নারীদের লেখাপড়া শিক্ষা: ফিতনার আশঙ্কা নাকি ইসলামে বৈধ জ্ঞান অর্জনের সুযোগ?

Womens Education in Islam (কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিশ্লেষণ)

সূত্রঃ কুরআন, সহীহ হাদীস ও মুহাদ্দিসদের ব্যাখ্যা ✍️ লিখেছেনঃ মাহবুব ওসমানী


ভূমিকা

ইসলাম নারীকে যেমন সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে, তেমনি তাকে ফিতনা ও অনৈতিকতা থেকে রক্ষার কঠোর নির্দেশনাও দিয়েছে।
সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে এমন একটি উক্তি ছড়িয়েছে — “নারীদেরকে লেখাপড়া শেখানো হারাম।”
অনেকে বিষয়টি একপেশে ব্যাখ্যা করছেন — কেউ একে সম্পূর্ণ হারাম বলছেন, আবার কেউ সম্পূর্ণ বৈধ বলে দাবি করছেন।

অতএব, প্রামাণ্য ইসলামী উৎস — কুরআন, সহীহ হাদীস ও মুহাদ্দিসদের ব্যাখ্যা অনুসারে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত জরুরি।


নিষেধাজ্ঞার হাদীসসমূহ

আল-হাকিম তাঁর আল-মুস্তাদরাক (হাদীস নং: ৩৪৯৪)-এ বর্ণনা করেছেন —

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، قَالَتْ:
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ:
«لَا تُسْكِنُوهُنَّ الْغُرَفَ، وَلَا تُعَلِّمُوهُنَّ الْكِتَابَةَ، وَعَلِّمُوهُنَّ الْمِغْزَلَ وَسُورَةَ النُّورِ»

“নারীদেরকে উঁচু ঘরে (অর্থাৎ বারান্দাযুক্ত কক্ষে) রাখো না এবং তাদেরকে লেখাও শেখিও না। বরং তাদেরকে শেখাও সুতা কাটা ও সূরা আন-নূর।”
(আল-মুস্তাদরাক ‘আলা সাহিহাইন’, হাদীস: ৩৪৯৪)

ইমাম আল-হাকিম (রহ.) বলেন —

هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحُ الإِسْنَادِ، وَلَمْ يُخَرِّجَاهُ

“এটি সহীহ সনদযুক্ত হাদীস, যদিও বুখারী ও মুসলিম একে সংকলন করেননি।”

ইমাম আল-বায়হাকীও (রহ.) এই হাদীসকে নির্ভরযোগ্য বলে মেনে নিয়েছেন, এবং আল-হাকিম আত-তিরমিযী (রহ.) তাঁর নাওয়াদিরুল উসূল (৩/৮২)-এ এই হাদীসকে প্রমাণযোগ্য বলে মত দিয়েছেন।


হাদীসের ব্যাখ্যা ও ফিতনার কারণ

আল-হাকিম আত-তিরমিযী (রহ.) ব্যাখ্যা করেছেন —

“নারীদের উঁচু ঘরে রাখা মানে এমন স্থানে রাখা, যেখান থেকে তারা পুরুষদের দেখতে পারে বা পুরুষেরা তাদের দেখতে পারে। এতে ফিতনার আশঙ্কা রয়েছে।”

তিনি আরও বলেন —

“লেখাপড়া শেখানোও ফিতনার কারণ হতে পারে, কারণ লেখার মাধ্যমে নারী যার প্রতি অনুরক্ত, তার সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করতে পারে; এতে অন্তরের ফিতনা সৃষ্টি হয়।”

অতএব, নবী ﷺ এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন নারীদের পবিত্রতা ও সমাজের নিরাপত্তা রক্ষার উদ্দেশ্যে, যাতে অশ্লীলতা ও ফিতনা ছড়িয়ে না পড়ে।

এটি এমন এক সতর্কতা-মূলক নিষেধ (نهي سَدًّا لِلذَّرَائِعِ) — অর্থাৎ সম্ভাব্য অকল্যাণের দরজা বন্ধ করার জন্য প্রদত্ত নির্দেশ।


