Tasawwuf – ইলমে তাসাউফঃ প্রয়োজনীয়তা, বিভ্রান্তি ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব

-ড. মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন

পবিত্র কুরআনে কারীমায় মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘শপথ সূর্যের ও তার কিরণের। শপথ চন্দ্রের যখন তা সূর্যের পশ্চাতে আসে। শপথ দিবসের যখন সে সূর্যকে প্রখরভাবে প্রকাশ করে। শপথ রাতের যখন সে সূর্যকে আচ্ছাদিত করে। শপথ আকাশের এবং যিনি তা নির্মাণ করেছেন, তাঁর। শপথ পৃথিবীর এবং যিনি তা বিস্তৃত করেছেন, তাঁর। শপথ প্রাণের এবং যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন, তাঁর। অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। যে ব্যক্তি নিজেকে শুদ্ধ করে, সে সফলকাম হয়। আর যে ব্যক্তি নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়।(সূরা শামস; ১-১০)

কোরআন পাকের বর্ণনার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা’য়ালার নিয়ম হলো- সাধারণ কোনো কথা স্বাভাবিকভাবে বর্ণনা করে থাকেন। কোনো কসম বা তাকিদের শব্দ ব্যবহার করেন না। কিন্তু বিষয়টি যদি গুরুত্বপূর্ণ হয় তখন একটা বা দুটো কসম ব্যবহার করে বিষয়টি মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলেন। যথা- একটি জিনিসের কসম করে আল্লাহপাক বলেছেন, যুগের কসম। আবার কখনো দুটো জিনিসের কসম করে বলেছেন, ত্বীন ও জয়তুনের কসম। কখনো তিনটা জিনিসের কসম করে বলেছেন, ‘নূন ও কলম এবং তাঁরা (ফেরেশতারা) যা লিখে তার কসম।  কিন্তু লক্ষ্য করুন  ‘তাযকিয়ায়ে নফস’ তথা ‘এহসান’ ও আত্মশুদ্ধি হাসিল বা দ্বীল সুন্দর করার ব্যাপারে সূরা ‘শামসে’ মহান আল্লাহ তা’য়ালা সাতটি কসম করেছেন, যার দ্বারা ‘এসলাহে নফস’ বা আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়।

রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ভালো করে শুনে রাখ। দেহের মাঝে গোশতের একটি টুকরা আছে। সেটা সুস্থ থাকলে সারা দেহ সুস্থ সঠিক থাকে, সেটা খারাপ হয়ে গেলে সারা দেহ খারাপ হয়ে যায়। খুব ভালোভাবে শুনে নাও। সেটা হল দিল, অমরাত্মা।’(ইবনে হিববান)

ড.মুশফিক আহমেদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলতেন, বাতাসেও জীবানু আছে আবার পানিতেও জীবানু আছে। এই জীবানু যুক্ত পরিবেশে কেউ সুস্থ থাকে আবার কেউ অসুস্থ হয়। এই সুস্থ থাকা আর না থাকার কারণ পরিবেশ নয়, কারণ হচ্ছে শরীর। কারণ যার রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বেশী অর্থাৎ যার জীবানুর সাথে মোকাবেলা করার ক্ষমতা বেশী সে সুস্থ থাকে আর যার রোগপ্রতিরোধ করার ক্ষমতা কম অর্থাৎ যার জীবানুর সাথে মোকাবেলা করার ক্ষমতা কম সে অসুস্থ হয়। এতো শরীরের কথা, এবার মস্তিস্কের কথা বলা যাক।

একই ক্লাসের ছাত্র, একই লেকচার শোনে, একই প্রশ্নে উত্তর দেয়। কিন্তু একজন ফেল করে আবার এবার একজন ভাল উত্তর দেয়। এজন্য লেকচার দ্বায়ী নয় আবার প্রশ্নও দ্বায়ী নয়। অর্থাৎ যার প্রশ্নের সাথে মোকাবেলা করার ক্ষমতা বেশী সে ভাল উত্তর দেয় আর যার প্রশ্নের সাথে মোকাবেলা করার ক্ষমতা কম সে ফেল করে। এজন্য কি করতে হবে? ছাত্রকে মজবুত করা যেন সে প্রশ্নের মোকাবেলা করতে পারে।

আর এক হচ্ছে দ্বীলের মোকাবেলা করার ক্ষমতা। একই হালতের উপর কেউ আত্মহত্যা করবে আবার কেউ আল্লাহর শুকরিয়া করবে।

আমার আত্মীয়দের মধ্যকার ঘটনা। এস.এস.সি রেজাল্ট হয়েছে। এক আত্মীয়ের ছেলে দুই মার্কের জন্য বোর্ড স্ট্যান্ড করেনি। ছেলে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভিতরে বসে আছে আর তার বাবা-মা ঘরের বাইরে বসে কাঁদছে। যেন সারা বাড়িতে শোকের ছাঁয়া নেমে এসেছে।

আবার আর এক আত্মীয়ের ছেলে সেকেন্ড ডিভিশান পেয়েছে। এর বাড়িতে যেন আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থা যেন, আনন্দের ঠেলায় বাড়ির ছাদ ফেটে যাবে। কারণ তার ফেল করার কথা ছিল কিন্তু কি করে যেন পাশ করে গেছে।

আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দ্দী হলের কথা। এক জন ছাত্র পরিকল্পনা করল সে অত্মহত্যা করবে। পরিকল্পনা হচ্ছে চারতলা ছাদ হতে নীচে সেফটি টেংকের উপর লাফ দেবে যেন বাঁচার কোন প্রকার সম্ভাবনা না থাকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী লাফ দিল, মরলোনা কিন্তু হাত-পা ভেঙ্গে গেল, মাথা ফেটে গেল, শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত-বিক্ষত হল। হাসপাতালে দীর্ঘ দিন চিকিৎসার পর যখন তাকে হলে ফিরিয়ে আনা হল, যখন সে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে তখন সে খুব আস্তে আস্তে উঠছে। প্রথমে যখন সে সুস্থ ছিল তখন দিলের অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে সে ছাদ হতে সুস্থ শরীরকে ফেলে অসুস্থ বনিয়েছে কিন্তু এখন শরীর অসুস্থ হাত-পা ভাঙ্গা, মাথা ফাটা শরীরের আগের মত দাম নেই কিন্তু দিলের হালত পরিবর্তন হয়ে গেছে এখন সিঁড়ি বেয়ে উঠছে খুব আস্তে আস্তে যেন একটি সিঁড়িও না ফসকায়।

ছোটতে মা তার নবজাতককে গোসল করায়, তেল মাখায় আবার রোদেও রাখে, সময় মত টিকা দেয় কারণ তাকে পরিবেশের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলে যেন তাকে জীবানু আক্রমন করতে না পারে। একটু বড় হলে তাকে লেখাপড়া শেখায় তাকে প্রশ্নের উত্তরের জন্য গড়ে তোলে।

এজন্য হালতের পরিবর্তন না করে যে হালতের মধ্যে পড়ে তাকে হালতের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলা।

মহান আল্লাহ তা’য়ালা সমস্ত আম্বিয়া আলাইহিসসাল্লাম কে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, তারা না মানুষের শরীরের পিছনে মেহনত করেছেন না মেহনত করেছেন মস্তিস্কের পিছনে। তারা সকলেই মানুষের দিলের পিছনে মেহনত করেছেন।

আমাদের রসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাঁর সাথীদের না শরীরের পিছনে মেহনত করেছেন না মেহনত করেছেন মস্তিস্কের পিছনে। রসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম সাহাবাদের দ্বীলের পিছনে মেহনত করেছিলেন। আর সাহাবারাও রসুলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহবতে কঠিন মোযাহাদার দ্বারা নিজেদের দ্বীলকে সুন্দর বানিয়েছিলেন। সেই মোযাহাদা কেমন ছিল? আমরা যদি দুনিয়ার নিয়মের দিকে দৃষ্টিপাত করি, কোন ক্ষমতাবান লোকের সাথে যদি কারো সম্পর্ক থাকে তাহলে তাকে সবাই ভয় করে। মনে করি আমার সাথে প্রধান মন্ত্রীর ভাল সম্পর্ক আছে, তিনি আমাকে ভাল জানেন এবং আমি তার সাথে সাথেই থাকি । কোন ঘটনাক্রমে আমাকে কেউ একটি চড় মারল । তাহলে এখন কি হবে? ঐ লোকটির হাড়গোড় কি কিছু থাকবে? থাকবে না।

আল্লাহ তা’য়ালা পরাক্রমশালী, রসূলাল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা’য়ালার নবী, তিনি মানুষদেরকে আল্লাহ তা’য়ালার দিকে ডাকছেন। যারা তাঁর কথা মানছে তারা নির্যাতিত হচ্ছে আবার তিনিও নির্যাতিত হচ্ছেন। আল্লাহ তা’য়ালা প্রতিশোধ নিচ্ছেন না। আমরা হলে হয়তো বলতাম হে মুহাম্মদ তুমি কেমন নবী আমরা এত কষ্ট পাচ্ছি তোমার আল্লাহ কি দেখে না?

বেলাল রাযিয়াল্লাহু আনহুকে তপ্ত বালুর উপর শোয়ানো হয়েছে। চাবুক দিয়ে আঘাত করছে। শরীর ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। তাঁর আহাদ আহাদ অর্তনাদে আকাশ বাতাস কম্পিত হচ্ছে। আল্লাহ তা’য়ালা প্রতিশোধ নিচ্ছেন না।

খাব্বাব রাযিয়াল্লাহু আনহুকে জ্বলন্ত কয়লার উপর দিয়ে টানা হচ্ছে, তাঁর চর্বি ও রক্ত দ্বারা ঐ আগুন নিভে যাচ্ছে। ঐ সময় একদিন খাব্বাব রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর মত আরো কতিপয় নির্যাতিত বন্ধুর সাথে রসূলাল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খিদমতে হাজির হয়ে নিজেদের দুঃখ-দুর্দশার কথা বললেন। খাব্বাব রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা যখন আমাদের কথা রসূলাল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট বললাম, তখন তিনি একটি ডোরাকাটা চাদর মাথার নীচ দিয়ে কা’বার ছায়ায় শুয়ে ছিলেন। আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি কি আমাদের জন্য আল্লাহর সাহায্য ও ক্ষমা চাইবেন না? আমাদের কথা শুনে রসূলাল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহরা মুবারক লাল হয়ে গেল। তিনি উঠে বসলেন। তারপর বললেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী অনেক লোককে ধরে গর্ত খুঁড়ে তার অর্ধাংশ পোতা হয়েছে, তারপর করাত দিয়ে মাথার মাঝখান থেকে ফেঁড়ে ফেলা হয়েছে। লোহার চিরুনী দিয়ে তাদের হাড় থেকে গোশত ছাড়িয়ে ফেলা হয়েছে। তবুও তাদের দ্বীন থেকে তারা বিন্দুমাত্র টলেনি। আল্লাহ তা’য়ালা অবশ্যই এই দ্বীনকে পূর্ণতা দান করবেন। এমন একদিন আসবে যখন একজন পথিক ‘সান’আ’ থেকে ‘হাদরামাউত’ পর্যন্ত ভ্রমণ করবে। এই দীর্ঘ ভ্রমণে সে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো ভয় করবে না। তখন নেকড়ে মেষপাল পাহারা দিবে। কিন্তু তোমরা বেশী অস্থির হয়ে পড়ছো’(রিজালুন হাওলার রসূল, উসুদুল গাবা)

নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাব্বাব রাযিয়াল্লাহু আনহুর জন্য দোওয়া করলেন না। ভয়ও দেখালেন আবার আশার বাণীও শোনালেন।

খন্দকের যুদ্ধের রাত। প্রচন্ড শীত আর বাতাস। ঘনকালো অন্ধকার। হুযাইফা রাযিয়াল্লাহু আনহু বসে আছে জড়সড় হয়ে। ছোট্ট একটি চাদর তাও স্ত্রীর। হাটু পর্যন্ত ঢাকা যায়। ঐ চাদরটি গায়ে জড়িয়ে মাটির সাথে মিশে গেছে যেন লজ্জাস্থান দেখা না যায়। ঘনকালো অন্ধকারে নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুযাইফা রাযিয়াল্লাহু আনহুর সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কে? উত্তর আসলো, আমি হুযাইফা। নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেলেন শত্রু দলের মধ্য গিয়ে সংবাদ নিয়ে এস। হুযাইফা রাযিয়াল্লাহু আনহু তৎক্ষণাৎ রওনা হলেন। প্রচন্ড শীত আর বাতাস, ঘনকালো অন্ধকার, গায়ে কাপড় নেই কিন্তু কোন প্রশ্নও নেই, আপত্তিও নেই রওনা হয়ে গেলেন।

রসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোওয়া করলেন ‘হে আল্লাহ আপনি তাকে হেফাজত করুন সম্মুখ থেকে, পিছন থেকে, ডান দিক থেকে, বাম দিক থেকে, উপর থেকে, নীচ থেকে’।

নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাপড়ের জন্য দোওয়া করলেন না। দোওয়া করলেন হেফাযতের জন্য।

লড়াই, হামলা, লুণ্ঠন আর খুনখারাবি ছিলো যাদের স্বভাব-প্রকৃতির অন্তর্গত। যুদ্ধ ছিলো যাদের গৌরব ও মর্যাদার সোপান, যুদ্ধই ছিলো যাদের আনন্দ-বিনোদনের এবং উচ্ছ্বাস-উল্লাস প্রকাশের সবচেয়ে প্রিয় মাধ্যম। আজ তারা নির্বিকারে নির্যাতন সহ্য করে যাচ্ছে! তাদের এ অবস্থা কোন ভীরুতা ও কাপুরুষতার কারণে ছিল না; কেননা মানবস্বভাবে ভীরুতা ও কাপুরুষতা এবং অনমনীয়তা ও অবিচলতা কখনো সহাবস্থান করে না, বরং এটা ছিলো নবীর আদেশ ও শিক্ষা মাথা পেতে নেয়ার কারণে। গোটা মক্কী জীবনে কেউ এমন একটি ঘটনাও দেখাতে পারবে না যে, কোন মুসলমান যুলুম নির্যাতনে প্রতিবাদ করেছেন এবং আত্মরক্ষার জন্য তলোয়ার তুলেছেন, অথচ জ্বলে ওঠার স্বভাব-অনুঘটকের অভাব ছিলো না তাঁদের মধ্যে। কিন্তু এটি ছিল আল্লাহর নবীর পক্ষ হতে তাদের জন্য সংযম ও সহনশীলতার পূর্ণ প্রশিক্ষন।

মনেকরি কোন মায়ের প্রসব বেদনা উঠেছে। প্রচন্ড বেদনা। বাড়ীতে ব্যাথার ঔষধও আছে। বাড়ীর অনেকেই এই পেইন কিলার সর্ম্পকে ধারনাও রাখে। কিন্তু এই সময় কেউ তাকে পেইন কিলার দেবেনা। কারন এখন এই ব্যাথা তার জন্য জরুরী।  আল্লাহ তা’য়ালা মানুষকে একটি বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছেন তা হলো ভালবাসা বা সম্পর্ক রাখতে পারা। এই যে সম্পর্কের নিয়ামত এটা আসে ব্যাথা এবং কষ্টের মাধ্যমে। মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক যেমন ব্যাথা দিয়ে করা হয় । গর্ভ ধারনের ব্যাথা আছে, প্রসবের ব্যাথা আছে, সন্তান লালন-পালনের ব্যাথা আছে, এই ব্যাথার মধ্য দিয়ে মায়ের সাথে সন্তানের ভালবাসার সম্পর্ক তৈরী হয়। আর আল্লাহ তা’য়ালার সাথে সম্পর্কও ব্যাথা দিয়েই তৈরী হয়। যারা আল্লাহ তা’য়ালার জন্য কষ্ট সহ্য করে ব্যাথা বহন করে তাদের সাথে আল্লাহ তা’য়ালার ভালবাসার সম্পর্ক তৈরী হয়।

রসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই হাকীমানা মেহনতে হযরতে সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুর আখলাক এত উজ্জল, স্বচ্ছ, নির্মল ও নির্ভেজাল খাটি সোনায় পরিনত হয়েছিল যে, তাদের পর পৃথিবীতে এরুপ উত্তম চরিত্রবান মানুষ আজ পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি।

আবদুল্লাহ ইবনে আবুবকর রাযিয়াল্লাহু আনহু জিহাদের ময়দানে তীর বিদ্ধ হলেন। ক্ষত স্থান থেকে রক্ত ক্ষরন হতে হতে তিনি শহীদ হয়ে গেলেন। আবুবকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু তীর খানা খুলে রাখলেন। কোন এক সময় ছাকিক গ্রোত্রের কিছু লোক ইসলাম গ্রহন করতে আসল। আবুবকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু তীর খানা বের করলেন। হাত দিয়ে উচু করে ধরে বললেন, এই তীর খানা কেউ চেন? সা’দ ইবনে ওবায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, হ্যাঁ আমি চিনি। এই তীরের পিছনে আমি নিজে হাতে পালক লাগিয়েছি এবং এর মাথায় আমি নিজে হাতে ধার দিয়েছি। এতে স্পষ্ট বোঝা গেলো সা’দ ইবনে ওবায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহুর তীরেই আবদুল্লাহ ইবনে আবুবকর রাযিয়াল্লাহু আনহু শহীদ হয়েছেন। আবুবকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন আল্লাহর শুকরিয়া তোমার তীর দ্বারা আল্লাহ আমার সন্তানকে সম্মানিত করেছেন।(হায়াতুস সাহাবা)

‘দুটি কুকুর হাড় নিয়ে কাড়াকাড়ি করে, কারন কি? কারন হাড় নয়, কারন হচ্ছে তারা কুকুর কিন্তু দুটি গরু ঘাস নিয়ে কাড়াকাড়ি করে না, এখানে কারন ঘাস নয় কারন ওরা গরু।’ (মোজাকারা হতে)

ভেবে দেখুন, জাহেলিয়াতের জীবনে কী ছিলো তাঁদের অবস্থা! শুধু প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধস্পৃহা এবং তালোয়ারচালনা ও যুদ্ধোন্মদনা। একেকটি যুদ্ধে রক্ত বয়ে যেতো পানির মত। তাঁরা তো ছিলো সেই কাওমের সন্তান যাদের গর্বের বিষয় ছিলো বাসূস ও দাহিস যুদ্ধের খুনি দাস্তান। ওয়াইল বংশের বকর ও তাগলিব গোত্রদ্বয়ের মধ্যকার যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিলো দীর্ঘ চল্লিশ বছর। আর আলফিজারের যুদ্ধও তো খুব দূরের ঘটনা ছিলো না! কিন্তু এই জঙ্গ ও জঙ্গি স্বভাব এবং তাঁদের আরবীয় অহমিকা রসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাকীমানা সহবতে এমনই অবদমিত হল যে, ক্রোধ ও প্রতিশোধের কথা যেন তাঁরা ভুলেই গেলেন। আজ নিজের সন্তানের খুনিকে সামনে পেয়ে গেলেন, কিন্তু প্রতিশোধ নিলেন না, আল্লাহর শুকরিয়া করলেন। একটা মানুষের দিল কতটা সুন্দর হলে তা করতে পারে।

এই আত্মিক জগতের পরিশুদ্ধি কিংবা ইসলাহে কলবের নাম’ই হলো তাযকিয়া।

পরবর্তিতে দ্বীনের এই অংশটি ইসলামের ইতিহাসে কোন এক সময়ে ‘তাসাওউফ’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

হযরত আশরাফ আলী থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ‘তালিমুদ্দীন’ এ লিখেছেন, মানব মাত্রেরই দিলের মধ্যে ভাল এবং মন্দ, এই দুই প্রকারের খাছ্লতের বীজ আছে; ভালটি অর্জন এবং মন্দটি বর্জন করার নামই দিল দুরস্ত করা। আরবীতে ভালটিকে ‘মাহমূদ’ বা ‘ফাযায়েল’ এবং মন্দটিকে ‘মাযমূম’ বা ‘রাযায়েল’ বলে এবং ভালটিকে অর্জন করার নাম তাহলিয়া আর মন্দটিকে বর্জন করার নাম তাখলিয়া। দিলের এছলাহ এবং দিলকে দুরুস্ত করা যে একান্ত জরুরী এবং সকলের মূল, হাদীস শরীফে এ সম্বন্ধে অতি সংক্ষিপ্ত এবং চিত্তাকর্ষক ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘দেহের মধ্যে একটি পিন্ড আছে, যদি তা সংশোধিত হয়, তবে সমস্ত দেহই সংশোধিত হয়, আর যদি তা খারাপ হয়, তবে দেহই খারাপ হয়, ঐ পিন্ড হল দিল অর্থাৎ, দিল যদি ভাল হয়, তবে সবই ভাল হবে, আর দিল যদি খারাপ হয়ে যায়, তবে সব খারাপ হয়ে যাবে।’

এই দিল দুরূস্ত করার নিয়মাবলী যে এলমের দ্বারা জানা যায়, সচরাচর তাকে এলমে তাসাউফ বলা হয়।(তালিমুদ্দীন)

আমার মুহতারাম সায়েখ মুফতী ইয়াহহিয়া দামাত রাকাতুহুমকে বলতে শুনেছি, হযরত ইবরাহীম খলীল আলাইহিসসাল্লাম মহান আল্লাহ তা’য়ালার দরবারে হযরত ইসমাইল আলাইহিসসাল্লামের বংশে বিশেষ গুণাবলী সম্পন্ন একজন রসূল প্রেরণের আবেদন জানিয়েছিলেন। কুরআনের ভাষা: ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি তাদের মধ্যে (হযরত ইসমাইল আলাইহিসসাল্লামের খান্দানে) এমন একজন রসূল প্রেরণ করুন, যিনি তাদেরই মধ্য হতে হবেন এবং যিনি (১) তাদের সামনে আপনার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবেন। (২) তাদেরকে কিতাব ও (৩) হিকমত শিক্ষা দিবেন এবং (৪) তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন।(সূরা বাকারা; ১২৯)

মহান আল্লাহ তা’য়ালা হযরত ইবরাহীম আলাইহিসসাল্লামের এই আবেদন কবুল করে হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আখেরী নবী ও সর্বশেষ রসূল হিসেবে দুনিয়াতে প্রেরণ করেন। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তা’য়ালা মুমিনদের প্রতি অতি বড় অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মাঝে তাদেরই মধ্যে হতে একজন রসূল পাঠিয়েছেন, যিনি (১) তাদের সামনে আল্লাহ তা’য়ালার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করেন (২) তাদের পরিশুদ্ধ করেন এবং (৩) তাদেরকে কিতাব ও (৪) হিকমত শিক্ষা দেন।(সূরা আলে ইমরান; ১৬৪)

হযরত ইবরাহীম আলাইহিসসাল্লাম আল্লাহ তা’য়ালার কাছে যে চার গুণ বিশিষ্ট রসূলের আবেদন করেছিলেন, হুবহু সেই চার গুণ বিশিষ্ট রসূলেরই সুসংবাদ এই আয়াতে দেয়া হল। তবে এখানে গুণাবলীর ধারাবাহিকতায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। আবেদনের ক্ষেত্রে পরিশুদ্ধ করণের গুণটিকে বলা হয়েছে চার নাম্বারে আর সুসংবাদের ক্ষেত্রে সেটিকে আনা হয়েছে দুই নাম্বারে। হযরতে ওলামায়ে কেরাম এর দু’টি হিকমত বর্ণনা করেছেন, (১) আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব সঠিকভাবে তুলে ধরতে এটা করা হয়েছে। (২) একথা বুঝানোর জন্য যে, নববী যিম্মাদারীর ধারাক্রম অনুযায়ী এটি চতুর্থ স্থানে হলেও কার্য ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব সবার উপরে। বরং এটি দ্বীনী সকল কাজের দিল এবং পূর্ব শর্ত। এটা ছাড়া দ্বীনের খেদমত অর্থহীন।(মোজাকারা হতে)

উপরের আয়াত থেকেই একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, শুধুমাত্র ইলম ও কিতাব আত্মশুদ্ধির জন্য যথেষ্ট নয়, বরং এর জন্য জরুরী এমন একজন ‘মুযাক্কী’ তথা সংশোধনকারীও, যার তরবীয়ত ও তত্বাবধানে এ দৌলত অর্জন করা যেতে পারে।

কেবল পুঁথিগতভাবে কোনো বিষয়ের জ্ঞানার্জন দ্বারাই বাস্তব ক্ষেত্রে ঐ বিষয়ের প্রয়োগ-পদ্ধতি জানা যায় না এবং তাতে পূর্ণতা অর্জিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন কোনো মুরব্বির তত্ত্বাবধানে অনুশীলনের মাধ্যমে তাকে অভ্যাসে পরিণত করা। তাসাউফ ও সুলূকের ময়দানে শায়খে কামেলের তরবিয়তের উদ্দেশ্য এটিই যে, তিনি কুরআন ও সুন্নাহ থেকে অর্জিত জ্ঞানকে বাস্তব ক্ষেত্রে অনুশীলন করিয়ে তা অভ্যাসে পরিণত করান। আল্লাহ তা’য়ালা সৃষ্টির আদিকাল থেকে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত মানুষের হিদায়াত ও সংশোধনের জন্য দুটি ধারা অব্যাহত রেখেছেন : এক, আসমানী গ্রন্থসমূহের ধারা। দুই. তা শিক্ষা দানকারী রসূলগণের ধারা। এ দ্বারা জানা গেল যে, মানুষের সঠিক শিক্ষা ও তরবিয়তের জন্য শুধু কিতাব বা শুধু মুরব্বী যথেষ্ট নয়; বরং একদিকে খোদায়ী দিকনির্দেশনা ও খোদায়ী বিধানের প্রয়োজন। অপরদিকে একজন শিক্ষক ও মুরব্বীরও প্রয়োজন, যিনি শিক্ষা ও তরবিয়ত দ্বারা মানুষকে খোদায়ী হিদায়াত সম্পর্কে অবহিত করে তা তাদের অভ্যাসে পরিণত করাবেন। কারণ, মানুষের প্রকৃত শিক্ষক একজন মানুষই হতে পারে। এ কারণেই ইসলামের সূচনা যেমন একটি কিতাব ও একজন রসূল দ্বারা হয়েছে, তেমনি পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও একদিকে পবিত্র শরীয়ত অপরদিকে আল্লাহ ওয়ালাগণের ধারা অব্যাহত রয়েছে।(তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন)

সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ‘তাযকিয়া’র আবশ্যকতাকে বুঝাতে গিয়ে লিখেছেন,  নবীদের আবির্ভাবের উদ্দেশ্য পূরণ এবং তাদের রবকত সকলের দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ‘তাযকিয়া’ ঠিক ততখানি আবশ্যক, যতখানি আবশ্যক আল্লাহর কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেওয়া। সরল কথায় বলতে গেলে, দ্বিতীয়টি হলো শিক্ষা এবং প্রথমটি হলো হাতে কলমে প্রশিক্ষণ। পূর্ণ মানবের বিকাশ ঘটাতে উভয়টিই অপরিহার্য। উচ্চশিক্ষা থাকা সত্ত্বেও তাযকিয়ার অভাব থাকা যেন সুস্বাদু ব্যঞ্জনে নিমকের অনুপস্থিতি। উভয়টির পরিণতিতে ততটুকু ব্যবধান পরিস্ফুট হয় যতটুকু কবি মরহুম আকবর তার একটি কাব্য চরণে ধরেছেন, ‘বাক্য পটুতায় পন্ডিত হলেও অন্তর পবিত্র হয় না’

আহলেদিল ব্যক্তিগণ সর্বদা এ প্রয়োজন পূরণে সোচ্চার রয়েছেন এবং দীনী খেদমত ও উম্মতের সংশোধন কার্যক্রমে আলেমদের পথ সুগম করেছেন। উভয় শক্তির সমন্বয়ে রসুলাল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্ণ প্রতিনিধিত্বের হক আদায় করা হয়। সাধারণ আলেমদের নিকট থেকে মানুষ আল্লাহর অভিপ্রেত পথের সন্ধান ও তার সন্তুষ্টি, অসন্তুষ্টি এবং শরীয়তের বিধি-বিধান অবগত হলে তাদের নিকট হতে জানতে পেরেছে শরীয়তের তত্ত্ব ও আল্লাহর হিকমত; ফলে তাদের ভেতর শরীয়তের বিধি-নিষেধ মেনে চলার আগ্রহ, উদ্যম, প্রতিযোগিতা, অন্তরে সজীবতা, নম্রতা ও হৃদয়ে নির্মলতা সৃষ্টি হয়েছে এবং অর্জিত হয়েছে সচ্চরিত্রতা ও শিষ্টাচার। এতে পূত-পবিত্র অন্তর নিয়ে আল্লাহর আনুগত্য করা তাদের পক্ষে সজহতর হয়ে গেছে। কুরআন ও হাদীসের পরিভাষায় এই সমুদয়কে এক কথায় ‘ইহসান’ শব্দে প্রকাশ করা হয়।(সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস)

হযরত আশরাফ আলী থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ‘কসদুস সাবীল’ এ লিখেছেন, ‘সুলুক’ ও ‘তরীকত’ যাকে মানুষ ‘তাসাওউফ’ বলে থাকে, তার হাকীকত বা মূল কথা এই যে, মুসলমান তার যাহের বাতেন তথা ভেতর ও বাহিরকে নেক আমল দ্বারা সজ্জিত করবে এবং বদআমল থেকে দূরে রাখবে। এর বিশ্লেষণ এই যে-

মুসলামানের জীবনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তা’য়ালাকে রাজি-খুশি করা। এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য লাভের উপায় হলো, শরীয়তের হুকুম-আহকাম পরিপূর্ণরূপে মেনে চলা। শরীয়তের হুকুম-আহকাম তথা বিধি-বিধানের মধ্যে কিছু রয়েছে মানুষের বাহ্যিক দিকের সাথে সম্পৃক্ত। যেমনঃ নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি। আরো রয়েছে বিবাহ, তালাক, স্বামী-স্ত্রীর হক আদায় করা, কসম (শপথ) এবং কসমের কাফফরা ইত্যাদি। আরো রয়েছে লেনদেন, মোকদ্দমা পরিচালনা, সাক্ষ্যদান, ওসীয়াত, উত্তরাধিকার সম্পদ বণ্টন ইত্যাদি। আরো রয়েছে সালাম-কালাম, খাওয়া-শোয়া, ওঠা-বসা, মেহমানী-মেযবানী ইত্যাদি সংক্রান্ত বিধানাবলী। উপরোক্ত সমস্ত বিষয় সংক্রান্ত মাসআলাসমূহকে ‘ইলমে ফিকহ’ বলে।

আর কিছু রয়েছে মানুষের অভ্যন্তর তথা অন্তর বিষয়ক বিধান। যেমন- আল্লাহ তা’য়ালাকে ভালোবাসা, তাঁকে ভয় করা, তাঁকে স্মরণ করা, দুনিয়াকে কম ভালোবাসা, আল্লাহর ইচ্ছার উপর সন্তুষ্ট থাকা, লোভ না করা, ইবাদতের সময় অন্তরকে হাযির রাখা, আল্লাহর কাজকে ইখলাসের সাথে আল্লাহরকে রাজি করার উদ্দেশ্য করা, কাউকে তুচ্ছ মনে না করা, আত্মশ্লাঘায় লিপ্ত না হওয়া, রাগ নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদি। এ সমস্ত স্বভাব-চরিত্র ও গুণাবলীকে ‘সুলুক’, তরীকত’ ও তাসাওউফ’ বলে।

