সাজিদ আজাদ সিরিজঃ পর্ব ০১ – পর্ব ০৪ / Sajid-Series
সাজিদ সিরিজ – পর্ব ০১: একজন অবিশ্বাসীর বিশ্বাস
আমি রুমে ঢুকেই দেখি সাজিদ কম্পিউটারের সামনে উবু হয়ে বসে আছে। খটাখট কী যেন টাইপ করছে হয়তো। আমি জগ থেকে পানি ঢালতে লাগলাম। প্রচন্ড রকম তৃষ্ণার্ত। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাবার জোগাড়। সাজিদ কম্পিউটার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কী রে, কিছু হইলো?’
আমি হতাশ গলায় বললাম, ‘নাহ।’
‘তার মানে তোকে এক বছর ড্রপ দিতেই হবে?’ সাজিদ জিজ্ঞেস করলো।
আমি বললাম,- ‘কী আর করা। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।’
সাজিদ বললো,- ‘তোদের এই এক দোষ,বুঝলি? দেখছিস পুওর এ্যাটেন্ডেন্সের জন্য এক বছর ড্রপ খাওয়াচ্ছে, তার মধ্যেও বলছিস, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। ভাই, এইখানে কোন ভালোটা তুই পাইলি, বলতো।’
সাজিদ সম্পর্কে কিছু বলে নেওয়া দরকার। আমি আর সাজিদ রুমমেট। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজিতে পড়ে। প্রথম জীবনে খুব ধার্মিক ছিলো। নামাজ-কালাম করতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কীভাবে কীভাবে যেন এগনোষ্টিক হয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে স্রষ্টার উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে এখন পুরোপুরি নাস্তিক হয়ে গেছে। ধর্মকে এখন সে আবর্জনা জ্ঞান করে। তার মতে পৃথিবীতে ধর্ম এনেছে মানুষ। আর ‘ঈশ্বর’ ধারণাটাই এইরকম স্বার্থান্বেষী কোনো মহলের মস্তিষ্কপ্রসূত।
সাজিদের সাথে এই মূহুর্তে তর্কে জড়াবার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু তাকে একদম ইগনোর করেও যাওয়া যায়না।
আমি বললাম, ‘আমার সাথে তো এর থেকেও খারাপ কিছু হতে পারতো, ঠিক না?’
– ‘আরে, খারাপ হবার আর কিছু বাকি আছে কি?’
– ‘হয়তো।’
– ‘যেমন?’
– ‘এরকমও তো হতে পারতো, ধর, আমি সারাবছর একদমই পড়াশুনা করলাম না। পরীক্ষায় ফেইল মারলাম। এখন ফেইল করলে আমার এক বছর ড্রপ যেতো। হয়তো ফেইলের অপমানটা আমি নিতে পারতাম না। আত্মহত্যা করে বসতাম।’
সাজিদ হা হা হা হা করে হাসা শুরু করলো। বললো, ‘কী বিদঘুটে বিশ্বাস নিয়ে চলিস রে ভাই।’
এই বলে সে আবার হাসা শুরু করলো। বিদ্রুপাত্মক হাসি।
রাতে সাজিদের সাথে আমার আরো একদফা তর্ক হলো।
সে বললো, ‘আচ্ছা, তোরা যে স্রষ্টায় বিশ্বাস করিস, কীসের ভিত্তিতে?’
আমি বললাম,- ‘বিশ্বাস দু ধরনের। একটা হলো, প্রমাণের ভিত্তিতে বিশ্বাস। অনেকটা,শর্তারোপে বিশ্বাস বলা যায়। অন্যটি হলো প্রমাণ ছাড়াই বিশ্বাস।’
সাজিদ হাসলো। সে বললো, ‘দ্বিতীয় ক্যাটাগরিকে সোজা বাংলায় অন্ধ বিশ্বাস বলে রে আবুল, বুঝলি?’
আমি তার কথায় কান দিলাম না। বলে যেতে লাগলাম-
‘প্রমাণের ভিত্তিতে যে বিশ্বাস, সেটা মূলত বিশ্বাসের মধ্যে পড়েনা। পড়লেও, খুবই টেম্পোরারি। এই বিশ্বাস এতই দুর্বল যে, এটা হঠাৎ হঠাৎ পাল্টায়।’
সাজিদ এবার নড়েচড়ে বসলো। সে বললো, ‘কী রকম?’
আমি বললাম, ‘এই যেমন ধর, সূর্য আর পৃথিবীকে নিয়ে মানুষের একটি আদিম কৌতূহল আছে। আমরা আদিকাল থেকেই এদের নিয়ে জানতে চেয়েছি, ঠিক না?’
– ‘হু, ঠিক।’
– ‘আমাদের কৌতূহল মেটাতে বিজ্ঞান আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে, ঠিক?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘আমরা একাট্টা ছিলাম। আমরা নির্ভুলভাবে জানতে চাইতাম যে, সূর্য আর পৃথিবীর রহস্যটা আসলে কী। সেই সুবাদে, পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা নানান সময়ে নানান তত্ত্ব আমাদের সামনে এনেছেন। পৃথিবী আর সূর্য নিয়ে প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন গ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমি। টলেমি কী বলেছিলো সেটা নিশ্চয় তুই জানিস?’
সাজিদ বললো, ‘হ্যাঁ। সে বলেছিলো সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে।’
– ‘একদম তা-ই। কিন্তু বিজ্ঞান কি আজও টলেমির থিওরিতে বসে আছে? নেই। কিন্তু কি জানিস, এই টলেমির থিওরিটা বিজ্ঞান মহলে টিকে ছিলো পুরো ২৫০ বছর। ভাবতে পারিস? ২৫০ বছর পৃথিবীর মানুষ, যাদের মধ্যে আবার বড় বড় বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ছিলো, তারাও বিশ্বাস করতো যে সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। এই ২৫০ বছরে তাদের মধ্যে যারা যারা মারা গেছে, তারা এই বিশ্বাস নিয়েই মারা গেছে যে, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে।’
সাজিদ সিগারেট ধরালো। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো, ‘তাতে কী? তখন তো আর টেলিস্কোপ ছিলো না, তাই ভুল মতবাদ দিয়েছে আরকি। পরে নিকোলাস কোপারনিকাস এসে তার থিওরিকে ভুল প্রমাণ করলো না?’
– ‘হ্যাঁ। কিন্তু কোপারনিকাসও একটা মস্তবড় ভুল করে গেছে।’
সাজিদ প্রশ্ন করলো, ‘কী রকম?’
– ‘অদ্ভুত! এটা তো তোর জানার কথা। যদিও কোপারনিকাস টলেমির থিওরির বিপরীত থিওরি দিয়ে প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন যে, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘোরে। কিন্তু, তিনি এক জায়গায় ভুল করেন। এবং সেই ভুলটাও বিজ্ঞান মহলে বীরদর্পে টিকে ছিলো গোটা ৫০ বছর।’
– ‘কোন ভুল?’
