ইমামের পিছনে ‘আমীন’ আস্তে নাকি জোরে বলবো? কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিশ্লেষণ

ইমামের পিছনে ‘আমীন’ আস্তে নাকি জোরে বলবো? কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিশ্লেষণ


✍️ লিখেছেন: মাহবুব ওসমানী
🔗 প্রকাশনা: https://islamidawahcenter.com


ভূমিকা

নামাযে সূরাহ ফাতিহা পাঠের পর ‘আমীন’ বলা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে মুসল্লিদের মধ্যে এ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে—ইমামের পিছনে আমীন জোরে বলবো, না আস্তে? একপক্ষ বলে উচ্চস্বরে বলাই সুন্নত, অপরপক্ষ বলে নিচু স্বরে বলাই উত্তম। এই প্রবন্ধে আমরা কুরআন ও হাদীসের দলিলসহ, সাহাবায়ে কেরাম ও ইমামদের মতামত তুলে ধরে এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করবো।


কুরআনের দলিল

📖 সূরা আল-বাকারা, আয়াত ৩

وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آمِنُوا كَمَا آمَنَ النَّاسُ
“আর যখন তাদের বলা হয়, ‘তোমরা ঈমান আনো, যেমন ঈমান এনেছে মানুষরা।” (সূরা আল-বাকারা: ২:১৩)

🔎 টীকা: এখানে “آمِنُوا” শব্দটি “أَمَّنَ” ধাতু থেকে এসেছে, যার একটি রূপ “آمِينَ”। যদিও সরাসরি আমীন বলার প্রসঙ্গ নয়, তবে “আমীন” বলার অর্থ— “হে আল্লাহ! তুমি যা বলেছ, আমরা তা মেনে নিলাম”—এটি মূলত দোয়ার প্রতি ঈমান প্রকাশ।


আমীন জোরে বলার হাদীসসমূহ

📘 সহিহ বুখারী, হাদিস: ٧٨٢

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ قَالَ:
“إِذَا قَالَ الْإِمَامُ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ فَقُولُوا آمِينَ، فَإِنَّهُ مَنْ وَافَقَ قَوْلُهُ قَوْلَ الْمَلَائِكَةِ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.”

🔹 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৭৮২
আবু হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“যখন ইমাম (সালাতে) ‘غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ’ (গায়রিল মাগদুবি ‘আলাইহিম ওয়া লাদ্ দোয়াল্লীন) বলেন, তখন তোমরা ‘আমীন’ বলো। কারণ যার ‘আমীন’ বলা ফেরেশতাদের আমীন বলার সঙ্গে মিলে যায়, তার পূর্বের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।”

📌 টীকা: হাদীসে জোরে বলার নির্দিষ্ট উল্লেখ নেই, তবে আমীন বলার ফজিলত স্পষ্ট করা হয়েছে।


📘 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ٤١٠

عَنْ أَبِي مُوسَى الْأَشْعَرِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ:
“إِذَا أَمَّنَ الْإِمَامُ فَأَمِّنُوا…”

বাংলা অনুবাদ:
আবু মূসা আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“যখন ইমাম আমীন বলে, তোমরাও তখন আমীন বলো…”

📌 টীকা: ইমাম আমীন বললে মুকতাদিকেও বলতে বলা হয়েছে; এখানে উচ্চ বা নিম্ন স্বরের উল্লেখ নেই।


📘 সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ٩٣٢ (সহিহ)

عَنْ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ، قَالَ: سَمِعْتُ النَّبِيَّ ﷺ قَرَأَ:
“وَلَا الضَّالِّينَ” فَقَالَ: “آمِينَ، رَفَعَ بِهَا صَوْتَهُ”

বাংলা অনুবাদ:
ওয়াইল ইবন হুজর (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে “وَلَا الضَّالِّينَ” (ওয়ালাদ্-দ্বাল্লীন) পাঠ করতে শুনেছি, এরপর তিনি “আমীন” বলেছেন এবং তা উচ্চ স্বরে বলেছেন।

📌 টীকা: এখানে রাসূলুল্লাহ ﷺ ‘আমীন’ জোরে বলেছেন—এটি সরাসরি জোরে আমীন বলার প্রমাণ।


সাহাবীদের আমল ও ইমামদের মতামত

“يُسْتَحَبُّ رَفْعُ الصَّوْتِ بِالتَّأْمِينِ لِلْإِمَامِ وَالْمَأْمُومِ.”
অর্থ: “ইমাম ও মুকতাদির জন্য উচ্চ স্বরে আমীন বলা সুন্নত।”


আস্তে আমীন বলার দলিল ও বিশ্লেষণ

📖 সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত ২০৪

وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
“যখন কুরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন তা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করো এবং নিশ্চুপ থাকো, যাতে তোমরা দয়া লাভ কর।”

📌 টীকা: নামাজে ইমামের কিরাআতের সময় মুকতাদিদের উচিত নীরব থাকা। তাই কিরাআতের পর নিচু স্বরে আমীন বলা প্রমাণিত।


📘 সহীহ ইবন খুযাইমা, হাদিস: ٦٨١

عَنْ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ، قَالَ: صَلَّيْتُ خَلْفَ النَّبِيِّ ﷺ، فَلَمَّا قَالَ:
“وَلَا الضَّالِّينَ”، قَالَ: “آمِينَ”، وَخَفَضَ بِهَا صَوْتَهُ.

