নারীদের জন্য জিহাদ ফরয কিনা এটা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে কেউ চাইলে করতে পারে নাজায়েয না। নফল হিসেবে তা গন্য হবে। এপ্রসঙ্গে নিম্নোক্ত লেখাটি পড়ুন।


“নারীদের জন্য ক্বিতালের ব্যাখ্যা” – লিখেছেন, শাইখ আব্দুল কাদির বিন আব্দুল আযীয (হাফিযাহুল্লাহ)


নেতৃস্থানীয় ফুকাহায়ে কেরাম যেটা বলেছেন- “ফরজে আইন জিহাদ নারীদের উপরও ওয়াজিব হয়” এতে আমার আপত্তি রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, এ মাসআলায় উলামায়ে কেরাম ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন বা এটা জুমহুর ফুকাহায়ে কেরামের অভিমত। অথচ বিষয়টি এমন নয়। তাই যারা যেকোনো ফরজে আইন জিহাদের স্থানগুলোতে নারীদের উপর জিহাদ ফরজ হওয়ার কথা বলেন, তারা এটা গ্রহণ করেন এই ফিকহী মূলনীতি থেকে যে, ‘ফরজে আইন বিধান নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মস্তিস্ক মুসলিমের উপর পালন করা আবশ্যক হয়।’ যেমনটা আমি আলকাসানী হানাফী ও আর রামালী শাফী থেকে উদ্ধৃত্য করেছি। কিন্তু বিশেষভাবে নারীদের জিহাদ সংশ্লিষ্ট শরয়ী বর্ণনাগুলো এ মূলনীতির বিরোধিতা করে এবং সেটাকেই গ্রহণ করা আবশ্যক করে। এর ব্যাখ্যা হলো এই:

ইমাম বুখারী রহ. তার সহীহের কিতাবুল জিহাদের باب جهاد النساء (নারীদের জিহাদ অধ্যায়) এ হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণনা করেন, আমি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট জিহাদে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। তিনি বললেন: “তোমাদের জিহাদ হলো হজ্জ।”

ইবনে হাজার রহ. বলেন: “ইবনে বাত্তাল রহ. বলেন, আয়েশা রাযি.-এর হাদিস প্রমাণ করে, নারীদের উপর জিহাদ আবশ্যক নয়। তবে তার কথা “তোমাদের জিহাদ হলো হজ্জ”-এর মধ্যে এটা নেই যে, নফল হিসাবে জিহাদ করতে পারবে না।”

আরেকটি হাদিসে, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. আয়েশা রাযি.থেক বর্ণনা করেন, আয়েশা রাযি. বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! নারীদের উপর কি জিহাদ আছে? বললেন, “এমন জিহাদ আছে, যাতে যুদ্ধ নেই। অর্থাৎ হজ্জ ও ওমরাহ।”

এ হাদিসটি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করছে যে, নারীদেরকে কোন জিহাদেরই আদেশ করা হয়নি, চাই তা ফরজে কিফায়া হোক বা ফরজে আইন হোক। এমনিভাবে ব্যাখ্যাকারগণ, তথা ইবনে বাত্তাল ও ইবনে হাজার রহ.ও নারীদের ক্ষেত্রে দুই ধরণের ফরজের মধ্যে কোন পার্থক্য করেননি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় অনেক সময়ই জিহাদ ফরজে আইন হতো। কিন্তু আমাদের নিকট এমন কোন যয়ীফ বর্ণনাও আসেনি যে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদেরকে যুদ্ধের আদেশ করেছেন। যদি থাকতো, তাহলে হয়তো আমরা উক্ত হাদিসটিকে পূর্বোল্লেখিত আয়েশা রাযি.-এর হাদিসের সীমা নির্ধারক মনে করতাম। কারণ যে সমস্ত স্থানগুলোতে জিহাদ ফরজে আইন হয়, তন্মধ্যে একটি হলো ইমাম কোন গোষ্ঠীকে জিহাদের জন্য আহ্বান করা। তখন তাদের উপর বের হওয়া আবশ্যক হয়ে যায়। এমন একটি ঘটনা হলো তাবুক যুদ্ধ। এ ‍যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ কোন দলকে বাদ দিয়ে কোন দলকে বের হতে আহ্বান করেননি, বরং আহ্বানটি ছিল সাধারণ ও ব্যাপক। প্রমাণ হলো, আল্লাহ তা’আলা এ যুদ্ধের ব্যাপারেই বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَا لَكُمْ إِذَا قِيلَ لَكُمُ انْفِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ اثَّاقَلْتُمْ إِلَى الْأَرْضِ