শরীয়তের বাহ্যিক বিধানবলী- নামায, রোযা ইত্যাদি উপর আমল করা যেমন ফরয-ওয়াজিব, তেমনিভাবে এ সমস্ত অভ্যন্তরীণ বিধানসমূহের উপর আমল করাও কুরআন ও সুন্নাহের দৃষ্টিতে ফরয-ওয়াজিব। তাছাড়া বাতেনী মন্দ চরিত্রসমূহ থেকে দূরে থাকার প্রতি গুরুত্বারোপ করা এজন্য অধিক জরুরি যে, এ সমস্ত বাতেনী মন্দ চরিত্রের কুপ্রভাব বাহ্যিক আমলসমূহের উপরও পড়ে থাকে। যেমন, আল্লাহ তা’য়ালার মুহাব্বত কম হওয়ার ফলে নামাযের মধ্যে অলসতা দেখা দিলো বা রুকু-সেজদার হক আদায় না করে দ্রুত পড়ে ফেললো, বা কৃপণতার ফলে যাকাত প্রদানের বা হজ্জ আদায় করার সাহস হলো না, বা অহংকার কিংবা রাগের প্রাবল্যের কারণে কারো উপর জুলুম হয়ে গেলো। সারকথা হলো, শরীয়ত ও তরীকত দু’টি পৃথক জিনিস নয়। শরীয়তের জাহেরী ও বাতেনী সমস্ত হুকুমের উপর পরিপূর্ণ আমল করার সংজ্ঞাই এমনভাবে দিয়েছেন যে, সংজ্ঞায় জাহেরী আমল ও বাতেনী আমল সবই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

কিন্তু পরবর্তীকালের আলেমগণ ইলম হাসিলের সুবিধার্থে জাহেরী আমলসমূহ যথা- নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, তালাক, বিবাহ, ব্যবসা, ভাড়া চুক্তি ইত্যাদি বিষয়সমূহকে পৃথকভাবে সংকলিত করে তার নাম দিয়েছেন -ইলমে ফিকহ। আর বাতেনী আমলসমূহ যথা- ইখলাস, সবর, শোকর, যুহদ ইত্যাদি আমলসমূহের বিধি-বিধানকে পৃথকভাবে সংকলিত করে তার নাম রেখেছেন – তাসাওউফ ও তরীকত। এ পরিভাষা অনুপাতে শরীয়ত ও তরীকতের একটিকে অপরটি থেকে এভাবে পৃথকও বলা যেতে পারে, যেমন কিনা নামায একটি পৃথক ইবাদত এবং রোযা একটি পৃথক ইবাদত। এবং যেমন কীনা মানুষের হাত একটি পৃথক অঙ্গ এবং পা পৃথক অঙ্গ। চোখ এক জিনিস আর কান অন্য জিনিস। অন্তর, কলিজা ও ঠোঁট পৃথক অঙ্গ। কিন্তু একটি মানবের পূর্ণতা ও এসবগুলোর সমন্বিত রূপেই হয়ে থাকে। এগুলোর একটিকে নিয়ে অপরটি বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই।

এমনিভাবে পরবর্তীকালের আলেমগণের পরিভাষাতে ইলমে আকায়িদ, ইলমে ফিকহ ও ইলমে তাসাওউফ নিঃসন্দেহে পৃথক পৃথক বিষয় ও শাস্ত্র, কিন্তু সঠিক ও পরিপূর্ণ মানুষ বা মুমিন ও মুসলমান এ সবকিছুর সমন্বয়েই হয়ে থাকে। এবং কুরআন ও সুন্নাহের প্রকৃত অনুসরণ এর সবগুলোর উপর আমল করার দ্বারাই লাভ হতে পারে। এগুলোর মধ্য থেকে কোন একটিকে নিয়ে অন্যগুলোকে এড়িয়ে চলা এমনই ধ্বংসাত্মক, যেমন ধ্বংসাত্মক কানের হেফাযত করে চোখ নষ্ট করা। বা রোযার হেফাযত করে নামায নষ্ট করা।(কসদুস সাবীল)

শায়খের প্রয়োজনীতা

এতক্ষন পর্যন্ত আমরা যে আলোচনা করলাম তা হতে বোঝাগেল, মানব জাতির ইসলাহ ও তরবিয়তের জন্য দুটি জিনিস প্রয়োজন। তা হলো:

এক- কুরআন ভিত্তিক হেদায়াত।

দুই- তা বুঝা এবং সে মুতাবেক আমল করার যোগ্যতা অর্জনের জন্য শরীয়ত বিশেষজ্ঞ ও আল্লাহওয়ালাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ।

একথা শুধু মাত্র দ্বীনি শিক্ষার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, বরং পৃথিবীর অন্যান্য বিদ্যা(Faculty) এবং শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা পদ্ধতির জন্যও প্রযোজ্য।

যেমন, একদিকে থাকবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের নির্ভরযোগ্য পুস্তকাবলী, অন্যদিকে থাকবে বিজ্ঞ ও যোগ্য ব্যক্তিবর্গের তা’লীম ও তরবিয়ত ও দিক নির্দেশনা।

তাই সাহাবায়ে কেরাম নিজেরা অধিকাংশ সময় নববী মজলিসে কাটাতেন। ইসলামি শিক্ষার তরবিয়ত হাতে-কলমে(Practically) গ্রহণ করতেন।

এজন্যে ইসলামি শরী’আতে নেককার এবং উলামায়ে কেরামের সংসর্গ অবলম্বনের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে।

আল্লামা মুফতী মুহাম্মদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম বলেন, কুপ্রবৃত্তি মানুষের চরিত্রকে ধ্বংস করে দেয়। তাই একজন চিকিৎসকের প্রয়োজন, যিনি এগুলো চেনেন। এ অনিষ্টতাগুলো আমাদের মাঝে আছে কিনা? তা জানা থাকলে তার চিকিৎসা করবেন। এরই নাম ‘তাসাওউফ’।

যেমন কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ তা’য়ালাতে ভয় কর, তাকওয়া অবলম্বন কর; আর তাকওয়া অবলম্বনের সহজ পথ হল যারা মুত্তাকী তাদের সংশ্রব-সোহবত অবলম্বন করা।’(সূরা তাওবা; ১১৯)

যখন তোমারা তাদের সংশ্রব গ্রহণ করবে তখন তাদের রং-ঢং তোমাদের মধ্যে চলে আসবে। তাদের স্বভাব-প্রকৃতি তোমাদের কাছে চলে আসবে আর তোমাদের মাঝে রোগ সৃষ্টি হলে তারা চিনে ফেলবেন এবং তারা চিকিৎসা করবেন এবং তোমাদের ইসলাহ করবেন। চরিত্রকে পবিত্র বানাবেন। তোমাদের ইসলাহ করার এ পদ্ধতি রসূলাল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে আজ পর্যন্ত চলে আসছে।(ইসলাম আওর হামারী যিন্দেগী)

ইমাম বায়হাকী রহমাতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় হাদিস গ্রন্থ ‘শুয়াবুল ঈমান’ এ লিখেছেন, ‘স্বতঃসিদ্ধ কথা যে, একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি যখন জ্ঞানীদের সাথে উঠা-বসা করে তখন তার বুদ্ধিমত্তা আরো বৃদ্ধি পায়। একজন আলেম যখন উলামায়ে কেরামের সংস্পর্শে আসে, তখন তার ইলম বৃদ্ধি পায়। এমনিভাবে একজন পুণ্যবান ও জ্ঞানীদের সোহবতে এলেও তাই হয়। কাজেই সৎগুণাবলী সম্পন্ন ব্যক্তিদের সোহবতে একজন সৎ চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তির নৈতিকতার উৎকর্ষ সাধন হবে এটাও অনস্বীকার্য।’(শুয়াবুল ঈমান)

আমার মুহতারাম সায়েখ মুফতী ইয়াহহিয়া দামাত রাকাতুহুমকে বলতে শুনেছি, নিসবত ও সম্পর্ক কোন বস্তুকে তার আপন অবস্থান থেকে অনেক উঁচুতে উঠিয়ে দেয়। আবার তার মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান অনেক নীচুতে নামিয়ে দেয়। বিষয়টি ভালোভাবে বোঝার জন্য আমারা একটি উদাহরণ নিতে পারি। একই থানের কাপড় থেকে একটি অংশ দিয়ে তৈরি করা হলো কুরআন মাজীদের গিলাফ, আরেকটি অংশ তৈরি করা হলো জুতা মোছার নেকড়া। তো যে অংশ দিয়ে কুরআন শরীফের গিলাফ তৈরী করা হলো সেটি কুরআনের সম্পর্কে লেগে গেলো। আর যে অংশ দ্বারা জুতা মোছার নেকড়া বানানো হলো তা জুতার সম্পর্কে লেগে গেলো।

দেখুন, উভয় কাপড়ের টুকরা একই থানের কাপড় সত্ত্বেও তাদের মাঝে কত ব্যবধান হয়ে গেলো। কুরআনের সম্পর্কে জুড়ে যাওয়া কাপড়ের অংশটি যদি অসাবধানতার কারণে পায়ে লেগে যায় তাহলে মুসলমান পরম সম্মানের সাথে তা তুলে নেয়। বুকে লাগায় ও চুমা খায়। মনে হয়, কুরআনের সাথেই তার কোনো বেআদবি হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে, যে কোনো কারণে জুতা মোছার কাপড়টি যদি তার পায়ে লেগে যায় তাহলে ঘৃণাভাবে সেটি দূরে ঠেলে দেয় এবং পা ঝাড়া দেয়। কেমন যেন পা-টাই ময়লা হয়ে গেলো। অথচ উভয় কাপড় একই থানের অংশ ছিলো।

তিনি আরো বলেন, পরিবেশ বড়ই দামী এবং বড়ই প্রভাব রাখে। মাওলানা জুলফিকার নকশাবন্দী দামাত বারাকাতুহুম কিতাবে লিখেছেন। অত্যন্ত মূল্যবান কথা; কোনো মানুষ যত ভালোই হোক না কেন যদি মন্দের পরিবেশে চলতে থাকে, একদিন না একদিন সে মন্দ হয়েই যাবে। সে আর ভালো থাকতে পারবে না। আর একজন মানুষ যতবড়ই মন্দ ও খারাপ হোক না কেনো, যদি ভালো মানুষের সাথে উঠাবসা করে। ভালোর পরিবেশে সর্বদা চলাফেরা করে, করতেই থাকে তাহলে সে আর খারাপ থাকতে পারবে না। সে একদিন না একদিন ভালো হয়েই যাবে। ইনশা’আল্লাহ। তো এই ভালো পরিবেশে সর্বদা লেগে থাকা যেমন মন্দ মানুষকে ভালো করেই ফেলবে তেমনই মন্দের পরিবেশে যাওয়া আসা ভালো মানুষকে খারাপ করেই ছাড়বে। সে যতবড়ই ভালো মানুষ হোক না কেনো।

পরিবেশ কী জিনিস? গরমের পরিবেশে গরম লাগবেই লাগবে। যতবড় পাহলোয়ান হয় না কেনো। ঠান্ডার পরিবেশে ঠান্ডা লাগবেই যতবড়ই শক্তিশালী ব্যক্তি হয় না কেনো। এর নাম পরিবেশ।

একই বাতাসে কোনো পুকুর বা নদী অতিক্রম করে আসে তার মধ্যে অর্দ্রতা ও ঠান্ডাভাব এসে পড়ে। ঐ বাতাস কোন ইটের ভাটা বা আগুন অতিক্রম করে আসে তার মধ্যে শুষ্ক ও গরমভাব আসে। একই বাতাস কোনো আতরের দোকান বা ফুল-বাগিচা অতিক্রম করে আসে, তার ভেতরে সুঘ্রাণ এসে পড়ে। ঐ বাতাস কোনো ময়লা-আর্বজনা অতিক্রম করে আসে, তার ভেতরে দুর্গন্ধ এসে পড়ে। এটাই হলো পরিবেশ। এমনিভাবে মানুষ দ্বীনের পরিবেশে এলে তার মাঝে দ্বীনের ছাপ আসতে থাকে।(মোজাকারা হতে)

হযরতে সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুর উপর পরিবেশের প্রভাব দেখুন। বিখ্যাত সাহাবী হযরত হানযালা রাযিয়াল্লাহু আনহু। তিনি রসূল রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে হাজির হতেন। রসূলের মজলিসে উপস্থিত হয়ে তাঁর মুখনিঃসৃত কথা শুনতেন। আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রসূলের মজলিসে উপস্থিত হয়ে তাঁর মুখনিঃসৃত কথা শুনলে একজন মুসলমানের মনের অবস্থা কী দাঁড়াত! মনটা কীরূপ গলে যেত এবং কেমন জযবা তৈরি হত !

তিনি একদিন হন্তদন্ত হয়ে রসূলের খেদমতে এসে হাজির হলেন এবং এসেই বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল ! হানযালা মুনাফেক হয়ে গেছে।’

অর্থাৎ হযরত হানযালা রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজের ব্যাপারে বলছেন, আমি মুনাফেক হয়ে গেছি। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, কেন কী  হয়েছে তোমার ? তুমি কীভাবে মুনাফেক হয়েছ? বললেন, হে আল্লাহর রসূল? আমি যতক্ষণ আপনার মজলিসে উপস্থিত থাকি, আপনার কথা শুনি, ততক্ষণ অন্তরে খুব ক্রিয়া থাকে এবং নিজেকে সংশোধনের ও নেক আমল করার খুব জযবা থাকে। কিন্তু যখন এখান থেকে বের হয়ে যাই, তখন এমনভাবে এই দুনিয়ার কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ি যে, আর সেই চেতনা অবশিষ্ট থাকে না। এতো মুনাফেকেরই কাজ যে, বাইরে এক আর ভেতরে আরেক। সেজন্য আমি শঙ্কিত যে, আমি মুনাফেক হয়ে গেলাম না তো?

প্রিয়নবী রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সান্তনা দিয়ে বললেন, না হানযালা, তুমি মুনাফেক হওনি। তুমি তোমার যে অবস্থার কথা ব্যক্ত করেছ, এটি স্বাভাবিক বিষয়। এমনটি হয়েই থাকে। মনের অবস্থা সব সময় এক রকম থাকে না। জযবা কখনও বেশি থাকে, কখনও কম থাকে। এত ভয়ের কিছু নেই। এই অবস্থার কারণে তুমি যে মনে করেছ, তুমি মুনাফেক হয়ে গেছ, তোমার এই ধারণা সঠিক নয়।

অর্থাৎ পরিবেশ এমন একটি প্রভাবসৃষ্টিকারী নিয়ামক, যা দ্বারা মানুষের মন-মতিস্ক প্রতি মুহূর্তে প্রভাবিত হতে থাকে এবং এই প্রভাবের ফলে তার আমল ও কাজকর্ম একটি বিশেষ ধাঁচে গঠিত হতে থাকে। এজন্য হযরতে ওলামায়ে কেরাম অন্তর আত্মাকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করতে একজন আল্লাহওয়ালার সঙ্গে সম্পর্ক জুড়ে নিয়ে তাঁর নিকটে নিজের অন্তরের বিভিন্ন অবস্থাগুলো জানিয়ে তাঁর দিক নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন।

তাসাওউফ সম্পর্কে বিভ্রান্তি

বর্তমানে আমাদের অনেকেরই তাসাওউফ শব্দটি শুনা মাত্রই কপালে ভাঁজ পড়ে যায়। এর কারণও আছে। কারণ অনেকে মনে করে তাসাওউফের আসল উদ্দেশ্য হল, আল্লাহর যিকির এবং আমরা যখন কোন শায়খের(পীরের) হাতে বায়আত হব, তখন তিনি আমাদেরকে কেবল বিভিন্ন ‘অযিফা’ বাতলে দেবেন। তেমনি কারো কারো এই ধারণা যে, তাসাওউফের আসল উদ্দেশ্য হল, তাবিজ-কবজ ও ঝাড়-ফুঁক। এমনিভাবে কোন কোন লোক মনে করে তাসাওউফের আসল উদ্দেশ্য হল, ‘মুরাকাবা’।

সায়েখুল ইসলাম আল্লামা মুফতী তাকী উসমানী দামাত রাকাতুহুম বলেন, যারা মনে করে তাসাওউফের আসল উদ্দেশ্য হল, আল্লাহর যিকির এবং আমরা যখন কোন শায়খের(পীরের) হাতে বায়আত হব, তখন তিনি আমাদেরকে কেবল বিভিন্ন ‘অযিফা’ বাতলে দেবেন। তাদের এ ধারণা যেমন সঠিক নয়, তেমনি কারো কারো এই ধারণা যে, তাসাওউফের আসল উদ্দেশ্য হল, তাবিজ-কবজ ও ঝাড়-ফুঁক এবং পীর সাহেব আমাদেরকে তাবিজ-কবজ, ঝাড়-ফুঁকের কিছু পদ্ধতি শিখিয়ে দেবেন। তাদের এ জাতীয় ধারণাও ঠিক নয়।

একথা ভালোভাবে বুঝে নেয়া দরকার যে, উপরোক্ত বিষয়সমূহের সাথে তাসাওউফের আদৌ কোন সম্পর্ক নেই। এমনকি যিকির তাসাওউফের আসল উদ্দেশ্য নয়। বরং যিকির হল, আসল উদ্দেশ্য অর্জনের একটি মাধ্যম মাত্র। এমনিভাবে কোন কোন লোক মনে করে তাসাওউফের আসল উদ্দেশ্য হল, ‘মুরাকাবা’। তারা মনে করে যে কোন একটি সময় নির্জনে বসে ধ্যান করবে এবং (পীর সাহেবের খানকায় চিল্লা দেবে, সাধনা করবে। অথচ এগুলোও তাসাওউফের আসল উদ্দেশ্য নয় বরং এগুলো হল আসল উদ্দেশ্য অর্জনের বিভিন্ন পথ ও পন্থা)

তাসাওউফের আসল চেতনা হল, চরিত্রের সংশোধন ও আত্মার আমালগুলোর সংশোধন করা। আর এর জন্য প্রয়োজন হল, সুন্নাতের অনুসারী বিশুদ্ধ জ্ঞান ও বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাসের অধিকারী কোন ব্যক্তিকে নিজের অনুসরণীয় ব্যক্তি বানিয়ে নেয়া, যিনি  নিজেও কোন বড় ব্যক্তির অধীনে থেকে নিজেকে সংশোধন করেছেন। তার কাছে গিয়ে বলবে, আমি আপনার দিক নির্দেশনা চাই, আতঃপর তিনি তাকে পথনির্দেশ দিবেন। যেভাবে সাহাবায়ে কেরাম রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্বীয় অনুসারণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আপনি আমাদের মুরববী, আমাদের প্রতিপালনকারী। আমাদের আখলাক ও আমলের সংশোধনকারী। কাজেই আপনার অনুসরণ আমাদের করতেই হবে। তাসাওউফের এটা ছিল সম্পূর্ণ সঠিক চেতনা। সঠিক খেয়াল। এটা ছিল পীর মুরীদের সঠিক পথ, কুরআন ও হাদীস অনুযায়ী। পরিত্র কুরআনের জায়গায় জায়গায় উত্তম চরিত্র অবলম্বন করার জন্য তালকীন করা হয়েছে। এক হাদীসে রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমাকে তো পাঠানোই হয়েছে এজন্য যে, আমি মানুষের চরিত্র সংশোধন করব ও তার পূর্ণতা বিধান করব।’(কানযুল উম্মাল; জমউল জাওয়ামিয়ি; সুয়ূতী কৃত; সুনানে বায়হাকী; জামিউল আহাদীস; আদাবুদ দুনিয়া; আদ-দুররুল মানসুর)

সাহাবায়ে কোরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিজেদেরকে সঁপে দিয়েছিলেন যে, আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই আমল করব। আমাদের মনে চাক বা না চাক । আমাদের বুঝে আসুক বা নাই আসুক। তারপরও আপনি যেভাবে যা কিছু বলবেন, আমরা সেভাবে তাই  করব। এর ফলে আল্লাহ তা’য়ালা সাহাবায়ে কেরামের আখলাককে এত উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ করেছিলেন, যে পরে পৃথিবীতে এরূপ উত্তম চরিত্রবান লোক আজ পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি। সাহাবায়ে কেরামের অবস্থা ছিল, যদিও তারা রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে তরবিয়ত গ্রহণ করেছেন, তবুও তারা মুহূর্তের জন্যও স্বীয় নফস সম্পর্কে উদাসীন হতেন না। যদিও তারা রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সোহবতের পরশে খাঁটি সোনায় পরিণত হয়েছিলেন। নির্মল ও নির্ভেজাল হয়েছিলেন। তবুও সব সময় তাদের মাঝে এ ভয় লেগে থাকত, না জানি কখন সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাই।

সায়েখুল ইসলাম অন্যত্র বলেন, কেউ কেউ মনে করে, কোন আল্লাহওয়ালারা তার প্রতি বিশেষ নজর দিলে, আলিঙ্গন করে নিলে, ওই আল্লাহ ওয়ালার বুক থেকে স্নিগ্ধঝরা এক অপার্থিব নূর তার বুকে প্রবেশ করবে। ফলে গোনাহ করার ইচ্ছা তার মন থেকে মুছে যাবে। মনে রাখবেন, এটা কখন ও হবে না। যে ব্যক্তি এ জাতীয় ধারনা নিয়ে বসে আছে, সে ধোঁকায়পড়ে আছে। এমনটি হলে তো দুনিয়াতে কাফের বলতে কোন প্রাণীর অস্তিত্ব থাকত না, আল্লাহওয়ালারা এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে ঈমানের নূর দ্বারা সবাইকে আলোকিত করে দিতেন।

একবার হযরত আশরাফ আলী থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহির দরবারে এক লোক এসে বলল, হজরত! আমাকে কিছু নসীহত করুন। হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাকে কিছু নসীহত করে দিলেন। চলে যাওয়ার সময় ওই লোক বলে ওঠল, হযরত! আপনার সীনা থেকে আমাকে কিছু দান করুন। এ কথা দ্বারা লোকটির উদ্দেশ্য ছিল, হাকীকমুল উম্মত হযরত থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি নুরের কোন বিচ্ছুরণ তার সীনাতে ঢুকিয়ে দেন, যার ফলে সে বেড়া পার হয়ে যাবে এবং গোনাহ করার খাহেশ তার অন্তর থেকে দূর হয়ে যাবে। হযরত থানভী উত্তরে দিলেন, আমার সীনা থেকে তোমাকে কী দেব? আমার সীনাতে কফ থুথু জমাট বেঁধে আছে, চাইলে নিতে পার।

আসলে বুজুর্গদের সম্পর্কে এ জাতীয় ধারনা করা ভুল। এটা নিছক কল্পনা, অসম্ভব ধারনা, পাগলামী পূর্ন চেতনা।

হ্যাঁ আল্লাহওয়ালাদের সংস্পর্শের একটা মূল্য অবশ্যই আছে। এর ফলে মানুষের মন মানুসের পরিবর্তন ঘটে। মানুষ তখন সঠিক পথে চলতে সক্ষম হয়।  চিন্তা চেতনার মাঝে বিপ্লব সৃষ্টি হয়। তবে কাজ করতে হয় নিজেকে, বুজুর্গদের কাজ হল শুধু সংস্পর্শ দেয়া।

মনসবী শরীফে মাওলানা রুমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ঘটনাটি লিখেছেন। এক কাঠুরিয়ার ঘটনা। প্রতিদিন সে জঙ্গলে যেত লাকড়ি জোগাড় করত, তারপর বাজারে বিক্রি করে দিত, এভাবেই তার পরিবার চলত। প্রতিদিনের মত আজ ও সে জঙ্গলে গেল। লাকড়ি কুড়িয়ে আঁটির ভেতরে চলে এল এক বিষধর সাপ। তবে জীবিত নয়, মনে হয় মৃত। কাঠুরিয়া ভাবল, মরা সাপ আর কী-ইবা করতে পারে। তাই সে এর প্রতি বিশেষ মনোযোগী হল না। রাতে সে ঘুমিয়ে পড়ল। অপর দিকে সাপটি তো আসলে মৃত ছিল না। বরং জীবিতই ছিল। হয়ত তার শরীরটার ওপর বিশাল ধকল গিয়েছিল। তাই আধমরা হয়ে গিয়েছিল। কাঠুরিয়া একেই ভেবেছিল মৃত। এখন সাপটি দীর্ঘ বিশ্রাম পেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠল, ধীরে ধীরে তাকে ফোঁস ফোঁস শুরু করল। এতকিছু ঘটে যাচ্ছিল, অথচ কাঠুরিয়া ও তার পরিবার ছিল সম্পূর্ন বেখবর। এক পর্যায়ে সাপটি ফনা তুলল এবং কাঠুরিয়াকে দংশন করে নিজের ঠিকানায় চলে গেল। আর কাঠুরিয়া মারা গেল। সকাল বেলা উঠে পরিবারের সবাই তো অবাক, কী থেকে কী হয়ে গেল! একটি মরা সাপ কীভাবে একজন জলজ্যান্ত লোককে এভাবে মেরে ফেলল!

এই ঘটনা বর্ণনা  করার পর মাওলানা রুমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, মানুষের নফস ও একটি বিষধর সাপের মত। মানুষ যখন আল্লাহওয়ালার সোহবতে থাকে, রিয়াযত মুজাহাদা করে তখন নফস কিছু সময়ের জন্য হয়ত নিস্তেজ হয়ে পড়ে, কিন্তু মরে তো যায়  না। সময় মত সে আবার জেগে উঠতে পারে, ফণা তুলতে পারে এবং বিষ ঢেলে দিতে পারে। সুতরাং তাকে মৃত ভাবার কোন কারণ নেই। মাওলানা রুমীর ভাষায়: মানুষের নফস ঐ বিষধর সাপের মত এখনও যার মৃত্যু হয় নি। রিয়াজত ও মুজাহাদা ও সাধনার  ঝড়ে তা নেতিয়ে পড়েছে তবে মারা যায় নি। যে কোন সময় সে তেজি হয়ে উঠতে পারে, ছোবল মারতে পারে, ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে। অতএব এর ধ্বংস ক্ষমতা সম্পর্কে মোটেও উদাস থাকা যাবে না। এক মুহুর্তে ও অসতর্কতার সুযোগ সে ধ্বংস করে দিতে পারে অনেক কিছু।(ইসলাম আওর হামারী যিন্দেগী)

হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ‘তারবিয়াতুস সালিক’ এ লিখেছেন, সুলূক বা তাসাওউফের সারমর্ম নিম্নরূপঃ

১)  না তো তাসাওউফের মধ্যে কাশফ ও কারামাত জরুরি।

২)  না এখানে কেয়ামতের ময়দানে নাজাত-মুক্তির জিম্মাদারী নেওয়া হয়।

৩)  না দুনিয়াবি কার্যোদ্ধারের অঙ্গীকার করা হয়। যেমন একথা বলা হয় না যে, পীরের তাবিজ-কবচ দিয়ে সব কাজ হয়ে যাবে। মামলা-মোকদ্দমার জিত হয়ে যাবে। উপর্জনের মধ্যে উন্নতিহবে। ঝাড়-ফুঁক দিয়ে রোগ-বালাই সব দূর হয়ে যাবে। অথবা ভবিষ্যতের কথা জানিয়ে দেওয়া হবে।

৪)  না তো পীরের মধ্যে এমন কোনো রূহানী শক্তি থাকা জরুরি যে তার তাওয়াজ্জুহের মাধ্যমে আপনা আপনি মুরীদের আত্মশুদ্ধি ঘটে যাবে। তার মধ্যে গুনাহ করার ইচ্ছাই জাগবে না। আপনা আপনিই ইবাদত হতে থাকবে, মুরীদের জোরালো ইচ্ছা ও করতে হবে না। অথবা মুরীদ শুধু পীরের তাওয়াজ্জুহের দ্বার হাফেয, আলেম হয়ে যাবে অথবা তার স্মরণশক্তি বেড়ে যাবে।

৫)  তাসাওউফের মধ্যে না এমন কোনো বাতেনি কাইফিয়ত (মনের অবস্থা) সৃষ্টি হওয়ার অঙ্গীকার আছে যে, সর্বদা অথবা ইবাদতের সময় মুরীদ আনন্দে বিভোর হয়ে থাকবে। ইবাদতের মধ্যে মনে কোনো প্রকার খেয়াল, সংশয় ও ওয়াস্ওয়াসাই জাগবে না, খুব কান্না আসবে , এমন আত্মহারা অবস্থা তৈরি হবে যে, অন্য কোনো কিছুই মনে থাকবে না।

৬)  না যিকির ও শোগলের সময় নূর ইত্যাদি চোখে পড়া জরুরি, না কোনো গায়েবী আওয়াজ কানে আসা জরুরি।

৭)  না ভালো ভালো স্বপ্ন দেখা, না মনের মধ্যে জেগে উঠা বিভিন্ন বিষয় জরুরি।

তাসাওউফের মধ্যে ঐ বিষয়গুলোর কোনোটাই জরুরি নয় এবং ঐগুলোর কোনোটাই তাসাওউফের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও নয়।(তারবিয়াতুস সালিক)

বাড়াবাড়ির মাত্রা দেখুন।

সায়েখুল ইসলাম আল্লামা মুফতী তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম বলেন, আমাদের এখানে এক ব্যক্তি আছে, যাকে ‘শায়খে তরিকত’ বলা হয়। যার মুরীদের সংখ্যাও অসংখ্য বলা হয়। তিনি লিখেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের মুরীদকে মসজিদুল হারামের মধ্যে নামায পড়াতে পারে না। সে শায়খ হওয়ার যোগ্য নয়।’ অর্থাৎ ওই শায়খ মুরীদের সামনে মসজিদুল হারামকে প্রকাশিত করবে এবং মুরিদদেরকে তাতে নামায পড়াবে। যে পীর এমন করতে পারবে না, সে পীর হওয়ার যোগ্য নয়। এসব কথার কারণে মানুষের মনে এ বিষয়টি বসে গেছে যে, এসব কাশফ ও মুরাকাবার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে। মনে রাখবেন, এসব জিনিসের কোন বাস্তবভিত্তিক গুরুত্ব নেই। কেউ যদি এগুলো লাভ করে তবে তা আল্লাহর নিয়ামত। কিন্তু এটি বড় নাজুক নেয়ামত। অনেক সময় এটি একটি পরীক্ষাও হয়ে থাকে। এটি লাভ হওয়ার পর বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। অনেক মনুষকে শয়তান এসব জিনিস দ্বারা পথভ্রষ্ট করেছে। এজন্য কখনই এগুলো অর্জন করার পেছনে পড়বে না। এগুলো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নয়। বেশির চেয়ে বেশি এগুলো প্রশংসিত এবং মনের পছন্দনীয় অবস্থা।(ইসলাম আওর হামারী যিন্দেগী)

আবার তাসাউফের নাম করে অনেক ভণ্ড বলে থাকে তারা ইয়াকীনের স্তরে পৌঁছে গেছে, তাই তাদের আর শরীয়তের হুকুম পালন করার প্রয়োজন নেই।

হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ‘তালিমুদ্দীন’ এ লিখেছেন, একটি মারাত্মক ভুল এই যে, শয়তানের ধোঁকায় কতক লোকের মাথায় এই খেয়াল চাপেছে যে, তরীকতের মধ্যে, ফকীরির রাস্তায় শরী’আতের পায়রবি করার আবশ্যকতা নেই।

এই মারত্মক ভুলের সংশোধন তরীকতের বড় বড় ইমামদের বাণীর দ্বারা করা হচ্ছে।

হযরত শায়েখ জিলানী বলেছেন, যদি আল্লাহর নির্দেশিত সীমারেখার(শরীয়তের বিধানাবলী এর) একটিও লঙ্ঘিত হয় তা হলে জেনে নাও, তুমি ফিতনায় পড়ে গেছ এবং শয়তান তোমাকে নিয়ে খেলছে। এমতাবস্থায় তুমি তাৎক্ষণিকভাবে শরয়ী বিধানের দিকে প্রত্যাবর্তন কর, তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর এবং প্রবৃত্তিজাত কামনা-বাসনার জবাব দাও। আর তার কারণ হল, প্রতিটি হাকিকত, যার পেছনে শরীয়তের কোনো সমর্থন নেই, তা বাতিল ও পরিত্যক্ত।(শারানীর তাবাকাতুল কুবরা)

বিখ্যাত বুযুর্গ সূফীকুল শিরোমণি জুনাইদ বাগদাদী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘আমাদের এই ইলম(ইলমে তাসাওউফ) কুরআন-হাদিসের সাথেই সম্পৃক্ত(অর্থাৎ, এগুলোর ভিত্তি কোরআন-হাদিস)।

সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআনের ইলম অর্জন করেনি এবং হাদিস ও ফিকহের জ্ঞান অর্জন করেনি তাকে আদর্শ বানানো যাবে না।’(সিয়ারুল আলামিন নুবালা)

শায়েখ আকবার রহমাতুল্লাহি আলাইহি ‘ফতুহাতে মক্কিয়া’ কিতাবে লিখেছেন, যে হাক্বীক্বত শরী’আতের খেলাফ হবে তা বদ্দ্বীনি এবং বাতেল।