বাংলা অনুবাদ:
ওয়াইল ইবন হুজর (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেছনে নামাজ পড়েছিলাম। যখন তিনি (সূরা ফাতিহার) “وَلَا الضَّالِّينَ” (অর্থ: এবং পথভ্রষ্টদের নয়) পাঠ করলেন, তখন তিনি বললেন “আমীন”, এবং তিনি তা নিম্নস্বরে (নিচু কণ্ঠে) বলেছিলেন।

📌 টীকা: রাসূল ﷺ নিজেও কখনো কখনো আস্তে আমীন বলতেন।


📘 মুসান্নাফ ইবন أبي شيبة, হাদীস: ٣٩٤٤٩

عَنْ أَبِي مَالِكٍ الْأَشْعَرِيِّ، قَالَ:
“كَانُوا يَأْمُرُونَا أَنْ نَقُولَ آمِينَ فِي أَدَبٍ وَبِصَوْتٍ خَفِيٍّ.”

আবূ মালিক আল-আশ’আরী (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
“তারা আমাদের আদবের সাথে এবং নিচু কণ্ঠে ‘আমীন’ বলার নির্দেশ দিতেন।”

📌 টীকা: সাহাবারা নিচু স্বরে ও আদবের সাথে আমীন বলার নির্দেশ দিতেন।


📘 আল-মুদাওয়ানা, ১/৭৫

إِمَامُ مَالِكٍ (رَحِمَهُ اللهُ):

“لَا يَرْفَعُ صَوْتَهُ بِهَا أَحَدٌ”
অর্থ: “কেউ আমীন বলার সময় উচ্চস্বরে বলবে না।”


ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-এর মতামত

তিনি বলেন, ইমামের পিছনে আস্তে আমীন বলা উত্তম; এতে জামাতের শৃঙ্খলা বজায় থাকে এবং মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে না। এটি মূলত ফিকহি কিয়াসভিত্তিক মত।


উপসংহার

‘আমীন’ বলা নামাযের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যার ফজিলত রয়েছে। অধিকাংশ সহিহ হাদীস থেকে বোঝা যায়, রাসূল ﷺ ও সাহাবারা উচ্চ স্বরে আমীন বলতেন, বিশেষ করে জোহরি সালাতে (যেমন: ফজর, মাগরিব, ঈশা)। তবে কিছু হাদীসে ও সাহাবার আমলে আস্তে আমীন বলার দিকনির্দেশনাও রয়েছে।

সুন্নাতের দিক থেকে জোরে আমীন বলাই ফজিলতপূর্ণ ও প্রমাণিত।
তবে নিচু স্বরে আমীন বলাও সহিহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, এবং ইমামগণও এ মত দিয়েছেন।

📌 অতএব, কেউ জোরে বললে তাকে দোষারোপ করা যাবে না, আবার কেউ আস্তে বললেও তার আমল শুদ্ধ। ইসলামে মতপার্থক্যে সহনশীলতা রাখা অপরিহার্য।


আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সহিহ আকীদা ও সহিহ হাদীস মোতাবেক আমল করার তাওফিক দিন। আমীন।
✍️ লিখেছেনঃ মাহবুব ওসমানী

 

 

আইডিসির সাথে যোগ দিয়ে উভয় জাহানের জন্য ভালো কিছু করুন।

 

 

 

আইডিসি এবং আইডিসি ফাউন্ডেশনের ব্যপারে বিস্তারিত জানতে  লিংক০১ ও লিংক০২ ভিজিট করুন।

Related posts

Muhammad-Before-Muslim-Name / নামের আগে ‘মুহাম্মদ’ যুক্ত করা কি সুন্নাত?

by IDCAdmin
6 years ago

Gadire-Khum / গাদীরে খুমের ভাষণ কি হযরত আলী রাঃ এর প্রথম খলীফা হবার দলীল?

by IDCAdmin
6 years ago

Human Creation In The Quran-DNA এবং মানুষ সৃষ্টির পক্রিয়ার কথা কুরআনে বলা হয়েছে প্রায় ১৪০০ বছর আগে

by IDCAdmin
5 years ago
Exit mobile version