– ‘উনি বলেছিলেন, পৃথিবীই সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে, কিন্তু সূর্য ঘোরে না। সূর্য স্থির। কিন্তু আজকের বিজ্ঞান বলে, নাহ, সূর্য স্থির নয়। সূর্যও নিজের কক্ষপথে অবিরাম ঘূর্ণনরত অবস্থায়।’
সাজিদ বললো,- ‘সেটা ঠিক বলেছিস। কিন্তু বিজ্ঞানের এটাই নিয়ম যে, এটা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হবে। এখানে শেষ বা ফাইনাল বলে কিছুই নেই।’
– ‘একদম তাই। বিজ্ঞানে শেষ বা ফাইনাল বলে কিছু নেই। একটা বৈজ্ঞানিক থিওরি ২ সেকেন্ডও টেকে না, আবার আরেকটা ২০০ বছরও টিকে যায়। তাই, প্রমান বা দলিল দিয়ে যা বিশ্বাস করা হয় তাকে আমরা বিশ্বাস বলিনা। এটাকে আমরা বড়জোর চুক্তি বলতে পারি। চুক্তিটা এরকম, ‘তোমায় ততক্ষণ বিশ্বাস করবো, যতক্ষণ তোমার চেয়ে অথেনটিক কিছু আমাদের সামনে না আসছে।’
সাজিদ আবার নড়েচড়ে বসলো। সে কিছুটা একমত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
আমি বললাম, ‘ধর্ম বা সৃষ্টিকর্তার ধারণা বা অস্তিত্ব হচ্ছে ঠিক এর বিপরীত। দ্যাখ, বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যকার এই গূঢ় পার্থক্য আছে বলেই আমাদের ধর্মগ্রন্থের শুরুতেই বিশ্বাসের কথা বলা আছে। বলা আছে- ‘এটা তাদের জন্য যারা বিশ্বাস করে।’ [সূরা আল-বাক্বারাহ(২): ২]
যদি বিজ্ঞানে শেষ বা ফাইনাল কিছু থাকতো, তাহলে হয়তো ধর্মগ্রন্থের শুরুতে বিশ্বাসের বদলে বিজ্ঞানের কথাই বলা হতো। হয়তো বলা হতো, ‘এটা তাদের জন্যই যারা বিজ্ঞানমনষ্ক।’
কিন্তু যে বিজ্ঞান সদা পরিবর্তনশীল, যে বিজ্ঞানের নিজের উপর নিজেরই বিশ্বাস নেই, তাকে কীভাবে অন্যরা বিশ্বাস করবে?’
সাজিদ বললো, ‘কিন্তু যাকে দেখি না, যার পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই, তাকে কী করে আমরা বিশ্বাস করতে পারি?’
– ‘সৃষ্টিকর্তার পক্ষে অনেক প্রমান আছে, কিন্তু সেটা বিজ্ঞান পুরোপুরি দিতে পারেনা। এটা বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, সৃষ্টিকর্তার নয়।বিজ্ঞান অনেক কিছুরই উত্তর দিতে পারেনা। লিষ্ট করতে গেলে অনেক লম্বা একটা লিষ্ট করা যাবে।’
সাজিদ রাগী রাগী গলায় বললো, ‘ফাজলামো করিস আমার সাথে?’
আমি হাসতে লাগলাম। বললাম, ‘আচ্ছা শোন, বলছি। তোর প্রেমিকার নাম মিতু না?’
– ‘এইখানে প্রেমিকার ব্যাপার আসছে কেনো?’
– ‘আরে বল না আগে।’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘কিছু মনে করিস না। কথার কথা বলছি। ধর, আমি মিতুকে ধর্ষণ করলাম। রক্তাক্ত অবস্থায় মিতু তার বেডে পড়ে আছে। আরো ধর, তুই কোনোভাবে ব্যাপারটা জেনে গেছিস।’
– ‘হু।’
– ‘এখন বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা কর দেখি, মিতুকে ধর্ষণ করায় কেনো আমার শাস্তি হওয়া দরকার?’
সাজিদ বললো, ‘ক্রিটিক্যাল কোয়েশ্চান। এটাকে বিজ্ঞান দিয়ে কীভাবে ব্যাখ্যা করবো?’
– ‘হা হা হা। আগেই বলেছি। এমন অনেক ব্যাপার আছে, যার উত্তর বিজ্ঞানে নেই।’
– ‘কিন্তু এর সাথে স্রষ্টায় বিশ্বাসের সম্পর্ক কী?’
– ‘সম্পর্ক আছে। স্রষ্টায় বিশ্বাসটাও এমন একটা বিষয়, যেটা আমরা, মানে মানুষেরা, আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রমাণাদি দিয়ে প্রমাণ করতে পারবো না। স্রষ্টা কোনো টেলিষ্কোপে ধরা পড়েন না। উনাকে অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়েও খুঁজে বের করা যায়না। উনাকে জাষ্ট ‘বিশ্বাস করে নিতে হয়’।’
সাজিদ এবার ৩৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলে বেঁকে বসলো। সে বললো, ‘ধুর! কিসব বাল ছাল বুঝালি। যা দেখি না, তাকে বিশ্বাস করে নেবো?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। পৃথিবীতে অবিশ্বাসী বলে কেউই নেই। সবাই বিশ্বাসী। সবাই এমন কিছু না কিছুতে ঠিক বিশ্বাস করে, যা তারা আদৌ দেখেনি বা দেখার কোনো সুযোগও নেই। কিন্তু এটা নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলে না। তারা নির্বিঘ্নে তাতে বিশ্বাস করে যায়। তুইও সেরকম।’
সাজিদ বললো, ‘আমি? পাগল হয়েছিস? আমি না দেখে কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করি না, করবোও না।’
– ‘তুই করিস। এবং, এটা নিয়ে তোর মধ্যে কোনোদিন কোনো প্রশ্ন জাগে নি। এবং, আজকে এই আলোচনা না করলে হয়তো জাগতোও না।’
সে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। বললাম,- ‘জানতে চাস?’
– ‘হু।’
– ‘আবার বলছি, কিছু মনে করিস না। যুক্তির খাতিরে বলছি।’
– ‘বল।’
– ‘আচ্ছা, তোর বাবা-মা’র মিলনেই যে তোর জন্ম হয়েছে, সেটা তুই দেখেছিলি? বা এই মূহুর্তে কোনো এভিডেন্স আছে তোর কাছে? হতে পারে তোর মা তোর বাবা ছাড়া অন্য কারো সাথে দৈহিক সম্পর্ক করেছে তোর জন্মের আগে। হতে পারে, তুই ওই ব্যক্তিরই জৈব ক্রিয়ার ফল। তুই এটা দেখিসনি। কিন্তু কোনদিনও কি তোর মা’কে এটা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলি? করিসনি। সেই ছোটবেলা থেকে যাকে বাবা হিসেবে দেখে আসছিস, এখনো তাকে বাবা ডাকছিস। যাকে ভাই হিসেবে জেনে আসছিস, তাকে ভাই। বোনকে বোন। তুই না দেখেই এসবে বিশ্বাস করিস না? কোনোদিন জানতে চেয়েছিস তুই এখন যাকে বাবা ডাকছিস, তুই আসলেই তার ঔরসজাত কিনা? জানতে চাসনি। বিশ্বাস করে গেছিস। এখনো করছিস। ভবিষ্যতেও করবি। স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসটাও ঠিক এমনই রে। এটাকে প্রশ্ন করা যায় না। সন্দেহ করা যায় না। এটাকে হৃদয়ের গভীরে ধারণ করতে হয়। এটার নামই বিশ্বাস।’
সাজিদ উঠে বাইরে চলে গেলো। ভাবলাম, সে আমার কথায় কষ্ট পেয়েছে হয়তো।
পরেরদিন ভোরে আমি যখন ফজরের নামাজের জন্য অযু করতে যাবো, দেখলাম আমার পাশে সাজিদ এসে দাঁড়িয়েছে। আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। সে আমার চাহনির প্রশ্নটা বুঝতে পেরেছে। সে বললো, ‘নামাজ পড়তে উঠেছি।’
সাজিদ সিরিজ – পর্ব ০৩: স্রষ্টা কেন মন্দ কাজের দায় নেন না?
