যেই বাবা-মা এই কঠিন পরীক্ষা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ধৈর্যের মাধ্যমে মোকাবেলা করবেন, তাদের জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশাল প্রতিদান রয়েছে।  আমরা এই সম্পর্কে নীচে ৪টি পর্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ –

▪পবিত্র কুরআনে তাদের কথা

▪ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বর্ণিত হাদীস সমূহে তাঁদের কথা

▪ একটি লক্ষণীয় ও জরুরী বিষয় ও

▪ একটি প্রশ্নের উত্তর

পবিত্র কুরআনে তাঁদের কথাঃ

“এবং অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের। যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয়ই আমরা সবাই মহান আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো। তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি মহান আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হিদায়াত প্রাপ্ত।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৫৫-১৫৭]

“… আর যারা সবর করে, মহান আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৪৬]

“… যারা সবরকারী, তারাই তাদের পুরস্কার পায় অগণিত।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত ১০]

পবিত্র কুরআনে আরো বেশ কিছু আয়াত রয়েছে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ধৈর্য তথা সবর করার তাত্পর্যের উপরে।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বর্ণিত হাদীস সমূহে তাঁদের কথাঃ

স্বাভাবিকভাবেই অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন – কেন মহান আল্লাহ তাঁদের সন্তান হারানোর মত কঠিন পরীক্ষায় ফেললেন? এর উত্তর উপরে সূরা আল-বাকারার আয়াতের মধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে যে মহান আল্লাহ আমাদের বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করবেন। এই পরীক্ষা যদি আমরা সবরের মাধ্যমে মোকাবেলা করতে পারি তবে কল্যাণ ছাড়া অন্য কিছু বরাদ্দ নেই আমাদের জন্য; আলহামদুলিল্লাহ।

মুসলিম মাত্রই আমরা বিশ্বাস করি যে, আমাদের উপর এমন কোন বিপদ-আপদ আসে না যার বিনিময়ে আমাদের পাপসমূহ মোচন করা হয়। আমরা এই সংক্রান্ত হাদীসসমূহ একটু দেখতে পারি।

একঃ উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ কোন মুসলমানের উপর কোন বিপদ আপতিত হলে তার বিনিময়ে তার গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়, এমনকি ক্ষুদ্রতর কোন কাঁটা বিদ্ধ হলেও।

[সহীহ মুসলিমঃ অধ্যায় ৪৫ (সদ্ব্যবহার, আত্নীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ও শিষ্টাচার অধ্যায়), হাদীস ৬২৩৯]

দুইঃ আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “মুমিন পুরুষ ও নারীর জান, সন্তান-সন্ততি ও তার ধন-সম্পদ (বিপদ-আপদ দ্বারা) পরীক্ষিত হতে থাকে। পরিশেষে সে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে নিষ্পাপ হয়ে সাক্ষাৎ করবে।”

[রিয়াদুস সালেহীনঃ অধ্যায় ১ (বিবিধ অধ্যায়) হাদীস ৪৯, জামে’ আত-তিরমিযী ও মুসনাদে আহমাদ]

তিনঃ আবু সা’ঈদ আল-খুদরী ও আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তারা উভয়েই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে বলতে শুনেছেন যে, “কোন ঈমানদার ব্যক্তির এমন কোন ব্যথা-ক্লেশ, রোগ-ব্যাধি, দুঃখ পৌঁছে না, এমনকি দুর্ভাবনা পর্যন্ত, যার বিনিময়ে তার কোন গুনাহ মাফ করা হয় না।

[সহীহ মুসলিমঃ অধ্যায় ৪৫ (সদ্ব্যবহার, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ও শিষ্টাচার অধ্যায়), হাদীস ৬২৪২]

চারঃ সুহাইব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ

“মু’মিন ব্যক্তির কাজ-কর্ম অবলোকন করলে খুব আশ্চর্য লাগে। কেননা তার সমস্ত কাজ তার জন্য কল্যাণকর। আর এটি হয়ে থাকে শুধু মু’মিনদের জন্য, অন্যের জন্য নয়। যখন সে কল্যাণকর কিছু লাভ করে তখন সে (মহান আল্লাহর) শুকরিয়া আদায় করে, আর তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যখন সে কোন বিপদে পতিত হয়, তখন সে ধৈর্য ধারণ করে (সেটিও তার জন্য কল্যাণকর)।”

[সহীহ মুসলিমঃ হাদীস ৫৩১৮]