তিনি আরও বলেছেন, ‘শরী’আতের রাস্তা ছাড়া আল্লাহকে পাওয়ার অন্য কোন রাস্তা নেই। শরী’আতের যে সব নিয়ম বাতান হয়েছে, তা ছাড়া আল্লাহকে পাওয়ার অন্য কোন পন্থা নেই।

তিনি আরও বলেছেন, ‘যদি কোন ফকীর বলে যে, শরী’আতের রাস্তার বরখেলাফ আল্লাহকে পাওয়ার অন্য কোন রাস্তা আছে, তবে তার কথা মিথ্যা; অতএব, এমন ফকীরের কথা মানা যাবে না, যার আদব নেই।’

হযরত বায়েযীদ বোস্তাময়ি রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘যদি তোমরা এমন একজন লোক দেখ যে, যে স্বীয় কারামতের বলে শূন্যে উড়তে পারে, তবুও তাতে তোমরা ধোঁকা খেয়ে ভক্ত হয়ে যাবে না। তাহকীক্ক করে দেখবে যে, সে শরী’আতের আদেশ-নিষেধ পালন করে কি না। শরী’আতের নির্ধারিত সীমাগুলি লঙ্ঘন তো করে না? নিয়ম মত শরী’আতের পাবন্দী করে কি না। যদি এই গুলিতে ঠিক পাও, তবে ভক্ত হবে, নতুবা নয়।’

সায়্যেদোত তায়েফা হযরত জোনায়েদ বাগদাদী কুদ্দিসা ছিররুহু বলেন, রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিছনে পিছনে যে চলেছে, তার রাস্তা ব্যতিরেকে অন্য সকল রাস্তা সমস্ত মানবের জন্য বন্ধ।

ফতুহাতে মক্কিয়া কিতাবে শায়খে আকবর কুদ্দিসা ছিররুহু বলেছেন, ‘আল্লাহর শরী’আতের হুকুমের এলম যে হাছিল করে নি, আল্লাহর নিকট তার কোনই মর্তবা নাই; আল্লাহ তা’য়ালা কখনও কোন জাহেলকে ওলী বানান নাই।’

ঐ কিতাবে আরও আছে, ‘জাহেলের কাজে লিপ্ত থাকা অপেক্ষা আলেমের বেকার বসে থাকাও ভাল।’(তালিমুদ্দীন)

এক লোক একবার জুনাইদ বাগদাদী রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেউ কেউ বলে থাকে, আমরা তো পৌঁছে গেছি। এখন আর আমাদের শরীয়তের অনুসরণের প্রয়োজন নেই। তিনি উত্তরে বললেন- ‘হ্যাঁ, তারা পৌঁছে গেছে। তবে জাহান্নামে।’(শরহু হাদিসীল ইলম)

এমনিভাবে কেউ কেউ মনে করেন পীর ধরলে পীর-মাশায়েখ মুরীদদের পাপের বোঝা বহন করে বা কবরে হাশরে মুরীদদের তা’লীম ও তালকীন দিয়ে তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করবেন। এটা কুরআন হাদীস বিরোধী কথা। কুরআন শরীফে বলা হয়েছে, ‘অর্থাৎ কেউ কারও পাপের বোঝা বহন করবে না।’(সূরা আনআম; ১৬৪)

কেউ নিজে আমল করে নিজের নাজাতের ব্যবস্থা না করলে কোনো পীর তাকে নাজাত দিতে পারবে না। কোন পীর তো রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বড় হতে পারে না। স্বয়ং রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর গোত্র বনূ হাশেম, বনূ মুত্তালিব ও নিজ কন্যা ফাতেমাকে ডেকে বলেছেন, হে নবী হাশেম! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষার ব্যবস্থা কর। হে বনূ আব্দিল মুত্তালিব! তোমরা  নিজেদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষার ব্যবস্থা কর। হে ফাতেমা! তুমি নিজেকে জাহান্নাম থেকে রক্ষার ব্যবস্থা কর, আমি অল্লাহর আযাব থেকে তোমাকে রক্ষায় কিছুই করতে পারব না। …।(মুসলিম)(ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ)

আবার কেউ কেউ বাইয়াত হওয়াকে ফরজ ও ওয়াজিবের পর্যায়ে নিয়ে যায়।

মুফতী আব্দুর রউফ কাসেমী দামাত রাকাতুহুম তাঁর ‘মারেফাতের ধোঁকা’ কিতাবে লিখেছেন, বর্তমান জামানার প্রচলিত পীর মুরিদী একমাত্র ভারত বর্ষে ছাড়া দুনিয়ার কোথাও নাই। হযরত নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জামানার যে বাইয়াত করতেন তা এই ধরণের পীর মুরিদী নয়। যেমন বাইয়াতে রেজওয়ান এটা ছিল যুদ্ধ থেকে কেউ না ভাগে তার জন্য ওয়াদা বা অঙ্গিকার করা, কথা দেওয়া কোন জিকির বা অজিফা ছিল না। কোন এক সময় জনৈক সাহাবাকে ওয়াদা বা বাইয়াত করেছেন মিথ্যা কথা না বলার জন্য, কোন সময় ওয়াদা বা বাইয়াত করেছেন নামাজ পড়া, যাকাত দেওয়াও মুসলমানদের সঙ্গে ভাল ব্যাবহার করার জন্য। বেশী রকম বাইয়াত হত নতুন মুসলমান হওয়ার জন্য। কোন জায়গার শাসক/গভর্ণর পাঠাতে হলে তাকে শপথ বা বাইয়াত করা হত, ওয়াদা নেওয়া হত যেমন বর্তমান জামানায় মেম্বর, চেয়ারম্যান এর শপথ পড়ান টি. এন.ও। এমপিদের শপথ পড়ান ডি.সি এবং প্রধান মন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতি শপথ পড়ান। এ ছুন্নত তরীকাটা এভাবে এখনও জারী আছে।

হযরত সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে নিয়ে তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী, আয়েম্মায়ে মোজতাহেদিন তথা খোলাফায়ে আব্বাছিয়া, উমাইয়ার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত বর্তমান প্রচলিত পীর মুরিদীর শায়েখ মাশায়েখের প্রথা ছিলানা। তখনকার ছনদগুলি উস্তাদ শাগরীদের। সত্য জমানার পর ৩৫০/৪০০ হিজরীর পর যখন খেলাফত তন্ত্র বাদ হয়ে যবরী হুকুমত রাজতন্ত্র, দিক বিজয় শাসনতন্ত্র শুরু হতে থাকে, তখন জনসাধারণ মুসলমান বিভিন্ন প্রকার বদদ্বীনের শিকার হতে থাকে। চতুর্দিকে বাতেল ফেরকাগুলি মাথা নাড়া দিয়ে ওঠে। রাফেজী, খারেজী মোতাজেলা, কাদরীয়া, যবরীয়া, যাহমিয়াদের খপ্পরে পড়ে সাধারণ মুসলমানরা বিভিন্ন বাতেল আকিদা বেদাত, কুপ্রথা ও শিরিকে লিপ্ত হতে থাকে। ঠিক এই সময় মধ্য যুগের বড় বড় ওলামায়ে কেরামগণ নিজ নিজ এলাকায় গণ মুসলমানের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়েন এছলাহের জন্য। পরবর্তী কালে ঐ ওলামায়ে কেরামগণের সাগরিদরা নিজ নিজ মুরব্বি যার থেকে যে উপকৃত হয়েছেন তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে নিজ নিজ মুরব্বিকে বিভিন্ন খেতাবে ভুষিত করতে শুরু করেন। সেই সীমালঙ্ঘন খেতাবের একটা হল ‘পীর’ খেতাব। আমরা এখনও হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু ছাড়া আর কিছু বলি না। এমন কি নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাড়া আর কিছু বলিনা। কিন্তু বর্তমান প্রচলিত পীর বুজুর্গদের নাম নিতে, মোজাদ্দেদে জামান থেকে শুরু করে, নামের  আগে পরে পাঁচ গন্ডা উপাধি ফিট করা হয় বাহারে উলুম পর্যন্ত এমনকি তার আসল নাম কোনটা তালাশ করে পাওয়া মুশকিল। বর্তমান জামানায় উপাধি ব্যবহারের যে প্রতিযোগীতা চলছে তা নিঃসন্দেহে সীমালংঘন। অথচ হযরত সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম গণ এদের চেয়ে হাজার গুণে বেশী উপাধির উপযুক্ত ছিলেন।(মারেফাতের ধোঁকা, পান্দেনামা খাকির ৪৮ পৃষ্ঠার হাসিয়ায় এ ভাবেই ইতিহাসটি বর্ণনা করা হয়েছে)

খুব ভালভাবে মনে রাখতে হবে, ইসলামি শরী’আতে পীর ধরা ফরয বা ওয়াজিব করা হয়নি কিন্তু এসলাহে নফসকে ফরজ করা হয়েছে।

মওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দীন দামাত বারাকাতুহুম তার ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ কিতাবে লিখেছেন, যারা মনে করেন পীর না ধরলে মুক্তি নেই তারা বাড়াবাড়িতে আছেন। পীর ধরা ফরয/ওয়াজিব নয়, পীরের হাতে বায়’আত হওয়া ফরয/ওয়াজিব নয়। এটাকে সুন্নাত বলা হয়। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে অনেকে বায়’আত হয়েছেন এই মর্মে যে, আমরা শিরক করব না, যেনা করব না, চুরি করব না, কোন পাপকাজ করব না, ভাল কাজ করব ইত্যাদি। এটাকে বায়’আতে সুলূক বলা যায়। কোন কোন সাহাবী রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হতে এরুপ বায়’আত হয়েছেন আবার অনেকে হন নি। বায়’আত হওয়া ফরয/ওয়াজিব হলে সব সাহাবীই বায়’আত হতেন। পীর-মাশায়েখ হলেন রুহানী ডাক্তার। তাঁরা হলেন আদ্ধাতিক চিকিৎসক।(ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ)

এক জন দক্ষ ডাক্তার কিন্তু শুদ্ধ মানুষ নয় তার কাছ থেকে যেমন কেউ উপকৃত হবে না আবার একজন দক্ষ শিক্ষক কিন্তু শুদ্ধ মানুষ নয় তার কাছ থেকেও কেউ উপকৃত হবে না। তেমনিভাবে একজন দক্ষ নেতা/আলেম কিন্তু শুদ্ধ মানুষ নয় তার কাছ থেকে কেউ উপকৃত হবে না বরং মানুষ বিপদগামী হবে।

ড. মুশফিক আহমাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলতেন, দুনিয়ার নানা ধরনের জিনিসে যেরকম প্রতারনা থাকে; ধরা যাক কোন একটা জিনিস বাজারে খুব চলছে, কোন একটি ব্র্যান্ড, তখন তার নকল বাজারে আসতে শুরু করে। একসময় আল-আমিন বিস্কুট বাজারে খুব চলতো। কিছুদিন পর আরো অনেক নকল আল-আমিন বিস্কুট বের হয়ে গেল, কিন্তু নিম্নমানের।

মানুষ দ্বীন চায়, দ্বীনের কদর আছে। আর দ্বীনের কদর যে আছে ঐ টা আল্লাহওয়ালাদের কারণে। এক একজন আল্লাহওয়ালার কারণে এক এক জামানায় এক এক দেশে লাখো কোটি মানুষের কাছে দ্বীনের কদর বেড়ে যায়। ঐ কদর থাকার কারণে অন্যান্যরাও ওখান থেকে ফায়দা নিতে চায়। একই নাম দিয়ে, একই হাব-ভাব দিয়ে সে তার নিজের স্বার্থ লুটতে চায়। রসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসবার আগে এই গোটা আরব অঞ্চলের মধ্যে বা দুনিয়ার অন্য কোন জায়গায় নবীর আবির্ভাবের কোন কথা, কোন খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসার পরে উনার কারণে অনেকেই ভাবল এটা তো এক বিরাট ব্যবসা। একজন, দুইজন নয়, রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর কিছুদিনের মধ্যেই অন্ততপক্ষে ত্রিশজন মিথ্যা নবীর দাবিদার আসল। এদের মধ্যে মহিলাও ছিল। নবী দাবীদার সেই মহিলা আর এক পুরুষ দাবীদার, তারা দু’জন আবার বিয়ে করে ফেলল। ব্যবসার ক্ষেত্রে যেমন দেখা যায় স্বতন্ত্র কোম্পানী চালানোর চেয়ে মার্জ করে ফেললে আরো বেশি লাভ হয়, যাকে মার্জার বলে। ব্যাবসার ক্ষেত্রে মার্জার প্রচুর দেখা যায়, যেমনঃ ইউনিলিভার, মার্সিডিজ বেঞ্জ ইত্যাদি। তো ওরা দু’জন বিয়ে করে একটা জয়েন্ট এন্টারপ্রাইজ খুলল। একসাথে তারা নবুওয়্যাত করবে! সেই বিয়ের পরে হাদীয়া হিসেবে তাদের ‘উম্মতের’ জন্য দুই ওয়াক্ত নামায মাফ করে দিল! তাদের বিয়ে উপলক্ষ্যে। সব জামানায় মানুষের কাছে দ্বীনের কদর আছে। এই কদর দ্বীনদার লোকের কারণে। কিন্তু ঐ নাম বিক্রি করে যুগ যুগ ধরে মানুষ অসৎ ব্যবসাও করেছে এবং এখনও করছে।(মোজাকারা হতে)

এজন্য কোন ছদ্মবেশী ধোঁকাবাজদের বাক পটুতায় এবং ভাষা চাতুর্য্যে মুগ্ধ হয়ে অন্ধ অনুসরনের মাধ্যমে ঈমান ও পরকালকে বরবাদ করা যাবেনা। একজন প্রানজ্বল বক্তা! সহজেই লোকদেরকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে পারে! প্রশ্নের উত্তর দেয় টপাটপ! কিন্তু তার জীবনের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের লেশ মাত্রও নেই! তাহলে? তাহলে স্পষ্টই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এ ধরনের নেতাদেরকে অনুস্মরন না করার।

কিভাবে একজন মানুষ শুদ্ধ পথপ্রর্দশক খুজে পাব?

একবার ড. মুশফিক আহমাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিভাবে একজন মানুষ শুদ্ধ পথপ্রর্দশক খুজে পাবে? এটা সবার জন্য সম্ভব কি না? তিনি খুব সুন্দর উত্তর দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘একজন গ্রামের সাদাসিধা মানুষ ঢাকা শহরে গিয়ে তার প্রয়োজনে ভাল হার্টের ডাক্তার খুজে বের করে ফেলে আর তার আখিরাতের প্রয়োজনে শুদ্ধ পথপ্রর্দশক বের করতে পারবে না এ কথা ঠিক নয়। কেউ যদি দ্বীল থেকে নিয়াৎ করে আল্লাহ তাকে সঠিক রাস্তা দেখাবেন।’(মোজাকারা হতে)

সায়েখুল ইসলাম আল্লামা মুফতী তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম বলেন, আমার সম্মানিত পিতা হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শফী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ প্রশ্নের খুবই সুন্দর একটি উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেন, মিয়া! মানুষ বলে, বর্তমানে সাদেকীন কোথায় তালাশ করব? সব জায়গায় ধোঁকা আর প্রতারণা চলছে। আসল কথা হল, এ যুগটিই নকলের মিশেলের যুগ। সব জিনিসের মধ্যেই ভেজাল। ঘিতে ভেজাল, চিনিতে ভেজাল, আটায় ভেজাল, দুনিয়ার সব জিনিসের মধ্যে ভেজাল। এমনকি বলা হয়, বিষেও ভেজাল। কেউ একটা খোশগল্প শুনাল যে, এক ব্যক্তি সব জিনিসের মধ্যে ভেজাল দেখে বলল যে, কোন কিছু তো খাঁটি পাওয়া যায় না। অপারগ হয়ে চিন্তা করল যে, আত্মহত্যা করবে। এ দুনিয়াতে বেঁচে থাকা অনার্থক। যেখানে কোন জিনিস খাঁটি পাওয়া যায় না। না আটা খাঁটি, না চিনি, না ঘি, কিছুই খাঁটি নেই। তাই চিন্তা করল যে, আত্মহত্যা করা উচিত এবং এ দুনিয়া থেকে চলে যাওয়া উচিত। সুতরাং সে বাজার থেকে বিষ ক্রয় করে আনল এবং বিষ খেয়ে ফেলল। খেয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করছে যে, একটু পরেই হয়ত মৃত্যু চলে আসবে। কিন্তু মৃত্যু তো আসছে না। পরে জানতে পারল যে, বিষও খাঁটি ছিল না।

বুঝা গেল দুনিয়ার কোন জিনিস খাঁটি নয়, ভেজালমুক্ত নয়। প্রত্যেক বস্ত্ততে ভেজাল। আমার পিতা বলেন, সব জিনিসই তো ভেজালযুক্ত। তাহলে কি আটায় ভেজাল থাকার কারণে একথা বলে আটা খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে যে, ভাই! আটা তো খাঁটিটা পাওয়া যাচ্ছে না; তাই চলো আজ থেকে আটা খাওয়া বন্ধ করে দিই। এখন থেকে ভূসি খাব অথবা ঘি তো খাঁটি পাওয়া যাচ্ছে না, তাই চলো আজ থেকে ঘি খাওয়া বন্ধ করে দেই এবং ঘি এর পরিবর্তে মাটির তেল ব্যবহার করব। নকলের সংমিশ্রাণ থাকা সত্ত্বেও কেউই তো আটা খাওয়া ছাড়েনি, ঘি খাওয়া ছাড়েনি। বরং খোঁজ নিতে থাকে যে, কোন বস্তিতে ভালো ঘি পাওয়া যায়, কোন দোকানে ভাল আটা পাওয়া যায়; লোক পাঠিয়ে সেখান থেকে কিনে নিয়ে আসে। মিষ্টি কোন দোকানে ভাল তৈয়ার করে, সেখানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে ভালটা বের করে নিয়ে আসে এবং তা খায়।

তিনি বলেন, নিঃসন্দেহে আটা, ঘি, চিনি কোনটাই ভেজালমু্ক্ত পাওয়া যায় না। কিন্তু তালাশকারী তো আজও পাওয়া যায়। এমনিভাবে মৌলভী তো খাঁটি পাওয়া যায় না কিন্তু তালাশকারী তো আজও পাওয়া যায়। যদি কোন বান্দা তালাশ করতে থাকে, অনুসন্ধান চালিয়ে যায়, তাহলে আজও ভাল আল্লাহওয়ালা পাওয়া যাবে। একথা বলা শয়তানের ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই নয় যে, বর্তমান যুগে সাদেকীন শেষ হয়ে গেছে। আরে ভাই! যখন আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন যে, তোমরা সত্যবাদীদের সংশ্রব অবলম্বন কর। এ হুকুম কি তাহলে শুধু সাহাবেদের যুগের সাথে নির্দিষ্ট ছিল যে, সাহাবারাই এর উপর আমল করতে পারবেন; বিংশ শতাব্দীর মানুষ এ আয়াতের উপর আমল করতে পারেন না?

বাহ্যত কুরআনুল কারীমের প্রত্যেকটা হুকুমের উপর কিয়ামত পর্যন্ত যতদিন পর্যন্ত দুনিয়াতে মুসলমান থাকবে আমল চলতে থাকবে। তাহলে এই অর্থ বের করে নিতে হবে যে, সত্যবাদী এখন পর্যন্ত বিদ্যমান আছে। হ্যাঁ, প্রয়োজন তালাশ করার। এমনটি নয় যে, আল্লাহওয়ালা পাওয়া যাচ্ছে না তাই বলে বসে থাকলাম। খোঁজ নেবে, অনুসন্ধান চালিয়ে যাবে তো পেয়ে যাবে।(ইসলাম আওর হামারী যিন্দেগী)

হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কামেল পীরের দশটি আলামতের কথা লিখেছেনঃ

১) যার মধ্যে আবশ্যক পরিমান দীনের ইলম আছে।

২) যিনি আকায়েদ, আমাল এবং আখলাকের ক্ষেত্রে শরীয়তের পরিপূর্ণ অনুসরণ করনে।

৩) যার মধ্যে পার্থিব লোভ-লালসা নেই, অর্থাৎ টাকা-পয়সার সম্মানের, সুখ্যাতির, প্রতিষ্ঠার, নেতৃত্বের বা কর্তৃত্বের লোভ নেই। যিনি নিজেকে ‘কামেল’ বলে দাবি করেন না। কারণ এ দাবিটাও দুনিয়াবি লালসার অর্ন্তুভূক্ত।

৪) যিনি কোনো কামেল পীরের সোহবতে বেশ কিছু সময় কাটিয়েছেন।

৫) যাকে সমসাময়িক আমানতদার, ভারসাম্যপূর্ণ ও বিচক্ষণ উলামায়ে কেরাম, পীর মাশায়েখ ‘কামেল’ মনে করেন।

৬)  যার প্রতি সাধারণ জনগণের চেয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অর্থাৎ ঈমানদার বুদ্ধিমান ও দ্বীনের সমঝাদার লোকেরা বেশি আকৃষ্ট হন।

৭) যার মুরীদের মধ্যে শরীয়তের হুকুম-আহকামের অনুসরণ এবং দুনিয়াবি লোভ-লালসা পরিত্যাগের  বিচারে অধিকাংশের অবস্থা ভালো পাওয়া যায়।

৮) অবস্থার প্রতি যত্ন ও মমতার দৃষ্টি রেখে তাদের সংশোধনের উদ্দেশ্য তা’লীম ও তালকীন করতে থাকেন। এবং তাদের কোনো বড় ধরনের দোষ-ত্রুটির কথা শুনলে বা দেখলে সেটা দূর করতে এবং সংশোধন করতে থাকনে। মুরিদদের আপন আপন স্বাধীন মর্জির উপর চলতে দেন না।

৯) যার সোহবতে কিছুদিন থাকলে দুনিয়ার আকর্ষণ কমে এবং আল্লাহর ভালোবাসা বাড়ে।

১০) নিজেও তিনি রীতিমতো যিকির ও শোগল করে থাকেন। নিজে আমল না করলে অথবা আমলের সংকল্প না থাকলে তার তা’লীম ও তালকীনের মধ্যে বরকত হয় না।(কসদুস সাবীল)

 

ইলমে তাসাউফের ঐতিহাসিক গুরুত্ব

রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অর্বিভাবের পূর্বে গোটা আরব জাযীরা যেন ছিলো শিকারীর জালে ঘেরা। কেউ জানে না, কখন কে কোথায় খুন হবে, কিংবা হবে লুণ্ঠনের শিকার। নির্জন মরুভূমিতে চলমান কাফেলায় আপন দলবলের মাঝখান থেকে যেন বাজপাখীর মত ছোঁ মের তুলে নেয়া হতো জ্যান্ত মানুষকে। পুরো শাসন-ব্যবস্থায় ছিলো নির্যাতন-নিপীড়ন ও শোষণ-লুণ্ঠনের আধিপত্য। শাসক, কর্তা ও কর্মকর্তা সবাই যেন জোট বেঁধেছিল দুষ্কৃতি, দুর্নীতি ও আত্মসাতের উপর। যেন এক উন্মত্ত প্রতিযোগিতা ছিলো যে, মানুষের জান-মাল ও ইযযত-আবরুর উপর কে কত ‘হাতসাফ’ করতে পারে। সমাজের সামনে তারা ছিলো যাবতীয় অন্যায় ও দুষ্কর্মের নিকৃষ্টতম উদাহরণ। সম্প্রদায়ের নিকৃষ্টতম লোকেরা ছিলো সমাজের ‘মাথা ও ব্যথা’। তাদের পশু ও কুকুরের তো উপদরপুর্তির ব্যবস্থা ছিলো, কিন্তু প্রজাদের ছিলো না ক্ষুধার অন্ন। তাদের প্রাসাদে ছিলো মূল্যবান গালিচা ও দামী পর্দা, অথচ প্রজাদের ঘরে ছিলো না স্ত্রী-কন্যার লজ্জা ঢাকার আবরণ। গোটা আরব বিশ্বে কন্যা সন্তান হলে জীবন্ত কবর দেওয়া হত। কখনো বা তাদের দেবদেবীর নামে বলি দেওয়া হত। কোন কোন ক্ষেত্রে পিতা তার ঔরসজাত কন্যাকে জীবন্ত কবর দিতে গিয়ে এমন নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিতো যা পড়লে অতি বড় পাষণেরও চোখে পানি আসে।

মানব জাতির এমন এক ভয়াবহ নৈতিক, অবক্ষয়ের যুগে আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন মুক্তির দিশারী ও শান্তির দূত হিসাবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণ করলেন। ছিন্নভিন্ন, বিপর্যস্ত ও বিভিন্ন নিপীড়ন-নির্যাতনের এই ভূখন্ড হঠাৎ ইসলামের সুশীতল বায়ু প্রবাহিত হলো। রসূলে করীম আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখতে পেলেন, গোটা আরব বিনাশ ও ধ্বংস এবং হালাকত ও বরবাদির দোরগোড়ায় চলে গিয়েছে। তিনি হাত ধরে সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করলেন এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তাদের নতুন জীবন দান করলেন। নূর দান করলেন, যার উজ্জ্বলতায় তারা মানবসমাজে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারে। তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিলেন এবং তাযকিয়া ও আত্মসংশোধনের দীক্ষা দিলেন। আল্লাহর নবীর নূরানী ছেহাবত ও জ্যোতির্ময় সাহচর্য এবং হাকীমানা তরবিয়াত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ দীক্ষার গুণে ধ্বংসের প্রান্তে উপনীত এই জাতির মধ্যে এক বিপ্লব সৃষ্টি হলো। তাঁদের চিন্তা-চেতনা, মন-মানস ও স্বভাব-চরিত্রে এক অভাবিতপূর্ব বিপ্লব সাধিত হল যা ধৈর্য, সাহস ও শৌর্য, ত্যাগ ও আত্মত্যাগ এবং উন্নত চরিত্র ও নৈতিকতার এমন গৌরবময় দৃষ্টান্ত স্থাপন করল, নীতি ও নৈতিকতার ইতিহাসে সত্যি যার কোন তুলনা নেই। যে আওস ও খাযরাজ ছিলো পরস্পরের চিরশত্রু, একে অন্যের রক্তের পিপাসু। বু’আছ যুদ্ধের ধুলিমাখা পোশাক তখনো ছিলো তাঁদের দেহে; তখনো ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে তাঁদের তলোয়ার থেকে। এমন প্রতিহিংসার পরিবেশেও ইসলাম তাঁদের অন্তরে সৃষ্টি করেছিলো প্রীতি ও সম্প্রতির সুমধুর বন্ধন। ফলে এমনভাবে তাঁরা বুকে বুক মিলালেন, যেন যুদ্ধের মাঠে কখনো তাদের মুখোমুখি হয়নি।

অল্প সময়ের মধ্যেই এমন সব ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হলো, যারা সত্যিকার অর্থেই ছিলেন ইতিহাসের মহাবিস্ময় এবং মানবতার অমূল্য সম্পদ।

ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু, যিনি পিতা খাত্তাবের বকরিপাল চরাতেন, আর ‘অকর্মন্য, অপদার্থ’ ইত্যাদি তিরস্কার শুনতেন, শক্তি, মর্যাদা ও আভিজাত্যে যিনি কোরায়শের মধ্যস্তরের ছিলেন; সমাজে ও সমবয়সীদের মধ্যে যার আলাদা কোন বৈশিষ্ট্য ছিলো না, সেই সাধারণ একজন ওমর হঠাৎ সারা বিশ্বকে আপন প্রতিভা, যোগ্যতা, গুণ ও বৈশিষ্ট্য দ্বারা তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।

সালমান ফারসী, যিনি ছিলেন পারস্যের কোন বস্তির ধর্মীয় নেতার পুত্র। নিজের এলাকার বাইরে কোন পরিচিতি ছিলো না। তিনি পারস্য থেকে বের হলেন। দাসত্বের পর দাসত্ব এবং বিপদের পর বিপদ বরণ করে অবশেষে মদীনায় এলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন, আর স্বদেশভূমি পারস্যের রাজধানী মাদায়েনের আমীর ও প্রশাসক হলেন! কালকের সাধারণ এক প্রজা, আজ হলেন সর্বোচ্চ ক্ষমাতার অধিকারী শাসক! তার চেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, এমন শাসন-ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তাঁর তাকওয়া ও ধার্মিকতায় এবং নির্মোহতা ও অনাড়ম্বরতায় আসেনি সামান্যতম পরিবর্তন! পারস্যের বিমুগ্ধ মানুষ অবাক হয়ে দেখে, তাদের শাসক ঝুপড়িতে বাস করেন এবং বোঝা মাথায় বাজারে আসা-যাওয়া করেন।

হাবশী দাস বেলাল, যার কোন মূল্য ছিলো না এমনকি বেচাকেনার বাজারেও, গুণ ও যোগ্যতায় এবং সতত্য ও ধার্মিকতায় তিনি এমন উচ্চস্তরে উপনীত হলেন যে, আমীরুল মুমিনীন ওমর ইবনুল খাত্তাব পর্যন্ত তাঁকে বলতেন, সাইয়িদুনা বিলল!