ক্লাসে নতুন একজন স্যার এসেছেন। নাম- মফিজুর রহমান। হ্যাংলা-পাতলা গড়ন, বাতাস আসলেই যেন ঢলে পড়বেন এমন অবস্থা শরীরের। ভদ্রলোকের চেহারার চেয়ে চোখ দুটি অস্বাভাবিক রকম বড়। দেখলেই মনে হয় যেন বড় বড় সাইজের দুটি জলপাই কেউ খোদাই করে বসিয়ে দিয়েছে।
ভদ্রলোক খুবই ভালো মানুষ। উনার সমস্যা একটিই- ক্লাসে উনি যতটা না বায়োলজি পড়ান, তারচেয়ে বেশি দর্শন চর্চা করেন। ধর্ম কোথা থেকে আসলো, ঠিক কবে থেকে মানুষ ধার্মিক হওয়া শুরু করলো, ‘ধর্ম আদতে কী’ আর, ‘কী নয়’ তার গল্প করেন।
আজকে উনার চতুর্থ ক্লাস। পড়াবেন Analytical techniques & bio-informatics। চতুর্থ সেমিস্টারে এটা পড়ানো হয়।
স্যার এসে প্রথমে বললেন, ‘Good morning, guys….’
সবাই সমস্বরে বললো, ‘Good morning, sir…’
এরপর স্যার জিজ্ঞেস করলেন, ‘সবাই কেমন আছো?’
স্যারের আরো একটি ভালো দিক হলো উনি ক্লাসে এলে এভাবেই সবার কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। সাধারণত হায়ার লেভেলে যেটা সব শিক্ষক করেন না। তাঁরা রোবটের মতো ক্লাসে আসেন,যন্ত্রের মতো করে লেকচারটা পড়িয়ে বেরিয়ে যান। সেদিক থেকে মফিজুর রহমান নামের এই ভদ্রলোক অনেকটা অন্যরকম।
আবারো সবাই সমস্বরে উত্তর দিলো। কিন্তু গোলমাল বাঁধলো এক জায়গায়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েকজন উত্তর দিয়েছে এভাবে- ‘আলহামমমমদুলিল্লাহ ভালো।’
স্যার কপালের ভাঁজ একটু দীর্ঘ করে বললেন,- ‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো বলেছো কে কে?’
অদ্ভুত প্রশ্ন। সবাই থতমত খেলো। একটু আগেই বলেছি স্যার একটু অন্যরকম। প্রাইমারি লেভেলের টিচারদের মতো ক্লাসে এসে বিকট চিৎকার করে Good Morning বলেন, সবাই কেমন আছে জানতে চান। এখন ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলার জন্য কি প্রাইমারি লেভেলের শিক্ষকদের মতো বেত দিয়ে পিটাবেন নাকি?
সাজিদের তখন তার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক বাবুল চন্দ্র দাশের কথা মনে পড়ে গেলো। এই লোকটা ক্লাসে কেউ দুটোর বেশি হাঁচি দিলেই বেত দিয়ে আচ্ছামতন পিটাতেন। উনার কথা হলো- ‘হাঁচির সর্বোচ্চ পরিমাণ হবে দু’টি। দু’টির বেশি হাঁচি দেওয়া মানে ইচ্ছে করেই বেয়াদবি করা।’ যাহোক, বাবুল চন্দ্রের পাঠ তো কবেই চুকেছে, এবার মফিজ চন্দ্রের হাতেই না গণপিটুনি খাওয়া লাগে!
ক্লাসের সর্বমোট সাতজন দাঁড়ালো। এরা সবাই ‘আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো’ বলেছে। এরা হচ্ছে- রাকিব, আদনান, জুনায়েদ, সাকিব, মরিয়ম, রিতা এবং সাজিদ। স্যার সবার চেহারাটা একটু ভালোমতো পরখ করে নিলেন। এরপর ফিক করে হেসে দিয়ে বললেন, ‘বসো।’
সবাই বসলো। আজকে আর মনে হয় এ্যাকাডেমিক পড়াশুনা হবে না। দর্শনের তাত্ত্বিক আলাপ হবে।
ঠিক তাই হলো। মফিজুর রহমান স্যার আদনানকে দাঁড় করালেন। বললেন, ‘তুমিও বলেছিলে সেটা, না?’
– ‘জ্বি স্যার।’ আদনান উত্তর দিলো।
স্যার বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ্’র অর্থ কি জানো?’
আদনান মনে হয় একটু ভয় পাচ্ছে। সে ঢোক গিলতে গিলতে বললো, ‘জ্বি স্যার, আলহামদুলিল্লাহ্ অর্থ হলো- সকল প্রশংসা কেবলই আল্লাহর।’
স্যার বললেন, ‘সকল প্রশংসা কেবলই আল্লাহর।’
স্যার এই বাক্যটি দু’বার উচ্চারণ করলেন। এরপর আদনানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বসো।’
আদনান বসলো। এবার স্যার রিতাকে দাঁড় করালেন। স্যার রিতার কাছে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, পৃথিবীতে চুরি-ডাকাতি আছে?’
রিতা বললো, ‘আছে।’
– ‘খুন-খারাবি, রাহাজানি, ধর্ষণ?’
– ‘জ্বি, আছে।’
– ‘কথা দিয়ে কথা না রাখা, মানুষকে ঠকানো, লোভ-লালসা এসব?’
– ‘জ্বি, আছে।’
– ‘এগুলো কি প্রশংসাযোগ্য?’
– ‘না।’
– ‘তাহলে মানুষ একটি ভালো কাজ করার পর তার সব প্রশংসা যদি আল্লাহর হয়, মানুষ যখন চুরি-ডাকাতি করে, লোক ঠকায়, খুন-খারাবি করে, ধর্ষণ করে, তখন সব মন্দের ক্রেডিট আল্লাহকে দেওয়া হয় না কেনো? উনি প্রশংসার ভাগ পাবেন, কিন্তু দুর্নামের ভাগ নিবেন না, তা কেমন হয়ে গেলো না?’
রিতা মাথা নিচু করে চুপ করে আছে। স্যার বললেন, ‘এখানেই ধর্মের ভেল্কিবাজি। ঈশ্বর সব ভালোটা বুঝেন, কিন্তু মন্দটা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। আদতে ঈশ্বর বলে কেউ নেই। যদি থাকতেন, তাহলে তিনি এরকম একচোখা হতেন না। বান্দার ভালো কাজের ক্রেডিটটা নিজে নিয়ে নিবেন, কিন্তু বান্দার মন্দ কাজের বেলায় বলবেন- ‘উঁহু, ওইটা থেকে আমি পবিত্র। ওইটা তোমার ভাগ।”
স্যারের কথা শুনে ক্লাসে যে ক’জন নাস্তিক আছে, তারা হাততালি দেওয়া শুরু করলো। সাজিদের পাশে যে নাস্তিকটা বসেছে, সে তো বলেই বসলো, ‘মফিজ স্যার হলেন আমাদের বাংলার প্লেটো।’
স্যার বলেই যাচ্ছেন ধর্ম আর স্রষ্টার অসারতা নিয়ে।
এবার সাজিদ দাঁড়ালো। স্যারের কথার মাঝে সে বললো, ‘স্যার, সৃষ্টিকর্তা একচোখা নন। তিনি মানুষের ভালো কাজের ক্রেডিট নেন না। তিনি ততটুকুই নেন, যতটুকু তিনি পাবেন। ঈশ্বর আছেন।’
স্যার সাজিদের দিকে একটু ভালোমতো তাকালেন। বললেন, ‘শিওর?’
– ‘জ্বি।’
– ‘তাহলে মানুষের মন্দ কাজের জন্য কে দায়ী?’
– ‘মানুষই দায়ী।’ সাজিদ বললো।
– ‘ভালো কাজের জন্য?’