এবার আমরা সুনির্দিষ্টভাবে সন্তান হারানোর বিষয়ের হাদীসগুলো দেখব।

পাঁচঃ আবু মুসা আল-আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ

যখন কারও সন্তান মারা যায়, তখন আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদেরকে ডেকে বলেন যে, ‘তোমরা আমার বান্দার সন্তানের জান কবয করে ফেলেছ?’ তারা বলেন – ‘হ্যাঁ।’ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা তার কলিজার টুকরার জান কবয করে ফেলেছ?’ তারা বলেন – ‘হ্যাঁ।’ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমার বান্দা কি বলেছে?’ তারা বলেন – ‘আপনার বান্দা এই বিপদেও ধৈর্য ধারণ করে আপনার প্রশংসা করেছে এবং ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়েছে।’ তখন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা আমার এই বান্দার জন্য জান্নাতে একটি গৃহ নির্মাণ কর এবং তার নামকরণ কর “বাইতুল হামদ” অর্থাৎ প্রশংসার গৃহ।’

[রিয়াদুস সালেহীনঃ অধ্যায় ১৪ (মহান আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা অধ্যায়) হাদীস ১৩৯৫। জামে’ আত-তিরমিযী]

ছয়ঃ আনাস বিন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ

‘‘যে কোন মুসলিমের তিনটি নাবালক সন্তান মারা যাবে, মহান আল্লাহ তাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহের বরকতে জান্নাত দেবেন।’’

[রিয়াদুস সালেহীনঃ অধ্যায় ৭ (রোগী দর্শন ও জানাযায় অংশগ্রহণ অধ্যায়) হাদীস ৯৫২। মুত্তাফাক্বুন আলাইহিঃ সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম]

সাতঃ আবু সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) বলেন, এক মহিলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিকট এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! কেবলমাত্র পুরুষেরাই আপনার হাদীস শোনার সৌভাগ্য লাভ করছে। সুতরাং আপনি আমাদের জন্যও একটি দিন নির্ধারিত করুন। আমরা সে দিন আপনার নিকট আসব, আপনি আমাদেরকে তা শিক্ষা দেবেন, যা আল্লাহ আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন।’ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘‘তোমরা অমুক অমুক দিন একত্রিত হও।’’

অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের নিকট এসে সে শিক্ষা দিলেন, যা মহান আল্লাহ তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘‘তোমাদের মধ্যে যে কোন মহিলার তিনটি সন্তান মারা যাবে, তারা (মৃত সন্তানেরা) তার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে আড় (প্রতিবন্ধক) হয়ে যাবে।’’

এক মহিলা বলল, ‘আর দু’টি সন্তান মারা গেলে?’ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘‘দু’টি মারা গেলেও (তাই হবে)।’’

[রিয়াদুস সালেহীনঃ অধ্যায় ৭ (রোগী দর্শন ও জানাযায় অংশগ্রহণ অধ্যায়) হাদীস ৯৫৪। মুত্তাফাক্বুন আলাইহিঃ সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম]

আটঃ কুররা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন বসতেন, তখন সাহাবীদের অনেকে তাঁর কাছে এসে বসতেন। তাদের মধ্যে একজনের অল্প বয়স্ক একটি ছেলে ছিল। তিনি তার ছেলেটিকে পেছনে দিক থেকে নিজের সামনে এনে বসাতেন। অতঃপর ছেলেটি মৃত্যুবরণ করল। সেই পিতা বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন। তার ছেলের কথা মনে করে তিনি মজলিসে উপস্থিত হতে পারতেন না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে না দেখে জিজ্ঞাসা করলেন যে, “আমি অমুক ব্যক্তিকে কেন দেখছি না?” সাহাবীগণ বললেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনি তার ছোট ছেলেটিকে দেখেছিলেন সে মৃত্যুবরণ করেছে।’

পরে তার সাথে সাক্ষাৎ করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার ছোট ছেলেটির কি হয়েছে?”

সে ব্যক্তি বললো, ‘ছেলেটির মৃত্যু হয়েছে।’

তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে ধৈর্য ধারণ করতে বললেন। তারপর তিনি বললেন, “হে অমুক! তোমার কাছে কোনটি পছন্দনীয় – তার দ্বারা তোমার পার্থিব জীবন সুখময় করা? না কাল কেয়ামতে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে তুমি প্রবেশ করতে চাইবে, তাকে সেখানেই পাওয়া – যেখানে সে পৌঁছে তোমার জন্য দরজা খুলে দিবে?”

