সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে যে এক জামাতের আমির হিন্দু সম্প্রদায়কে “শারদীয় শুভেচ্ছা” জানিয়েছেন। এই ঘটনাটি মুসলিম সমাজে তীব্র প্রশ্ন তুলেছে—এমন বক্তব্য কি ইসলামসম্মত? এর মাধ্যমে কি ঈমান অটুট থাকে, নাকি এটি ঈমানের জন্য গুরুতর ঝুঁকির কারণ?

এখানে আমাদের আলোচনার উদ্দেশ্য কারো ব্যক্তিগত তাকফীর করা নয়, বরং কুরআন, হাদীস ও আলেমদের ব্যাখ্যা দ্বারা এ ধরনের কাজের ইসলামী হুকুম স্পষ্ট করা।


১. কুরআনের আলোকে

(ক) মিথ্যা ও কুফরী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের নিষেধাজ্ঞা

وَالَّذِينَ لَا يَشْهَدُونَ الزُّورَ
“আর তারা (আল্লাহর বান্দাগণ) মিথ্যা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে না।”
(সূরা আল-ফুরকান 25:72)

ইবন কাসীর (রহ.) এর ব্যাখ্যায় এসেছে—“الزُّورَ” এর মধ্যে মুশরিক ও কাফেরদের ধর্মীয় উৎসব অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ আল্লাহর বান্দারা এসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয় না, শুভেচ্ছা জানায় না।


(খ) কুফরীর কাজে সম্মতি না দেওয়ার নির্দেশ

وَقَدْ نَزَّلَ عَلَيْكُمْ فِي الْكِتَابِ أَنْ إِذَا سَمِعْتُمْ آيَاتِ اللَّهِ يُكْفَرُ بِهَا وَيُسْتَهْزَأُ بِهَا فَلَا تَقْعُدُوا مَعَهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ ۚ إِنَّكُمْ إِذًا مِثْلُهُمْ
“তোমাদের প্রতি কিতাবে অবতীর্ণ হয়েছে যে, যখন তোমরা দেখবে আল্লাহর আয়াত অস্বীকার করা হচ্ছে এবং তা নিয়ে ঠাট্টা করা হচ্ছে, তখন তাদের সাথে বসো না যতক্ষণ না তারা অন্য কথায় লিপ্ত হয়। অন্যথায় তোমরাও তাদের মতো হয়ে যাবে।”
(সূরা আন-নিসা 4:140)

এই আয়াত স্পষ্ট করে জানাচ্ছে—যদি মুসলিমরা কাফেরদের কুফরীর কাজে সম্মতি প্রকাশ করে বা অংশ নেয়, তবে তারা তাদের মতো বিবেচিত হবে।


(গ) কাফেরদের সাদৃশ্য গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন—

مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
“যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত।”
(সুনান আবূ দাউদ, হাদীস: 4031)

অতএব, হিন্দুদের “দুর্গাপূজা” উপলক্ষে তাদের মতো শুভেচ্ছা জানানোও সাদৃশ্য প্রকাশের অন্তর্ভুক্ত।


২. হাদীসের আলোকে

(ক) কুফরীতে অংশগ্রহণের অমার্জনীয়তা

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন—

إِنَّ اللَّهَ قَدْ حَجَبَ التَّوْبَةَ عَنْ كُلِّ صَاحِبِ بِدْعَةٍ حَتَّى يَدَعَ بِدْعَتَهُ
“আল্লাহ তাওবা ফিরিয়ে নেন প্রত্যেক বিদআতকারীর কাছ থেকে যতক্ষণ না সে তার বিদআত ত্যাগ করে।”
(আল-মুজাম আল-কবীর, তাবরানী, হাদীস: 13615)

অতএব, কুফরীর প্রতীকী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা একধরনের বিদআত, যা ঈমানের জন্য গুরুতর ঝুঁকি।


(খ) রাসূল ﷺ-এর দোয়া

রাসূলুল্লাহ ﷺ সর্বদা আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন—

اللَّهُمَّ لاَ تَجْعَلْ مُصِيبَتَنَا فِي دِينِنَا
“হে আল্লাহ! আমাদের বিপদ যেন আমাদের দ্বীনের মধ্যে না হয়।”
(সুনান আত-তিরমিযী, হাদীস: 3502)

অতএব, দ্বীনের ক্ষতি যেমন—কুফরীর উৎসবে স্বীকৃতি দেওয়া—সবচেয়ে ভয়াবহ বিপদ।


৩. আলেমদের ব্যাখ্যা

(ক) ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.)