– ‘তাও মানুষ।’
স্যার এবার চিৎকার করে বললেন, ‘এক্সাক্টলি, এটাই বলতে চাচ্ছি। ভালো/মন্দ এসব মানুষেরই কাজ। সো, এর সব ক্রেডিটই মানুষের। এখানে স্রষ্টার কোনো হাত নেই। সো, তিনি এখান থেকে না প্রশংসা পেতে পারেন, না তিরস্কার। সোজা কথায়, স্রষ্টা বলতে কেউই নেই।’
ক্লাসে পিনপতন নিরবতা। সাজিদ বললো, ‘মানুষের ভালো কাজের জন্য স্রষ্টা অবশ্যই প্রশংসা পাবেন। কারণ, মানুষকে স্রষ্টা ভালো কাজ করার জন্য দুটি হাত দিয়েছেন, ভালো জিনিস দেখার জন্য দুটি চোখ দিয়েছেন, চিন্তা করার জন্য মস্তিষ্ক দিয়েছেন, দুটি পা দিয়েছেন। এসবকিছুই স্রষ্টার দান। তাই ভালো কাজের জন্য তিনি অবশ্যই প্রশংসা পাবেন।’
স্যার বললেন, ‘এইগুলো দিয়ে তো মানুষ খারাপ কাজও করে, তখন?’
– ‘এর দায় স্রষ্টার নয়।’
– ‘হা হা হা হা। তুমি খুব মজার মানুষ দেখছি। হা হা হা হা।’
সাজিদ বললো, ‘স্যার, স্রষ্টা মানুষকে একটি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন। এটা দিয়ে সে নিজেই নিজের কাজ ঠিক করে নেয়। সে কি ভালো করবে, না মন্দ।’
স্যার তিরস্কারের সুরে বললেন, ‘ধর্মীয় কিতাবাদির কথা বাদ দাও, ম্যান। কাম টু দ্য পয়েন্ট এন্ড বি লজিক্যাল।’
সাজিদ বললো, ‘স্যার, আমি কি উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে পারি ব্যাপারটা?’
– ‘অবশ্যই।’ স্যার বললেন।
সাজিদ বলতে শুরু করলো-
‘ধরুন, খুব গভীর সাগরে একটি জাহাজ ডুবে গেলো। ধরুন, সেটা বার্মুডা ট্রায়াঙ্গল। এখন কোনো ডুবুরিই সেখানে ডুব দিয়ে জাহাজের মানুষগুলোকে উদ্ধার করতে পারছে না। বার্মুডা ট্রায়াঙ্গলে তো নয়ই। এই মুহূর্তে ধরুন সেখানে আপনার আবির্ভাব ঘটলো। আপনি সবাইকে বললেন, ‘আমি এমন একটি যন্ত্র বানিয়ে দিতে পারি, যেটা গায়ে লাগিয়ে যে কোনো মানুষ খুব সহজেই ডুবে যাওয়া জাহাজের মানুষগুলোকে উদ্ধার করতে পারবে। ডুবুরির কোনোরকম ক্ষতি হবে না।’
স্যার বললেন, ‘হুম, তো?’
– ‘ধরুন, আপনি যন্ত্রটি তৎক্ষণাৎ বানালেন এবং একজন ডুবুরি সেই যন্ত্র গায়ে লাগিয়ে সাগরে নেমে পড়লো ডুবে যাওয়া মানুষগুলোকে উদ্ধার করতে।’
ক্লাসে তখন একদম পিনপতন নিরবতা। সবাই মুগ্ধ শ্রোতা। কারো চোখের পলকই যেনো পড়ছে না।
সাজিদ বলে যেতে লাগলো-
‘ধরুন, ডুবুরিটা ডুব দিয়ে ডুবে যাওয়া জাহাজে চলে গেলো। সেখানে গিয়ে সে দেখলো মানুষগুলো হাঁসফাস করছে। সে একে একে সবাইকে একটি করে অক্সিজেনের সিলিন্ডার দিয়ে দিলো। এবং তাদের একজন একজন করে উদ্ধার করতে লাগলো।’
স্যার বললেন, ‘হুম।’
– ‘ধরুন, সব যাত্রীকে উদ্ধার করা শেষ। বাকি আছে মাত্র একজন। ডুবুরিটা যখন শেষ লোকটাকে উদ্ধার করতে গেলো, তখন ডুবুরিটা দেখলো এই লোকটাকে সে আগে থেকেই চিনে।’
এতটুকু বলে সাজিদ স্যারের কাছে প্রশ্ন করলো, ‘স্যার, এরকম কি হতে পারে না?’
স্যার বললেন, ‘অবশ্যই হতে পারে। লোকটা ডুবুরির আত্মীয় বা পরিচিত হয়ে যেতেই পারে। অস্বাভাবিক কিছু নয়।’
সাজিদ বললো, ‘জ্বি। ডুবুরিটা লোকটাকে চিনতে পারলো। সে দেখলো, এটা হচ্ছে তার চরম শত্রু। এই লোকের সাথে তার দীর্ঘদিনের বিরোধ চলছে। এরকম হতে পারে না, স্যার?’
– ‘হ্যাঁ, হতে পারে।’
সাজিদ বললো, ‘ধরুন, ডুবুরির মধ্যে ব্যক্তিগত হিংসাবোধ জেগে উঠলো। সে শত্রুতাবশত ঠিক করলো যে এই লোকটাকে সে বাঁচাবে না। কারণ, লোকটা তার দীর্ঘদিনের শত্রু। সে একটা চরম সুযোগ পেলো এবং প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠলো। ধরুন, ডুবুরি ওই লোকটাকে অক্সিজেনের সিলিন্ডার তো দিলোই না, উল্টো উঠে আসার সময় লোকটাকে পেটে একটা জোরে লাথি দিয়ে আসলো।’
ক্লাসে তখনও পিনপতন নিরবতা। সবাই সাজিদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
স্যার বললেন, ‘তো, তাতে কী প্রমান হয়, সাজিদ?’
সাজিদ স্যারের দিকে ফিরলো। ফিরে বললো, ‘Let me finish my beloved sir….’
– ‘Okay, you are permitted to carry on.’ স্যার বললেন।
সাজিদ এবার স্যারকে প্রশ্ন করলো, ‘স্যার, বলুন তো, এই যে এতগুলো ডুবে যাওয়া লোককে ডুবুরিটা উদ্ধার করে আনলো, এর জন্য আপনি কি কোন ক্রেডিট পাবেন?’
স্যার বললেন, ‘অবশ্যই আমি ক্রেডিট পাবো। কারণ, আমি যদি ওই বিশেষ যন্ত্রটি না বানিয়ে দিতাম, তাহলে তো এই লোকগুলোর কেউই বাঁচতো না।’
সাজিদ বললো, ‘একদম ঠিক স্যার। আপনি অবশ্যই এর জন্য ক্রেডিট পাবেন। কিন্তু আমার পরবর্তী প্রশ্ন হচ্ছে, ডুবুরিটা সবাইকে উদ্ধার করলেও একজন লোককে সে শত্রুতাবশত উদ্ধার না করে মৃত্যুকূপে ফেলে রেখে এসেছে। আসার সময় তার পেটে একটি জোরে লাথিও দিয়ে এসেছে। ঠিক?’
– ‘হুম।’
– ‘এখন স্যার, ডুবুরির এহেন অন্যায়ের জন্য কি আপনি দায়ী হবেন? ডুবুরির এই অন্যায়ের ভাগটা কি সমানভাবে আপনিও ভাগ করে নেবেন?’