“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কী হলো যে, তোমাদেরকে যখন বলা হয় আল্লাহর পথে জিহাদে বের হও, তখন মাটি আঁকড়ে বসে থাকো “

আর আমরা জানি যে, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا বলে সম্বোধন নারী-পুরুষ সকলকেই শামিল করে। তবে নারীগণ এ যুদ্ধে বের হননি। দলিল হলো আলি ইবনে আবি তালিব রাযি.-এর উক্তি, যখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ যুদ্ধে তাকে মদিনার স্থলাভিষিক্ত বানিয়ে যেতে চাইলেন, তখন তিনি বলেছিলেন:“আমাকে নারী ও শিশুদের সঙ্গে রেখে যাচ্ছেন?” এটা প্রমাণ করে, ব্যাপক ডাক নারীদেরকে শামিল করে না। অতএব পূর্বোল্লেখিত আয়েশা রাযি.-এর হাদিসটি কোন সীমাবদ্ধকরণ ব্যতিত সাধারণ অবস্থায়ই থাকবে।

যে সমস্ত স্থানে জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়, তন্মধ্যে আরেকটি স্থান হলো, যখন কাফেরগণ কোন দেশে ঢুকে পড়ে, তখন তার অধিবাসীদের উপর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এবং তাদেরকে প্রতিহত করা ফরজে আইন হয়ে যায়। এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় খন্দকের যুদ্ধে ঘটেছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন: إِذْ جَاءُوكُمْ مِنْ فَوْقِكُمْ وَمِنْ أَسْفَلَ مِنْكُمْ “যখন তারা তোমদের উপর দিক এবং নিচের দিক থেকে আগমন করলো।” অথচ এ যুদ্ধে নারীগণ যুদ্ধের জন্য বের হননি। বরং তাদেরকে ঘাটি ও দূর্গেই রাখা হয়েছে।

ইবনে কুদামা আল হাম্বলী রহ.-এর বক্তব্যও এই দিকে ইঙ্গিত করে। তিনি বলেন, “মাসআলা: যখন শত্রু এসে পড়ে, তখন মানুষের উপর ওয়াজিব হলো বের হয়ে পড়া। চাই তারা স্ববল হোক বা দুর্বল হোক। আর আমিরের অনুমতি ব্যতিত শত্রুর উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাবে না। তবে যদি তাদেরকে আকস্মিকভাবে এমন শত্রু আক্রমণ করে, যাদের সংখ্যা অনেক বেশি, ফলে তাদের পক্ষে অনুমতি নেওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে ভিন্ন কথা।”

(এখানে স্ববল হোক বা দুর্বল হোক, কথাটির অর্থ হলো, ধনী হোক বা গরীব হোক। অর্থাৎ যারাই যুদ্ধক্ষম, সকলকেই আহ্বানটি শামিল করবে।) যখন শত্রু তাদের নিকটে চলে আসার কারণে তাদের বের হওয়ার প্রয়োজন হয়। কারো জন্যই পশ্চাতে বসে থাকা জায়েয হবে না। তবে গৃহ-পরিবার ও সম্পদ হেফাজতের জন্য যাদের থাকার প্রয়োজ হবে তারা ব্যতিত।এখানে ইবনে কুদামা রহ.-এর বক্তব্য “গৃহ-পরিবার হেফাজতের জন্য” ইঙ্গিত করে, যখন কোন দেশে শত্রু আক্রমণ করে, তখন নারীদের উপর বের হওয়া আবশ্যক নয়।”

এমনিভাবে ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন: “এর দৃষ্টান্ত হলো, শত্রু কোন মুসলিম দেশে আক্রমণ করলো। আর যোদ্ধা অর্ধেকের চেয়ে কম। এখন যদি তারা সরে যায়, তাহলে শত্রু সীমান্ত দখল করে ফেলবে। তাহলে এটা এবং এ ধরণের ক্ষেত্রগুলো হলো প্রতিরক্ষামূলক জিহাদ, এটা আক্রমণাত্মক জিহাদ নয়। এটা থেকে পশ্চাদপসরণ করা কিছুতেই জায়েয হবে না। ওহুদ যুদ্ধের ঘটনাটিও এই প্রকৃতির।”

তার বক্তব্যে “অর্ধেকের চেয়ে কম” কথাটির অর্থ হলো, মুসলিম সৈন্যসংখ্যা শত্রুসৈন্যদের থেকে অর্ধেকের চেয়ে কম হয়।