আবু হোযায়ফা রাযিয়াল্লাহু আনহুর আযাদকৃত গোলাম সালিম, আরব জাহিলিয়াতে যার আলাদা কোন পরিচয় ছিলো না, ইসলাম তাকে এমনই অত্যুচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত করলো যে, খলীফা ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে খেলাফতের গুরু দায়িত্ব বহনেরও উপযুক্ত মনে করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আবু হোযায়ফার আযাদকৃত গোলাম সালিম যদি বেঁচে থাকতো, তাকে আমার স্থলবর্তী করে যেতাম।

যায়দ ইবনে হারিছা, যিনি লুণ্ঠিত কাফেলা থেকে দাসবাজারে গিয়ে বিক্রি হয়েছেন, মুতার যুদ্ধে ছিলেন মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি, যেখানে ছিলেন জা’ফর বিন আবু তালিব ও খালিদ ইবনে ওয়ালীদের মত অভিযাত কোরায়শ-বীর; আর তাঁর পুত্র উসামা ছিলেন সেই বাহিনীর প্রধান যাতে ছিলেন আবু বকর ও ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর মত ছাহাবী।

আবু যর, আলমিকদাদ, আবুদ্-দারদা, আম্মার বিন ইয়াসির, মু’আয বিন জাবালও উবাই ইবনে কা’আব- জাহেলী যুগের এই সাধারণ মানুষগুলোর উপর দিয়ে যখন ইসলামের সুরভিত বায়ু প্রবাহিত হলো, তাঁরা হয়ে গেলেন যুহদ ও তাকওয়ার আদর্শ এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার জগতে উজ্জ্বল জ্যেতিষ্ক।

আলী ইবনে আবু তালিব, আয়েশা বিনতে আবু বকর, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, যায়দ ইবনে ছাবিত ও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস-উম্মী নবীর ক্রোড়ে প্রতিপালিত হয়ে এঁরা প্রত্যেকে হয়ে গেলেন মুসলিম উম্মাহর এমন জ্ঞানপ্রদীপ যার আলোতে উদ্ভাসিত হলো সারা বিশ্ব। তাঁদের কলব থেকে প্রবাহিত হলো ইলমের এমন ঝর্ণাধারা এবং তাদের জবান থেকে নিঃসৃত হলো হিকমত ও প্রজ্ঞার এমন অমীয় বাণী, যার তুলনা হতে পারে শুধু যমযমের ঝর্ণাধারা।

তাঁরা এবং অন্যসকল সাহাবা এককথায় তাঁদের পরিচয় হলো, হৃদয়ের দিক থেকে মানবসমাজে পবিত্রমত, ইলম ও প্রজ্ঞার দিক থেকে গভীরতম এবং লৌকিকতার দিক থেকে সহজতম। হক ও ইনসাফের ধারক এবং ন্যায় ও সত্যের বাহক। চরম ক্রোধ ও অসন্তোষের মুহূর্তে এবং শত্রুতা ও বিদ্বেষের চূড়ান্ত মানববীয় দুর্বলতার সময়ও ন্যায় ও সুবিচার থেকে তারা তিলপরিমাণ বিচ্যুত হয়নি এবং প্রতিশোধের পাশবিকতায় গা ভাসিয়ে দেননি। বিজয়াভিযানের বিস্তার ও সভ্যতার ব্যপ্তির পাশাপাশি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতিও ছিল অব্যাহত। তাঁরা যখন কথা বলতেন, যামানা নিশ্চুপ হয়ে তাঁদের কথা শুনতো এবং ইতিহাসের কলম তা লিখে রাখতো।

একদিকে যেমন তাঁরা ছিলেন মসজিদের মাননীয় ইমাম, অন্যদিকে ছিলেন আদালতের মাহামান্য বিচারক। মসজিদে তাঁরা দ্বীন ও ইলম শিক্ষা দিতেন এবং আদালতের বিচারকের আসনে ইনছাফ কায়েম করতেন। একদিকে তাঁরা ছিলেন বাইতুল মালের আমানতদার ও পাহারাদার, অন্যদিকে রণাঙ্গনের যোগ্য সেনাপতি ও কুশলী যুদ্ধ-পরিচালক। এককথায় তাঁদের প্রত্যেকে একই সঙ্গে ছিলেন মুত্তাকী, পরহেযগার ও আল্লাহভীরু ধার্মিক এবং সাহসী মুজাহিদ, ফকীহ মুমতাহিদ, বিজ্ঞ বিচারক, সুদক্ষ শাসক ও কুশলী রাজনীতিক। তাঁদের একই ব্যক্তি ছিলেন দ্বীন ও দুনিয়া এবং ধর্ম ও রাজনীতির ধারক, আর তিনি হলেন খলীফাতুল মুসলিমীন ও আমীরুল মুমিনীন।

জীবন ও সভ্যতা এবং ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ মহাকালের পথে যেভাবে চলছিলো সেভাবেই যদি চলতে থাকতো এবং মানবজাতি যদি সেই মহান জামা’আতের নেতৃত্বেই পরিচালিত হতে থাকতো যাদের উত্থানই হয়েছিলো কল্যাণের পথে মানবসভ্যতার নেতৃত্বদানের জন্য তাহলে মানবজাতির ইতিহাস অবশ্যই এই কলঙ্কিত রূপ থেকে অনেক ভিন্ন হতো যা এখন আমাদের সামনে রয়েছে, যাতে লেখা আছে শুধু মানবতার দুর্ভোগ ও দুর্যোগের মর্মন্তুদ কাহিনী। তখন আমাদের সামনে থাকতো এমন এক সুন্দর সমুজ্জ্বল ইতিহাস যা নিয়ে গোটা মানবজাতি গর্ব করতো এবং যা মানবতার চক্ষু জুড়িয়ে দিতো। কিন্তু তাকদীরের লিখন অন্যকিছু লিখে দিলো এবং স্বয়ং মুসলিম উম্মাহর জীবনেই শুরু হয়ে গেলো অবক্ষয় ও অধঃপতন।

কিন্তু মানবজাতির দুর্ভাগ্য এই যে, খিলাফতে রাশেদার পর ইসলামী উম্মাহর ইমামাতের মহাগুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভার ক্রমে এমন লোকদের দখলে চলে গেলো যারা কোনভাবেই এর যোগ্য ছিলো না এবং এজন্য তাদের যথাযথ প্রস্ত্ততিও ছিলো না। তাদের পূর্ববর্তীগণ, এমনকি তাদের সমকালীন অনেকে যে দ্বীনী তারবিয়াত ও আধ্যাত্মিক দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন তা থেকে তারা ছিল বঞ্চিত এবং আরবদের প্রাচীন গোত্রীয় চিন্তা-চেতনা ও ঝোঁক-প্রবণতা থেকেও তাদের মন-মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলো না। তাদের না ছিল দ্বীন ও শারী’আতের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, আর না তারা ওলামায়ে উম্মতের পৃষ্ঠাপোষকতা গ্রহণ করত। রাজনীতি ও রাজ্যশাসনে তাদের ছিলো একচ্ছত্রক্ষমতা। খেয়াল-খুশিতে, বা  স্বার্থ-সুবিধার তাগাদায় তারা ওলামায়ে উম্মতের পরামর্শ যতটুকু ইচ্ছা গ্রহণ করতো, যতটুকু ইচ্ছে বর্জন করতো। আবার সুযোগ হলে একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নিতো। এমনকি অনেক সময় তাঁদের উপর নির্মম নির্যাতন চালাতো। এভাবে রাজনীতি ও রাজ্যশাসন দ্বীনের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে গিয়েছিলো এবং ইসলামী খিলাফত রোম ও পারস্যের মত নিছক স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্রে পরিণত হয়েছিলো। খলীফা ও তার ফিলাফত তখন যেন ছিলো লাগামহীন অবাধ্য উট। এই অপদার্থ শাসকবর্গ তাদের যাবতীয় আচরণে উচ্চারণে প্রকৃতপক্ষে নিজেদের ভ্রান্ত চিন্তা-চেতনা এবং ভ্রষ্ট রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থারই শুধু প্রতিনিধিত্ব করছিলো; ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ, ইসলামের রাজনীতি ও সমরনীতি এবং ইসলামের সভ্যতা ও শাসনব্যবস্থার খুব কম প্রতিফলনই ছিলো তাদের জীবনে। ফলে ইসলামী সমাজ ও মুসলিম জীবনে জাহিলিয়াত আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো এবং দ্রুত শক্তি বিস্তার করতে লাগলো। গোত্রীয় অহমিকা, খান্দানি পক্ষপাতিত্ব, আত্মীয় তোষণ বা স্বজনপ্রীতি, যা খিলাফতে রাশেদার আমলে ভীষণ দূষণীয় ও অন্যায় কর্ম বলে গণ্য হত, পুররায় প্রশংসনীয় গুণে পরিণত হয়। আর দ্বীন ও দ্বীনিয়াত ভুলে মানুষ ডুবে গেলো ভোগ-বিলাস, খেল-বিনোদন ও খাহেশাতের গলীয গান্দেগিত। চিরস্থায়ী আখেরাতের পরিবর্তে মানুষের তখন লক্ষ্য ছিলো দুনিয়ার ধনদৌলত এবং ক্ষণস্থায়ী যিন্দেগির শানশৌকত। নফস ও নফসানিয়াতের বাজার ছিলো গরম। নাচ-গান এবং সুর ও সুরার মায়ফিল ছিলো জমজমাট। একথায় সমাজের প্রায় সবমানুষ সবকিছু ভুলে সবকিছুতে ডুবে গিয়েছিলো। জীবন ও চরিত্রের এত দূর অধঃপতনের পর এবং অনাচার, পাপাচার ও ভোগ-বিলসের এমন অতলে ডুবে যাওয়ার পর কোন জাতির পক্ষে আর যাই হোক, ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করা এবং নবুয়তের স্থলবর্তী হয়ে আল্লাহ ও আখেরাতের পথে দাওয়াত দেয়া এবং তাকওয়া ও তাহারাতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা এবং জীবন চরিত্রে মানুষের জন্য আদর্শ হওয়া কিছুতেই সম্ভব ছিলনা।

এর ফলে ইসলামের মযবূত দেয়লে এমন এমন ফাটল দেখা দিলো, যা আর বন্ধ করা সম্ভব হয়নি এবং ইসলামী উম্মাহর জীবন এমন বিচ্যুতি ও বিকৃতি ঘটলো এবং একের পর এক এমন সব ফিতনা ও দুর্যোগ ধেয়ে আসতে লাগলো যা রোধ করা কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি।

পরিস্থিতি যখন এমন গুরুতর অবস্থা ধারন করল, তখন ওলামায়ে উম্মতের কেউ হুকুমতের প্রকাশ্য বিরোধিতায় অবর্তীণ হতেন এবং কখনো বিদ্রোহ ঘোষণা করতেন। কেউবা সংশোধনের চেষ্টায় কখনো কঠোর কখনো কোমল ভাষায় তিরস্কার করতেন এবং উপদেশ দিতেন। তাঁরা সব দেখতেন, শুনতেন, আর নীরবে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতেন; কার্যত তাঁদের করার কিছুই ছিলো না। কেউ কেউ সংশোধনে হতাশ হয়ে সবকিছু থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিলেন। রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছানির্বাসনে গিয়ে তাঁরা আত্মশোধন ও ব্যক্তিসংশোধনের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হলেন। হয়ত তাঁরা এটাই ভেবেছিলেন, এভাবে যদি নিজেকে ও অল্পসংখ্যক অনুযসারীকে দুনিয়ার ফিতনা থেকে বাঁচানো যায়, সেটাও হবে অনেক বড় কামিয়াবি।

ওলামায়ে উম্মত, যাদের দায়িত্বই হলো উম্মাহর দ্বীনী তত্ত্বাবধান, আল্লাহ তাঁদের দান করেছেন পর্বতের অবিচলতা এবং সিংহের সাহস, উম্মাহর পতন ও অধঃপতনের যুগেও তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করে গেলেন। যখন ভোগবাদ ও বস্ত্তবাদের সাগর-জোয়ারে মুসলিমবিশ্ব ভেসে যাচ্ছিল তখন ওলামায়ে উম্মত সেই ঝড়বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে ছোট ছোট দ্বীপ-উপদ্বীপ তৈরী করলেন, যেন দ্বীনের অনুসারীরা যেখানে আশ্রয় নিতে এবং ঈমান ও বিশ্বাসের শেষ সম্বলটুকু রক্ষা করতে পারে।

দ্বীনের ধারক, বাহক ও রক্ষক এই মহান ব্যক্তিগণ যেন অন্ধকার সমুদ্রে ছিলেন আলোর মিনার। মানুষকে তারা জড়বাদ ও বস্ত্তবাদের ঘূর্ণাবর্ত থেকে উদ্ধার করে আনতেন এবং দ্বীনী তারবিয়াত ও আধ্যাত্মিক সংশোধন দ্বারা তাদের ঝড়-তুফানের মুকাবেলা করে জীবনের লক্ষ্যে এগিয়ে চলার যোগ্যরূপে গড়ে তুলতেন। পরবর্তী যুগে তাঁরাই ছুফিয়া ও মাশায়েখ নামে অভিহিত হয়েছেন।

বলা যায়, শেষ শতাব্দীগুলোতে এই মহান আধ্যাত্মিক ব্যক্তিগণই ছিলেন মুসলিম সমাজের ধার্মিকতা ও ধর্মানুরাগ পরিমাপের মোটামুটি মানদন্ড। অর্থাৎ তাঁদের প্রতি সাধারণ মুসলিমের ভক্তি-মুহব্বতের গভীরতা থেকেই আমরা ধারণা করতে পারি, তখন মানুষ বস্ত্তবাদিতা ও দুনিয়ামুখিতা হতে কতটা দূরে ছিলো এবং তাদের অন্তরে দ্বীনের তলব ও তড়প কেমন ছিলো।

মুসলিমবিশ্বের সমস্ত কেন্দ্রীয় শহর ও জনপদে এমন কিছু নূরানী ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি ছিলো যারা ভোগবাদিতা ও বস্ত্তবাদিতার ‘অন্ধকার সমুদ্রে’ সত্যি সত্যি ছিলে আলোর মিনার। সেই আধ্যাত্মিক আলোর আকর্ষণে চারদিক থেকে মানুষ পতঙ্গের মত এসে ঝাঁপিয়ে পড়তো। দুনিয়ার দূরদারায এলাকা থেকে বিভিন্ন ভাষা বর্ণ ও গোত্রের মানুষ তাঁদের খানকায় জড়ো হতো। বলা যায়, সেগুলো ছিলো মুসলিম উম্মাহর আন্তর্জাতিক বসতি, যেখানে পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণ সব এলাকার সবগোত্রের মুসলামানদের উপস্থিতি ছিলো। আজকের পরিভাষায় বলা যায়, সুবিস্তৃত মুসলিম জাহান যেন নিজেকে গুটিয়ে এখানে মেলে ধরেছিলো: এটা ছিলো ‘মিনি মুসলিম জাহান’।(মা যা খাসিয়াল আলামু বি-ইনহিতাতিল মুসলিমীন)

তাই আজকে আমরা যদি ইলমে তাসাউফের এই মহান মেহনতকে উপেক্ষা করি বা অস্বিকার কারি, তাহলে আমরা পুরা ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব।

যদিও আজ কারো কারো ‘তাসাওউফ’ শব্দটি শুনা মাত্রই কপালের ভাঁজ পড়ে যায়। এর কারণ হল, এই পরিভাষার প্রতি নানাভাবে তাদের ভীতি জন্মেছে এবং তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে স্বয়ং তথাকথিত সূফীদের সম্পর্কে। যা আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি। কিন্তু মনেরাখতে হবে এরূপ ঘটনা শুধু তাসাওউফের ক্ষেত্রেই ঘটেনি, বরং সকল শাস্ত্র, প্রতিটি ইসলাহী দাওয়াত এবং প্রতিটি নেক কাজের একই দশা। তার ধারক-বাহকদের মাঝে, তার আহ্বায়ক এবং দাবীদারদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল খাঁটি-মেকি, অভিজ্ঞ-অনভিজ্ঞ, পরিপক্ক-অপরিপক্ক, সত্যবাদী-মুনাফেক সব প্রকৃতির মানুষ। এতদসত্বেও কোন তত্ত্বসন্ধানী ব্যক্তি মূল বিষয়টির প্রয়োজনীতা অস্বীকার করতে বা তার বিরোধিতা করতে পারে না।

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সঠিক কথার উপর আমল করারর তৌফিক দান করুন। ———————–(আমিন)—————— লেখক -ড. মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন, বায়োকেমিস্ট, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ

তাসাউফ সম্পর্কে প্রাথমিক চিন্তা-ভাবনা ও অভিজ্ঞতা

মাওলানা মুহাম্মদ মনযুর নুমানী

 

 

১৩৬১ হিজরী সনের শেষে ১৩৬২ হিজরীর শুরুতে আমি এমন একটি অস্বস্তিকর অবস্থার সম্মুখীন হলাম যে, আমার তখন কিছু দিন এমন জায়গায় কাটানোর প্রয়োজন হল, যেখানে আমার মন ও মস্তিষ্ক অস্বস্তিকর চিন্তা-ভাবনা থেকে মু্ক্ত থাকবে এবং আমার হৃদয় শান্তি ও স্বস্তি লাভ করবে। এ উদ্দেশ্যে আমার নির্বাচনের দৃষ্টি সে সময় একজন আল্লাহ ওয়ালা বুযুর্গের খানকাহর প্রতি নিবদ্ধ হল। খানকাহটি লোকালয়ের কোলাহল থেকে দূরে একটি নির্জন জায়গায় অবস্থিত। সেখানের পরিবেশ সবুজ শ্যামল ও মনোরম। মোটকথা আমি সেখানে পৌঁছে গেলাম।

সম্ভবত প্রথম দিন মাগরিব নামাযের পর উক্ত বুযুর্গ খানকাহর প্রাঙ্গনে একটি খাটে বসেছিলেন। আমাকেও স্নেহ করে নিজের সাথে বসালেন। আমার যতটুকু মনে পড়ে, সেখানে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি ছিল না। নিকটেই খানকাহর কয়েকজন দরবেশ ‘নফী-ইসবাত’ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু-এর যিকর করছিলেন। অপর কয়েকজন ‘ইসমে যাত’ (আল্লাহ আল্লাহ)-এর যিকর করছিলেন। এরা সকলেই খুব জোরে জোরে যিকর করছিলেন। পীর সাহেবদের নির্দেশিত বিশেষ পন্থায় কলবের উপর ‘যরব’ লাগাচ্ছিলেন। আল্লাহ পাকের যিকর উচ্চ স্বরে করা এবং বিশেষ পদ্ধতিতে যরব লাগান সে সময় কেবল যে আমার জন্য অপরিচিত ছিল তাই নয়, কিছুটা অসহ্যও ছিল। কাজেই আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। আদব ও সম্মানের সঙ্গে ঐ বুযুর্গকে  বললাম-

‘হযরত! সারা জীবন ইসলাম সম্পর্কে যা পড়াশোনা করেছি এবং কিতাবপত্রে যা পেয়েছি, তা থেকে একথা বুঝেছি যে, প্রকৃত ইসলাম সেটাই যার শিক্ষা মহানবী  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে দিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম থেকে পরবর্তী লোকেরা শিখেছেন। এভাবে বিশুদ্ধ বর্ণনাসূত্রে আমাদের নিকট পৌঁছেছে।

‘এ সকল দরবেশ ছাহেবান যেভাবে উচ্চস্বরে এবং ‘যরব’সহ যিকর করছেন, আমার যতটুকু জানা আছে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে এভাবে যিকর করতে শেখাননি। সাহাবায়ে কেরামও তাবেয়ীদেরকে এভাবে যিকর করাননি। তাবেয়ীগণ পরবর্তীদেরকে এভাবে যিকর করতে বলেননি। এ জন্য যিকরের এই পদ্ধতি সম্পর্কে আমার সংশয় আছে। আমি চাই যে, এ সংশয় যদি কোনো ভুল ধারণার কারণে হয়ে থাকে তাহলে তা যেন দৃঢ় হয়ে যায়।

ঐ বুযুর্গ আমার ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত, আমার প্রশ্নকে একেবারেই এড়িয়ে গিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে বলে উঠলেন-

‘মৌলবী ছাহেব! এ সকল নিরীহ লোক যারা আমার কাছে আসে, অন্য কোনো কাজের যোগ্য নয়। শুধু এ কাজটাই করতে পারে। আর এ জন্য আমিও তাদেরকে এটাই (যিকর) শিখিয়ে দেই। আপনি যে কাজ করেন সেটা অনেক বড় কাজ। আপনি ঐ কাজই করতে থাকুন। আপনি (এদের মতো) যিকর করার চক্করে পড়বেন না।

জানা কথা, এটা আমার প্রশ্নের উত্তর ছিল না। কিন্তু ঐ বুযুর্গ আমার কথার জবাবে এতটুকুই বললেন। আমাকে আর কিছু বলার কিংবা পুনরায় ঐ প্রশ্নের প্রতি তার মনোযোগ আকর্ষণ করার কোনো সুযোগ না দিয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন শ্রেণীর মুসলমানদের সমস্যা ও তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি নতুন আলোচনা শুরু করলেন। এ বিষয়টি আমার জন্যও আকর্ষণীয় ছিল। আমি তার এ ব্যবহার দেখে নিজ থেকে পুনরায় প্রশ্ন উত্থাপন করা সমীচীন মনে করলাম না। এশার নামাযের সময় আমাদের বৈঠক শেষ হল।

পরদিনও মাগরিব নামাযের পর একই অবস্থা হল, যাকেরীন (দরবেশগণ) একই ধরনের অধ্যাবসায় ও মনযোগসহ নিজ নিজ যিকর আরম্ভ করে দিলেন। আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। গতকালের প্রশ্ন আমি তাকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিলাম। কিন্তু ঐ বুযুর্গ আজও কালকের মতো একই পন্থা অবলম্বন করলেন। তিনি আমার কথার প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে ভারতবর্ষের অতীত ও বর্তমানের বিভিন্ন আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা আরম্ভ করলেন। আমার প্রশ্নের উত্তর আজো পেলাম না।

তাঁর এ আচরণে আলহামদুলিল্লাহ আমি এমন কোনো ভুল ধারণার শিকার হইনি যে, আমার প্রশ্নের উত্তর যেহেতু তার কাছে নেই তাই তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন। বরং আমার এই ধারণা হল যে, সম্ভবত আমার প্রশ্নকে কোনো যোগ্য ও আগ্রহী ব্যক্তির প্রশ্ন মনে করা হয়নি। একজন উদ্ধত ও অহংকারী ব্যক্তির (অহেতুক) আপত্তি মনে করা হয়েছে। আমারও যদ্দূর মনে পড়ে, সে সময় এই প্রশ্নের দ্বারা নিজের সংশয় নিরসন উদ্দেশ্য ছিল না; বরং অন্য কিছু উদ্দেশ্য ছিল।

খানকাহর যে কামরায় আমার থাকার ব্যবস্থা ছিল, আমি এশার নামায ও অন্যান্য কাজ থেকে ফারেগ হয়ে সেখানে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে তাসাউফের এ সকল যিকর ও ‘শোগল’ বিশেষ পদ্ধতিকে নিয়ে নিজে নিজেই চিন্তা করতে লাগলাম। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম এবং নিজেই উত্তর দিচ্ছিলাম। আমার এখনো মনে পড়ে যে, মনোজগতের এ প্রশ্নোত্তরের কারণে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আমার ঘুম আসেনি। আমি চাচ্ছিলাম এ সমস্যার ব্যাপারে আমার মন যেন একেবারে সংশয়মু্ক্ত হয়ে যায়। আর এ ব্যাপারে আমার কোনো ভুল ধারণা থকলে সেটাও যেন দূর হয়ে যায়। আর আমার চিন্তা-ভাবনা যদি সঠিক হয়ে থাকে তাহলে আমার মনে যেন এমন শক্তি ও বিশ্বাস অর্জিত হয় যার সাহায্যে আমি পূর্ণ শক্তি দিয়ে এ সকল বিষয়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে পারি এবং একজন হকপন্থীর ভূমিকা পালন করতে পারি।

দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এ চিন্তা-ভাবনায় ডুবে থাকার পর আমার মাথায় একথাটি আসল যে, তাসাউফের এই বিশেষ পদ্ধতির আমল ও ‘শোগল’কে (যেমন, যিকর ও মুরাকাবার ঐ সকল বিশেষ পদ্ধতি যা পীর ছাহেবান মুরীদদেরকে বাতলে থাকেন, যা প্রচলিত রূপে সরাসরি সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়) আমি যে অবৈধ মনে করছি, আমার এ ধারণা যদি সঠিক হয় তাহলে এর অর্থ হবে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রাহ. হযরত শাহ ওয়ালি উল্লাহ রাহ. হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রাহ. হযরত শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ. এবং তাদের পূর্বের ঐ সকল বুযুর্গ যারা এদের মতো এ সকল কাজ করতেন তাদেরকে মুজাদ্দিদ ও সংস্কারক না বলে বিদআতপন্থী এবং বিদআতের প্রচলনকারী বলতে হবে। কেননা এ সকল মনীষী কেবলমাত্র কল্যাণ চিন্তা অথবা সময়ের চাহিদা পূরণ করার জন্য এ সকল বিষয়ে শিথিলতা করেছেন তা নয়; বরং এ সকল বিষয়ের তালীমে তাদের রচিত কিতাবসমূহ পরিপূর্ণ। তারা সারা জীবন তাদের কাছে আগত খোদা প্রেমিক লোকদেরকে এ পদ্ধতিতে যিকর ও শোগল করিয়ে তাদের খোদাপ্রাপ্তির পথ অতিক্রম করিয়েছেন। এ সকল বুযুর্গদের রচিত কিতাব যারা পড়েছেন এবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে যারা অবগত তারা সবাই জানেন যে, এ সকল মহা মনীষীর জীবনের এ দিকটি অন্যান্য দিকের তুলনায় অত্যন্ত প্রবল ও পরিস্ফুট।

এ ভাবনা আসার পর আমার হৃদয় এ সিদ্ধান্তে অতি দ্রুতই উপনীত হল যে, আমার মতো নির্বোধ ও অসম্পূর্ণ ইলমের অধিকারী ব্যক্তি কোনো মাসআলা বুঝার ক্ষেত্রে ভুল করারই সম্ভাবনা বেশি এবং এটাই অধিক যুক্তিযুক্ত। পক্ষান্তরে ইমামে রববানী মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রাহ.,হযরত শাহ ওয়ালি উল্লাহ রাহ. এবং হযরত শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ.-এর মতো ইলমে দ্বীনের ধারক-বাহক আকাবিরের সাথে ভুলের সম্বন্ধ করা নিতান্তই বোকামি। সেটাও আবার এমন বিষয়ে যার সাথে আমার সম্পর্ক অতি সামান্য আর তাদের ছিল এ বিষয়ে জীবনব্যাপী গভীর সম্পর্ক।

যেহেতু আমি তাঁদের কিতাবাদি পড়েছি এবং তাঁদের ব্যক্তিজীবন, ইসলাহী খেদমত ও সংস্কারমূলক অবদান সম্পর্কে অবগত ছিলাম এবং তাঁদের ইলমের গভীরতা, দ্বীনের সঠিক বুঝ এবং আল্লাহ পাকের প্রিয় পাত্র হওয়ার বিষয়গুলো আমার কাছে পূর্ব হতেই স্বীকৃত ছিল তাই নিজ ধারণার বিরুদ্ধে অতি সহজে অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম। আমার অন্তর কোনোভাবেই এ কথা মানতে পারছিল না যে, এ সকল মহা মনীষী তৎকালীন সময়ে দ্বীনী বিষয়ে অধিক অবগত এবং উম্মতের জীবন ও চরিত্রের সংস্কারক হওয়া স্বত্ত্বেও কিছু কুসংস্কার ও বিদআতকে আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভের মাধ্যম মনে করে নিজেরা সমগ্র জীবন তাতে মগ্ন থেকেছেন এবং আল্লাহ পাকের হাজার হাজার বান্দাকে তাতে মগ্ন করেছেন। এটা হতেই পারে না।

নিঃসন্দেহে মুজাদ্দিদগণ নবীদের মতো নিষ্পাপ নন এবং তাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে অহীও আসে না। কিন্তু তাঁরা বিদআতের প্রবর্তক এবং বিদআতের দিকে আহবানকারীও হতে পারেন না। বিশেষত দ্বীনের ঐ শাখায় যাতে তাঁরা অন্যান্য শাখার তুলনায় বেশি মনোনিবেশ করেছেন, যেদিকে মানুষের মনোযোগ বেশি আকর্ষণ করেছেন এবং যার মাধ্যমে মানুষের সংশোধন ও সমাজ সংস্কারের কাজ করেছেন। এ শাখায়ই যদি তাঁরা বিদআত ও বিদআত নয়-এমন বিষয়ে পার্থক্য করতে না পারেন তাহলে অবশ্যই তাঁরা সংশোধনের চেয়ে অধঃপতন এবং হেদায়েতের পরিবর্তে গোমরাহীর কারণ হবেন। মোটকথা, চিন্তার এ পর্যায়ে পৌঁছে আমার মানসিক সংশয় কিছুটা দূর হল এবং আমি এ কথা মেনে নিলাম যে, সম্ভবত এ বিষয়ে বুঝতে আমার ভুল হয়েছে। এখন আমার কর্তব্য, নিজের ভুল চিহ্নিত করা এবং তা সংশোধনের চেষ্টা করা।

রাত অনেক হয়েছিল। এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে আমি ঘুমানোর ইচ্ছা করলাম এবং ঘুমিয়ে পড়লাম।

এ কাহিনী যে বুযুর্গের খানকাহর তার নিয়ম ছিল, প্রতি দিন ফজর নামাযের পর কয়েক মাইল হাঁটতেন। সেদিন হাঁটার সময় আমিও সঙ্গে চললাম। গতরাতে নিজের মনের সাথে বোঝা-পড়া করা ও পরিশেষে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম তাও তাকে খুলে বললাম, যে, ‘আমার মন ও মস্তিষ্ক এ কথা তো মেনে নিয়েছে যে, তাসাউফের এ সকল আমল ও ‘শোগল’ সম্পর্কে এ পর্যন্ত আমি যা বুঝেছিলাম সম্ভবত তা সঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে আমার কোথাও না কোথাও ভুল হচ্ছে। কিন্তু আমি এখনো পর্যন্ত নিজের সে ভুল চিহ্নিত করতে পারিনি। যেহেতু আমার মন ও মানসিকতা ছাত্রসুলভ তাই আমার ইচ্ছে হল, এ রহস্যটিও আমার সামনে উদঘাটিত হোক। আমার মনে এখনো যতটুকু সংশয় আছে তাও দূর হয়ে যাক। সেই বুযুর্গ আমার এ কথা শুনে মুচকি হাসলেন এবং বললেন-

মৌলবী ছাহেব! আপনার হয়তো এই সন্দেহ হচ্ছে যে, এ সকল কর্ম-কান্ড বিদআত। আচ্ছা, আপনি বলুন বিদআতের সংজ্ঞা কী?

আমি বললাম, বিদআতের সংজ্ঞা উলামায়ে কেরাম কয়েকভাবে দিয়েছেন। কিন্তু যেটা সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন মনে হয় সেটা এই সাদাসিধে সংজ্ঞা যে ‘দ্বীনের ব্যাপারে এমন কোনো জিনিস সংযোজন করা যার কোনো দলিল শরীয়তে নেই।’

সে বুযুর্গ বললেন, হ্যাঁ, এটা ঠিক। কিন্তু আপনি এর কী জবাব দিবেন ‘যদি শরীয়তে কোনো জিনিস উদ্দেশ্য হয় এবং শরীয়ত তা পালন করতে নির্দেশ দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটা পালন করাকে আবশ্যক করেন, কিন্তু কালের বিবর্তনে মানুষের অভ্যাস পরিবর্তন হওয়ার ফলে সেটা ঐ পদ্ধতিতে অর্জন করা না যায়; যে পদ্ধতিতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময়ে এবং সাহাবায়ে কেরামের সময়ে অর্জিত হয়েছে। বরং তা অর্জন করার জন্য অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হয় তাহলে কি আপনি ঐ নতুন পন্থা অবলম্বন করাকেও ‘দ্বীনের মধ্যে নবসংযোজন’ এবং ‘বিদআত’ বলবেন? (এরপর তিনি নিজ বক্তব্য আরো স্পষ্ট করার জন্য বললেন) যেমন মনে করুন, দ্বীনী ইলম শিক্ষা করা এবং দ্বীন শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক। ইসলাম এ বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে। আপনি এটাও জানেন যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামের যুগে শুধু সোহবতই (সান্নিধ্য) এ জন্য যথেষ্ট ছিল। শিক্ষা দানের ভিন্ন কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মাদরাসাও ছিল না। কিতাবও ছিল না। কিন্তু পরবর্তী যুগের অবস্থা এমনভাবে বদলে গেছে যে, ইলম শিক্ষার জন্য এখন শুধু সোহবত যথেষ্ট নয়। কিতাব, শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় আল্লাহর বান্দাগণ কিতাব লিখেছেন, মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এরপর হতে দ্বীন শেখা ও শেখানোর সকল কাজ এভাবেই চলছে। যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। তাহলে দ্বীন শেখা ও শেখানোর এই পদ্ধতিগত পরিবর্তনকেও দ্বীনী বিষয়ে নতুন সংযোজন ও ‘বিদআত’ বলা হবে?