স্যার বললেন, ‘অবশ্যই না। ওর দোষের ভাগ আমি কেন নেবো? আমি তো তাকে এরকম অন্যায় কাজ করতে বলিনি। সেটা সে নিজে করেছে। সুতরাং এর পুরো দায় তার।’
সাজিদ এবার হাসলো। হেসে সে বললো, ‘স্যার, ঠিক একইভাবে আল্লাহ তা’আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ভালো কাজ করার জন্য। আপনি যেরকম ডুবুরিকে একটা বিশেষ যন্ত্র বানিয়ে দিয়েছেন, সেরকম সৃষ্টিকর্তাও মানুষকে অনুগ্রহ করে হাত, পা, চোখ, নাক, কান, মুখ, মস্তিষ্ক এসব দিয়ে দিয়েছেন। সাথে দিয়েছেন একটি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি। এখন এসব ব্যবহার করে সে যদি কোনো ভালো কাজ করে, তার ক্রেডিট স্রষ্টাও পাবেন, যেরকম বিশেষ যন্ত্রটি বানিয়ে আপনি ক্রেডিট পাচ্ছেন। আবার, সে যদি এগুলো ব্যবহার করে কোনো খারাপ কাজ করে, গর্হিত কাজ করে, তাহলে এর দায়ভার স্রষ্টা নেবেন না। যেরকম, ডুবুরির ওই অন্যায়ের দায় আপনার উপর বর্তায় না। আমি কি বোঝাতে পেরেছি, স্যার?’
ক্লাসে এতক্ষণ ধরে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছিলো। এবার ক্লসের সকল আস্তিকেরা মিলে একসাথে জোরে জোরে হাততালি দেওয়া শুরু করলো।
স্যারের জবাবের আশায় সাজিদ স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে। স্যার বললেন, ‘হুম। আই গট দ্য পয়েন্ট।’ এই বলে স্যার সেদিনের মতো ক্লাস শেষ করে চলে যান।
(এটি ‘সাজিদ’ সিরিজের ৩য় পর্ব। সাজিদ একটি কাল্পনিক চরিত্র। এই চরিত্রটি কাল্পনিক নানান ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে নাস্তিক তথা ইসলাম ধর্মবিদ্বেষীদের যুক্তিগুলোকে দর্শন, যুক্তি, বিজ্ঞান আর বাস্তবতার আলোকে খণ্ডন করে)
সাজিদ সিরিজ – পর্ব ০৪: তাকদির বনাম স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি- স্রষ্টা কি এখানে বিতর্কিত?
সাজিদের ব্যাগে ইয়া মোটা একটি ডায়েরি থাকে সবসময়।
ডায়েরিটা প্রাগৈতিহাসিক আমলের কোন নিদর্শনের মতো। জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। ছেঁড়া জায়গার কোনোটাতে সূতো দিয়ে সেলাই করা, কোনো জায়গায় আঠা দিয়ে প্রলেপ লাগানো, কোনো জায়গায় ট্যাপ করা।
এই ডায়েরিতে সে তার জীবনের নানা উল্লেখযোগ্য ঘটনা লিখে রাখে। এই ডায়েরির মাঝামাঝি কোনো এক জায়গায় সাজিদ আমার সাথে প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাটিও লিখে রেখেছে। তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় টি.এস.সি তে।
সে আমার সম্পর্কে লিখে রেখেছে-
‘ভ্যাবলা টাইপের এক ছেলের সাথে সাক্ষাৎ হলো আজ। দেখলেই মনে হবে, জগতের কঠিন বিষয়ের কোনোকিছুই সে বুঝে না।কথা বলার পরে বুঝলাম, এই ছেলে অত্যন্ত বুদ্ধিমান, কিন্তু বোকা। ছেলেটার নাম- আরিফ।’
নিচে তারিখ দেওয়া- ০৫/০৩/০৯
এই ডায়েরিতে নানান বিখ্যাত ব্যক্তিদের কথাও লিখা আছে। একবার কানাডার টরেন্টোতে সাজিদ তার বাবার সাথে একটি অফিসিয়াল ট্যুরে গিয়েছিলো। সেখানে অনেক সেলেব্রিটির সাথে বিলগেটসও আমন্ত্রিত ছিলেন। বিলগেটস সেখানে দশ মিনিটের জন্য বক্তৃতা রেখেছিলেন। সে ঘটনাটি লিখা আছে।
জাফর ইকবালের সাথে সাজিদের একবার বই মেলায় দেখা হয়ে যায়। সেবারের বইমেলায় জাফর স্যারের বই ‘একটুখানি বিজ্ঞান’ এর দ্বিতীয় কিস্তি ‘আরো একটুখানি বিজ্ঞান’ প্রকাশিত হয়। সাজিদ জাফর স্যারের বই কিনে বের হওয়ার পথে জাফর স্যারের সাথে তার দেখা হয়ে যায়। সাজিদ স্যারের একটি অটোগ্রাফ নিয়ে স্যারের কাছে হেসে জানতে চাইলো,- “স্যার, ‘একটুখানি বিজ্ঞান’ পাইলাম। এরপর পাইলাম ‘আরো একটুখানি বিজ্ঞান’। এটার পরে, ‘আরো আরো একটুখানি বিজ্ঞান’ কবে পাচ্ছি?”
সেদিন নাকি জাফর স্যার মিষ্টি হেসে বলেছিলেন,- ‘পাবে।’
নিজের সাথে ঘটে যাওয়া এরকম অনেক ঘটনাই ঠাঁই পেয়েছে সাজিদের ডায়েরিটাতে।
সাজিদের ডায়েরির আদ্যোপান্ত আমার পড়া ছিলো। কিন্তু সেমিস্টার ফাইনাল সামনে চলে আসায় গত বেশ কিছুদিন তার ডায়েরিটা আমার আর পড়া হয়নি। অবশ্য ডায়েরিটা আমি লুকিয়ে লুকিয়েই পড়ি।
সেদিন থার্ড সেমিস্টারের শেষ পরীক্ষাটি দিয়ে রুমে আসলাম। এসে দেখি সাজিদ ঘরে নেই। তার টেবিলের উপরে তার ডায়েরিটা পড়ে আছে খোলা অবস্থায়।
ঘর্মাক্ত শরীর। কাঠফাটা রোদের মধ্যে ক্যাম্পাস থেকে হেঁটে বাসায় ফিরেছি। এই মুহূর্তে বসে ডায়েরিটা উল্টাবো, সে শক্তি বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই। কিন্তু ডায়েরিটা বন্ধ করতে গিয়ে একটি শিরোনামে আমার চোখ আটকে যায়। আমি সাজিদের টেবিলেই বসে পড়ি। লেখাটির শিরোনাম ছিলো-
‘ভাগ্য বনাম স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি- স্রষ্টা কি এখানে বিতর্কিত?’
বেশ লোভনীয় শিরোনাম। শারীরিক ক্লান্তি ভুলেই আমি ঘটনাটির প্রথম থেকে পড়া শুরু করলাম। ঘটনাটি সাজিদের ডায়েরিতে যেভাবে লেখা, ঠিক সেভাবেই আমি পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি-
‘কয়েকদিন আগে ক্লাসের থার্ড পিরিয়ডে মফিজুর রহমান স্যার এসে আমাকে দাঁড় করালেন। বললেন, ‘তুমি ভাগ্যে, আই মিন তাকদিরে বিশ্বাস করো?’