লেখাপড়া শেখার বৈধতার সহীহ হাদীস

অন্যদিকে, বহু সহীহ হাদীস প্রমাণ করে যে, নারীদেরকে লেখাপড়া শেখানো বৈধ ও প্রশংসনীয় — যদি তা ফিতনা বা হারাম পথে না যায়।

আবু দাউদ (হাদীস নং: ৩৮৮৭)-এ বর্ণিত —

عَنْ الشِّفَاءِ بِنْتِ عَبْدِ اللَّهِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، قَالَتْ:
دَخَلَ عَلَيَّ النَّبِيُّ ﷺ وَأَنَا عِنْدَ حَفْصَةَ، فَقَالَ:
«أَلَا تُعَلِّمِينَ هَذِهِ رُقْيَةَ النَّمْلَةِ كَمَا عَلَّمْتِيهَا الْكِتَابَةَ؟»

“রাসূলুল্লাহ ﷺ আমার ঘরে প্রবেশ করলেন, তখন আমি হাফসা (রাঃ)-এর কাছে ছিলাম। তিনি বললেন:
‘তুমি যেমন তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছো, তেমনি কি তাকে পিপড়ার কামড়ের রুকইয়া শেখাবে না?’”
(সুনান আবি দাউদ, হাদীস: ৩৮৮৭)

ইমাম আন-নববী (রহ.) শরহুল মাজহাব (৯/৬৫)-এ এই হাদীসের সনদকে সহীহ বলেছেন।


ফকীহ ও মুহাদ্দিসদের ব্যাখ্যা

১️⃣ ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহ.)
ইবনু মুফলিহ আল-আদাবুশ শরইয়্যাহ (৩/২৯৬)-এ বলেন:

“আমি এই হাদীসটি ইমাম আহমাদের (রহ.) কাছে উল্লেখ করলাম, তিনি বললেন — এটি নারীদেরকে লেখাপড়া শেখানোর বৈধতার প্রমাণ।”

২️⃣ আস-সারম ও ইবরাহীম নাখাঈ (রহ.)
তাঁরাও বলেন — “এই হাদীস লেখাপড়া শেখানোর অনুমতি প্রদান করে।”

৩️⃣ মজদুদ্দীন ইবনু তাইমিয়া (রহ.)
আল-মুনতাকা-তে তিনি বলেন:

“এই হাদীস নারীদের জন্য লেখাপড়া শেখার বৈধতার দলিল।”

৪️⃣ ইমাম খাত্তাবী (রহ.)
মা‘আলিমুস সুন্নান (৪/২২৭)-এ বলেন:

“এই হাদীস প্রমাণ করে যে নারীদেরকে লেখাপড়া শেখানো মাকরূহ নয়।”

৫️⃣ ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.)
যাদুল মা‘আদ (৪/১৭০)-এ বলেন:

“এই হাদীস (আশ-শিফা হাদীস) নারীদেরকে লেখাপড়া শেখানোর বৈধতার স্পষ্ট প্রমাণ।”

৬️⃣ ইবনু রুসলান (রহ.)
শরহ সুন্নান আবি দাউদ (১৫/৬১৮)-এ বলেন:

“যে হাদীসে লেখা শেখানো নিষেধ করা হয়েছে, তা এমন পরিস্থিতির জন্য, যখন লেখাপড়া শেখা ফিতনার আশঙ্কা তৈরি করে।”

৭️⃣ আলী ক্বারী (রহ.)
আল-মিরকাত (৭/২৮৮৪)-এ বলেন:

“সম্ভবত সলফ যুগে এটি বৈধ ছিল, কিন্তু পরবর্তী যুগে ফিতনা বৃদ্ধি পাওয়ায় তা নিরুৎসাহিত।”

৮️⃣ আযীমাবাদী (রহ.)
তিনি তাঁর রিসালা ‘উকুদুল জুমান ফি জাওয়াজিল কিতাবা লিন নিসওয়ান’ এবং আউনুল মাআবুদ (১০/২৬৭)-এ নারীদের লেখাপড়া শেখার বৈধতা প্রমাণ করেছেন।