সে বললো, ‘হে আল্লাহর রাসূল! বরং সে আমার জান্নাতের দরজায় গিয়ে আমার জন্য দরজা খুলে দেবে এটাই আমার কাছে অধিক পছন্দনীয়।’

তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, “তাহলে তা-ই তোমার জন্য হবে।”

[সুনানে আন-নাসাইঃ অধ্যায় ২১ (জানাযা অধ্যায়), হাদীস ২০৯০। তাহকিকঃ সহীহ]

নয়ঃ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ “তোমরা তোমাদের মধ্যে কাকে নিঃসন্তান বলে গণ্য কর?” বর্ণনাকারী বলেন, ‘আমরা যার সন্তান হয় না তাকেই নিঃসন্তান মনে করি।’ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, “সে ব্যক্তি নিঃসন্তান নয়, বরং সেই ব্যক্তি-ই নিঃসন্তান, যে তার কোন সন্তান আগে পাঠায় নি (অর্থাৎ যার জীবদ্দশায় তার সন্তান মৃত্যুবরণ করেনি)।”

[সহীহ মুসলিমঃ অধ্যায় ৪৫ (সদ্ব্যবহার, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ও শিষ্টাচার অধ্যায়), হাদীস ৬৩১১]

অর্থাৎ যে ব্যক্তির কোন সন্তান তার আগে জান্নাতে পিতামাতার জন্য অপেক্ষা করবে না, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকেই নিঃসন্তান বলেছেন।

একটি লক্ষ্যণীয় ও জরুরী বিষয়ঃ

একটি বিষয় লক্ষ্য করুন। যদি সন্তান বেঁচে থাকত, তবে সে বড় হয়ে জীবিকার তাগিদে, প্রয়োজনের তাগিদে কোন এক সময় বাবা-মা’র থেকে দুরে চলে যেতে হতো। সারাজীবন সন্তানকে আঁকড়ে ধরে রাখা সম্ভব নয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরে নৈতিকতার অধঃপতনের বেড়াজালে হয়তো অনেক আগেই জড়িয়ে পড়তে পারতো সেই সন্তান। আপন বাবা-মাকে খুন করে ফাঁসির দন্ডাদেশ পাওয়া কিশোরী “ঐশী”-ই তার প্রমাণ।

“মৃত্যু” – এই পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম সত্য যা এড়িয়ে যাবার কোন উপায় নেই। মৃত্যুর পূর্বের কষ্ট (সাকরাতুল মওত), কবরের আযাব, বিচার দিবসের সীমাহীন আতংক এবং জাহান্নামের কঠোরতম শাস্তি – এর সবকিছুর উর্ধ্বে রয়েছে অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা আমাদের সন্তানেরা। তারা উর্ধ্ব আকাশে সাইয়িদুনা ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) এর আশেপাশে অন্যান্য শিশুদের সাথে খেলছে। সুবহানাল্লাহ!

সামুরাহ ইবনে জুনদুব (রাঃ) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজের স্বপ্নের বর্ণনায় বলেছেন, “…. …আমরা চললাম এবং একটা সজীব শ্যামল বাগানে উপনীত হলাম, যেখানে বসন্তের হরেক রকম ফুলের কলি রয়েছে। আর বাগানের মাঝে আসমানের থেকে অধিক উঁচু দীর্ঘকায় একজন পুরুষ রয়েছে যার মাথা যেন আমি দেখতেই পাচ্ছি না। এমনিভাবে তার চতুপার্শে এত বিপুল সংখ্যক বালক-বালিকা দেখলাম যে, এত বেশি আর কখনো আমি দেখি নি। আমি তাদেরকে বললাম, উনি কে? আমাকে বলা হলো – ইনি ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) আর তার আশেপাশের বালক-বালিকারা হলো ঐসব শিশু, যারা ফিৎরাতের (স্বভাবধর্ম) ওপর মৃত্যুবরণ করেছে।”

[সহীহ বুখারীঃ অধ্যায় ৫৯ (সৃষ্টির সূচনা অধ্যায়), হাদীস ৪২৯]

উপরন্তু এই বালক-বালিকারা তাঁদের বাবা-মায়ের জান্নাতে প্রবেশের কারণ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

আবু হাসসান (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবু হুরায়রা (রাঃ) কে বললাম, ‘আমার দু’টি পুত্র সন্তান মারা গিয়েছে। আপনি কি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) -এর তরফ থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করবেন, যাতে আমরা মৃতদের সম্পর্কে আমাদের অন্তরে সান্ত্বনা পেতে পারি?’