আমি আচমকা অবাক হলাম। আসলে এই আলাপগুলো হলো ধর্মীয় আলাপ। মাইক্রোবায়োলজির একজন শিক্ষক যখন ক্লাসে এসে এসব জিজ্ঞেস করেন, তখন খানিকটা বিব্রত বোধ করাই স্বাভাবিক। স্যার আমার উত্তরের আশায় আমার মুখের দিকে চেয়ে আছেন।
আমি বললাম, ‘জ্বি, স্যার। এ্যাজ এ্যা মুসলিম, আমি তাকদিরে বিশ্বাস করি। এটি আমার ঈমানের মূল সাতটি বিষয়ের মধ্যে একটি।’
স্যার বললেন, ‘তুমি কি বিশ্বাস করো যে, মানুষ জীবনে যা যা করবে তার সবকিছুই তার জন্মের অনেক অনেক বছর আগে তার তাকদিরে লিখে দেওয়া হয়েছে?’
– ‘জ্বি স্যার।’ আমি উত্তর দিলাম।
– ‘বলা হয়, স্রষ্টার অনুমতি ছাড়া গাছের একটি ক্ষুদ্র পাতাও নড়েনা, তাই না?’
– ‘জ্বি স্যার।’
– ‘ধরো, আজ সকালে আমি একজন লোককে খুন করলাম। এটা কি আমার তাকদিরে পূর্বনির্ধারিত ছিলো না?’
– ‘জ্বি, ছিলো।’
– ‘আমার তাকদির যখন লেখা হচ্ছিলো, তখন কি আমি জীবিত ছিলাম?’
– ‘না, ছিলেন না।’
– ‘আমার তাকদির কে লিখেছে? বা কার নির্দেশে লিখিত হয়েছে?’
– ‘স্রষ্টার।’
– ‘তাহলে সোজা এবং সরল লজিক এটাই বলে- ‘আজ সকালে যে খুনটি আমি করেছি, সেটি মূলত আমি করিনি। আমি এখানে একটি রোবট মাত্র। আমার ভেতরে একটি প্রোগ্রাম সেট করে দিয়েছেন স্রষ্টা। সেই প্রোগ্রামে লেখা ছিলো যে, আজ সকালে আমি একজন লোককে খুন করবো। সুতরাং, আমি ঠিক তা-ই করেছি, যা আমার জন্য স্রষ্টা পূর্বে ঠিক করে রেখেছেন। এতে আমার কোন হাত নেই। ডু ইউ এগ্রি,সাজিদ?’
– ‘কিছুটা।’ আমি উত্তর দিলাম।
স্যার এবার হাসলেন। হেসে বললেন, ‘আমি জানতাম তুমি কিছুটাই একমত হবে, পুরোটা নয়। এখন তুমি আমাকে নিশ্চই যুক্তি দেখিয়ে বলবে, স্যার, স্রষ্টা আমাদের একটি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন। আমরা এটা দিয়ে ভালো-মন্দ বিচার করে চলি,রাইট?’
– ‘জ্বি স্যার।’
– ‘কিন্তু সাজিদ, এটা খুবই লেইম লজিক, ইউ নো? ধরো, আমি তোমার হাতে বাজারের একটি লিস্ট দিলাম। লিস্টে যা যা কিনতে হবে, তার সবকিছু লেখা আছে। এখন তুমি বাজার করে ফিরলে। তুমি ঠিক তা-ই তা-ই কিনলে যা আমি লিস্টে লিখে দিয়েছি। এবং তুমি এটা করতে বাধ্য।’
এতটুকু বলে স্যার আমার কাছে জানতে চাইলেন, ‘বুঝতে পারছো?’
আমি বললাম, ‘জ্বি স্যার।’
– ‘ভেরি গুড! ধরো, তুমি বাজার করে আসার পর একজন জিজ্ঞেস করলো, সাজিদ কী কী বাজার করেছো? তখন আমি উত্তর দিলাম, ‘ওর যা যা খেতে মন চেয়েছে, তা-ই তা-ই কিনেছে। বলো তো, আমি সত্য বলেছি কিনা?’
আমি বললাম,- ‘নাহ, আপনি মিথ্যা বলেছেন।’
স্যার চিৎকার করে বলে উঠলেন, “এক্সাক্টলি। ইউ হ্যাভ গট দ্য পয়েন্ট, মাই ডিয়ার। আমি মিথ্যা বলেছি। আমি লিস্টে বলেই দিয়েছি তোমাকে কী কী কিনতে হবে। তুমি ঠিক তা-ই তা-ই কিনেছো যা আমি কিনতে বলেছি। যা কিনেছো সব আমার পছন্দের জিনিস। এখন আমি যদি বলি, ‘ওর যা যা খেতে মন চেয়েছে,সে তা-ই তা-ই কিনেছে’, তাহলে এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা,না?”
– ‘জ্বি, স্যার।’
– ‘ঠিক স্রষ্টাও এভাবে মিথ্যা বলেছেন। দুই নাম্বারি করেছেন। তিনি অনেক আগে আমাদের তাকদির লিখে তা আমাদের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন। এখন আমরা সেটাই করি, যা স্রষ্টা সেখানে লিখে রেখেছেন। আবার, এ্যাট দ্য এন্ড অফ দ্য ডে, এই কাজের জন্য কেউ জান্নাতে যাচ্ছে, কেউ জাহান্নামে। কিন্তু কেন? এখানে মানুষের তো কোন হাত নেই। ম্যানুয়ালটা স্রষ্টার তৈরি। আমরা তো জাস্ট পারফর্মার। স্ক্রিপ্ট রাইটার তো স্রষ্টা। স্রষ্টা এর জন্য আমাদের কাউকে জান্নাত, কাউকে জাহান্নাম দিতে পারেন না। যুক্তি তাই বলে, ঠিক?’
আমি চুপ করে রইলাম। পুরো ক্লাসে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে তখন।
স্যার বললেন, ‘হ্যাভ ইউ এনি প্রপার লজিক অন দ্যাট টিপিক্যাল কোয়েশ্চান, ডিয়ার?’
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।
স্যার মুচকি হাসলেন। মনে হলো উনি ধরেই নিয়েছেন যে, উনি আমাকে এবার সত্যি সত্যিই কুপোকাত করে দিয়েছেন। বিজয়ীর হাসি। আমাকে যারা চিনে তারা জানে, আমি কখনো কারো প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় নিই না। আজকে যেহেতু তার ব্যতিক্রম ঘটলো, আমার বন্ধুরা আমার দিকে ড্যাব ড্যাব চোখ করে তাকালো। তাদের চাহনি দেখে মনে হচ্ছিলো, এই সাজিদকে তারা চিনেই না।কোনোদিন দেখেনি।
আর ক্লাসে আমার বিরুদ্ধ মতের যারা আছে, তাদের চেহারা তখন মুহূর্তেই উজ্জ্বল বর্ণ ধারণ করলো। তারা হয়তো মনে মনে বলতে লাগলো, ‘মোল্লার দৌড় ওই মসজিদ পর্যন্তই। হা হা হা।’
আমি মুখ তুলে স্যারের দিকে তাকালাম।মুচকি হাসিটা স্যারের মুখে তখনও বিরাজমান।
আমি বললাম, ‘স্যার, এই ক্লাসে কার সম্পর্কে আপনার কী অভিমত?’
স্যার ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন। স্যার জিজ্ঞেস করেছেন কী আর আমি বলছি কী।
স্যার বললেন,- ‘বুঝলাম না।’
– ‘মানে, আমাদের ক্লাসের কার মেধা কী রকম, সে বিষয়ে আপনার কী ধারণা?’
– ‘ভালো ধারণা। ছাত্রদের সম্পর্কে একজন শিক্ষকেরই তো সবচেয়ে ভালো জ্ঞান থাকে।’
আমি বললাম, ‘স্যার, আপনি বলুন তো এই ক্লাসে কারা কারা ফার্স্ট ক্লাস আর কারা কারা সেকেন্ড ক্লাস পাবে?’