আমি বললাম, ‘না, দ্বীনী বিষয়ে নব সংযোজন তো তখন বলা হবে যখন এটাকেই উদ্দেশ্য এবং শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত বিধান হিসেবে পালন করা হবে। কিন্তু যদি দ্বীনী কোনো উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য পুরাতন পদ্ধতি যথেষ্ট না হওয়ার কারণে শরীয়তে বৈধ নতুন কোনো পন্থা অবলম্বন করা হয়, তাহলে সেটা দ্বীনী ব্যাপারে নব সংযোজন বলা যাবে না এবং সেটা বিদআতও হবে না ।

সে বুযুর্গ বললেন, তাসাউফের যে সকল আমল ও ‘শোগল’ সম্পর্কে আপনার বিদআত হওয়ার আশঙ্কা হচ্ছে সেগুলোও এ ধরনেরই। এর মধ্যে কোনোটাকেই আসল উদ্দেশ্য মনে  করে চর্চা করা হয় না; বরং এগুলো শুধু আত্মশুদ্ধি ও আত্মাকে উত্তম গুণে গুণান্বিত করার জন্য (মাধ্যম হিসেবে) করানো হয়। আর এটা (আত্মশুদ্ধি এবং আত্মাকে উত্তম গুণে গুণান্বিত করা) দ্বীনের উদ্দেশ্য এবং শরীয়তের নির্দেশ। যেমন মনে করুন, আল্লাহ পাকের সাথে মুহাববত রাখা, সর্বক্ষণ তাঁকে স্মরণ রাখা, তাঁর সন্তুষ্টির প্রতি খেয়াল রাখা, এ ব্যাপারে সর্বক্ষণ সতর্ক থাকা, কোনো সময় অমনোযোগী না হওয়া-এ অবস্থাটা ধর্মের উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত। কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে বোঝা যায় যে, এটা ছাড়া ঈমান ও ইসলাম পূর্ণ হয় না। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে দ্বীনী তালীমের মতো এ সকল ঈমানী গুণও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সান্নিধ্য থেকেই অর্জিত হত। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় সোহবত থেকে অর্জিত করার ফলে সাহাবায়ে কেরামের সোহবতেও এ রকম প্রভাব ছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে পরিবেশ বিকৃত হওয়ার কারণে এবং মানুষের যোগ্যতা কমে যাওয়ার কারণে এ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য শুধু কামেল লোকদের সোহবত যথেষ্ট মনে করা হয় না। তখন এ বিষয়ের ইমামগণ ঐ সকল গুণ অর্জন করার জন্য বুযুর্গদের সোহবতের সাথে সাথে অধিক পরিমাণে যিকর ও ফিকর সংযোজন করলেন।* অভিজ্ঞতায় এই সংযোজন সার্থক প্রমাণিত হল। তদ্রূপ কোনো কোনো বুযুর্গ সে সময়ের লোকদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তাদের রিপু দমন এবং প্রবৃত্তির অবৈধ চাহিদাকে পরাজিত করে স্বভাবের মধ্যে নম্রতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তাদেরকে বিশেষ বিশেষ ধরনের পরিশ্রম এবং সাধনা (মুজাহাদা) করিয়ে থাকেন। এমনিভাবে যিকর এর ক্রিয়া বৃদ্ধির জন্য স্বভাবের মধ্যে নম্রতা ও একনিষ্ঠতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যরবের এই পন্থা আবিষ্কার করেছেন। এ সবের কোনোটাকেই উদ্দেশ্য এবং শরীয়ত কর্তৃক সুনির্ধারিত এবং আদিষ্ট পন্থা মনে করা হয় না। বরং এ সকল কাজ কেবল চিকিৎসা ও চেষ্টা হিসেবে করা হয়ে থাকে। আর এ জন্যই মূল উদ্দেশ্য (আল্লাহ পাকের সাথে বিশেষ সম্পর্ক ও মুহাববত) অর্জন হয়ে গেলে এ সকল অতিরিক্ত বিষয়গুলো ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। আর এই একই কারণে এ বিষয়ের ইমামগণ নিজ নিজ সময়ের অবস্থা ও অভিজ্ঞতার আলোকে এ সকল জিনিসে (যিকর শোগল, রিয়াযত ও মুজাহাদার) পরিবর্তন-পরিবর্ধন, সংযোজন ও বিয়োজন করে থাকেন এবং এখনো করছেন। যোগ্যতা অনুসারে একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন আমল ও পন্থা বাতলে থাকেন। কেউ কেউ অবশ্য এমন উচ্চ পর্যায়ের যোগ্যতা সম্পন্ন হয়ে থাকেন, যার দরুন তার এ ধরনের যিকর ও শোগল করারই প্রয়োজন হয় না । আল্লাহ পাকের মুহাববত ও নৈকট্য তাদের এমনিই অর্জিত হয়। এর দ্বারা সকলেই এ কথা বুঝতে পারে যে, এই সকল বিষয় কেবল চিকিৎসা ও সহায়ক হিসেবে অবলম্বন করা ও করানো হয়।’

তাঁর এ ব্যাখ্যায় আমার সংশয় তো দূর হল। কিন্তু একই সঙ্গে নতুন এই আগ্রহও জাগ্রত হল যে, তিনি যা বললেন তা নিজে পরীক্ষা করে দেখব। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আত্মিক প্রশান্তি ও বিশ্বাসকে আরো মজবুত করব। কিন্তু আমার সে সময়ের অবস্থা ও ব্যস্ততায় এটা সম্ভব ছিল না যে, আমি এ কাজের জন্য ভিন্নভাবে দীর্ঘ সময় বের করি। এ জন্য আমি তাঁকে সরাসরি সাফ সাফ বললাম যে-

যদি এ সকল যিকর-শোগল ঐ উদ্দেশ্যে (আল্লাহ পাকের মুহাববত ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য) করা হয় এবং এর দ্বারা তা অর্জন করা যায় তাহলে তো আমিও এর মুখাপেক্ষী। কিন্তু আমি তো এ কাজের জন্য বেশি সময় দিতে পারব না। কারণ দ্বীনের যে সকল কাজের সাথে আমার সামান্য সম্পর্ক আছে, তাও আমি ছাড়তে চাই না।

সেই বুযুর্গ বললেন-

তাসাউফ দ্বীনের কাজ ছাড়ানোর জন্য নয়; বরং তাসাউফের মাধ্যমে দ্বীনের কাজে আরো শক্তি সঞ্চার হয় এবং তাতে প্রাণশক্তি আসে। কিন্তু কী বলব, আল্লাহ পাকের ইচ্ছা, যাদেরকে আল্লাহ পাক দ্বীনের কাজের জন্য বানিয়েছেন, তারা এ দিকে মনোযোগ দেন না। অথচ তারা যদি এ দিকে সামান্য মনোযোগ দেন, তাহলে দেখতে পারবেন তাদের কাজে কীরূপ শক্তির সঞ্চার হয়। হযরত খাজা ছাহেব পরবর্তীতে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রাহ., হযরত শাহ ওলীউল্লাহ রাহ., হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রাহ. প্রমুখ বুযুর্গানে দ্বীন আমাদের এ দেশে দ্বীনের যে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন এবং যা কিছু করে দেখিয়েছেন (যার শতাংশ বা সহস্রাংশও বড় বড় সংগঠন ও দল করতে সক্ষম নয়) এ ক্ষেত্রে তাদের ইখলাস এবং হৃদয়ের ঐ আধ্যাত্মিক শক্তির বিশেষ ভূমিকা ছিল, যা তাসাউফের এ পথে অর্জিত হয়েছিল। কিন্তু এখন অবস্থা এই হয়েছে যে, এদিকে শুধু ঐ সকল লোকই আসে যারা শুধু আল্লাহ আল্লাহই করতে জানে। এটাতো আপনিও জানেন যে, আল্লাহ পাক তাঁর বিভিন্ন বান্দার মধ্যে বিভিন্ন মাপের যোগ্যতা রেখেছেন। অযোগ্য লোকেরা কখনও যোগ্য লোকদের (সমান) কাজ করতে পারে না।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

অনুবাদ : মাওলানা হাবীবুর রহমান খান

এলমে তাসাউফের আরকান পরিচিতি

১০ সংখ্যাটি যৌগিক সংখ্যা। ১ এবং শূন্য মিলে ১০ হয়েছে। এই পৃথিবী ১০ দিকের দ্বারা বিন্যস্ত। ঈষাণ, বায়ু, অগ্নি, নৈঋত, পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঊর্ধ্ব ও অধ:।

মহান আল্লাহপাক মানুষকে ১০ দিকেই চলাফেরার অধিকার দিয়েছেন। এই অধিকার মানুষ আত্মশুদ্ধি ও তাসাউকের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। তাসাউফ ও আত্মশুদ্ধির আরকান ১০টি। এগুলোর পরিচিতি এই : ১. তাজরিদুত্ তাওহিদ : অর্থাৎ এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর সঙ্গে কোনো জিনিসের সাদৃশ্য ও অনুরূপ খেয়াল না করা এবং আল্লাহর বেকারত্বের চিন্তা মনে স্থান না দেয়া। ২. ফাহমুছ ছিমায়ি : অর্থাৎ আল্লাহ ও তার রাসুলের কালাম ও দ্বীনের হুকুম-আহকাম এবং দ্বীনের মাসায়েলগুলোর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা এবং আমল করা।

৩. হুছনুল আছরাতি : অর্থাৎ আন্তরিকতার সাথে নেক লোকের সংসর্গে বসা এবং পবিত্রভাবে স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করা।

৪. ইছারুল ইছারে : অর্থাৎ অন্যের মঙ্গল এবং সুবিধাকে নিজের উপর প্রাধান্য দেয়া। এতে করে পর হিতৈষণার ফযিলত লাভ করা সম্ভব হবে।

৫. তরকুল এখতিয়ারে : অর্থাৎ আল্লাপাক বান্দাহকে যে সকল কাজের অধিকার দিয়েছেন এর উপর বিশ্বাস রেখে আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা করত : কাজ কর্ম-সম্পাদন করা।

৬. ছুরয়াতুল ওয়াজদে : অর্থাৎ যে জিনিস ভালো বলে বোধ হবে সে বস্তু হতে নিজের অন্তরকে কখনও খালি না রাখা। যেমন জিকির, তিলাওয়াত, ইবাদত ইত্যাদি। আর যে সকল কাজ ও কথা আল্লাহর তরফ হতে নিষিদ্ধ তা হতে বিরত থাকা।

৭. আল কাশফু আনিল খাওয়াতের : অর্থাৎ মনের মধ্যে যে সকল ধারণা ঘুরপাক খাচ্ছে এগুলোর মধ্যে যে ধারণা আল্লাহর আদেশের অনুক‚ল হবে এর তাঁবেদারী করা এবং যা প্রতিক‚ল হবে, তা পরিত্যাগ করা।

৮. কাছরাতুল আছফার : অর্থাৎ আল্লাহর কুদরতের উদাহরণ পরিদর্শনের জন্য যথাসম্ভব অধিক বার দেশ ভ্রমণ করা।

৯. তরকুল একতেছাব : অর্থাৎ নিজের মনকে তাওয়াক্কুলে মনোনিবেশ করবার জন্য সুন্নাত তরিকার বিপরীতমুখি আয়-উপার্জন পরিহার করা।

১০. তাহারিমুল এদ্দেখার : অর্থাৎ মানুষের মধ্যে সংকট সৃষ্টির লক্ষ্যে ও অধিক মুনাফায় লোভে মাল সম্পদ গুদাম জাত না করা।

বিশ্লেষণ-১ : আসলে তাসাউফের অর্থ হলো- আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিদ্যমান এর উপর মনেপ্রাণে পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা এবং মহান মাবুদের মোশাহাদা বা পর্যবেক্ষণ ও তার জাতপাকের মধ্যে ডুবে যাওয়া। হাদিসে জিব্রাঈলে সুস্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে যে, তাসাউফের উপর আমল করলে এহসানের মর্যাদা হাসিল হয়। উল্লিখিত হাদিসে এহসানের দুটি সংজ্ঞা বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমটি মোশাহাদা বা পর্যবেক্ষণ। দ্বিতীয়টি মোরাকাবাহ বা আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হওয়া। আর মোশাহাদাকেই আইনুল একীন বলা হয়।

বিশ্লেষণ -২ : ঈমান দুই প্রকার। প্রথম ঈমানে তাকলিদী। অর্থাৎ অনুগামী ঈমান। তা হল নিজের মোমেন পিতা-মাতাকে দেখে অনুসন্ধান ও দলিল প্রমাণ ছাড়া ঈমান আনয়ন করা। দ্বিতীয় প্রকার ঈমানে তাহকিকী অর্থাৎ অনুসন্ধানের মাধ্যমে যে ঈমান লাভ করা হয়েছে।

অতঃপর ঈমানে তাহকিকী দুই প্রকার। প্রথম ইছতেদলালী : অর্থাৎ দলিল প্রমাণের মাধ্যমে যে ঈমান গ্রহণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় কাশফী অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা তার উপর ঈমানকে খুলে দিয়েছেন এবং তার অন্তরে ঈমানের আলো ঢেলে দিয়েছেন।

ঈমানে ইছতেদলালীর নির্দিষ্ট সীমা আছে। এই সীমা অতিক্রম করা যাবে না। ইহাকে এলমুল একীন বলে। ঈমানে কাশফীর সমাপ্তি নেই, নির্দিষ্ট কোনো সীমা নেই। এই প্রকারের ঈমান দুই প্রকার।

প্রথমত : তা মোশাহাদা যাকে আইনুল ইয়াকীন বলে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার সিফতে জালাল ও সিফতে রহমত বান্দাহর উপর খুলে যায়, এভাবে যে, সে যেন দেখতেছে। দ্বিতীয়ত : শুহুদে জাতি যাকে হাক্কুল ইয়াকীন বলে। অর্থাৎ আল্লাহ পাকের জাত পাককে যেন ঈমানের চক্ষুতে দেখতেছে। আর একে মোয়ায়েনাও বলে।

 

ইলমে তাসাউফ, তাজকিয়ায়ে নফস এবং চরিত্র গঠন

“ইলমে তাসাওউফ” : “তাজকিয়ায়ে নাফস” : চরিত্র গঠন ▆
মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গের সাথে যেমন ভাবে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত বিধি-বিধান রয়েছে ঠিক তেমনিভাবে মানুষের আত্মার সাথে সম্পৃক্ত বিধি-বিধানও আছে। শারিরীক বিধানের মতোই ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত ও মুস্তাহাব যেমন আছে ঠিক তেমনি আছে হারাম, মাকরূহ। এই আত্মিক জগতের পরিশুদ্ধি কিংবা ইসলাহে কলবের নাম হলো তাযকিয়া।
দ্বীনের এই অংশটি অতীতের কোন এক সময়ে “তাসাওউফ” নামে পরিচিতি পেয়ে গেছে। আবার আমাদের উপমহাদেশে তা প্রসিদ্ধি লাভ করেছে ‘পীর-মুরিদী’ নামে। যে ইলম অভ্যন্তরীণ সৎ গুণাবলীর বিশদ ব্যাখ্যা এবং তা অর্জনের দিক নির্দেশনা দেয়; অন্তরের রোগ সমূহের বিশ্লেষণ এবং তার চিকিৎসা নির্ধারণ করে তারই নাম “ইলমে তাসাউওফ”।
আর সেসব সৎ গুণাবলী অর্জন এবং আত্মিক রোগ মুক্তির জন্যে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও হক্কানী বুযুর্গের চিকিৎসা ও তরবিয়তের অধীনে থাকার নাম ‘পীর-মুরীদী’।
√ তসাওউফের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ
তসাওউফের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ পাকের মহব্বত, আল্লাহর ভয়, ইয়াকিন, ইখলাস, ইস্তিহযার, ইহসান ও আখলাকে হামিদা অর্জন করা। ইসলামে তাই এর গুরুত্ব অনেক বেশি এবং নিঃসন্দেহে ঈমান ও ইসলামের পূর্ণতাও এগুলোর উপর নির্ভরশীল এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লামও অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় উম্মতকে এসব শিখিয়েছেন এবং উৎসাহ দিয়েছেন।
এই তাসাউফ অর্থাৎ ইসলাহে বাতেনকে তথা আত্ম শুদ্ধিকেই কুরআনের ভাষায় তাযকিয়া বলা হয়। আর এই তাযকিয়াকেই আল্লাহ তাআলা সফলতার চাবিকাঠি বলেছেন।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ

ﻗَﺪْ ﺃَﻓْﻠَﺢَ ﻣَﻦ ﺯَﻛَّﺎﻫَﺎ

অর্থাৎ, যে নিজের নফসকে পবিত্র করছে, সেই সফলকাম হয়েছে

ﻭَﻗَﺪْ ﺧَﺎﺏَ ﻣَﻦ ﺩَﺳَّﺎﻫَﺎ

এবং যে নিজেকে কলুষিত করেছে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়েছে।

(সূরা আশ-শামস; আয়াত ৯)
এ তাযকিয়াই আখেরী নবী মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লামের প্রেরণের একটি উদ্দেশ্য।
কুরআনের ভাষায়-

ﻟَﻘَﺪْ ﻣَﻦَّ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟْﻤُﺆْﻣِﻨِﻴﻦَ ﺇِﺫْ ﺑَﻌَﺚَ ﻓِﻴﻬِﻢْ ﺭَﺳُﻮﻟًﺎ ﻣِّﻦْ ﺃَﻧﻔُﺴِﻬِﻢْ ﻳَﺘْﻠُﻮ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﺁﻳَﺎﺗِﻪِ ﻭَﻳُﺰَﻛِّﻴﻬِﻢْ ﻭَﻳُﻌَﻠِّﻤُﻬُﻢُ ﺍﻟْﻜِﺘَﺎﺏَ ﻭَﺍﻟْﺤِﻜْﻤَﺔَ ﻭَﺇِﻥ ﻛَﺎﻧُﻮﺍ ﻣِﻦ ﻗَﺒْﻞُ ﻟَﻔِﻲ ﺿَﻠَﺎﻝٍ ﻣُّﺒِﻴﻦٍ ‏[ ٣ : ١٦٤

অর্থাৎ : আল্লাহ ঈমানদারদের উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছেন। তিনি তাদের জন্য তাঁর আয়াত সমূহ পাঠ করেন। তাদেরকে পরিশোধন (তাযকিয়া) করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও কাজের কথা শিক্ষা দেন। বস্তুতঃ তারা ছিল পূর্ব থেকেই পথভ্রষ্ট। (সূরা আলে ইমরান; আয়াত ১৬৪)
উক্ত আয়াতে (এমনিভাবে সূরা বাকারার ১২৯ নং আয়াতে) থেকে সুস্পষ্ট যে, কালামে পাকের তেলাওয়াত এবং কোরআন ও হিকমত শিক্ষার পাশাপাশি তাযকিয়াও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া অালিহি ওয়াসাল্লামের আগমনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত। আর এ তাযকিয়াই তাসাউফের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

#এখন প্রশ্ন জাগতে পারে তাযকিয়ার জন্যে কেনো কোনো শায়খের প্রয়োজন যেখানে আমাদের সামনে কোরআন ও সুন্নাহ রয়েছে?

উপরের আয়াত থেকেই একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইলম ও কিতাব আত্মশুদ্ধির জন্য যথেষ্ট নয়, বরং এর জন্য জরুরী এমন একজন “মুযাক্কী’ তথা সংশোধনকারীও, যার তরবীয়ত ও তত্বাবধানে এ দৌলত অর্জন করা যেতে পারে। কারণ শুধু নীতি ও দর্শনগত দিক থেকে কোন বিষয় হাছিল হওয়ার দ্বারা আমলের পূর্ণতা (Maturity) অর্জিত হয় না। তাই যতদিন কোন রাহানুমা /রাহবার /মুরব্বী/ বয়:জ্যেষ্ঠ অভিজ্ঞ ব্যক্তির অধীনে থেকে আমলী সংশোধনের মাধ্যমে দ্বীনকে অভ্যাসে পরিণত না করবে ততদিন পর্যন্ত অপূর্ণতা থেকেই যাবে।
সুলূক ও তাসাওউফে একজন কামেল শাইখ বা উস্তাদ কিংবা পীরের কাজ এতটুকু যে, কোরান-হাদিসে যেসব বিধানাবলীর তাত্ত্বিক (থিওরিক্যাল) আলোচনা রয়েছে, তিনি সেগুলোকে আমলের রূপদান এবং অভ্যাসে পরিণত করিয়ে থাকেন অর্থাৎ ব্যবহারিক (প্র্যাকটিক্যাল) শিক্ষা দিয়ে থাকেন।
#কোরআন-হাদিস অনুযায়ী একথা স্পষ্ট যে, মানব জাতির ইসলাহ ও তরবিয়তের জন্য সর্বযুগে দুটি জিনিস প্রয়োজন। তা হলো:

এক- কুরআন ভিত্তিক হেদায়াত।

দুই- তা বুঝা এবং সে মুতাবেক আমল করার যোগ্যতা অর্জনের জন্য শরীয়ত বিশেষজ্ঞ ও আল্লাহ ওয়ালাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ।

একথা শুধু দ্বীনি শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, বরং পৃথিবীর অন্যান্য বিদ্যা (Faculty) এবং শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা পদ্ধতির জন্যও প্রযোজ্য। যেমন : একদিকে থাকবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের নির্ভরযোগ্য পুস্তকাবলী, অন্যদিকে থাকবে বিজ্ঞ ও যোগ্য ব্যক্তিবর্গের তা’লীম ও তরবিয়ত ও দিক নির্দেশনা। তাই সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের অধিকাংশ সময় নববী মজলিসে কাটাতেন। ইসলামি শিক্ষার তরবিয়ত হাতে-কলমে (Practically) গ্রহণ করতেন। এজন্যই পূর্ববর্তীদের মাঝে শুরু থেকেই বুযুর্গদের (Matured) সংশ্রব অবলম্বন এবং তাঁদের নসীহত ও ইসলাহের মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার ধারা চলে আসছে।
#আত্মশুদ্ধি ও আমলী তরবিয়ত এ পথে যতটুকু সম্ভব, শুধু কিতাবের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে তা সম্ভব নয়।

• শাইখুত তা’লীম বা উস্তাদঃ 

দ্বীনী ইলম যে শাইখ (Master) থেকে অর্জন করা হয় তাকে বলে শাইখুত তা’লীম বা উস্তাদ।

• শাইখুত তরবিয়ত তথা পীর বা মুরব্বীঃ

যে শাইখ (Master) হতে তাযকিয়া ও তরবিয়ত অর্জন করা হয় তাঁকে বলা হয় শাইখুত তরবিয়ত তথা পীর বা মুরব্বী।
কখনো এমন হতে পারে যিনি উস্তাদ তার মুরব্বী (Practically Experienced Master) হওয়ার যোগ্যতাও আছে। যাহোক, নফসের ইসলাহ ও সংশোধনের জন্যে, তরবীয়তের জন্যে একজন শাইখ (Master) কিংবা মুরব্বী (Practically Experienced Master) এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। একে ‘পীর-মুরীদী’ বলা হোক কিংবা অন্য কিছু, সেটা মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নয়।
√ সোহবত বা সান্নিধ্য লাভের প্রভাবঃ
সোহবত বা সান্নিধ্য লাভের প্রভাব স্বভাবের উপর অত্যন্ত কার্যকরী হয়। এটি অতি সুস্পষ্ট বিষয়। এজন্যে শরীয়তে নেককার এবং উলামায়ে কেরামের সংসর্গ অবলম্বনের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন-

ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺁﻣَﻨُﻮﺍ ﺍﺗَّﻘُﻮﺍ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻭَﻛُﻮﻧُﻮﺍ ﻣَﻊَ ﺍﻟﺼَّﺎﺩِﻗِﻴﻦَ ‏[ ٩: ١١٩ ]

অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক। (সূরা তাওবা, আয়াত ১১৯)
উপরের আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ তা’আলার ভয় অর্জনের পন্থা বাতলে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহওয়ালা তথা আল্লাহর সত্যিকারের বান্দাদের সান্নিধ্যই মানুষকে পাপমুক্ত শুদ্ধ জীবন যাপনে অভ্যস্ত করে। অতএব আত্মশুদ্ধির সবচেয়ে নিরাপদ ও সহজ পথ হলো সত্যিকার আল্লাহ ওয়ালাদের সান্নিধ্য বা সোহবত।
হাদিসেও আল্লাহ ওয়ালাদের সান্নিধ্যের কথা বলা হয়েছে এবং সাথে সাথে অসৎ সঙ্গ বর্জনের জন্য কঠোরভাবে তাকিদ দেওয়া হয়েছে। ইমাম বায়হাকী (রহ) স্বীয় হাদিস গ্রন্থ ‘শুয়াবুল ঈমান’ এ লিখেনঃ

“স্বতঃসিদ্ধ কথা যে, একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি যখন জ্ঞানীদের সাথে উঠা-বসা করে তখন তার বুদ্ধিমত্তা আরো বৃদ্ধি পায়। একজন আলেম যখন উলামায়ে কেরামের সংস্পর্শে আসে, তখন তার ইলম বৃদ্ধি পায়। এমনি ভাবে একজন পুণ্যবান ও জ্ঞানীদের সোহবতে এলেও তাই হয়। কাজেই সৎ গুণাবলী সম্পন্ন ব্যক্তিদের সোহবতে একজন সৎ চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তির নৈতিকতার উৎকর্ষ সাধন হবে এটাও অনস্বীকার্য।”

(শুয়াবুল ঈমান; ৬/২২৯)
হাদিসে ইরশাদ করা হয়েছেঃ

“পুণ্যবান সঙ্গী এবং অসৎ সঙ্গী যথাক্রমে মেশক বহনকারী এবং হাপরের ফুৎকার দানকারীর ন্যায়।

মেশক বহনকারী হয়ত তোমাকে মেশক প্রদান করবে কিংবা তুমি তার নিকট হতে ক্রয় করবে। তাও না হলে সুগন্ধি তুমি অবশ্যই পাবে। পক্ষান্তরে হাপরের ফুৎকারকারী হয়ত তোমার কাপড় জ্বালাবে, নতুবা দুর্গন্ধতো অবশ্যই পাবে।” [গ্রন্থ সূত্র : সহীহ বুখারী; ২/৮৩০, হাদিস ৫৫৩৪]
আরেক হাদিসে দুর্গন্ধের জায়গায় বলা আছে-

“তার স্ফুলিঙ্গ না লাগলেও ধোঁয়া থেকে রেহাই পাবে না।” [গ্রন্থ সূত্র : সুনানে আবু দাউদ; ২/৬৬৪, হাদিস ৪৮১৯]
অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে-

“তোমাদের সর্বোৎকৃষ্ট সঙ্গী সে, যাকে দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়, যার কথায় ইলম বৃদ্ধি পায়; যার কাজ-কর্ম তোমাদেরকে পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।” [গ্রন্থ সূত্র : আব্দ ইবনে হুমাইদ, আবু ইয়ালা- ইথাফুল খিয়ারা; ৮/১৬৩]
আরেক হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছেঃ

“মুমিন মুমিনের জন্য আয়না”। [গ্রন্থ সূত্র : সুনানে আবু দাউদ; ২/৩১৭, হাদিস ৪৯১৮।]
এ হাদিসের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মুনাভী (রহ) বলেনঃ

“যে ব্যক্তির মধ্যে ঈমানী গুনাবলীর সমন্বয় ঘটে, ইসলামের আদব-শিষ্টাচার পূর্ণতা লাভ করে এবং যার অন্তর সৎ চরিত্রে আলোকিত, যার অন্তকরণ ইহসানের চূড়ায় আরোহণ করে, তিনি লির্মলতায় হন আয়নাতুল্য। মুমিনগণ তাঁর দিকে তাকালে তাঁর স্বচ্ছতায় নিজেদের দোষ গুলো দেখতে পায়। ভেসে উঠে তার সুন্দরতম চরিত্রে নিজেদের অসুভ কার্যকলাপ সমূহ।” [গ্রন্থ সূত্র : ফয়যুল কাদীর; ৬/২৫১-২৫২।]

√ সারকথাঃ-

আত্মশুদ্ধির জন্যে, তাকওয়া অর্জনের লক্ষ্যে নেককার মুত্তাকীদের সোহবত-সংশ্রব অবলম্বনের অপর নাম ‘পীর-মুরিদী’ বা ‘তাসাওউফ’। আর যে শাস্ত্রে কুরআন-হাদিস এবং সলফের (পূর্বসূরীদের) বাণী সমূহের আলোকে আত্মশুদ্ধি বা পীর-মুরীদী সম্পর্কিত নিয়ম কানুন ও তার বিধিবিধানের আলোচনা করা হয় তারই নাম “ইলমে তাসাওউফ”।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

“শুনে রাখ! মানব শরীরে একটি গোশতের টুকরোম আছে, যা ঠিক হয়ে গেলে পুরো শরীর ঠিক হয়ে যায়।

আর তা নষ্ট হয়ে গেলে পুরো শরীরটাই নষ্ট হয়ে যায়। আর শুনে রাখ! সে টুকরোটি হচ্ছে ক্বলব।” [গ্রন্থ সূত্র : সহীহ বুখারীঃ ১/১৩, হাদিস ৫২; সহীহ মুসলিমঃ ২/২৮, হাদিস ৩৯৭৩।]
চিন্তার বিষয় এই যে,

সাইয়্যিদুল আম্বিয়া ইমামুল মুর্সালীন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম পুরো শরীরের আমলের ইসলাহ ও সংশোধনকে অন্তরের ইসলাহ ও সংশোধনের উপর নির্ভরশীল বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
তিনি আরো বলেছেন,

অন্তরের ত্রুটি দেখা দিলে পুরো শরীরের আমলের মাঝে ত্রুটি ও বিপর্যয় দেখা দেয়।
আত্মিক গুণাবলীর মাঝে আছে-

‘ইখলাস, খোদাভীতি, তাওয়াক্কুল, সবর, শোকর, আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্টি, আল্লাহর মহব্বত, বদন্যতা ও নম্রতা ইত্যাদি। পক্ষান্তরে আত্মিক রোগ সমূহের মধ্যে রয়েছে- রিয়া, কপটতা, অহংকার, আত্মগর্ব, হিংসা-বিদ্বেষ, অবৈধ যৌনাচার, কুপ্রবৃত্তি, ধন-সম্পদ ও সম্মানের মোহ, লোভ-লালসা ও কুধারণা ইত্যাদি।
কুরআন হাদিসে অন্তরকে উপরোক্ত গুণাবলীসহ অন্যান্য গুণাবলী দ্বারা অন্তরকে সুসজ্জিত করার জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে, সাথে সাথে উপরোক্ত রোগ সমূহ সহ অন্যান্য রোগ থেকে অন্তরকে পবিত্র রাখার জন্যেও জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে এবং অন্তরকে এসবের সাথে জড়ানোর ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে।
#এখন অনেকেই প্রশ্ন করেন তাসাওউফে আত্মশুদ্ধির জন্য যে বিশেষ ধরণের কাজ গুলো করা হয় সেগুলোর সুস্পষ্ট বিধান তো কোরআন হাদিসে নেই, তাহলে এটা কি বিদায়াত নয়?
তাসাওউফের মূল লক্ষ্য ও উদেশ্য কি তা উপরেই আলোচনা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে তাসাওউফের মাঝে এমন কিছু কাজ করা হয় যেগুলো মাধ্যম বা উপায় বা পন্থা হিসেবে করা হয়।

এসব মাধ্যম গুলোর কোন কোনটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কুরআন হাদিসে বিধৃত হয়েছে। যেমন শরয়ী মুজাহাদা, অধিকতর মৃত্যুর স্মরণ ও নফসের মুহাসাবা (হিসাব নেওয়া) ইত্যাদি। আর কতিপয় মাধ্যম বা পন্থা এমন আছে, যেগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনভাবেই কুরআন হাদিসে বর্ণিত নেই, আবার শরীয়তের কোন দলীলের পরিপন্থীও নয়। বরং হক্কানী মাশায়েখ স্থান-কাল-পরিবেশ এবং মুরীদের বিশেষ অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখে সেগুলোর নির্দেশ (Prescribe) দিয়েছেন। সেগুলো শরীয়তের বিধান হিসেবে নয়, বরং কোন শরয়ী উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য চিকিৎসা স্বরূপ (As prescriptions)। যেমন-যিকিরের সময় বিশেষ পদ্ধতির জবর লাগানো এবং পানাহার অত্যাধিক কমিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। এ গুলোকে শরীয়তের হুকুম বা বিধান মনে করা বা সুন্নাতের মর্যাদা দেওয়া নিতান্তই ভুল এবং এগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি করাও ঠিক নয়। তাছাড়া যিকির ও মুজাহাদার সময় বহু মানুষই অনিচ্ছাধীন বিভিন্ন অবস্থার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। যেমন যিকিরের সময় আলো দেখতে পাওয়া, কোন গায়েবী আওয়াজ শুনা, ভাল স্বপ্ন দেখা এবং ভয়ের আধিক্যে সংজ্ঞাহীন হওয়া ইত্যাদি। এ ধরণের অবস্থা সৃষ্টি হওয়াও শরীয়তের নির্দেশনাবলীর অন্তর্ভুক্ত নয়। এগুলোকে তাসাওউফের উদ্দেশ্য মনে করা এবং সেগুলো সম্পর্কে অতিরঞ্জিত করা আদৌ ঠিক নয়। [গ্রন্থ সূত্র : আল ইতিসাম (আল্লামা শাতেবী রহঃ) : ১/২৬৫-২৬৯, দেওবন্দী গ্রন্থ সূত্র : তারবিয়াতুস সালেক (শাহ ইসমাইল দেহলভী) :১/২৬-৩৪, কামালাতে আশ্রাফিয়াঃ ১৩৫,৩২৪; শরীয়ত ও তরীকত কা আলাযুমঃ ১৬৭-১৬৯, বিস বড়ে মুসলমানঃ ১০০-১০১৪, ইমদাদুল ফাতোয়াঃ ১/১১৬-১১৭।]
কিন্তু বর্তমানে কিছু লোকের তাসাওউফ শব্দটি শুনা মাত্রই কপালের ভাঁজ পড়ে যায়। এর কারণ হল, এ পরিভাষার প্রতি তাদের ভীতি জন্মেছে এবং তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে স্বয়ং তথাকথিত সূফীদের সম্পর্কে। কিন্তু এরূপ ঘটনা শুধু তাসাওউফের ক্ষেত্রেই ঘটেনি, বরং সকল শাস্ত্র, প্রতিটি ইসলাহী দাওয়াত এবং প্রতিটি নেক কাজের একই দশা। তার ধারক-বাহকদের মাঝে, তার আহ্বায়ক এবং দাবীদারদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল খাঁটি-মেকি, অভিজ্ঞ-অনভিজ্ঞ, পরিপক্ক-অপরিপক্ক, সত্যবাদী-মুনাফেক সব প্রকৃতির মানুষ। এতদসত্বেও কোন তত্ত্বসন্ধানী ব্যক্তিই মূল বিষয়টির প্রয়োজনীতা অস্বীকার করতে বা তার বিরোধিতা করতে পারে না। ইসলামের ইতিহাসে এমন কোন যুগ অতিবাহিত হয়নি, যে যুগে তাসাওউফ সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ এবং তাসাওউফের ইমামগণ আসল-নকল, হাকীকত-সূরত, মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও প্রথাকে পৃথক পৃথক বুঝিয়ে দেননি ।
ইমাম গাযালী (রহ), শাইখ আব্দুল কাদের জিলানী (রহ) ও শাইখ শিহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দী (রহ) থেকে নিয়ে মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ), হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (রহ), হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্বী (রহ) প্রমুখ মনীষীরা সবাই মূল দ্বীনী ও আনুষঙ্গিক উভয় বিষয়ে বিস্তারিত ব্যখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছেন।