আবু হুরায়রা (রাঃ) বললেন, “হ্যাঁ, তাদের ছোট সন্তানরা জান্নাতের প্রজাপতিতুল্য। তাদের কেউ যখন পিতা কিংবা পিতামাতা উভয়ের সংগে মিলিত হবে, তখন তার পরিধানের বস্ত্র কিংবা হাত ধরবে, যেভাবে এখন আমি তোমার কাপড়ের আঁচল ধরেছি। এরপর সেই বস্ত্র কিংবা হাত আর পরিত্যাগ করবে না যতক্ষণ না মহান আল্লাহ তাকে তার বাবা-মা সহ জান্নাতে প্রবেশ না করাবেন।”

[সহীহ মুসলিমঃ অধ্যায় ৪৫ (সদ্ব্যবহার, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ও শিষ্টাচার অধ্যায়), হাদীস ৬৩৭০]

একটি প্রশ্নের উত্তরঃ

অনেক দম্পতির সন্তান গর্ভাবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।  সুবহানাল্লাহ, পৃথিবীর বুকে না এসেও গর্ভস্থিত সেই ভ্রুণ তার বাবা-মায়ের জন্য মহান আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে এবং জান্নাতের ফয়সালা করিয়ে নিবে।

মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ “সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! গর্ভপাত হওয়া সন্তানের (Miscarried Fetus) মাতা তাতে সওয়াব আশা করলে (ধৈর্যের মাধ্যমে) ঐ সন্তান তার নাভিরজ্জু (Umbilical Cord) দ্বারা তাকে টেনে জান্নাতে নিয়ে যাবে।”

[সুনানে ইবনে মাজাহঃ অধ্যায় ৬ (জানাযা অধ্যায়), হাদীস ১৬৭৭, মিশকাত ১৭৫৪]

আলী ইবনে আবু তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “গর্ভপাত (অসুস্থতাজনিত) হওয়া সন্তান (Miscarried Fetus) এর রব তার পিতা-মাতাকে যখন জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন তখন সে তার প্রভুর সাথে বিতর্ক করবে। তাকে বলা হবে, ওহে প্রভুর সাথে বিতর্ককারী গর্ভপাত হওয়া সন্তান! তোমার পিতা-মাতাকে জান্নাতে প্রবেশ করাও। অতএব সে তাদেরকে নিজের নাভিরজ্জু  (Umbilical Cord)  দ্বারা টানতে টানতে শেষে জান্নাতে প্রবেশ করাবে।”

[সুনানে ইবনে মাজাহঃ অধ্যায় ৬ (জানাযা অধ্যায়), হাদীস ১৬৭৬, এই বর্ণনাটি দুর্বল]

ইমাম আন-নববী (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর মাজমু’ ফাতওয়া (৫/২৮৭) এ বলেছেন – মৃত সন্তানের ক্ষেত্রের হাদীসগুলো গর্ভপাত (অসুস্থতা জনিত) হওয়া সন্তানের বেলাতেও প্রযোজ্য হবে। মহান আল্লাহ সর্বোত্তম জানেন।

[মাজমু’ ফাতওয়া, ইমাম নববী (৫/২৮৭), হাশিয়াত ইবনে আবেদীন (২/২২৮)]

মুহাম্মদ সালিহ আল-উসাইমীন (রহিমাহুল্লাহ) সহ অধিকাংশ ফুক্বাহাদের মতে ভ্রুণ-এ রুহ সঞ্চার করা হয় ৪ মাস তথা ১২০ দিন পর।  রুহ সঞ্চারের পর থেকেই অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান মৃত্যু সংশ্লিষ্ট হাদীসগুলো প্রযোজ্য হবে।  মহান আল্লাহ সর্বোত্তম জানেন।

[ফাতওয়া আল-লাজনাহ আল-দা’ইমাহ, ২১/৪৩৪-৪৩৮।

ফাতওয়া আল-মার’আহ আল-মুসলিমাহ, ১/৩০৩, ৩০৫।

আস’ইলাত আল-বাবিল মাফতুহ (মুহাম্মদ সালিহ আল-উসাইমীন); প্রশ্ন নং ৬৫৩]

সুবহানাল্লাহি বিহামদিহী, সুবহানাল্লাহিল ‘আযীম।

মহান আল্লাহ কাছে প্রার্থনা করি – তিনি যেন সকল সন্তানহারা বাবা-মা’দের ধৈর্য ধারণ করার মাধ্যমে এই অশেষ পুরষ্কারের গর্বিত মালিক হওয়ার তাওফীক প্রদান করেন।

জাযাকুমুল্লাহু খাইরান।

 

লিখাঃ মুহাম্মদ জাভেদ কায়সার ( আল্লাহ উনাকে জান্নাতের উঁচু মাকাম জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন )

 

কুরআন হাদিসের আলোকে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার (রুকইয়াহ) হাদিয়া।