স্যার কিছুটা বিস্মিত হলেন। বললেন, ‘আমি তোমাকে অন্য বিষয়ে প্রশ্ন করেছি। তুমি ‘আউট অফ কনটেক্সট’ এ গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করছো, সাজিদ।’
– ‘না স্যার, আমি কনটেক্সটেই আছি। আপনি উত্তর দিন।’
স্যার বললেন,- ‘এই ক্লাশ থেকে রায়হান, মমতাজ, ফারহানা, সজীব, ওয়ারেশ, ইফতি, সুমন,জাবেদ এবং তুমি ফার্স্ট ক্লাস পাবে। আর বাকিরা সেকেন্ড ক্লাস।’
স্যার যাদের নাম বলেছেন, তারা সবাই ক্লাসের ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। সুতরাং, স্যারের অনুমান খুব একটা ভুল না।
আমি বললাম, ‘স্যার, আপনি এটা লিখে দিতে পারেন?’
– ‘Why not?’ স্যার বললেন।
এই বলে তিনি খচখচ করে একটা কাগজের একপাশে যারা ফার্স্ট ক্লাস পাবে তাদের নাম, অন্যপাশে যারা সেকেন্ড ক্লাস পাবে, তাদের নাম লিখে আমার হাতে দিলেন।
আমি বললাম, ‘স্যার, ধরে নিলাম যে আপনার ভবিষ্যৎবাণী সম্পূর্ণ সত্য হয়েছে। মানে আপনি ফার্স্ট ক্লাস পাবে বলে যাদের নাম লিখেছেন,তারা সবাই ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে, আর যারা সেকেন্ড ক্লাস পাবে লিখেছেন, তাদের সবাই সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে।’
– ‘হুম, তো?’
– ‘এখন, স্যার বলুন তো, যারা ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে, আপনি এই কাগজে তাদের নাম লিখেছেন বলেই কি তারা ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে?’
– ‘নাহ তো।’
– ‘যারা সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে, তারা সেকেন্ড ক্লাস পাবে বলে আপনি এই কাগজে লিখেছেন বলেই কি তারা সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে?’
স্যার বললেন, ‘একদম না।’
– ‘তাহলে মূল ব্যাপারটি কী স্যার?’
স্যার বললেন, ‘মূল ব্যাপার হলো, আমি তোমাদের শিক্ষক। আমি খুব ভালো জানি পড়াশুনায় তোমাদের কে কেমন। আমি খুব ভালো করেই জানি, কার কেমন মেধা। সুতরাং আমি চোখ বন্ধ করেই বলে দিতে পারি কে কেমন রেজাল্ট করবে।’
আমি হাসলাম। বললাম, ‘স্যার, যারা সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে, তারা যদি আপনাকে দোষ দেয়? যদি বলে, আপনি ‘সেকেন্ড ক্লাস’ ক্যাটাগরিতে তাদের নাম লিখেছেন বলেই তারা সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে?’
স্যার কপালের ভাঁজ লম্বা করে বললেন, ‘ইট উড বি টোট্যালি বুলশিট! আমি কেন এর জন্য দায়ী হবো? এটা তো সম্পূর্ণ তাদের দায়। আমি শুধু তাদের মেধা, যোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা রাখি বলেই অগ্রিম বলে দিতে পেরেছি যে কে কেমন রেজাল্ট করবে।’
আমি আবার জোরে জোরে হাসতে লাগলাম। পুরো ক্লাস আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
আমি থামলাম।বললাম, ‘স্যার, তাকদির তথা ভাগ্যটাও ঠিক এরকম। আপনি যেমন আমাদের মেধা, যোগ্যতা, ক্ষমতা সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন, স্রষ্টাও তেমনি তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে ধারণা রাখেন। আপনার ধারণা মাঝে মাঝে ভুল হতে পারে, কিন্তু স্রষ্টার ধারণায় কোনো ভুল নেই। স্রষ্টা হলেন আলিমুল গায়েব। তিনি ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব জানেন। আপনি যেরকম আমাদের সম্পর্কে পূর্বানুমান করে লিখে দিয়েছেন যে আমাদের মধ্যে কারা কারা ফার্স্ট ক্লাস পাবে, আর কারা সেকেন্ড ক্লাস। এর মানে কিন্তু এই না যে আপনি বলেছেন বলে আমাদের কেউ ফার্স্ট ক্লাস পাচ্ছি, কেউ সেকেন্ড ক্লাস। স্রষ্টাও সেরকম তাঁর জ্ঞানের কারণে আমাদের তাকদির লিখে রেখেছেন। তাতে লেখা আছে দুনিয়ায় আমরা কে কী করবো। এর মানেও কিন্তু এই না যে তিনি লিখে দিয়েছেন বলেই আমরা কাজগুলো করছি। বরং এর মানে হলো এই, তিনি জানেন যে আমরা দুনিয়ায় এই এই কাজগুলো করবো। তাই তিনি তা অগ্রিম লিখে রেখেছেন তাকদির হিসেবে। আমাদের মধ্যে কেউ ফার্স্ট ক্লাস আর কেউ সেকেন্ড ক্লাস পাবার জন্য যেমন কোনোভাবেই আপনি দায়ী নন, ঠিক সেভাবে মানুষের মধ্যে কেউ ভালো কাজ করে জান্নাতে, আর কেউ খারাপ কাজ করে জাহান্নামে যাবার জন্যও স্রষ্টা দায়ী নন। স্রষ্টা জানেন যে, আপনি আজ সকালে একজনকে খুন করবেন। তাই তিনি সেটা আগেই আপনার তাকদিরে লিখে রেখেছেন। এটার মানে এই না যে স্রষ্টা লিখে রেখেছেন বলেই আপনি খুনটি করেছেন। এর মানে হলো স্রষ্টা জানেন যে,আপনি আজ খুনটি করবেন। তাই সেটা অগ্রিম লিখে রেখেছেন আপনার তাকদির হিসেবে। স্যার, ব্যাপারটা কি এখন পরিষ্কার?’
স্যারের চেহারাটা কিছুটা ফ্যাকাশে মনে হলো। তিনি বললেন, ‘হুম।’
এরপর স্যার কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। তারপর বললেন, ‘আমি শুনেছিলাম তুমি ক’দিন আগেও নাস্তিক ছিলে। তুমি আবার আস্তিক হলে কবে?’
আমি হা হা হা করে হাসলাম। বললাম, ‘এই প্রশ্নটা কিন্তু স্যার আউট অফ কনটেক্সট।’
এটা শুনে পুরো ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়লো।
পিরিওডের একদম শেষদিকে স্যার আবার আমাকে দাঁড় করালেন। বললেন, ‘বুঝলাম স্রষ্টা আগে থেকে জানেন বলেই লিখে রেখেছেন। তিনি যেহেতু আগে থেকেই জানেন কে ভালো কাজ করবে আর কে খারাপ কাজ করবে, তাহলে পরীক্ষা নেওয়ার কী দরকার? যারা জান্নাতে যাওয়ার তাদের জান্নাতে, যারা জাহান্নামে যাওয়ার তাদের জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেই তো হতো, তাই না?’
আমি আবার হাসলাম। আমার হাতে স্যারের লিখে দেওয়া কাগজটি তখনও ধরা ছিলো। আমি সেটা স্যারকে দেখিয়ে বললাম, ‘স্যার, এই কাগজে কারা কারা ফার্স্ট ক্লাস পাবে, আর কারা কারা সেকেন্ড ক্লাস পাবে, তাদের নাম লেখা আছে। তাহলে এই কাগজটির ভিত্তিতেই রেজাল্ট দিয়ে দিন। বাড়তি করে পরীক্ষা নিচ্ছেন কেনো?’