বিশদ ব্যাখ্যার মাধ্যমে হক-নাহকের পার্থক্য তুলে ধরারা ক্ষেত্রে তাঁরা অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। কঠোর হস্তে ঐ সব রসম-রেওয়াজ খণ্ডন করেছেন, যেগুলো অমুসলিমদের সংশ্রবের মাধ্যমে মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করেছিল।
#এখন সূফিয়া-কিরামের কিছু বাণী দেখুন, তারা কিরূপ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন ইলমে তাসাওউফের সঠিক রুপরেখা প্রদানের জন্যে-
• বিখ্যাত বুযুর্গ সূফীকুল শিরোমণি জুনাইদ বাগদাদী (রহ) বলেন-

“আমাদের এই ইলম (ইলমে তাসাওউফ) কুরআন-হাদিসের সাথেই সম্পৃক্ত (অর্থাৎ, এগুলোর ভিত্তি কোরআন-হাদিস)। সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআনের ইলম অর্জন করেনি এবং হাদিস ও ফিকহের জ্ঞান অর্জন করেনি তাকে আদর্শ বানানো যাবে না।” (গ্রন্থ সূত্র : সিয়ারুল আলামিন নুবালাঃ ১১/১৫৪।)
• শাইখ আব্দুল কাদের জিলানী(রহ) বলেন-

“সকল আউলিয়া কেরাম শুধু কুরআন-হাদিসের (শরীয়তের বিধানাবলী) আহরণ করেন এবং কুরআন হাদিসের যাহের মোতাবেকই আমল করেন।” (গ্রন্থ সূত্র : রুহুল মাআনীঃ ১৬/১৯।)
• ইমামে রাব্বনী মুজাদ্দেদে আলফে সানী (রহ) স্বীয় মাততুবাতে লিখেন-

“স্বীয় যাহেরকে (বাহ্যিক দিক) শরীয়তের যাহের তথা আহকাম দ্বারা এবং বাতেনকে (অভ্যন্তরকে) শরীয়তের বাতেন (আকীদা এবং ইসলাহে নফস সংক্রান্ত বিধানাবলী) দ্বারা সুসজ্জিত রাখুন। কেননা, হাকীকত ও তরীকত দ্বারা শরীয়তেরই হাকীকত ও তরীকত উদ্দেশ্য। এমন নয় যে, শরীয়ত এক জিনিস আর হাকীকত ও তরীকত ভিন্ন আরেক জিনিস। কেননা, এরূপ (ভিন্নতার) ধারণা যিন্দিকী, ইলহাদ ও কুফরী।” (গ্রন্থ সূত্র : ইরশাদে মুজাদ্দেদে আলফে সানীঃ মাকতুবঃ ৫৭।)
• বিখ্যাত বুযুর্গ আবু ইয়াযীদ বিস্তামী (রহ) লোক মুখে যিনি বায়েজিদ বোস্তামী নামে প্রসিদ্ধ তিনি বলেন,

“তোমরা যদি কারো হাতে অলৌকিক কার্যাবলী প্রকাশ পেতে দেখ, এমনকি যদি তাকে আকাশে উড়তেও দেখ, তবু প্রতারিত হয়ো না, যতক্ষণ পর্যন্ত যাচাই করে না দেখবে যে, সে শরীয়তের আদেশ-নিষেধ, শরয়ী সীমা সংরক্ষণ, শরীয়তের পাবন্দী এবং শরীয়তের অনুসরণ অনুকরণে সে কেমন?” (গ্রন্থ সূত্র : সিয়ারু আলামিন নুবালাঃ ১০/৪৮৪।)
• তাসাওউফ শাস্ত্রের ইমাম শাইখ আবু সুলাইমান দারানী (রহ) বলেন-

“প্রায়ই আমার অন্তরে তাসাওউফের কোন ভেদতত্ত উদয় হয়, কিন্তু আমি তা নির্ভরযোগ্য সাক্ষীদ্বয়- কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল-এঁর সাক্ষী ব্যতীত গ্রহণ করি না।” (গ্রন্থ সূত্র : সিয়ারু আলামিন নুবালাঃ ৮/৪৭৩।)
#তাসাওফের নাম করে অনেক ভণ্ড বলে থাকে তারা ইয়াকীনের স্তরে পৌঁছে গেছে, তাই তাদের আর শরীয়তের হুকুম পালন করার প্রয়োজন নেই। দেখুন হক্কানী সূফিগণ তাদের সস্পর্কে কি বলেছেন-
“এক লোক একবার জুনাইদ বাগদাদী (রহ) কে জিজ্ঞেস করেছিল, কেউ কেউ বলে থাকে, আমরা তো পৌঁছে গেছি। এখন আর আমাদের শরীয়তের অনুসরণের প্রয়োজন নেই। তিনি উত্তরে বললেন- “হ্যাঁ, তারা পৌঁছে গেছে। তবে জাহান্নামে।” (গ্রন্থ সূত্র : শরহু হাদিসীল ইলমঃ ১৬, রিসালাতুল মুসতারশিদীনঃ ৮৩ টিকা।)
তিনি একথাও বলেছেন যে,

“এমনটি বলা যিনা-ব্যাভিচার, চুরি ও মদ্যপান অপেক্ষাও নিকৃষ্ট।” (গ্রন্থ সূত্র : মাজমূউ ফাতওয়া ইবনে তাইমিয়াঃ ১১/৪২০।)
এভাবে হক্কানী সূফিগণ বাতীলদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করেছেন। উলামায়ে দেওবন্দের মাওলানা আশরাফ আলী থানভী-এর ভাষায় তাসাওউফ ও পীর-মুরীদীর হাকিকত বা সার সংক্ষেপ শুনুন। তারপর আপনি নিজেই ভেবে দেখুন এতে কোন বিষয়টি আছে যাকে বিদায়াত বা শরীয়ত পরিপন্থী বলা যায়।
• উলামায়ে দেওবন্দের হাকিম হযরত আশ্রাফ আলী থানবী সাহেব বলেনঃ

“তাসাওউফের সারকথা অতি অল্প।

তা হল, যে নেক কাজে অলসতা অনুভব হয়, অলসতার মোকাবেলা করে সে কাজটি সম্পাদন করবেন এবং গুনাহের চাহিদা হলে তা দমন করতঃ গোনাহের কাজ হতে বিরত থাকবেন। যে ব্যক্তি এ পর্যায়ে পৌঁছতে পেরেছে, তার কোন কিছুর প্রয়োজন নেই। কেননা, এতটুকুই আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টিকারী, এটাই তার সংরক্ষক এবং এটাই তাকে উন্নতির পথে অগ্রসর করবে।” (গ্রন্থ সূত্র : ওয়াযুত তাকওয়া-বাসায়েরে হাকীমুল উম্মতঃ ১০৬।)
এই হল তাসাওউফ এবং পীর মুরীদীর মূলকথা, তার আসল অবয়ব। অথচ এ ব্যাপারে উদাসিনতার কারণে, স্পষ্ট ধারণার অভাবে কিছু লোক তাসাওউফ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণায় পতিত হয়েছে এবং তাসাওউফকে বিদায়াত বা শরীয়ত পরিপন্থী বলে আখ্যা দিয়েছে। অথচ সত্যিকারের তাসাওউফের মাঝে শরীয়তের অনুসরণ-অনুকরণ ব্যাতীত অন্য কিছুর সামান্যতম মিশ্রণ পর্যন্ত নেই। তাসাওউফের বর্ণিত হাকিকত (মূলতত্ত্ব) জানার পর বিষয়টি দিবালোকের মত সুস্পষ্ট হয়ে যায়।

তাসাওউফ দ্বীনের কাজ ছাড়ানোর জন্য নয়, বরং তাসাওউফের মাধ্যমে দীনের কাজে আরো শক্তি সঞ্চার হয়, তাতে প্রাণশক্তি আসে।
ইমাম গাযালী(রহ), শাইখ আব্দুল কাদের জিলানী(রহ), হযরত খাজা মুইনুদ্দিন চিশতি(রহ), হযরত শাহাজালাল (রহ), হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ), হযরত শাহ ওয়ালীওল্লাহ (রহ), সৈয়দ আমদ রায় বেরলভী (রহ), আবু বকর ছিদ্দিক ফুরফুরাভী (রহ), হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী (রহ) প্রমুখ বুজুর্গানে দ্বীনের যে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন এবং যা কিছু দেখিয়েছেন [যার শতাংশ বা সহস্রাংশও বড় বড় সংগঠন ও দল করতে সক্ষম নয়] এ ক্ষেত্রে তাদের ইখলাস এবং হৃদয়ের ঐ আধ্যাত্মিক শক্তির বিশেষ ভূমিকা ছিল, যা তাসাওউফের এ পথে অর্জিত হয়েছিল। তাই দীনের দাঈ, আলেমদের এদিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিৎ।
এবার তাসাওউফকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপকারী সে লোকদের মতো উপমহাদেশের এক ব্যক্তির কথা শুনুন যার সাথে সে লোকদের বিশ্বাস অনেকটা মিলে যায়, তিনি হলেন মওদুদী সাহেব। তিনি সূফীবাদের নাম, এর পরিভাষা সমূহ এবং তার রীতি নিয়মের সাথে উপহাস করেছেন। তিনি পূর্ববর্তীগণের পূণ্যময় তাসাউফকে ‘অনৈসলামিক’ বলার দুঃসাহস দেখান নি বটে, কিন্তু তাসাউফকে ব্যাঙ্গ করে লিখেছেন- “কাজেই পানি যেমন হালাল বস্তুও কোন সময় রোগীর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তা নিষিদ্ধ হয়, তেমনই এই আদর্শ (তথা তাসাওউফ) মুবাহ হওয়া সত্ত্বেও তখন এ কারণে অকাট্যরূপে বর্জন যোগ্য হয়ে গিয়েছিল যে, এর পোষাকে মুসলমানদেরকে ‘আফিং’-এর চুমুক লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে নিকটে যেতেই উক্ত দীর্ঘ দিনের পুরাতন রোগীদেরকে পুনরায় সেই ‘চুনাইয়া বেগম’ -এর স্মরণ করিয়ে দেয়, যা তাকে ক্রমশ ক্ষত করতেই থাকে।” (গ্রন্থ সূত্র : মওদুদী সাহেবের রচিত তাজদীদ ও ইহইয়ায়ে দ্বীনঃ ১৩২।)
তারপর মওদুদী সাহেব ইমাম গাযযালী, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী, শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী-দের উপর খড়গহস্ত হয়েছেন “কেনো তারা তাদের সংস্কার কাজের সময় এই “সুফিয়াতের রোগ” এর জীবানু থেকে নিজেদের মুক্ত করলেন না আর শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কেনো মনযোগ দিলেন না।” (গ্রন্থ সূত্র : তাজদীদ ও ইহইয়ায়ে দ্বীন- ৭৮, ৮৬, ১৩১, ১৩৩, ১৩৪।)
যারা তাসাওউফের সমালোচনা করেন, তারা অনেকটা এপথে না এসেই, কিংবা ভাসা ভাসা ধারণার উপর। তাই একজন বুযুর্গ খুব সুন্দর কথা বলেছেনঃ

“ঘরের ভেতরের জিনিস সম্পর্কে পূর্ণ অবগতি তো ঘরে প্রবেশের পরই অর্জন করা যায়।”
এ যেন একটি প্রসিদ্ধ উক্তির বাস্তব উপলব্ধি-

ﻣﻦ ﻟﻢ ﻳﺬﻕ ﺟﻢ ﻳﺪﺭ

অর্থাৎ, যে চেখে দেখেনি সে এর স্বাদ বুঝবে না।

মওদুদী সাহেব তার লেখায় তাসাওউফ সম্পর্কে যা লিখেছেন, তাতে এ ধারণা হয় যে, একটি মেধাবী বালক এমন এক বিষয়ে স্বীয় মতামত ব্যক্ত করেছে, যে বিষয়ে প্রাথমিক ধ্যান-ধারণা লাভের সুযোগ তার হয়নি। তা সত্ত্বেও তার মেধা ধন্যবাদ লাভের যোগ্য। আর তার চিন্তা এরকমই যে, মাথা ব্যাথা হলে পুরো মাথাটাই কেটে ফেলা উচিৎ।
তাসাওউফ সম্পর্কে এত অল্প পরিসরে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব নয়। কারণ এটি একটি জরুরী এবং জটিল বিষয়। একদিকে এটিকে নিয়ে যেমন চলছে ছাড়াছাড়ি আরেক দিকে এটিকে নিয়ে চলছে বাড়াবাড়ি। তাই বিনীত অনুরোধ তাসাওউফ সম্পর্কে ভালভাবে জানার জন্যে কোরআনকে নিজের খেয়াল খুশি মত বুঝতে চাইবেন না। বরং উলামায়ে কিরাম এবং আউলিয়া কিরাম যেভাবে বুঝিয়েছেন সেভাবেই বুঝুন। কারণ যারা নিজেদের মন মত কোরআন বুঝতে চায়, তাদের দ্বারা ইসলামের ক্ষতি ব্যতীত কোন লাভ হয়নি। আর আপনি পীর বলেন, শায়েখ বলেন, আর ওস্তাদ বলেন, যাই বলেন না কেন একথা কেউ অস্বীকার করে নি যে, দ্বীনের পথে চলার জন্য কোন রাহবার প্রয়োজন হয়, তা না হলে নফসের অনুগামী হয়ে এই কোরআন হাদিসকেই কেউ অহংকারের কাজে, বিভেদ সৃষ্টির কাজে, কাউকে ব্যঙ্গ করার কাজে, বিনা লাজে ব্যবহার করতে পারে। তাই এরকম নিজে নিজে কোরআন হাদিস বুঝা থেকে আল্লাহ আমদের রক্ষা করুক। আমিন।
#আর কারো মনে প্রশ্ন উদ্রেক হতে পারে যে, মানুষ দৈহিক পবিত্রতার পর তাসাওউফের শায়খ কিংবা মুরব্বীর সান্নিধ্যে গমন করে আত্মিক পবিত্রতা লাভ করলে, এতসব ঘুষ, খুন, ডাকাতী, চুরিচামারি এ ইগুলো কে করে?

দেখুন, হক্ক ও বাতিলের অস্থিত্ব চিরকালীন। হক্কের তুলনায় বাতিলের সংখ্যা বেশী। অনেকেই এমন রয়েছে যে হক্কের সান্নিধ্যে গমন করে কিন্তু নিজের সংশোধনের জন্য যায় না; যায় দুনিয়া উপার্জনের জন্যে। আর যারা নিজেদের সংশোধন চান তারা দেখে শুনে যাচাই বাছাই করেই তা করে। আর আপনার যদি অসুখ হয় তাহলে আপনি নিশ্চয় কোন হাতুড়ী ডাক্তারের কাছে যাবেন না, অবশ্যই আপনি খুঁজেন কে কত ভাল ডাক্তার। বাকিটা নিজেই বুঝে নিবেন।

√ তাসাওউফে ধ্যানমগ্নতা / মোরাকাবাঃ

তাসাওউফে ধ্যানমগ্নতা সম্পর্কে কখনো অভিযোগ করা হয় যে,

“ধ্যান মগ্নতাতো হিন্দু সাধকও করে। তাযকিয়া করা হবে কোরআন ও হিকমাহর মাধ্যমে। কোন মগ্নতায় ডুবে যাওয়ার মাধ্যমে না”।
দেখুন, কোন হিন্দু সাধক কি তার ধ্যনের মাঝে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ধ্যান করে, আসলেই অভিযোগ কারীদের বুঝ অপূর্ব! হাদিসে কি ধ্যান করতে নিষেধ করা হয়েছে, কোন হাদিস কি তারা দেখাতে পারবে?
বরং হাদিসে তো এমন উল্লেখ আছে, “তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এমন ভাবে কাজ করবে যেন তুমি তাঁকে দেখছো। আর যদি তুমি তাঁকে না দেখো তবে তিনি তো তোমাকে অবশ্যই দেখেন।” (গ্রন্থ সূত্র : সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদিস ১৭৩।)

আর জানা থাকা চাই যে, ধ্যান কখনো আসল উদ্দেশ্য হিসেবে করা হয় না বরং তা মাধ্যম হিসেবে করা হয়। আর সাহাবায়ে কিরাম তো সরাসরি নবীর সান্নিধ্যে ছিলেন এবং তাঁদের ইমানী হালত ও কাইফিয়াত অনেক মজবুত ছিল, তাই তারা নিজেদের বাহ্য অনুভূতি কখনো হারাতেন না, কিন্তু তাবেয়ীদের থেকেই এই বিশেষ মুরাকাবার চালু হয় যাতে আল্লাহর ধ্যান ও মুহাব্বাত অন্তরে পোক্ত হয়ে যায়। এ অবস্থায় তারা অনেকেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন, অনেকে আল্লাহর ভয়ে মারাও গিয়েছেন। এগুলো আমার কথা নয় বরং উয়ালামায়ে কিরামের কথা, যার রেফারেন্স দেয়া সম্ভব। আর উলামায়ে ক্বিরাম নিজেদেরকে সাহাবাদের সমান মনে করেননি যে, তাদের হালত সাহাবীদের মতই হবে। এখন এ যুগে যদি কেউ মনে করে সে সাহাবীদের মাকামে পৌঁছে গেছে তাহলে এক্ষেত্রে কোন মন্তব্য না করাই শ্রেয়।
আর অভিযোগকারীর অভিযোগ তাযকিয়া করার জন্য শুধু কুরআন আর হিকমাই যথেষ্ট, যা সরাসরি কোরআনের সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ এটা আল্লাহর বিধান যে, মানুষের শিক্ষা এবং সংশোধনের জন্য কিতাবুল্লাহ এবং রিজালুল্লাহ (আল্লাহ প্রেমিক মানুষ) উভয়ই প্রয়োজন। তাহলে আল্লাহ শুধু কিতাব পাঠিয়ে দিলেই হতো আর আদেশ দিতেন, নিজে নিজে শিখে নাও আর সংশোধন হয়ে যাও। আর সে আয়াতে (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৬৪)-ই দেখুন কি সুন্দর করে বলা হয়েছে, নবী তাদের কিতাব (কোরআন) ও হিকমাহ শিক্ষা দেন। এখন যদি শুধু কিতাবই যথেষ্ট হতো তাহলে কেন নবীকে শিক্ষা দিতে বলা হলো, তখনকার আরবেরা কি আরবী বুঝতো না, বরং তখন আরবের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকরা বাস করত। তাহলে কেনো কিতাব শিক্ষার জন্য মানুষের (রিজালুল্লাহর) প্রয়োজন হলো।
কিতাব শিক্ষা এবং সংশোধনের জন্য যে শিক্ষক প্রয়োজন তা প্রতি যুগের উলামায়ে কিরাম মেনে চলেছেন, কিন্তু যারা ঘরে বাইরে নিজদের মন মত কোরআন আর হাদিস বুঝতে চেয়েছে তারাই গোমরাহ হয়েছে।

কামেল পীর হওয়ার পূর্ব শর্ত গুলো কি? কি? 💎

🌷হযরত ইমাম মালেক (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি ফিকাহের ইল্ম হাসিল করল। কিন্তু তাসাওউফের ইল্ম শিক্ষা করল না, সে ফাসেক। আর যে ব্যক্তি তাসাওউফের ইল্ম হাসিল করল, কিন্তু ফিকাহের ইল্ম শিক্ষা করল না, সে জিন্দিক। তবে যে ব্যক্তি জাহেরী ও বাতেনী উভয় ইল্ম শিক্ষা করল। সেই সত্যিকারের হক্কানী আলেম।🌹
(মেশকাত শরিফের শরাহ মেরকাত, কাহেরার ১ খ. ৩১৩ পৃ. এবং বাইরুত ২ খ. ৪৭৮ পৃ.)
* হযরত জুনাইদ বোগদাদী (র:)বলেন- তুমি আলেম হয়ে সুফী হও,সুফী হয়ে আলেম হয়োনা
ধ্বংস হয়ে যাবে ।👆

👉*ইলমে ফিকাহ কি ?
ইবাদাত ও
মুআমালাত এর ঈলম

*ইলমে তাছাওউফ কি? 👈
মুহলিকাত ও মুনযিআত

কাযী সানাউল্লাহ পানিপথী (রাঃ) তাফসীরে মাজহারীতে লিখেছেনঃ💞
করণীয় ও বর্জনীয় বাতেনী তথা আধ্যাত্নিক আমলসমুহ যেগুলোকে ইলমে তাসাউফ বলা হয়, সে সম্পর্কিত জ্ঞ্যান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজে আইন বিদ্যার অন্তরভুক্ত। অধুনা ইলমে তাসাউফ বহুবিধ তত্ত্বজ্ঞ্যান, কাশফ, আত্নোপলদ্বিজনিত প্রচুর জ্ঞ্যানসম্ভারে সম্মিলিত রূপ প্ররিগ্রহ করেছে। তবে এই ক্ষেএে ফরজে আইন বলতে কেবল ঐ অংশকে বুঝায়, যে অংশে ফরজ ও ওয়াজিব পর্যায়ে বাতেনী আমলের বিবরণ রয়েছে।
যেমন- বিশুদ্ব আকায়েদ, সবর, শোকর, কানা’আত ইত্যাদি বিশেষ স্তর পর্যন্ত ফরজে আইন। পক্ষান্তরে গর্ব, অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ, কৃপণতা, দুনিয়ার মোহ ইত্যাদি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া। জাগতিক বৃত্তিসমুহ অর্জন করা, হারাম ও বর্জনীয় বিষয়াবলী বর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ। এসল বিষয়ের উপরই হলো ইলমে তাসাউফের মুল ভিত্তি যা ফরজে আইন।

ইসলামি পরিভাষায় তাসাওউফ বলতে অবিনশ্বর আত্মার পরিশুদ্ধি বা তাজকিয়ায়ে নফস এর মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সাধনাকে বুঝায়।
-এদেশের মানুষ সাধারণত ধর্মপরায়ণ । তাদের ধর্ম পরায়ণতার সুযোগ নিয়ে সমাজে বেশ কিছু ব্যবসায়ী পীরের আবির্ভাব ঘটেছে- যাদের ভিতর হক্কানী পীর (যারা আল্লাহর রাস্তায় সঠিক পথ প্রদর্শক)-এর দশটি আলামতের কোন একটিও পাওয়া যায় না ।

মন্ত্রনালয়, খুলনা

** 👉কামেল পীরের বৈশিষ্ট্য: ইমাম গা্জ্জালী (র:) ——————বলেছেন,💖

১, একজন কামেল পীরের বৈশিষ্ট্যগুলোর
মধ্যে প্রথমটি হলো তাঁকে আল্লাহ্ তা’লার নৈকট্যপ্রাপ্ত
বান্দা (কুরবাত) ও রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর নায়েব (প্রতিনিধি),👈
হিসেবে দ্বীনের (ধর্মের) যাহেরী (প্রকাশ্য)
এবং বাতেনী (আধ্যাত্মিক) জ্ঞানে একজন আলেম বা জ্ঞান
বিশারদ হতে হবে। মোট কথা, ইসলামী জ্ঞানের সকল
শাখায় তাঁর অগাধ জ্ঞান থাকতে হবে। তাঁকে আহলে সুন্নাত
ওয়াল জামাতের আকিদা-বিশ্বাস সম্পর্কেও জানতে হবে।

২, দ্বিতীয়তঃ তাঁকে আরেফ বা ভেদের রহস্য
সম্পর্কে জ্ঞানী হতে হবে। তাঁর ইহ্সান
অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে, যেমন মহানবী (দ:)
এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর এবাদত এমনভাবে করো যেন
তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছো, আর যদি না দেখতে পাও
তবে এটি জানো যে তিনি তোমাকে দেখছেন” (আল
হাদীস)। একজন আরেফ তাঁর অন্তরে সাক্ষ্য দেবেন
যে আল্লাহ্ তা’লা তাঁর যাত মোবারক, গুণাবলী ও কর্মে এক ও
অনন্য।

৩, তৃতীয়তঃ কামেল পীর তাঁর পীরের
তত্ত্বাবধানে ইতোমধ্যেই পরিশুদ্ধ। তাঁকে নফস
তথা একগুঁয়ে সত্তার বিভিন্ন স্তর বা পর্যায়, রোগ ও ত্রুটি-
বিচ্যুতি সম্পর্কে ওয়াকেফহাল হতে হবে। শয়তান কোন্
কোন্ পদ্ধতিতে কলব্ বা অন্তরে প্রবেশ
করতে পারে তাও তাঁকে জানতে হবে। তাঁর মুরীদদের
পরিশুদ্ধ করা এবং কামেলিয়াত বা পূর্ণতার পর্যায়ে উন্নীত করার
সকল পদ্ধতিও তাঁর জানা থাকা প্রয়োজন।
অর্থাৎ তারিফ. ছবাব. আলামত. ইলায. এর ইলম থাকতে হবে। যিনি চার ধারার মাছয়ালার মাধ্যমে মুহলিকাত ও মুনজিয়াত এর ইলম শিক্ষা দিবেন।

৪, চতুর্থতঃ তরীকতের
পথে অনুসারীদের পথ দেখানোর ক্ষেত্রে একজন
কামেল পীরের প্রয়োজন তাঁর পীর কেবলার এজাযত
বা অনুমতি।👈

৫, বস্তুতঃ একজন কামেল পীরের বৈশিষ্ট্য ও গুণ
হলো তাঁকে দেখলেই আল্লাহর কথা স্মরণ হবে, তাঁর
কথাবার্তা শুনলে ঈমান সজীব ও চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

** হযরত বড়পীর (রহ.) পীর বা মুর্শিদের জন্য নিম্নোক্ত পাঁচটি গুণ থাকা অবশ্য কর্তব্য বলে বর্ণনা করেছেন।———
(১) শরীয়তে পরিপূর্ণ জ্ঞানসম্পন্ন আলেম হওয়া।
(২) ই’লমে হাকীকত সম্পর্কে পূর্ণজ্ঞান থাকা।
(৩) সাক্ষাত্ প্রার্থীর সাথে স্নিগ্ধ ও মার্জিত ব্যবহার এবং প্রফুল্ল বদন ও সন্তুষ্টচিত্তে দর্শন দান করা।
(৪) দীন-হীনদের সাথে কথায় ও কাজে নম্রতাপূর্ণ ব্যবহার করা।
(৫) ভক্তবৃন্দের অন্তরের ব্যাধিসমূহ নির্ধারণপূর্বক তা দূরীকরণের উপায় সম্বন্ধে অভিজ্ঞ হওয়া। নিজেকে রিয়া, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, গর্ব-অহমিকা ইত্যাদি থেকে মুক্ত রাখা, কর্তব্যকর্মে শৈথিল্য এবং আরামপ্রিয়তা দূরীভূত করা।

**শায়েখ ও পীর হওয়ার জন্য যে সব শর্ত জরুরী…………..শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী (র:)

(১) পীর হওয়ার জন্য প্রথম শর্ত হল, কোরআন,
হাদীসের আলেম হওয়া। (আল কওলুল জামিল ২০
পৃ.)
(২) পীর হওয়ার জন্য দ্বিতীয় শর্ত হল,
ন্যায়নীতিবান ও খোদাভীরু হওয়া।
কবীরা গোনাহ
থেকে বেঁচে থাকবে এবং ছগীরা গোনাহও
বার-বার করবে না। (আল কওলুল জামিল ২৪ পৃ.)
(৩) পীর হওয়ার জন্য তৃতীয় শর্ত হল,
দুনিয়াত্যাগী ও আখেরাতমুখী হওয়া। যিকির ও
মামূলাত নিয়মিত পালন করা এবং সঠিক
হাদীস দ্বারা প্রমাণিত সুন্নতে মুয়াক্কাদা ও
নফল ইবাদত সময়মত আদায় করা।
অন্তরে সর্বদা আল্লাহ পাকের স্বরণ রাখা।
যাকে ‘ইয়াদ-দাশত’ বলা হয়, তা যেন
অন্ত্মরের স্থায়ী গুণে পরিণত হয়ে যায়। (আল
কওলুল জামিল ২৫ পৃ.)
(৪) পীর হওয়ার জন্য চতুর্থ শর্ত হল, সৎ
কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা।
সঠিক জ্ঞানের অধিকারী হওয়া, কথা ও
কাজে বিশ্বস্ত থাকা। যেন তার আদেশ-
নিষেধের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা যায়।
যেমন আল্লাহ পাক বলেন,
ﻣِﻤَّﻦْ ﺗَﺮْﺿَﻮْﻥَ ﻣِﻦَ
ﺍﻟﺸُّﻬَﺪَﺍﺀ “যে সব সাক্ষীগণের সাক্ষী দেওয়ার
প্রতি তোমরা সন্ত্মুষ্ট থাকো, তাদের
সাক্ষী গ্রহণ করো”। তাহলে পীরের
প্রতি কেমন ধরনের সুধারণা হওয়া উচিত?
কারণ সাক্ষী গ্রহণ করার
ক্ষেত্রে যদি সাক্ষীগণের বিশ্বস্ত্ম হওয়ার
প্রয়োজন হয়, তাহলে পীর হওয়ার জন্য
বিশ্বস্ত্ম হওয়া কত বেশি প্রয়োজন
হওয়া উচিত। (আল কওলুল জামিল ২৫ পৃ.)
সাক্ষী দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি সাক্ষীগণের
বিশ্বস্ত্ম হওয়ার প্রয়োজন হয়, যা পার্থিব
বিষয়। তাহলে ঈমানের সত্যতা প্রমাণ করার
জন্য বাইয়াত গ্রহণকারী পীরের জন্য
মুত্তাকী, পরহেজগার ও বিশ্বস্ত্ম
হওয়া আরো বেশি প্রয়োজন, কারণ তা ঈমানী ও
ইসলাহী বিষয়। আর তার জন্য সুন্নতের অনুসরণ
করাও জরুরী। লোক সমাজে পীরের বিশ্বস্ত্ম
হওয়ার জন্য জাহেরী ও বাতেনী গোনাহ
থেকে বেঁচে থাকা এবং ছগীরা গোনাহ থেকেও
বেঁচে থাকা জরুরী।
(৫) পীর হওয়ার জন্য পঞ্চম শর্ত হল, অনেক
দিন ধরে পীর-মাশায়েখের
সোহবতে থেকে আদব আখলাক শিক্ষা করা।
বাতেনী নূর হাসিল করা এবং ‘সাকিনা’
অর্থাৎ সবর-ধৈর্য ও বিনয়-নম্রতার গুণ অর্জন
করা। কারণ আল্লাহ পাকের নিয়ম হল, কোন
মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত্ম দ্বীন হাসিল
করতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে কোন বুযুর্গ
ব্যক্তির সঙ্গ লাভ
না করবে এবং তাদেরকে দেখে দেখে ভাল
গুণগুলো শিক্ষা না করবে। (আল কওলুল জামিল
২৬ পৃ.)
ফায়দা : এখানে আল্লাহ পাকের নিয়মের
কথা বলা হচ্ছে, সঠিক তরিকায় দ্বীন ও ঈমান
হাসিল করতে হলে, কোন ওলী-মুর্শিদ ও বুযুর্গ
ব্যক্তির
সোহবতে থাকা এবং তাদেরকে দেখে দেখে ভাল
আমল ও ভাল গুণগুলো গ্রহণ করা জরুরী। যেমন
অনেক সাহাবা কেরাম (রা.) কিতাবী ইল্ম
শিক্ষা করার তেমন বেশি সুযোগ পাননি।
কিন্ত্মু তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামের সোহবতে থেকে ও
তাঁকে দেখে দেখে যা কিছু শিক্ষা করেছিলেন
এবং তাঁর যে সুন্নতসমূহ তারা আমলের জন্য
গ্রহণ করেছিলেন, তা তাদের ঈমান-ইসলাম ও
হেদায়েত পাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। যার
সত্যতা প্রমাণের জন্য স্বয়ং রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও
বলেছিলেন, যারাই আমার সাহাবাদের অনুসরণ
করবে তারাই হেদায়েত পাবে।
এমনিভাবে পরবর্তী যুগেও এই একই
নিয়মে দ্বীন হাসিল করার নিয়ম চলে আসছে।
সুতরাং বিকল্প কোন তরিকায় দ্বীন ও ঈমান
পাওয়ার আশা করা নিতান্ত্ম গোমরাহী। যেমন
‘এলাউস সুনান’ নামক কিতাবে বলা হয়েছে,
কোন কামেল শায়েখের হাতে বাইয়াত
হয়ে তার সোহবতে থেকে আখলাক-চরিত্র
সংশোধন করানো ছাড়া বাতেনী ইসলাহ
পাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং যারা মনে করেন,
শুধু মাদরাসায় কিতাবের দরসে বসে ইল্ম
শিক্ষা করার দ্বারা আখলাক-চরিত্র সঠিক
করে নিতে সক্ষম হবে, তারা অনেক
বেশি গোমরাহ।
(এলাউস সুনান ১৮ খ. ৪৫৪ পৃ. হাদীস নং ৬০৬২)