  • ঢাকার মধ্যে রুকইয়ার হাদিয়া প্রতি রোগী প্রথমবার ৫০০০ টাকা, ২য়/তয় বার ৪০০০ টাকা, আর ঢাকার বাহিরে হলে প্রথমবার ১০,০০০ টাকা, ২য়/৩য়  বার  ৮০০০ টাকা ।
  • বি. দ্রঃ খুব বেশি দূরত্ব, অসুস্থতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বড় বেশি কঠিন রোগীর ক্ষেত্রে হাদিয়া আলোচনা সাপেক্ষে কম বেশি হতে পারে।
  • এই ইসলামিক চিকিৎসা পদ্ধতি দিয়ে আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে, কোরআন হাদিসের চিকিৎসা সমাজে কায়েম করানো, আল্লাহ্‌ আমাদের সবাইকে দীন-ইসলামের খাদেম হিসাবে কবুল করুন, আমীন, সুম্মা আমীন।

আইডিসির সাথে যোগ দিয়ে উভয় জাহানের জন্য ভালো কিছু করুন।

 

আইডিসি এবং আইডিসি ফাউন্ডেশনের ব্যপারে বিস্তারিত জানতে  লিংক০১ ও লিংক০২ ভিজিট করুন।

আইডিসি  মাদরাসার ব্যপারে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। 

আপনি আইডিসি  মাদরাসার একজন স্থায়ী সদস্য /পার্টনার হতে চাইলে এই লিংক দেখুন.

আইডিসি এতীমখানা ও গোরাবা ফান্ডে দান করে  দুনিয়া এবং আখিরাতে সফলতা অর্জন করুন।

কুরআন হাদিসের আলোকে বিভিন্ন কঠিন রোগের চিকিৎসা করাতেআইডিসি ‘র সাথে যোগাযোগ করুন।

ইসলামিক বিষয়ে জানতে এবং জানাতে এই গ্রুপে জয়েন করুন।

Islami Dawah Center Cover photo

ইসলামী দাওয়াহ সেন্টারকে সচল রাখতে সাহায্য করুন!

 

ইসলামী দাওয়াহ সেন্টার ১টি অলাভজনক দাওয়াহ প্রতিষ্ঠান, এই প্রতিষ্ঠানের ইসলামিক ব্লগটি বর্তমানে ২০,০০০+ মানুষ প্রতিমাসে পড়ে, দিন দিন আরো অনেক বেশি বেড়ে যাবে, ইংশাআল্লাহ।

বর্তমানে মাদরাসা এবং ব্লগ প্রজেক্টের বিভিন্ন খাতে (ওয়েবসাইট হোস্টিং, CDN,কনটেন্ট রাইটিং, প্রুফ রিডিং, ব্লগ পোস্টিং, ডিজাইন এবং মার্কেটিং) মাসে গড়ে ৫০,০০০+ টাকা খরচ হয়, যা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। সেকারনে, এই বিশাল ধর্মীয় কাজকে সামনে এগিয়ে নিতে সর্বপ্রথম আল্লাহর কাছে আপনাদের দোয়া এবং আপনাদের সহযোগিতা প্রয়োজন, এমন কিছু ভাই ও বোন ( ৩১৩ জন ) দরকার, যারা আইডিসিকে নির্দিষ্ট অংকের সাহায্য করবেন, তাহলে এই পথ চলা অনেক সহজ হয়ে যাবে, ইংশাআল্লাহ।

যারা এককালিন, মাসিক অথবা বাৎসরিক সাহায্য করবেন, তারা আইডিসির মুল টিমের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন, ইংশাআল্লাহ।

আইডিসির ঠিকানাঃ খঃ ৬৫/৫, শাহজাদপুর, গুলশান, ঢাকা -১২১২, মোবাইলঃ +88 01609 820 094, +88 01716 988 953 ( নগদ/বিকাশ পার্সোনাল )

ইমেলঃ info@islamidawahcenter.com, info@idcmadrasah.com, ওয়েব: www.islamidawahcenter.com, www.idcmadrasah.com সার্বিক তত্ত্বাবধানেঃ হাঃ মুফতি মাহবুব ওসমানী ( এম. এ. ইন ইংলিশ, ফার্স্ট ক্লাস )

Related posts

রুকইয়াহ অডিও নিয়ে যত কথা / As-Much-Talk-About-Ruqyah-Audio

by IDCAdmin
5 years ago

একজন পাকিস্তানি যাদুকরের কনফেশন – Confessions of a Magician

by IDCAdmin
2 years ago

সিহরের কমন রুকইয়াহ / Ruqyah-The-Commoner-Of-The-City

by IDCAdmin
5 years ago
Exit mobile version