স্যার বললেন, “পরীক্ষা না নিলে কেউ হয়তো এই বলে অভিযোগ করতে পারে যে, ‘স্যার আমাকে ইচ্ছা করেই সেকেন্ড ক্লাস দিয়েছে। পরীক্ষা দিলে আমি হয়তো ঠিকই ফার্স্ট ক্লাস পেতাম।’
আমি বললাম, ‘একদম তাই, স্যার। স্রষ্টাও এইজন্য পরীক্ষা নিচ্ছেন যাতে কেউ বলতে না পারে দুনিয়ায় পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলে আমি অবশ্যই আজকে জান্নাতে থাকতাম। স্রষ্টা ইচ্ছা করেই আমাকে জাহান্নামে পাঠিয়েছে।’
ক্লাসের সবাই হাত তালি দিতে শুরু করলো। স্যার বললেন, ‘সাজিদ, আই হ্যাভ এ্যা লাস্ট কোয়েশ্চান।’
– ‘ডেফিনেইটলি, স্যার।’ আমি বললাম।
– ‘আচ্ছা, যে মানুষ পুরো জীবনে খারাপ কাজ বেশি করে, সে অন্তত কিছু না কিছু ভালো কাজ তো করে,তাই না?’
– ‘জ্বি স্যার।’
– ‘তাহলে, এই ভালো কাজগুলোর জন্য হলেও তো তার জান্নাতে যাওয়া দরকার,তাই না?’
আমি বললাম, ‘স্যার, পানি কীভাবে তৈরি হয়?’
স্যার আবার অবাক হলেন। হয়তো বলতে যাচ্ছিলেন যে এই প্রশ্নটাও আউট অফ কনটেক্সট, কিন্তু কী ভেবে যেন চুপসে গেলেন।বললেন, ‘দুই ভাগ হাইড্রোজেন আর এক ভাগ অক্সিজেনের সংমিশ্রণে।’
আমি বললাম,- ‘আপনি এক ভাগ হাইড্রোজেন আর এক ভাগ অক্সিজেন দিয়ে পানি তৈরি করতে পারবেন?’
– ‘কখনোই না।’
– ‘ঠিক সেভাবে, এক ভাগ ভালো কাজ আর এক ভাগ মন্দ কাজে জান্নাত পাওয়া যায়না। জান্নাত পেতে হলে হয় তিন ভাগই ভালো কাজ হতে হবে, নতুবা দুই ভাগ ভালো কাজ, এক ভাগ মন্দ কাজ হতে হবে। অর্থাৎ, ভালো কাজের পাল্লা ভারি হওয়া আবশ্যক।’
সেদিন আর কোন প্রশ্ন স্যার আমাকে করেননি।’
–
এক নিশ্বাঃসে পুরোটা পড়ে ফেললাম। কোথাও একটুও থামিনি। পড়া শেষে যেই মাত্র সাজিদের ডায়েরিটা বন্ধ করতে যাবো, অমনি দেখলাম পেছন থেকে সাজিদ এসে আমার কান মলে ধরেছে। সে বললো,- ‘তুই তো সাংঘাতিক লেভেলের চোর।’
আমি হেসে বললাম,- ‘হা হা হা। স্যারকে তো ভালো জব্দ করেছিস ব্যাটা।’
কথাটা সে কানে নিলো বলে মনে হলো না। নিজের সম্পর্কে কোন কমপ্লিমেন্টই সে আমলে নেয় না। গামছায় মুখ মুছতে মুছতে সে খাটের উপর শুয়ে পড়লো।
আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম। বললাম,- ‘সাজিদ……’
– ‘হু’
– ‘একটা কথা বলবো?’
– ‘বল।’
– ‘জানিস, একসময় যুবকেরা হিমু হতে চাইতো। হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে, মরুভূমিতে গর্ত খুঁড়ে জ্যোৎস্না দেখার স্বপ্ন দেখতো।দেখিস, এমন একদিন আসবে, যেদিন যুবকেরা সাজিদ হতে চাইবে। ঠিক তোর মতো……’
এই বলে আমি সাজিদের দিকে তাকালাম। দেখলাম, ততক্ষণে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। অঘোর ঘুম……..
(এটি ‘সাজিদ’ সিরিজের চতুর্থ পর্ব। সাজিদ একটি কাল্পনিক চরিত্র। এই চরিত্রটি কাল্পনিক নানান ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে নাস্তিক তথা ইসলাম ধর্ম বিদ্বেষীদের যুক্তিগুলোকে দর্শন, যুক্তি, বিজ্ঞান আর বাস্তবতার আলোকে খন্ডন করে)
আইডিসির সাথে যোগ দিয়ে উভয় জাহানের জন্য ভালো কিছু করুন।
আইডিসি এবং আইডিসি ফাউন্ডেশনের ব্যপারে বিস্তারিত জানতে লিংক০১ ও লিংক০২ ভিজিট করুন।
আইডিসি মাদরাসার ব্যপারে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
আপনি আইডিসি মাদরাসার একজন স্থায়ী সদস্য /পার্টনার হতে চাইলে এই লিংক দেখুন.
আইডিসি এতীমখানা ও গোরাবা ফান্ডে দান করে দুনিয়া এবং আখিরাতে সফলতা অর্জন করুন।
কুরআন হাদিসের আলোকে বিভিন্ন কঠিন রোগের চিকিৎসা করাতেআইডিসি ‘র সাথে যোগাযোগ করুন।
ইসলামিক বিষয়ে জানতে এবং জানাতে এই গ্রুপে জয়েন করুন।
ইসলামী দাওয়াহ সেন্টারকে সচল রাখতে সাহায্য করুন!
ইসলামী দাওয়াহ সেন্টার ১টি অলাভজনক দাওয়াহ প্রতিষ্ঠান, এই প্রতিষ্ঠানের ইসলামিক ব্লগটি বর্তমানে ২০,০০০+ মানুষ প্রতিমাসে পড়ে, দিন দিন আরো অনেক বেশি বেড়ে যাবে, ইংশাআল্লাহ।
বর্তমানে মাদরাসা এবং ব্লগ প্রজেক্টের বিভিন্ন খাতে (ওয়েবসাইট হোস্টিং, CDN,কনটেন্ট রাইটিং, প্রুফ রিডিং, ব্লগ পোস্টিং, ডিজাইন এবং মার্কেটিং) মাসে গড়ে ৫০,০০০+ টাকা খরচ হয়, যা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। সেকারনে, এই বিশাল ধর্মীয় কাজকে সামনে এগিয়ে নিতে সর্বপ্রথম আল্লাহর কাছে আপনাদের দোয়া এবং আপনাদের সহযোগিতা প্রয়োজন, এমন কিছু ভাই ও বোন ( ৩১৩ জন ) দরকার, যারা আইডিসিকে নির্দিষ্ট অংকের সাহায্য করবেন, তাহলে এই পথ চলা অনেক সহজ হয়ে যাবে, ইংশাআল্লাহ।
যারা এককালিন, মাসিক অথবা বাৎসরিক সাহায্য করবেন, তারা আইডিসির মুল টিমের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন, ইংশাআল্লাহ।
আইডিসির ঠিকানাঃ খঃ ৬৫/৫, শাহজাদপুর, গুলশান, ঢাকা -১২১২, মোবাইলঃ +88 01609 820 094, +88 01716 988 953 ( নগদ/বিকাশ পার্সোনাল )
ইমেলঃ info@islamidawahcenter.com, info@idcmadrasah.com, ওয়েব: www.islamidawahcenter.com, www.idcmadrasah.com সার্বিক তত্ত্বাবধানেঃ হাঃ মুফতি মাহবুব ওসমানী ( এম. এ. ইন ইংলিশ, ফার্স্ট ক্লাস )