** কামেল পীরের আলামত: ভারত বর্ষের বিখ্যাত পিরে কামিল হাকীমুল উম্মাহ পনর শত কিতাবের মহামান্য লেখক, শাহ মাওলানা আশরাফ আলী দেওবন্দী রহঃ 👈

(১) পীর সাহেব কুরআন, হাদীস মাসলা মাসায়েল সম্পর্কে আলেম হবেন( অর্থাৎ ফিকাহ ও তাসাওউফের জরুরী ইলেমের) । তবে এ ইলমের শেষ মর্তবা ও সব ইলম সম্পর্কে আলেম হওয়ার আবশ্যক।
(২) পীর সাহেব আকীদা-বিশ্বাস ও আমল শরীয়তের মোয়াফেক। স্বভাব চরিত্র ও অন্যান্য গুণাবলী যে রকম শরীয়তে চায় সে রকম হওয়া দরকার।
(৩) পীর সাহেবের মাঝে লোভ টাকা পয়সা, সম্মান, প্রতিপত্তি, যশঃ ও সুখ্যাতির লিপ্সা থাকবে না। নিজে কামেল হওয়ার দাবী করবে না। কেননা, এটাও দুনিয়া মহব্বতেরই অন্তর্ভূক্ত।
(৪) তিনি কোন কামেল পীরের খেদমতে দীর্ঘ দিন থেকেছেন। তাদের থেকে বাতেনী নূর ও শান্তি লাভ করেছেন। তিনি কোন হক্কানী শায়েখ থেকে কামেল হয়েছেন। অর্থাৎ কামেল শায়েখ থেকে এসলাহের ইলম হাসিল করেছেন। কেননা, আল্লাহ পাকের রীতি চলে আসছে যে, কোন ব্যক্তি সফলতা লাভ করতে পারে না যতক্ষণ সফলকামীদেরকে না দেখে। যেমন আলেমগণের খেদমতে থাকা ছাড়া ইলম হাসিল করা। এছাড়া আন্যান্য জ্ঞানের ব্যাপারে একই নিয়ম। তাই এ পথের ভাল মন্দ কোন কামেল শায়েখ থেকে শিখতে হয়।
(৫) সমসাময়ীক পরহেযগার মুত্তাকী আলেমগণ পীরগণ তাকে শায়েখ ও অনুসরণের যোগ্য মনে করবেন।
(৬) দুনিয়াদার ও ফাসেক লোকদের অপেক্ষায় দ্বীনদার লোকেরাই তার প্রতি বেশী ভক্তি রাখে।
(৭) তাঁর মুরীদের মধ্যে অধিকাংশ এ রকম হবে যে, তাদের অধিকাংশ হক্ক ও সঠিক পথে চলে।
(৮) মুরীদদেরকে এ পথের ভাল মন্দ শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে। তিনি মন দিয়ে তার মুরীদদেরকে
আল্লাহরওলী বানানোর চেষ্টা করেন। তাদেরকে নরমে গরমে সংশোধন করেন।
(৯) তার সোহবতে কিছুদিন যাবৎ থাকলে দুনিয়ার মহব্বত কম হয় এবং আখেরাতের চিন্তা বেশী হতে থাকে।
(১০) পীর কামেল তিনি নিজেও রীতিমত যেকের আযকার বিভিন্ন সময়ে হাদীসের বর্ণিত দোয়াগুলো আমলের উপর পাবন্দী করেন। অন্তরকে সর্বদা আল্লাহ পাকের সাথে মিলিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। তিনি নিজে সর্বদা আমলের প্রতি পাবন্দী করেন অন্ততঃপক্ষে আমল করার পাক্কা ইচ্ছা রাখেন।
(কসদুল সাবীল, আশরাফ আলী থানভী.রহ।

মহান আল্লাহ পাক আমাদেরকে ইসলাহে জাহের ও বাতেনের মহা উপকারী ইলম নসিব করুন আমীন। ইয়া রব্বাল আলামীন ।

 

ইরফান ও তাসাউফ

 

ইরফান ও তাসাউফ-বহুল প্রচলিত পরিভাষায় সুফীবাদ,দীনদারী,মুক্তিসন্ধান,খোদাপ্রেম ও মুক্তির সমন্বিত অর্থে তা ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষার অনুপ্রেরণা থেকে উৎসারিত। হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বিশিষ্ট সাহাবী হযরত সালমান ফারসী,হযরত আবু যার গিফারী,হযরত শুহাইব ইবনে সিনান ও হযরত আম্মার দীনদারী ও ইখলাছের জন্য সুপরিচিত এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন। তাঁরা ছিলেন ‘আসহাবে সুফ্ফার’১ অন্যতম। কোন কোন গ্রন্থে হযরত সালমান ফারসী,হযরত উয়াইস কারানী ও হযরত হাসান বাসরীকে সুফী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদে

ইরফান ও তাসাউফ-বহুল প্রচলিত পরিভাষায় সুফীবাদ,দীনদারী,মুক্তিসন্ধান,খোদাপ্রেম ও মুক্তির সমন্বিত অর্থে তা ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষার অনুপ্রেরণা থেকে উৎসারিত। হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বিশিষ্ট সাহাবী হযরত সালমান ফারসী,হযরত আবু যার গিফারী,হযরত শুহাইব ইবনে সিনান ও হযরত আম্মার দীনদারী ও ইখলাছের জন্য সুপরিচিত এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন। তাঁরা ছিলেন ‘আসহাবে সুফ্ফার’১ অন্যতম। কোন কোন গ্রন্থে হযরত সালমান ফারসী,হযরত উয়াইস কারানী ও হযরত হাসান বাসরীকে সুফী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের প্রতি অনেকে আধ্যাত্মিক পূর্ণতা (কামালিয়াত) ও বিভিন্ন ধরনের গুণাবলী আরোপ করে থাকেন।

উমাইয়্যা শাসনামলে স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক ও দুনিয়াপূজারী শাসকরা ইসলামের সঠিক শিক্ষাকে নির্বাসিত করে। এ সময় বিরাজমান পরিস্থিতির ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে একদল খাঁটি মুসলমান নিজেদেরকে পার্থিব বিষয়াদি থেকে দূরে সরিয়ে নেন এবং ধর্ম-কর্ম ও ইবাদত বন্দেগীতে আত্মনিয়োগ করেন। ইবনে খালদুনের মতে,পরবর্তীকালে এ গোষ্ঠী ‘সুফীয়াহ্’ (صوفیة) নামে পরিচিত হন।

অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন যে,অনারব জনগণের ওপর (যাদের বেশিরভাগই ছিল ইরানী) আরবদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ‘শুয়ূবিয়্যাহ্ আন্দোলন’২ থেকেই সুফীবাদের জন্ম হয়।

কেউ কেউ বলেন,‘সুফী’ শব্দটির মূল হচ্ছে ‘সুফ্’ যার মানে ‘পশম’;সুফীরা আত্মিক পূর্ণতায় উপনীত হবার লক্ষ্যে নিজেদেরকে শারীরিকভাবে কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে মোটা পশমের তৈরি পোশাক পরিধান করতেন বলে তাঁদেরকে ‘সুফী’ বলা হতো।

সর্বপ্রথম যে গ্রন্থে ‘সুফীয়্যাহ্’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় তা হচ্ছে আল-জাহেয৩ লিখিত ‘আল বায়ান্ ওয়াত্ তিবয়ীন’। সর্বপ্রথম যে ব্যক্তির জন্য ‘সুফী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় তিনি হলেন আবু হাশেম সুফী৪;তিনি ছিলেন সুফিয়ান সাওরী (মৃত্যু ১৬১ হি.) ও ইবরাহীম আদহাম বালখী (মৃত্যু ১৬২ হি.)-এর সমসাময়িক।

সুফীবাদের উৎপত্তি

আত্মসংশোধন,আত্মসংযম,আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সত্যের উদ্ঘাটন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের ওপর নির্ভরশীলতা এ ক’টি ধারণার ওপর সুফীবাদ প্রতিষ্ঠিত। এ সবের মাধ্যমে সাধকের হৃদয় সকল প্রকার পঙ্কিলতা থেকে পরিশুদ্ধ হয় এবং তাজাল্লীর মাধ্যমে হৃদয়ে আল্লাহর নূরের প্রতিফলন ঘটে। এর ফলে অব্যবহিত যে আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় তা হচ্ছে সাধকের কাছে অদৃশ্য দৃশ্যমান হয় এবং সকল পর্দা অপসারিত হয়।

প্রকৃতপক্ষে মানব জাতির ইতিহাসে প্রাচীনকাল থেকেই সকল ধর্মেই এ ধরনের প্রচেষ্টা ও আধ্যাত্মিক সাধনা লক্ষ্য করা গেছে। তাই কোন বিশেষ যুগে,দেশে ও জাতি বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ আধ্যাত্মিক সাধনা আন্দোলনের ঐতিহাসিক উৎপত্তি অনুসন্ধান করা সম্ভব নয়। তাই কবির এ কথা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য :

“এমন কোন মস্তিষ্ক নেই যাতে খোদার রহস্য নিহিত নেই।”

সূচনায় সুফীবাদ ছিল অত্যন্ত সহজ-সরল একটি আধ্যাত্মিক আবেদন হিসাবে। যাঁরা ধর্মীয় জীবনযাপন করতেন,জনসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতেন এবং আল্লাহ্ তায়ালার জন্য পুরোপুরি উৎসর্গীকৃত ছিলেন তাঁদেরকেই সুফী বলা হতো। তবে কালের প্রবাহে সুফীবাদের সরলতা হারিয়ে যায়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধরনের বিজাতীয় মতাদর্শের সাথে সংমিশ্রণের ফলে,যেমন নিউ প্লেটোনিজম (ঈশ্বর থেকে সৃষ্টির নিষ্পন্ন হওয়ার তত্ত্ব),প্রাচীন খ্রিষ্টীয় মরমীবাদ,পিথাগোরীয়ানবাদ,স্টোয়িসিজম (জেনোর মতবাদ;সুখ-দুঃখের প্রতি ঔদাসীন্য),ইরানের খোসরাভী দর্শন (পাহলাভিয়্যাত)৫,হিন্দু ধর্ম (বেদান্ত দর্শন),বৌদ্ধ ধর্ম,খ্রিষ্টধর্ম এবং তৎকালে প্রচলিত মানীচীয়ান,মাযদী ও মাজিয়ান ধর্মের অনুরূপ মরমী প্রবণতার সংস্পর্শে আসায় সুফীবাদের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়। এর ফলে রহস্যে আবৃত প্রকৃত সত্য ও অবস্থা উদ্ঘাটন (মুকাশাফাহ্),প্রত্যক্ষকরণ (মুশাহাদাহ্),প্রেম ও বিচ্ছেদ ইত্যাদি ধ্যান-ধারণা ভিত্তিক একটি মিশ্র দর্শনের উদ্ভব ঘটে। এ দর্শনের ঝোঁক ও প্রবণতার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহ্ তায়ালার নিরঙ্কুশ একত্ব (তাওহীদে মুতলাক),সত্তা বা অস্তিত্বের একত্ব (ওয়াহ্দাতুল উজুদ),আল্লাহতে আত্মার বিলুপ্তি (ফানাফিল্লাহ্) এবং ঐশী সত্তায় একীভূত হওয়ার মাধ্যমে আল্লাহতে চিরন্তনত্ব লাভ (বাকাবিল্লাহ্)। অতএব,সুফীবাদ কোন সুনিদিষ্ট ধর্ম নয় বা অন্যান্য চিন্তাধারা থেকে স্বতন্ত্রভাবে বিবেচনাযোগ্য কোন চিন্তাধারা বা চৈন্তিক পদ্ধতি নয়। তবে একটি কথা সুস্পষ্টভাবে বলা যেতে পারে যে,সুফীবাদের দাবি অনুযায়ী সুফীবাদের ভিত্তি হচ্ছে খাঁটি তাওহীদ (একত্ববাদ) এবং এ মতবাদ অনুযায়ী যে কারো পক্ষেই আল্লাহ্ তায়ালার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব। তাই বলা হয়েছে :

“আল্লাহ্ অভিমুখী পথের সংখ্যা সৃষ্টি সংখ্যার (মানুষ সংখ্যার) অনুরূপ।”

অন্য কথায় প্রতিটি হৃদয়ই আল্লাহ্ অভিমুখী একেকটি পথ খুলে দেয়। হিজরী তৃতীয় শতকে মুসলিম সমাজে মরমী শিক্ষা প্রবেশ করে। যদিও সুফী মূলত কোরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াত,নবী করীম (সা.)-এর বিভিন্ন হাদীস ও সুন্নাহ্ এবং অন্যান্য ইসলামী ঐতিহ্যগত সূত্র থেকে উৎসারিত হয়েছে,তথাপি বলা যেতে পারে যে,এছাড়াও সেমিটিক৬ তাওহীদবাদ গ্রীক যুক্তিবাদের সাথে পিথাগোরিয়ান ও স্টোয়িক প্রভাব এবং কার্যকারণ তত্ত্ব,অ্যারিস্টটলীয় পরম কারণবাদ ও নিউ প্লেটোনিক সর্বেশ্বরবাদ সুফীবাদী আন্দোলনকে বিশেষ চরিত্র-বৈশিষ্ট্য প্রদানে ভূমিকা পালন করেছে।

আমাদের সালফে সালেহীন সত্যে উপনীত হবার জন্য চারটি পথের কথা ঘোষণা করেছেন। তা হচ্ছে :

১. হিকমাতে মাশশা (অ্যারিস্টটলীয় দর্শন)

২. হিকমাতে ইশরাক (সৃষ্টি হচ্ছে স্রষ্টার তাজাল্লী-এ দর্শন)

৩. ইলমে কালাম (পাণ্ডিত্যমূলক দর্শন) এবং

৪. ইরফান।

১. হিকমাতে মাশশা : হিকমাতে মাশশা বা অ্যারিস্টটলীয় দর্শন হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক দর্শন। এ দর্শন কারণ ও প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল। মুসলিম দার্শনিকগণের মধ্যে এ দর্শনের প্রধান প্রবক্তা ও ব্যাখ্যাকার হলেন আল কিন্দী,ফারাবী ও ইবনে সিনা।

২. হিকমাতে ইশরাক : হিকমাতে ইশরাক বা তাজাল্লী দর্শনের বক্তব্য হচ্ছে এই যে,নিরঙ্কুশ সত্য কেবল মুকাশাফাহ্,শওক (আকর্ষণ),ইশরাক (তাজাল্লী),ইশক (প্রেম) ও রিয়াযাহ্ (আত্মসংযম)-এর মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে। এ দর্শন অনুযায়ী আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাকে অবশ্যই ঈমান ও দীনের আলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হবে,নয়তো শুধু আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা মানুষকে পথ দেখাতে সক্ষম নয়। হিকমাতে মাশশার দার্শনিকদের ন্যায় হিকমাতে ইশরাকের দার্শনিকগণও শরীয়তের খুঁটি-নাটি বিধান অনুসরণকে অপরিহার্য গণ্য করেন না। কিন্তু তাঁরা শরীয়তের মৌলিক বিধানসমূহ অস্বীকার করেন না।

৩. ইলমে কালাম : এ দর্শন অনুযায়ী কেবল বিচারবুদ্ধির সাহায্যে তথা যুক্তিবিজ্ঞানসম্মত যুক্তিতর্কের মাধ্যমেই সত্যে উপনীত হওয়া সম্ভব। এ ধারার দার্শনিকগণ খোদায়ী আহকামের যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা আহকাম বা বিচার-বুদ্ধির মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন এবং প্রতিপক্ষের আপত্তি খণ্ডন করেন। বিখ্যাত কালামশাস্ত্রবিদগণের মধ্যে ছিলেন ওয়াসেল বিন আতা,আল আশআরী,আল বাক্কেলানী,ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী,শাহরিস্তানী,আল্লামা হিল্লী ও খাজা নাসিরুদ্দীন তুসী। তাঁদের সকলেই শারয়ী বিধি-বিধানের কঠোর অনুসারী ছিলেন।

৪. ইরফান বা মরমী দর্শন : ইরফানী দর্শনের ভিত্তি হচ্ছে ইশরাক,ইনকিশাফ (রহস্য উন্মোচিত হওয়া এবং ইনজিযাব (আল্লাহতে বিলীন হওয়া)। আরেফগণ মনে করেন যে,আল্লাহকে পাওয়া এবং জানার জন্য বিচারবুদ্ধি ও যুক্তি যথেষ্ট নয়। তাঁরা ওহী তথা ঐশী গ্রন্থ,নবী-রাসূলগণের বাণী এবং শীর্ষস্থানীয় মুসলিম অলিদের অনুসরণ করেন। প্রকৃত আরেফগণ সর্বদা কোরআনের তেলাওয়াত ও আল্লাহর যিকিরে মশগুল থাকেন। তাঁরা সবসময়ই ধর্মীয় বিধি-বিধান মেনে চলেন।

শরীয়ত,তরীকত ও হাকীকত

শরীয়ত (ধর্মীয় বিধি-বিধান) : শরীয়ত শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পানির উৎস অর্থাৎ যেখান থেকে পানি সংগ্রহ করা হয় তদভিমুখী পথ। কিন্তু পারিভাষিক অর্থে শরীয়ত বলতে বুঝায় মানুষের ইহকালীন জীবনকে কল্যাণময়করণ ও পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে তাদের জন্য আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রদত্ত আদেশ-নিষেধসমূহ যা তিনি তাঁর রাসূলের মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছেন এবং রাসূলের কথা ও কাজের মাধ্যমে তা মানুষকে জ্ঞাত ও বাস্তবায়িত করেছেন। যেহেতু শরীয়ত হচ্ছে আল্লাহর অনুগ্রহের বহিঃপ্রকাশ যা সকল মানুষের জন্যই প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর নবী-রাসূলগণকে পাঠিয়ে সমগ্র মানব জাতিকে উপকৃত ও অনুগ্রহ করেছেন।

‘শারহে গোলশানে রয’ গ্রন্থে প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী শরীয়ত হচ্ছে মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের বিধি-বিধান এবং তা বাইরের আবরণ বা খোলসের কাজ করে। আর কুশাইরী বলেন,‘শরীয়ত অপরিহার্যভাবেই ইসলাম (আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ)-এর সাথে সম্পর্কিত। আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ বা তাঁর দাসত্ব (ইবাদত) করা মানে আল্লাহর একত্বকে মেনে নেয়া,তাঁর নবী-রাসূলগণের নবুওয়াত বা রিসালাতের অনুকূলে সাক্ষ্যদান এবং ইসলামের অনুসরণ। আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর উক্তি অনুযায়ী ইসলাম অর্থ আত্মসমর্পণ যার মানে দাসত্বের দাবি অনুযায়ী কাজ করা।

বাহ্যিক ও গূঢ় দিক : ইসলামের বাহ্যিক ও গূঢ় উভয় দিকই রয়েছে। ইসলামের বাহ্যিক দিক হচ্ছে মৌখিক স্বীকারোক্তি বা বাহ্যত ইসলামের বিধি-বিধানের নিকট আত্মসমর্পণ। অন্যদিকে ইসলামের গূঢ় দিক মৌখিক স্বীকৃতির পাশাপাশি অন্তর থেকে আল্লাহ তায়ালার সাথে নিঃশর্ত সংশ্লিষ্টতা দাবি করে। বস্তুত এ হচ্ছে খাঁটি ঈমান। কারণ প্রকৃতপক্ষে মানুষের হৃদয় ও চেতনাই হচ্ছে আসল সত্তা।

শরীয়তের ভিত্তি হচ্ছে নিরঙ্কুশ সত্যের পরিচয় লাভ যা কেবল আত্মপরিচয়ের মাধ্যমেই সম্ভব। তাই বলা হয়, من عرف نفسه فقد عرف ربّه (যে নিজেকে চিনেছে সে তার রবকে চিনেছে)। একটি হাদীসে কুদসী অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালা বলেন,

كنت كترا مخفيا فاجببت أن أعرف فخلقت الخلق لكي أعرف

“আমি ছিলাম একটি গুপ্ত ধনভাণ্ডার,অতঃপর আমি নিজেকে পরিচিত করাতে চাইলাম,তাই আমি সৃষ্টিকে সৃষ্টি করলাম যাতে আমি পরিচিত হতে পারি।”

আল্লাহ তায়ালা স্বীয় অনুগ্রহবশত সৃষ্টিকর্মের প্রক্রিয়া শুরু করেন এবং এরই ধারাবাহিকতায় স্বীয় গুণ-বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশ প্রদানপূর্বক মানুষকে সৃষ্টি করেন। তিনি মানুষকে ধরণির বুকে তাঁর প্রতিনিধি মনোনীত করেন এবং তার ওপরে আল্লাহ্ তায়ালার পূর্ণ পরিচিতি অবগত হওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করেন। কবি হাফিয বলেন,

“যে আমানতের বোঝা আসমান বহন করতে পারে নি

তার ব্যাপারে ভাগ্য পরীক্ষার লটারীতে আমার মতো পাগলের নাম উঠল।”

আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম সৃষ্টির ইচ্ছা করেন। অতঃপর তিনি তাঁর ঐশী ইচ্ছা দ্বারা সবকিছুকে সৃষ্টি করেন। কেবল ইবাদতের মাধ্যমেই আল্লাহকে পাওয়া যেতে পারে এবং সর্বদা তাঁর স্মরণ অর্জিত হতে পারে। আল্লাহ তায়ালাকে সর্বদা স্মরণ রাখতে হলে সবসময় ইবাদতে অর্থাৎ নামায,রোযা,যাকাত,খুমস্,জিহাদ ইত্যাদিতে মশগুল থাকতে হবে এবং কখনই তাঁর স্মরণ থেকে গাফেল হওয়া চলবে না;এতদসহ সবসময়ই তাঁর পবিত্র নামসমূহ উচ্চারণ করতে হবে।

সুফীবাদের প্রথম পর্যায়ে পূর্ণ মনে-প্রাণে শরীয়তের বিধি-বিধানসমূহ মেনে চলতে হবে। কোন ব্যক্তি যদি শরীয়তের নির্ধারিত দায়িত্ব-কর্তব্য যথাযথভাবে পালন না করে তাহলে তার পক্ষে নিজেকে উচ্চতর স্তরের জন্য প্রস্তুত করা সম্ভব হয় না। ইবনে সিনার মতে,ইবাদত ও আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে আত্মাকে প্রস্তুত হতে হবে যাতে সে নাফসে মুতমায়িন্নাহ্ (প্রশান্ত ব্যক্তিসত্তা) হতে পারে এবং সত্যে উপনীত হবার দিকে এগিয়ে যেতে পারে।

যারা শরীয়তের বিধি-বিধান অনুসরণ করে না তাদের পক্ষে প্রকৃত ইরফানে উপনীত হওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। এ ধরনের লোকেরা নিজেদেরকে আরেফ বলে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা অত্যন্ত অপরিপক্ব,নির্বোধ ও দায়িত্বহীন। একজন সুফী যখন অত্যন্ত সাফল্যের সাথে শরীয়তের স্তর অতিক্রম করেন তখন তিনি তরীকতের স্তরে উপনীত হন এবং আরেফ হিসাবে পরিগণিত হন। কিন্তু যারা শুধু ধর্মের বাহ্যিক রূপ ও দিকসমূহ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকে এবং স্বচ্ছ দৃষ্টির অধিকারী হতে পারে না তারা নিচের স্তরেই পড়ে থাকে। যাদের অন্তঃকরণ সত্যের আলোকে আলোকিত হয় নি এরূপ স্বঘোষিত সুফীরা আত্ম প্রবঞ্চনাকারী মাত্র। এ পথের একজন আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান পথিককে অবশ্যই বিশুদ্ধতা অর্জনের জন্য নির্ধারিত সবগুলো স্তরই অতিক্রম করতে হবে।

তরীকত : বান্দা আল্লাহ তায়ালার ইবাদতের মধ্য দিয়ে নিজেকে পরবর্তী স্তরে উন্নীত করার জন্য প্রস্তুত করে। এ স্তরকে তরীকত বা সুফীর পথ বলা হয়। আল্লাহ তায়ালা কোরআন মজীদে এরশাদ করেন,

وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا

“আর যারা আমাতে চেষ্টা-সাধনা করে তাদেরকে অবশ্যই আমি আমার পথসমূহে পরিচালিত করব।” (সূরা আনকাবুত : ৬৯)

শরীয়তের জন্য অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে আন্তরিকতা ও প্রকৃত ঈমান। যারা এ স্তরে উপনীত হয় তারা আধ্যাত্মিক উন্নতির অভিযাত্রার (সায়র ওয়া সুলূক) জন্য প্রস্তুত হয় এবং আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বিশুদ্ধতা অর্জনে সক্ষম হয়। এ পথে অভিযাত্রার জন্য একজন পথ প্রদর্শকের প্রয়োজন হয়। যেমন কবি বলেন :

“এ পথ খিযিরের সাহচর্য ছাড়া অতিক্রম করো না

কারণ এ পথে আঁধার আছে,

তাই পথচ্যুতির বিপদের ভয় করে।”

শেখ মাহমুদ শাবেস্তারীর মতে,তরীকাত হচ্ছে সত্যের পথে পথচারীর (সালেক) বিশেষ সফর। এতে যে সব কাজ অন্তর্ভুক্ত তা হচ্ছে : দুনিয়া বর্জন,আল্লাহর যিকিরের ওপর স্থিতি (সর্বাবস্থায় যিকির),ঐশী সূত্রে মনোসংযোগ কেন্দ্রীভূতকরণ,নির্জনে অবস্থান,অনবরত আনুষ্ঠানিক শারীরিক পবিত্রতায় থাকা,ওযু,সত্যবাদিতা ও আন্তরিকতা ইত্যাদি।

আল কুরাইশী তাঁর ‘রিসালাতুল কুশাইরিয়াহ্’ তরীকতের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তাতে তিনি বলেন,তরীকত হচ্ছে সর্বাবস্থায় শরীয়তের অনুগামী থাকা এবং শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত দায়িত্ব-কর্তব্যসমূহ যথাযথভাবে পালন করা। এ সব দায়িত্ব-কর্তব্যের মধ্যে রয়েছে নৈতিক পবিত্রতা,উন্নত মানবিক গুণাবলী অর্জন,ওলী আল্লাহর পর্যায়ে উন্নীত হবার জন্য চেষ্টা সাধনা করা ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ্ অনুযায়ী আমল করা এবং আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) ও অন্যান্য ইমামগণ এবং ওলী আল্লাহর আদর্শ-চরিত্র ও আচরণ অনুসরণ করা। তরীকতের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে একজন মানুষকে পূর্ণ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা।

ইবনে সিনার মতে,আধ্যাত্মিক অগ্রগতির প্রথম ধাপ হচ্ছে ব্যক্তির ইচ্ছাকে (ইরাদা) পবিত্রকরণ যা ঈমান থেকে অর্জিত হয়,যে ঈমান ইতিবাচক বা সৎ জীবন-যাপন,নিশ্চিন্ততা ও অন্তরের প্রশান্তির দিকে নিয়ে যায়। যে ব্যক্তি এভাবে ইচ্ছার বিশুদ্ধতা অর্জনের প্রাথমিক পর্যায়ে অগ্রসর হয় তাকে ‘মুরীদ’ (ইচ্ছাকারী) তথা শিষ্য বলা হয়। একজন মুরীদের জন্য সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে এ স্তরে উপনীত হবার জন্য একাগ্রতা ও দৃঢ়তা। এ একাগ্রতা ও দৃঢ়তা তাকে আত্মদমনে অনুপ্রাণিত করে। অর্থাৎ সে তার পাপপ্রবণ নাফসকে (নাফসে আম্মারাহ্) স্বীয় প্রশান্ত নাফস (নাফসে মুত্মায়িন্নাহ্)-এর অনুগত করে নেবে। এ পর্যায়ে উপনীত হবার জন্য একজন শিষ্যকে নিম্নলিখিত তিনটি স্তর অতিক্রম করতে হয় :

১. তাখলিয়াহ্ (تخلية) : এর আভিধানিক অর্থ ‘খালি করা’;পারিভাষিক অর্থে শরীরকে সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করার জন্য নিজেকে প্রবৃত্তির কামনা বাসনা ও ঝোঁকপ্রবণতা থেকে মুক্ত করা।

২. তাহলিয়াহ্ (تحلية) : এর আভিধানিক অর্থ ‘অলঙ্কার দ্বারা সুসজ্জিতকরণ’;পারিভাষিক অর্থ ব্যক্তির নাফসকে উন্নত নৈতিক গুণাবলী দ্বারা ভূষিতকরণ।

৩. তাজলিয়াহ্ (تجلية) : এর আভিধানিক অর্থ ‘আলোকোদ্ভাসিত হওয়া’;পারিভাষিক অর্থ ঐশী সত্তায় নিমজ্জিত হওয়া অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা এক এবং অদ্বিতীয় এবং তিনি ভিন্ন আর কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই-এ সত্যের যথার্থ স্বীকারোক্তির লক্ষ্যে স্বীয় আমিত্বকে পরিত্যাগ করা। আরেফকে এ সব স্তর অতিক্রম করার পর সাতটি উপত্যকা৭ পার হয়ে যেতে হবে। তা হচ্ছে:

১. তালাব (আকাঙ্ক্ষা ও সন্ধান) : এর মানে হচ্ছে মুরীদের মধ্যে না পাওয়ার বেদনা ও প্রতীক্ষার অনুভূতি। তাঁর অন্তর অদৃশ্যজগতের জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষী এবং সর্বত্র প্রিয়তমের সন্ধান করে।

২. ইশক (প্রেম) : এ স্তরে আধ্যাত্মিক পথের পথিক (সালেক) প্রিয়তমের সাথে মিলনের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় ও বিচ্ছেদের আগুনে দগ্ধ হন। তিনি প্রিয়তমের সন্ধানে কোন চেষ্টা থেকেই বিরত হন না।