দুই দলিলের মাঝে সমন্বয় (تَطْبِيق)

ইসলামী গবেষক ও মুহাদ্দিসগণ বলেন —
দুই হাদীসের মাঝে বিরোধ নেই, বরং তাতবীক (সমন্বয়) করা যায় এভাবে —

“নিষেধাজ্ঞা তখনই প্রযোজ্য, যখন লেখাপড়া ফিতনার কারণ হয়;
আর বৈধতা তখনই প্রযোজ্য, যখন তা জ্ঞান, দ্বীন ও কল্যাণের পথে ব্যবহৃত হয়।”


কুরআনের সাধারণ নীতি

আল্লাহ তাআলা বলেন —

قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ

“বলুন, যারা জানে আর যারা জানে না — তারা কি সমান হতে পারে?”
(সূরা আয-যুমার, ৩৯:৯)

এই আয়াত পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য।
ইসলাম জ্ঞান অর্জনকে আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকত, মর্যাদা ও ইবাদাতের মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করেছে।


সারসংক্ষেপ

✅ নবী ﷺ এর নিষেধাজ্ঞার হাদীসগুলো ফিতনা প্রতিরোধমূলক সতর্কতা ছিল।
✅ সহীহ হাদীস ও সাহাবিয়াতদের জীবনের প্রমাণে নারীদের লেখাপড়া শেখানো বৈধ ও প্রশংসনীয়।
✅ তবে, যদি শিক্ষার মাধ্যমে ফিতনা, হারাম সম্পর্ক বা অনৈতিকতা সৃষ্টি হয়, তবে তা নিষিদ্ধ ও গুনাহের কারণ।

সুতরাং, ইসলামের দৃষ্টিতে নারী শিক্ষার অনুমতি রয়েছে, কিন্তু ফিতনা থেকে নিরাপদ থাকা আবশ্যক।


দোয়া

اللَّهُمَّ عَلِّمْنَا مَا يَنْفَعُنَا، وَانْفَعْنَا بِمَا عَلَّمْتَنَا، وَزِدْنَا عِلْمًا نَافِعًا

“হে আল্লাহ! আমাদের এমন জ্ঞান দাও যা আমাদের উপকারে আসে,
আর যা শিখিয়েছো তার দ্বারা আমাদের উপকার করো,
এবং আমাদের উপকারী জ্ঞান বৃদ্ধি করো।”


📚 তথ্যসূত্রঃ

লিখেছেন: মাহবুব ওসমানী – প্রকাশনা: Islamidawahcenter.com

Mahbub Osmane — একজন ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক এবং IslamiDawahCenter.com এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি কুরআন ও সহীহ হাদীসভিত্তিক বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। 

To learn more, comment below or message us on wa.me/+966549485900 or  wa.me/+8801716988953 or call us at +44-73801-27019. Email at hi@islamidawahcenter.com

আইডিসির সাথে যোগ দিয়ে উভয় জাহানের জন্য ভালো কিছু করুন।

ইসলামিক বিষয়ে জানতে এবং জানাতে এই গ্রুপে জয়েন করুন।

আইডিসি এবং আইডিসি ফাউন্ডেশনের ব্যপারে বিস্তারিত জানতে  লিংক০১ ও লিংক০২ ভিজিট করুন।

আইডিসি  মাদরাসার ব্যপারে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। 

আইডিসি এতীমখানা ও গোরাবা ফান্ডে দান করে  দুনিয়া এবং আখিরাতে সফলতা অর্জন করুন।

কুরআন হাদিসের আলোকে বিভিন্ন কঠিন রোগের চিকিৎসা করাতেআইডিসি ‘র সাথে যোগাযোগ করুন।

Related posts

Surah Hud

by IDCAdmin
2 years ago

Surah Shura

by IDCAdmin
2 years ago

“সঠিক ব্যক্তি — সঠিক সময় — সঠিক দায়িত্ব” — নবী ﷺ এর সুশৃঙ্খল নেতৃত্বময় ট্যালেন্ট ম্যানেজমেন্ট

by IDCAdmin
4 weeks ago
Exit mobile version