আর তার বক্তব্যে “যদি সরে যায়, তাহলে শত্রু সীমান্ত দখল করে নিবে” এটা প্রমাণ করে, তিনি এ সকল স্থানে নারীদের যুদ্ধের জন্য বের হওয়াকে ফরজে আইন জিহাদের স্থান মনে করতেন না।

এটাই আমরা বলি যে, ফরজে আইন জিহাদের যেকোনো স্থানেই নারীদের উপর জিহাদ আবশ্যক হবে না। হয়তো একটি স্থানে হতে পারে। সেটা হলো, যখন শত্রু কোন শহরে আক্রমণ করে গৃহ ও নারীদের কাছে পৌঁছে যায়। তখন নারী আত্মরক্ষা ও সঙ্গীদেরকে রক্ষার জন্য তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। যেমন ইমাম মুসলিম রহ. আনাস রাযি. থেকে বর্ণনা করেন, হুনায়নের দিন উম্মে সুলাইম একটি খঞ্জর নিলেন। তারপর সেটা তার সঙ্গেই ছিল। আবু তালহা তাকে এ অবস্থায় দেখে আল্লাহর রাসূলকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এই যে উম্মে সুলাইমের সাথে খঞ্জর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন: এই খঞ্জর কেন? তিনি বললেন: আমি এটা নিয়েছি, যাতে যদি মুশরিকদের কেউ আমার নিকটবর্তী হয়, তাহলে এটা দিয়ে তার পেট ফেড়ে ফেলতে পারি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসতে লাগলেন।

একই রকম ঘটনা ছিল খন্দক যুদ্ধে সাফিয়্যাহ বিনতে আব্দুল মুত্তালিবের কাজটি, যেমনটা সীরাতের কিতাবসমূহে বর্ণিত হয়েছে, যদি বর্ণনাটি সঠিক হয়ে থাকে।

তবে নির্দিষ্ট একটি অবস্থা ব্যতিত নারীদের উপর জিহাদ ফরজ না হওয়ার কথা বললেও এটা হতে পারে যে, কোন নারী আমিরের অনুমতি সাপেক্ষে স্বেচ্ছায় সওয়াবের নিয়তে জিহাদে বের হলো। যেমন ইমাম মুসলিম রহ. আনাস রাযি. হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধে ছিলেন। আর তার সঙ্গে ছিলেন উম্মে সুলাইম ও কয়েকজন আনসারি মহিলা। তারা পানি পরিবেশন করতেন এবং আহতদের চিকিৎসা করতেন।

ইমাম মুসলিম রহ. একই ধরণের হাদিস ইবনে আব্বাস রাযি. থেকেও উল্লেখ করেছেন। ফুকাহায়ে কেরাম শর্তারোপ করেছেন, বৃদ্ধা নারী হতে হবে। যুবতী সুন্দরী নারীদের জন্য নিষেধ।

ইবনে কুদামা রহ. বলেন: খিরকী বলেছেন, মুসলমানদের সাথে কোন নারী শত্রুদেশে প্রবেশ করবে না। তবে বয়স্ক নারীগণ করতে পারেন পানি পরিবেশন ও আহতদের চিকিৎসা করার জন্য, যেমনটা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন।

সারকথা, যেহেতু নারীদের উপর নির্দিষ্ট একটি অবস্থায় জিহাদ ফরজ হয়, তাই এর জন্য অস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুতি গ্রহণ করাও আবশ্যক হবে।এ ক্ষেত্রে শুধু আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রকার অস্ত্রগুলোই যথেষ্ট। তাকে প্রশিক্ষণ দিবে তার স্বামী বা তার মাহরাম পুরুষগণ বা কোন প্রশিক্ষিত নারী। এটা ঠিক যে, এ ব্যাপারে আমাদের নিকট কোন বর্ণনা নেই। কিন্তু নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় উম্মে সুলাইম কর্তৃক খঞ্জর ব্যবহারকে সমর্থন করেছেন, আমরা তার থেকে ইস্তিম্বাত বা উদঘাটন করেছি। তাই যখন আমাদের নিকট নারীদের অস্ত্র ব্যবহার স্বীকৃত হলো, সেহেতু তাদের উপর তার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করাও ওয়াজিব হবে। কারণ যা ছাড়া ওয়াজিব সম্পাদন করা যায় না, তাও ওয়াজিব হয়। আল্লাহই সর্বাধিক ভালো জানেন।