তিনি বলেন—

وَأَمَّا التَّهْنِئَةُ بِشَعَائِرِ الْكُفْرِ الْخَاصَّةِ بِهِ فَمُحَرَّمَةٌ بِاتِّفَاقِ الْفُقَهَاءِ
“অমুসলিমদের বিশেষ কুফরীর ধর্মীয় প্রতীক বা উৎসব উপলক্ষে তাদেরকে শুভেচ্ছা জানানো হারাম—এ ব্যাপারে ফকীহগণের সর্বসম্মত ঐক্য আছে।”
(আহকাম আহলিয-জিম্মাহ, 1/441)


(খ) ইমাম মালিক (রহ.)

তিনি বলেছেন—“যে ব্যক্তি অমুসলিমদের উৎসবে অংশগ্রহণ করে, সে কুফরীতে প্রবেশ করার আশঙ্কা তৈরি করে।”


(গ) আধুনিক ফতওয়া

মাজলিসে উলামায়ে ইসলাম (দারুল উলুম দেওবন্দ) বলেছে—
“হিন্দুদের পূজা-পার্বণে মুসলিমদের শুভেচ্ছা জানানো হারাম। এটি ইসলামী আকীদার পরিপন্থী।”

শাইখ ইবনে বায (রহ.) ফতওয়ায় বলেছেন—
“অমুসলিমদের উৎসবে শুভেচ্ছা জানানো হারাম, এতে অংশগ্রহণ করা শির্কের দিকে নিয়ে যেতে পারে।”


৪. চার মাযহাবের রায়

হানাফি: কাফেরদের ধর্মীয় উৎসবে অংশগ্রহণ ও শুভেচ্ছা জানানো হারাম (ফতাওয়া আলমগীরী)।

মালিকি: তাদের উৎসবে সামিল হওয়া কুফরীর দিকে নিয়ে যায়।

শাফিঈ: তাদের ধর্মীয় প্রতীক স্বীকৃতি দেওয়া হারাম।

হানাবলি: ইবনে কুদামাহ বলেন—“কাফেরদের উৎসবকে সম্মান করা মুসলিমের জন্য হারাম।”


৫. ভারত-বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে

ভারত ও বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতারা প্রায়ই হিন্দু ধর্মীয় উৎসবে শুভেচ্ছা বার্তা দেন। তবে প্রশ্ন হলো—ইসলামী শরীয়তের আলোকে মুসলিম নেতাদের জন্য কি এটি বৈধ?

সাধারণ ভদ্রতা ও সামাজিক সম্প্রীতি প্রকাশ করা বৈধ, তবে

তাদের পূজা বা ধর্মীয় কর্মকাণ্ডকে স্বীকৃতি দেওয়া বৈধ নয়।

ইসলামী দাওয়াতি দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলিম নেতাদের উচিত—শুভেচ্ছা না দিয়ে বরং ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা, শান্তি ও সহাবস্থানের বার্তা প্রদান করা।


৬. জামাতের আমিরের ঈমান গেছে কি না?

এখানে দুটি অবস্থা—

  1. যদি তিনি কুফরীকে স্বীকৃতি দেন—তাহলে তা ঈমান নষ্টকারী।
  2. যদি ভদ্রতাবশত বা রাজনৈতিক চাপে বলেন—তাহলে এটি বড় গুনাহ, কিন্তু সরাসরি তাকফীর করার জন্য শরীয়তের দৃষ্টিতে স্পষ্ট শর্ত পূরণ করতে হবে।

অতএব, তার ঈমান নষ্ট হয়েছে বলা যায় না, তবে তার কাজটি হারাম ও মারাত্মক গুনাহ।


৭. মুসলিমদের করণীয়

অমুসলিমদের প্রতি ন্যায়বিচার করা

সামাজিকভাবে সহানুভূতি ও সদাচরণ করা

কিন্তু তাদের ধর্মীয় প্রতীকে অংশ না নেওয়া

মুসলিম নেতৃবৃন্দকে ইসলামী আকীদায় দৃঢ় থাকা এবং এ ধরনের বিতর্কিত কাজ থেকে বিরত থাকা


উপসংহার

জামাতের আমির কর্তৃক “শারদীয় শুভেচ্ছা” জানানো ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম ও গুনাহের কাজ।
তবে সরাসরি তাকফীর করার আগে উদ্দেশ্য, প্রেক্ষাপট ও আকীদা যাচাই করা জরুরি।
আমাদের উচিত—আল্লাহর দেওয়া আকীদা অটুট রাখা, কুফরী অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকা, এবং মুসলিম সমাজকে সত্য দাওয়াহর দিকে আহ্বান করা।


✍️ লিখেছেনঃ মাহবুব ওসমানী
Mahbub Osmane একজন ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক এবং IslamiDawahCenter.com এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি কুরআন ও সহীহ হাদীসভিত্তিক বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।