৩. ইরফান : শরীয়ত অনুযায়ী আমল ও তরীকতের পথ অতিক্রম করার পর তাঁর অন্তরে ঐশী ইলমের সূর্য দেদীপ্যমান হয়ে ওঠে এবং তিনি কম-বেশি ঐশী সত্যকে উপলব্ধি করতে শুরু করেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে,এ বিশ্বে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কোন শক্তির অস্তিত্ব নেই। তিনি আত্ম উপলব্ধির মধ্য দিয়ে আল্লাহকে উপলব্ধি করার স্তরে উপনীত হন এবং সর্বত্র ঐশী নিদর্শন দেখতে পান।

৪. ইসতিগনা (মুখাপেক্ষিতা থেকে মুক্তি) : এ স্তরে সালেক আল্লাহ্ ছাড়া সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন এবং শুধু তাঁর দিকেই মনোসংযোগ করেন।

৫. তাওহীদ : সালেক এ স্তরে এসে অনুভব করেন যে,তাঁর হৃদয়ে ঐশী সত্তার একত্বের মর্মবাণী ও তাওহীদের শিখা দেদীপ্যমান হয়ে আছে।

৬. হায়রাহ্ (দিশেহারা অবস্থা) : এ স্তরে সালেক সর্বশক্তিমান ও মহামহিম আল্লাহ তায়ালার সামনে নিজেকে এক দিশেহারা ও হতবুদ্ধি অবস্থায় নিমজ্জিত এবং এক বিস্ময়কর অবস্থার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া দেখতে পান।

৭. ফাকর ওয়া ফানা (দারিদ্র্য ও আত্মবিনয়) : এ স্তরে বহুত্ব একত্বের মাঝে বিলুপ্ত হয় ঠিক যেভাবে ঢেউ সমুদ্রের সত্তায় বিলুপ্ত হয়। এ স্তরের অভিজ্ঞতা অবর্ণনীয় যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

সুফীদের করণীয়

সুফীদের করণীয় সুফীদের কার্যাবলীকে তিনভাগে ভাগ করা যায় :

১. ইবাদত : শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত বাহ্যিক ইবাদতসমূহ অর্থাৎ নামায,রোযা,খুমস্,যাকাত,জিহাদ ইত্যাদি যা সকল মুসলমান আদায় করে সুফীরাও তা আদায় করেন;এ ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য নেই।

২. রিয়াযাত (আধ্যাত্মিক চর্চা) : এর মানে ব্যক্তিগত প্রশিক্ষণ-মৌখিকভাবে ও অন্তরে আল্লাহ তায়ালার যিকিরের শিক্ষাদান অর্থাৎ প্রকাশ্যে-সশব্দে বা গোপনে-মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করতে হয়। এ ছাড়া চল্লিশ দিনের জন্য নির্জনবাস এবং মুস্তাহাব ইবাদত আঞ্জাম দেয়ার জন্য কোথাও সফর বা সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোথাও অবস্থান এ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।

৩. বিশেষ নিয়মাবলী মেনে চলা : যেমন খানকার নিয়মাবলী ও পীরের আদেশ-নিষেধসমূহ মেনে চলা। এ ছাড়া ভক্তিমূলক গান-বাজনা ও নাচ এবং আরো কতগুলো কাজ এ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। এ সব কাজে বিভিন্ন সুফী ধারার মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানার জন্য ‘মিসবাহুল হিদায়া’,‘মিফতাহুল কিফায়া’,‘কাশফুল মাহজুব’,‘আওয়ারিফুল মা’আরিফ’ প্রভৃতি গ্রন্থের সাহায্য নেয়া যেতে পারে।

কোন কোন ক্ষেত্রে সুফীদের ও শরীয়তের অনুসারীদের মধ্যে বিরোধ দেখা যায়। সুফীদের কাজকর্ম ও ধর্মীয় বিধি-বিধানের মধ্যে অনেক সময় বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয়। এ ব্যাপারে পরস্পরের মতামত খণ্ডন করে বেশ কিছু বই-পুস্তকও লেখা হয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা ও গবেষণার জন্য নিম্নলিখিত গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করা যেতে পারে :

‘কিতাবু তাবসিলাতুল আওয়াম’ : সাইয়্যেদ মুরতাযা দাঈ আর রাযী,‘আল ফাসল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া’ : ইবনে হাজম,‘আসরারুত তাওহীদ’ : আল মাজলিসী,আগা বাকের বেহবাহানী,আগা মুহাম্মদ আলী কেরমানশাহী,হাজী মুহাম্মদ জাফর কাবুতার অহাঙ্গী,হাজী মোল্লা যয়নুল আবেদীন আল শিরওয়ানী প্রমুখ (একই শিরোনামে প্রত্যেকের লিখিত)। ‘আর রাওয়াত’,‘মুস্তাদরাকুল ওয়াসায়েল’,‘তারায়েকুল হাকায়েক’ প্রভৃতি গ্রন্থে তাঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। এ ছাড়া মোল্লা ইসমাঈল আল খাজাভী (মৃত্যু ১১৭৩ হি.) সত্তার একত্ব (ওয়াহ্দাতুল উজুদ) তত্ত্ব খণ্ডন করে ফার্সী ভাষায় একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। অধিকাংশ সুফী কবিই তাঁদের কবিতায় শরীয়তের কঠোর অনুসারীদের উপহাস করেছেন।

হাকীকত (নিরঙ্কুশ সত্য)

ইতঃপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে,শরীয়ত হচ্ছে আল্লাহ্ অভিমুখী পথের স্বীকৃতি,অন্যদিকে তরীকত হচ্ছে আত্মসংশোধন এবং তাখলিয়াহ্,তাহলিয়াহ ও তাজলিয়াহ্ স্তর অতিক্রমের পর পর্যায়ক্রমে সাত উপত্যকা অর্থাৎ তালাব,ইশক,ইরফান,ইসতিগনা,তাওহীদ,হায়রাহ্ ও সবশেষে ফাকর ও ফানাহ্ অতিক্রম করা। আর হাকীকত বা নিরঙ্কুশ সত্যে উপনীত হওয়া মানে পরম লক্ষ্যে উপনীত হওয়া;এ লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য হাসিল এবং তার রুবুবিয়াতের মহিমা প্রত্যক্ষকরণ।

আল লাহিজীর মতে হাকীকত হচ্ছে ঐশী গূঢ় রহস্যের অনাবৃত প্রদর্শনী;ঐশী সত্তার জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হবার কারণে সকল ভেদাভেদের কুয়াশা ও মিথ্যা বহুত্ব দূরীভূত হবার মাধ্যমে এ প্রদর্শনী অর্জিত হয়। বলা হয় যে,হাকীকতের প্রথম স্তর হচ্ছে শুহুদ (ঐশী সত্যতা প্রত্যক্ষকরণ) এবং এর সর্বশেষ স্তর হচ্ছে সসীম সত্তার অসীমে অর্থাৎ আল্লাহতে বিলয় ঘটা (ফানা ফীল্লাহ্)। এরপর আসে আল্লাহর সাথে চিরন্তন স্থায়িত্ব লাভ (বাক্বাবিল্লাহ্)। একইভাবে যেহেতু আল্লাহ তায়ালার কালাম অসীম,সেহেতু হাকীকতে উপনীত হওয়ার স্তরসমূহও অসীম।

খাজা আবদুল্লাহ্ আনসারী বলেন,“শরীয়তকে শরীর,তরীকতকে হৃদয় এবং হাকীকতকে আত্মা স্বরূপ গণ্য কর।”

ইবনে সিনা বলেন,“একজন আরেফ আধ্যাত্মিকভাবে ঊর্ধ্বারোহণ করেন এবং পবিত্র সত্তাসমূহের জগতকে প্রত্যক্ষ করেন,তিনি তার এ প্রত্যক্ষণের বর্ণনাদানের ক্ষেত্রে স্বীয় কল্পনাশক্তিকে (খেয়াল) কাজে লাগান। কারণ তার যথাযথ বর্ণনা প্রদান অসম্ভব ব্যাপার এবং তার তাৎপর্য অনুধাবন করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব।”৮

তিনি আরো বলেন যে,“প্রত্যয়ের নয়ন (আইনুল ইয়াকীন) যা প্রত্যক্ষ করে তা প্রত্যয়ের জ্ঞানের (ইলমুল ইয়াকীন) মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়। সালেক,মুরীদ ও আরেফ কেবল কাশফ ও শুহুদ-এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার সাথে মিলন হাসিল করতে সক্ষম হন এবং স্বর্গসুখদায়ক দৃশ্যের নেয়ামত হাসিল করেন। আল্লাহ তায়ালার সাথে এই নৈকট্য ও ঐক্য যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে হাসিল করা সম্ভব নয়।”৯

খাজা নাসিরুদ্দীন তুসী তাঁর ‘শারহুল ইশারাত’ গ্রন্থে যাহেদ,আবেদ ও আরেফের মধ্যকার পার্থক্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,“একজন যাহেদ-যে আরেফ নয়,সে হচ্ছে একজন শিল্পকর্মী বা একজন ব্যবসায়ীর মতো যে তার পণ্যকে অন্যের সাথে (অর্থ বা অন্য পণ্য নিয়ে) বিনিময় করে। আর একজন আবেদ-যে আরেফ নয়,সে হচ্ছে একজন শ্রমিকের ন্যায় যে মজুরীর জন্য কাজ করে। যদিও একজন শিল্পকর্মী ও একজন শ্রমিকের কাজের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে তথাপি উদ্দেশ্যের বিচারে অর্থাৎ বিনিময় ও মজুরীর জন্য কাজ করে বিধায় তারা পরস্পর অনুরূপ। কিন্তু একজন আরেফের যুহদের এর উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্য সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে স্থায়ীভাবে শুধু আল্লাহর প্রতি মনোযোগী থাকা। তাঁর যুহদ হচ্ছে তাঁর বিবেকের বা অভ্যন্তরীণ সত্তার এক ধরনের বিশুদ্ধকরণ যার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য যে কোন কিছুতে জড়িয়ে পড়া থেকে বিরত থাকা। তিনি আল্লাহ তায়ালার প্রতি এমনভাবে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেন যে,তিনি অন্য কোন কিছুর দিকেই ভ্রূক্ষেপ করেন না এবং অন্য সবকিছুর প্রতিই বিরাগ পোষণ করেন। আরেফ কেবল পরম সত্তার সন্ধানে ব্যস্ত থাকেন এবং অন্য কোন কিছুর সন্ধান করেন না। তিনি এ কারণে ইবাদত করেন যে,কেবল আল্লাহ তায়ালাকে ইবাদত পাবার হকদার বলে মনে করেন। আরেফ ভয় অথবা পুরস্কারের লোভে ইবাদত করেন না। তিনি বেহেশত পাবার আশায় আল্লাহকে ভালোবাসেন না,বরং আল্লাহ্ই যেহেতু তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য শুধু সে কারণেই তাঁকে ভালোবাসেন।

আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) বলেন,“হে আমার রব! আমি জাহান্নামের ভয়ে বা জান্নাতের আশায় আপনার ইবাদত করি না। যেহেতু আমি কেবল আপনাকেই ইবাদতের যোগ্য বলে মনে করি কেবল এ কারণেই আপনার সামনে আমার মাথা নত করি।”

ইরফানের কযেকটি সুগভীর তত্ত্ব

১. তাওহীদ (একত্ব) : আরেফগণের মতে বহুত্বের কোন অস্তিত্ব নেই। সকল বাস্তবতা (হাকীকত) অনিবার্যভাবেই এক। মানুষের রূহ ও নাফস তাদের বহুত্ব সত্ত্বেও এক। বহুত্ব হচ্ছে স্থান ও কালের তৈরি বিভিন্ন প্রকরণ এবং তা কেবল বস্তুজগতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আত্মিক জগতে একত্ব (ওয়াহ্দাত) ছাড়া কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। যেহেতু রূহ হচ্ছে আদেশের জগৎ (আলম আমর)১০-এর বিষয় সেহেতু তা বহুত্বের ঊর্ধ্বস্থিত বিষয়। কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا

“তারা আপনাকে রূহ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করছে;বলুন : রূহ হচ্ছে আমার রবের আদেশ থেকে (উদ্ভূত),আর তোমাদেরকে তো খুব সামান্যই জ্ঞান দেয়া হয়েছে।” (বনী ইসরাঈল : ৮৫)

কোরআন মজীদে আরো এরশাদ হয়েছে :

هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ

“তিনিই তোমাদেরকে একটি মাত্র নাফস (ব্যক্তিসত্তা) থেকে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আল আরাফ : ১৮৯)

আত্মার একত্বকে সাধারণত একটি আলোর উপমা দিয়ে বুঝানো হয় যা বিভিন্ন রঙের আয়নায় প্রতিফলিত হলে তার প্রতিফলন বিভিন্ন রঙের হবে। কবি বলেন :

“এ জগতের সবটাই ছিল বিভিন্ন ধরনের কাঁচ

তাতে অস্তিত্বের আলোকপুঞ্জের রশ্মি নিপতিত হলো,

যে কাঁচের রঙ লাল,হলুদ বা নীল ছিল

সে কাঁচে ঐ আলো সে রঙই ধারণ করল।”

এ সৃষ্টিলোক হচ্ছে একটি ঢেউ অথবা একটি বুদবুদের ন্যায় যা দৃশ্যমান,কিন্তু প্রকৃত অর্থে তার কোন অস্তিত্ব নেই;এ ক্ষেত্রে সমুদ্র হচ্ছে একমাত্র সত্য। সৃষ্টিলোকের বাস্তবতাকে সূর্যরশ্মির সাথে তুলনা করা চলে;সূর্যরশ্মি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে,কিন্তু প্রকৃত সত্য শুধু সূর্য। মাওলানা রুমী বলেন :

“আমরা অভিন্ন ছিলাম১১ এবং সকলে একটিমাত্র মুক্তা ছিলাম

আমরা ছিলাম শরীরবিহীন,আর তা-ই সকলের গূঢ় রহস্য,

আমরা ছিলাম সূর্যের মতো একটি মুক্তা

জটিলতাহীন আর পানির মতো স্বচ্ছ ছিলাম।”

তিনি আরো বলেন,

“ঐ পরম জ্যোতি যখন রূপ পরিগ্রহ করল

দুর্গোপরি টিবিসারির ছায়াসম বহুগুণিত হলো,

টিবিশ্রেণিকে কামানের গোলা নিক্ষেপে ধ্বংস করে দাও

যাতে তাদের মধ্যকার পার্থক্য বিলুপ্ত হয়ে যায়।”

আরেফগণের পরিভাষায় সত্য এক এবং তার বহিঃপ্রকাশ সর্বত্র। প্রতিটি জিনিসই আল্লাহ তায়ালার চিহ্ন বা নিদর্শন;ঐশী জ্যোতি সকল সৃষ্টিতেই প্রতিফলিত। কোরআন মজীদে বলা হয়েছে যে,মানুষের শরীর কাদামাটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এবং তাতে ঐশী চেতনা ফুঁকে দেয়া হয়েছে (সূরা সাদ : ৭১-৭২)। যা কিছু প্রকৃত তা-ই সত্য এবং তা এক,আর যা কিছু সত্য ও এক তা-ই চিরন্তন। অতএব,রূহ হচ্ছে ঐশী ঝলক (তাজ্জালী) এবং এ কারণে তা চিরন্তন,তা সৃষ্ট নয়।

আরেফগণের বিশ্বদৃষ্টি অনুযায়ী ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের প্রকৃতপক্ষে কোন বাহ্যিক অস্তিত্ব নেই,বরং তা একটি আয়নার পেছন দিককার সমতুল্য;আত্মা হচ্ছে আয়নার সামনের দিকের ন্যায়। এ বিশ্বজগৎ হচ্ছে শরীরতুল্য এবং আল্লাহ তায়ালা তার আত্মাস্বরূপ। আত্মা হচ্ছে এক এবং একক।

আল্লাহ তায়ালা,রূহ ও ব্যক্তিসত্তা বা নাফসের মধ্যকার সম্পর্ক তিনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে,তা হচ্ছে :

ক. সৃষ্টি (خلق)

খ. দেহধারণ (حلول) ও

গ. বহিঃপ্রকাশ (صدور)-ঈশ্বর থেকে সৃষ্টির নিষ্পন্ন হওয়ার তত্ত্ব : নিউ প্লেটোনিক দর্শন

সৃষ্টি (খালক)-এর মতবাদ একটি সেমিটিক মতবাদ। আর দেহধারণ (হুলুল)-কে খ্রিস্টীয় মতবাদের আলোকে অর্থাৎ হযরত ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর পুত্র গণ্যকারী খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের আলোকে ব্যাখ্যা করা হয়। আর বহিঃপ্রকাশ (সুদুর) তত্ত্বের উৎস হচ্ছে নব্য প্লেটোনিক দর্শন। আরেফগণ তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপনের জন্য এ তিনটি তত্ত্বকেই ব্যবহার করেছেন। কবি বলেন :

“এক ডিম্বসম মুক্তা উচ্ছ্বসিত হলো ও সাগরে পরিণত হলো

তাতে ফেনা হলো,ফেনা থেকে জমিন হলো,আর ধোঁয়া থেকে হলো আসমান

যদিও ঝিনুক উপকূল থেকে একটি ফোটা হরণ করল আর হারিয়ে গেল

যে ডুবুরি তাকে চিনতে পেরেছে সে তাকে সাগরেই সন্ধান করে।”

সুফিগণ অনেক সময় বহিঃপ্রকাশকে (সুদুর) ব্যাখ্যা করেন পরম সুন্দরকে পাবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা হিসাবে,যে পরম সুন্দর তাজাল্লী রূপে দেখা দেন। এ কারণে কবি আবদুর রহমান জামী

كنت كترا مخفيا (আমি ছিলাম এক গুপ্ত ধনভাণ্ডার)-

এ হাদীসে কুদসীকে তাঁর কবিতায় ‘চিরন্তন সৌন্দর্য’ ও ‘তাঁকে দেখার উদগ্র বাসনা’ অর্থে ইউসুফ ও যুলাইখা রূপে ব্যাখ্যা করেছেন। বহিঃপ্রকাশ ও দেহধারণ তত্ত্বের সমন্বিত রূপ এভাবে পেশ করা হয়েছে যে,যদিও মানুষ সৃষ্টি বৈ নয়,তবে তাকে খোদায়ী গুণে গুণান্বিত করে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ কারণে বলা হয়,

خلق الله آدم على صورته

“আল্লাহ্ আদমকে তাঁর নিজ গুণে গুণান্বিত করে সৃষ্টি করেছেন।”

সৃষ্টি ও দেহধারণ-এর ধারণাকে পানি ও মহাসাগরের উপমা আকারে পরস্পর সমন্বিত করা হয়েছে। মাওলানা রুমী বলেন,

“সেদিন আমি ছিলাম যখন নামসমূহ ছিল না

নামধারী কোন অস্তিত্বের চিহ্নও ছিল না

‘আমাদের’ থেকে নামধারী ও নামসমূহ আত্মপ্রকাশ করল

সেই দিন থেকে যেদিন ‘আমি’ ও ‘আমরা’ ছিল না।”

মানুষের ইচ্ছা আসলে আল্লাহর ইচ্ছামাত্র। আর যা কিছু অস্তিত্ববান এবং যা কিছু অস্তিত্বহীন তার সবকিছুই তিনি। আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান। ‘মানতেকুত তায়র’১২-এ প্রদত্ত সি-মোরগের১৩ উপমা এবং সুফী সাহিত্যে প্রদত্ত অন্যান্য উপমা সুফীতাত্ত্বিক তাওহীদে সর্বেশ্বরবাদ বা অভেদবাদের উপাদানই নির্দেশ করে। আল্লাহ্ হচ্ছেন আসমানসমূহ ও জমিনের জ্যোতি। তিনি হচ্ছেন এক এবং চিরন্তন। তিনি সবকিছু জানেন এবং তিনি সর্বত্র বিরাজমান। তিনি অনাদিকাল থেকে আছেন এবং অনন্তকাল পর্যন্ত থাকবেন। সমগ্র সৃষ্টিলোকই তাঁর অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করে এবং তিনি তাঁর নিকটতম বান্দাদের নিকট নিজেকে প্রদর্শন করেন।

২. আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন-প্রেম : মাওলানা রুমী বলেন,

“যে তার নিজ থেকে দূরে পড়ে রয়েছে

নিজের সাথে পুনর্মিলনের চেষ্টাই হোক তার জীবনের সাধনা।”

ইরফানী সাহিত্যে আল্লাহ্ থেকে আত্মার বিচ্ছিন্নতা নিয়ে আলোচনা করা হয়,বরং একে একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য বা অনিবার্য বাস্তবতা হিসাবে গণ্য করা হয়। বলা হয় যে,মানুষের আত্মাসমূহ এক সময় আল্লাহ তায়ালার সত্তার নৈকট্যে অবস্থান করছিল,কিন্তু পরে তা পৃথক হয়ে যায়। তাই আত্মা এখন তার বিচ্ছেদের বেদনায় বিলাপ করছে এবং পূর্নমিলনের জন্য উতলা হয়ে আছে। স্বীয় মুল বা উৎসে প্রত্যাবর্তনের আকাঙ্ক্ষা দ্বারাই সে সবসময় পরিচালিত হয়।

আরেফগণের বিশ্বাস অনুযায়ী এ আকর্ষণের পেছনে প্রেমের শক্তি ক্রিয়াশীল যা বিচার-বুদ্ধি থেকে স্বতন্ত্র একটি উপাদান। পরম লক্ষ্যে উপনীত হওয়া অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার সাথে মিলিত হবার এটিই একমাত্র পথ।

আরেফগণের মতে বিচার-বুদ্ধি হচ্ছে মশাল ও পথপ্রদর্শক সমতুল্য,কিন্তু পরম সত্যাভিমুখী প্রকৃত পথ হচ্ছে প্রেম। প্রেমকে দু’ধরনের বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ”

১. বাহ্যিক বা দৈহিক প্রেম : (ইশকে সুরী ও যাহেরী) : এর মানে হচ্ছে যা কিছু দৃশ্যত ও বাহ্যত সুন্দর তার প্রতি আকর্ষণ।

২. অভ্যন্তরীণ বা প্রকৃত প্রেম (ইশকে বাতেনী ও হাকীকী ) : যেহেতু যা কিছু সুন্দর তা-ই আল্লাহ তায়ালার সৌন্দর্য ও পূর্ণতার প্রতিফলন,সেহেতু বাহ্যিক প্রেমের মধ্য দিয়ে প্রকৃত প্রেমের স্তরে উপনীত হওয়া সম্ভব।

প্রেম ও বিচার-বুদ্ধির মধ্যকার বিরোধ ও বৈপরীত্য সব সময়ই সুফী সাহিত্যের অন্যতম আলোচ্য বিষয় হিসাবে পরিগণিত হয়ে এসেছে। মানুষের মধ্যে এ দু’টি শক্তির প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায়। অনুরূপভাবে সুফী সাহিত্যে শরীয়তের বিধি-বিধান ও প্রেমের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিয়েও আলোচনা হয়েছে।

সংক্ষেপে বলা চলে যে,প্রেম হচ্ছে আধ্যাত্মিক তৎপরতার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সত্তাকে বিশোধনের একটি পদ্ধতি। হৃদয় বিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন হবার পর আল্লাহ তায়ালার নূর গ্রহণ করার জন্য উপযুক্ত হয়।

রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেছেন :

تخلقوا باخلاق الله

“তোমাদের নিজেদেরকে আল্লাহর গুণাবলীতে গুণান্বিত কর।”

হৃদয় যখন এমন একটি আয়নায় পরিণত হয় যাতে আল্লাহ তায়ালার বহিঃপ্রকাশসমূহ (মাযাহের) প্রতিফলিত হয়,তখন তাতে প্রকৃত বাস্তবতা তথা সত্য মুদ্রিত হয়ে যায় এবং তাতে সুস্পষ্ট দৃশ্য দেখা যায়। অতঃপর মানুষ যা কিছুই দেখে তাতে আল্লাহকেই দেখা যায়। আর এ স্তরেই প্রকৃত ঐক্য (ওয়াহ্দাত) ও পূর্ণতা (কামালিয়াত) অর্জিত হয়।

৩. তাওয়াক্কুল : সুফীবাদের অন্যতম মৌলিক আকীদা হচ্ছে তাওয়াক্কুল অর্থাৎ সকল বিষয়ে আল্লাহ তায়ালার ওপর নির্ভরতা ও তাঁর ইচ্ছার নিকট আত্মসমর্পণ। বস্তুত আল্লাহর ওপর নির্ভরতা ও তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ (তাসলীম) এবং তাঁর প্রতি সর্বাবস্থায় সন্তুষ্ট থাকাকে (রেযা) ইসলামী মরমীবাদের স্তম্ভ হিসাবে গণ্য করা হয়। প্রকৃতপক্ষে মুসলিম সুফিগণ ইসলাম বলতে আত্মসমর্পণ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ও তাঁর নির্ধারিত বিধান সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নেয়াকেই বুঝিয়ে থাকেন। সুফীদের বিশ্বাস এই যে,আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি মানুষের ভাগ্যকেই পূর্ব থেকেই নির্ধারণ করে রেখেছেন। (এর ভিত্তিতেই কতক সুফী নির্জন বাস অবলম্বন করেন এবং কোন কাজ-কর্ম করা থেকে পুরোপুরি বিরত থাকেন।) অবশ্য অন্যদের আকীদা হচ্ছে এই যে,আল্লাহ তায়ালা মানুষকে কর্মপ্রচেষ্টার ক্ষমতা ও ইখতিয়ার প্রদান করেছেন এবং এ ক্ষমতা ও ইখতিয়ার ব্যবহার করে কাজের মাধ্যমে আমাদেরকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,

ليس للأنسان اّلا ما سعى

“মানুষের জন্য কেবল তা-ই আছে যে জন্য সে চেষ্টা-সাধনা করেছে।”

এক ব্যক্তি সারী আস সাদিকীর নিকট এসে বলল : “পাহাড়ে অবস্থানরত অমুক ব্যক্তি আপনাকে সালাম দিয়েছেন।” জবাবে তিনি বললেন,“যেহেতু সে পাহাড়ে বসবাস করে,(আমাদের সাথে) তার কোন কাজ নেই;বরং যা উচিত তা হচ্ছে একজন লোক বাজারে যাবে,সেখানে কর্মব্যস্ত থাকবে,কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও আল্লাহ তায়ালাকে ভুলবে না।”

মাওলানা রুমি মানুষের ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি তাওয়াক্কুলের মূলনীতিকে স্বীকার করতেন,কিন্তু পাশাপাশি জীবনের জন্য কর্ম ও প্রচেষ্টাকে অপরিহার্য গণ্য করতেন। তিনি বলেন,

“বললেন হ্যাঁ,তাওয়াক্কুল যদি পথ প্রদর্শক হয়ে থাকে

তো এই কার্যকারণও রাসূলের সুন্নাত

রাসূল উচ্চৈঃস্বরে বললেন : তাওয়াক্কুলের সাথে সাথে উটের হাঁটুকেও বেধে রাখ

‘শ্রমিক আল্লাহর বন্ধু’-এ কথার গূঢ় তাৎপর্য শোন

তাওয়াক্কুলের কারণে কার্যকারণ থেকে গাফেল হয়ো না।”

আল্লাহ তায়ালা এ জগতে ভালো-মন্দ এবং সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণের সুযোগ দিয়েছেন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে,মানুষ যেন স্বেচ্ছায় তাওয়াক্কুল ও আল্লাহর কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে নিজের অভ্যন্তরে (ঈমানের) কষ্টিপাথর তৈরি করে নিতে পারে। এ ধরনের মানুষ সকল প্রকার বিপদাপদ ও প্রতিকূলতাকে বরণ করে নেয়,কিন্তু সর্বাবস্থায়ই সবকিছুতেই সৌন্দর্য আবিষ্কার করে।

পাদটীকা :

১. ‘আসহাবে সুফ্ফা’ মানে ‘বারান্দায় বসবাসকারিগণ’। যে সব সাহাবী মসজিদে নববীতে বসবাস করতেন তাঁদেরকে এ নামে অভিহিত করা হয়। আবুল ফিদা তাঁদের সম্পর্কে লিখেছেন : “তারা ছিলেন দরিদ্র বহিরাগত;তাঁদের মদীনায় কোন বন্ধু-বান্ধব বা বাসগৃহ ছিল না। তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর হাতে বাইয়াত হন এবং তাঁর আশ্রয় প্রার্থনা করেন। এভাবে মসজিদের বারান্দা তাঁদের বাসস্থানে পরিণত হয় এবং এ থেকেই তাঁরা এ নামে অভিহিত হন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যখন খাবার খেতেন তখন তাঁদের মধ্য থেকে কতককে ডেকে নিয়ে খাওয়াতেন এবং অন্যদেরকে খাওয়ানোর জন্য বিভিন্ন সাহাবীকে দায়িত্ব দিতেন।” এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য হাফেয আবু নাঈম আল ইসফাহানী লিখিত ‘হিলইয়াতুল আউলিয়া’ এবং আল হুজাবিরী লিখিত ‘কাশফুল মাহজুব’ গ্রন্থ অধ্যয়ন করা যেতে পারে।

২. উমাইয়্যা শাসনমলে তাদের অনুসারী আরবরা নিজেদেরকে অনাবরবদের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর বলে দাবি করত এবং অনারবদেরকে হেয় প্রতিপন্ন ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত। তারা অনারবদের ওপর নিজেদের সামাজিক রীতি-নীতি ও আদব-কায়দা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এর প্রতিক্রিয়ায় অনারবদের মধ্যে, বিশেষ করে ইরানীদের মধ্যে একটি দল স্বীয় জাতীয় সংস্কৃতি-সভ্যতা,আদব-কায়দা ও গৌরবময় ইতিহাসকে বহু পুস্তকের মাধ্যমে বিশেষত কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরার ও শ্রেষ্ঠতর প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে। এরাই ‘শুয়ূবিয়্যাহ্’ নামে পরিচিত হয়।

৩. হিজরী ১৬৩-২৫৫

৪. আল জামী লিখিত ‘নাফাহাতুল উনস’।

৫. শায়খুল ইশরাক শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী ও সাদরুল মুতাআল্লেহীন শিরাজী (মোল্লা সাদরা)-এর গ্রন্থাবলীতে পাহলাভিয়্যাত সম্পর্কে উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়।

৬. পারিভাষিক অর্থে বর্তমানে সেমিটিক বলতে (ধর্মীয় জনগোষ্ঠী অর্থে) ইহুদীদেরকে বুঝানো হয়।-    অনুবাদক

৭. সানায়ী তাঁর ‘সায়রুল ইবাদ ইলাল ইবাদ’ গ্রন্থে এবং আত্তার তাঁর ‘মানতিকুত তায়র’ গ্রন্থে এ স্তরগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন।

৮. ইবনে সিনা : আল ইশারাত,নবম ভাগ,ফার্সী অনুবাদ,পৃ. ৫৪।

৯. প্রাগুক্ত।

১০. শহীদ আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হোসেন বেহেশতী তাঁর লেখা ‘কোরআন এবং আলমে খালক ও আলমে আমর তত্ত্ব” শীর্ষক প্রবন্ধে (Al-Tawhid, Vol 1, No. 2  দ্রষ্টব্য) আলমে খালক ও আলমে আমর বিষয়ক পুরো তত্ত্বটিই প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন,এটি একটি কোরআন বহির্ভুত তত্ত্ব যা মুতাকাল্লিমগণ কর্তৃক বাইরে থেকে আমদানি করা হয়েছে।- Editor, Al-Tawhid

১১. منبسط এর আভিধানিক অর্থ ‘সম্প্রসারিত;পারিভাষিক অর্থে ‘অবিভাজ্য’।-অনুবাদক

১২. শেখ ফরিদ্দুদীন আত্তার লিখিত।

১৪. রূপকথার বৃহত্তম কাল্পনিক পাখি যা মানুষের মতোই কথা বলে এবং কাফকায (ককেশাস) পর্বতে বসবাস করে বলে ‘শাহনামা’য় উল্লেখ করা হয়েছে-যে পাখি মানুষের কল্যাণকামী ও সত্য-ন্যায়ের পৃষ্ঠপোষক।-অনুবাদক