১টি মাযহাব অনুসরণ (Following a Majhab) বাধ্যতামূলক নয়: কোরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াসের আলোকে বিশ্লেষণ।

লিখেছেনঃ মাহবুব ওসমানী

ভূমিকা
ইসলামী শরীয়তে চারটি সুপ্রতিষ্ঠিত মাযহাব রয়েছে: হানাফী, মালিকী, শাফঈ ও হাম্বলী। প্রশ্ন উঠতে পারে, একজন মুসলিমের জন্য কি শুধুমাত্র একটি মাযহাব অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক, নাকি প্রয়োজনে ভিন্ন মাযহাবের মতামত গ্রহণ করা যায়? এই প্রবন্ধে কোরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াসের আলোকে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

কোরআনের দৃষ্টিতে মাযহাব অনুসরণ

আল্লাহ তাআলা বলেন:
> **﴿فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ﴾**
“তোমরা যদি না জানো, তবে জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা করো।”
— [সূরা আন-নাহল, ১৬:৪৩]
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, সাধারণ মুসলিমদের জন্য জ্ঞানীদের অনুসরণ করা অনুমোদিত। তবে এটি কোনো নির্দিষ্ট মাযহাবের প্রতি আবদ্ধ নয়।

হাদীসের আলোকে মাযহাব অনুসরণ

প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেন:
> **«فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ»**
“তোমরা আমার সুন্নাহ এবং সঠিকভাবে পরিচালিত খলিফাদের সুন্নাহ অনুসরণ করো।”
— [আবু দাউদ, হাদীস: ৪৬০৭]
এখানে কোনো নির্দিষ্ট মাযহাবের প্রতি বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়নি। বরং সুন্নাহ অনুসরণের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে।

ইজমা ও কিয়াসের আলোকে মাযহাব পরিবর্তন

ইমাম কারাফি (রহ.) বলেন:
> **”انعقد الإجماع على أن من أسلم فله أن يقلد من شاء من العلماء بغير حجر.”**
“ইজমা হয়েছে যে, যে ইসলাম গ্রহণ করেছে, সে যেকোনো আলেমকে অনুসরণ করতে পারে, এতে কোনো বাধা নেই।”
— [আল-যাখিরাহ, ১৩/৩৬৩]
এছাড়া, ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে প্রয়োজনে ভিন্ন মাযহাবের মতামত গ্রহণ করা যায়, যদি তা শরীয়তের মূলনীতির পরিপন্থী না হয়।

আধুনিক ফিকহবিদদের মতামত

শাইখ ইবনে বায (রহ.) বলেন:
> “যদি কোনো ব্যক্তি কোনো মাযহাবের কিছু বিষয়ে অন্য মাযহাবের মতামত অনুসরণ করে, এবং তা তার কাছে সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়, তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই।”
— [ইবনে বায ফাতাওয়া, ফাতওয়া নং: ৮৪২৬]
ইসলামিক ওয়েবসাইট ইসলাম ওয়েব-এ বলা হয়েছে:
> “যদি কেউ কোনো মাযহাবের কিছু বিষয়ে অন্য মাযহাবের মতামত গ্রহণ করে, এবং তা শরীয়তের পরিপন্থী না হয়, তাহলে এটি অনুমোদিত।”
— [ইসলাম ওয়েব ফাতওয়া নং: ৩৪৩৬৭২]
নিচে চার ইমাম—ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফি’ই এবং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের—মাযহাব অনুসরণ এবং প্রয়োজনে ভিন্ন মাযহাবের মত গ্রহণ সম্পর্কে মতামত উপস্থাপন করা হলো।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.)
ইমাম আবু হানিফা বলেন:
> **”إذا صح الحديث فهو مذهبي”**
“যদি হাদীস সহীহ হয়, তবে সেটাই আমার মাযহাব।”
— [আল-মুস্তাসফা, ইমাম গাযালী]
তিনি আরও বলেন:
> **”حرام على من لم يعرف دليلي أن يفتي بكلامي”**
“যে ব্যক্তি আমার দলীল জানে না, তার জন্য আমার কথা অনুযায়ী ফতোয়া দেওয়া হারাম।”
— [আল-ইন্তিকা, ইবন আব্দুল বার]
এ থেকে বোঝা যায়, ইমাম আবু হানিফা সহীহ হাদীসের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন এবং অন্ধ অনুসরণ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন।
ইমাম মালিক ইবনে আনাস (রহ.)
ইমাম মালিক বলেন:
> **”إنما أنا بشر، أصيب وأخطئ، فانظروا في قولي، فكل ما وافق الكتاب والسنة فخذوه، وكل ما لم يوافق الكتاب والسنة فاتركوه”**
“আমি তো একজন মানুষ, কখনো সঠিক বলি, কখনো ভুল করি। আমার কথাগুলো যাচাই করো; যা কুরআন ও সুন্নাহর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, তা গ্রহণ করো; আর যা সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তা পরিত্যাগ করো।”
— [আল-জারহ ওয়াত-তাদীল, ইবন আবি হাতিম]
তিনি আরও বলেন:
> **”كل يؤخذ من قوله ويترك إلا صاحب هذا القبر”**
“প্রত্যেকের কথা গ্রহণও করা যায়, পরিত্যাগও করা যায়; শুধু এই কবরের অধিবাসী (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যতীত।”
— [আল-জারহ ওয়াত-তাদীল, ইবন আবি হাতিম]
এ থেকে স্পষ্ট, ইমাম মালিক কুরআন ও সুন্নাহর উপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং অন্ধ অনুসরণ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন।
ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইদরিস আশ-শাফি’ই (রহ.)
ইমাম শাফি’ই বলেন:
> **”إذا صح الحديث فهو مذهبي”**
“যদি হাদীস সহীহ হয়, তবে সেটাই আমার মাযহাব।”
— [আল-মাজমু’, ইমাম নববী]
তিনি আরও বলেন:
> **”إذا وجدتم في كتابي خلاف سنة رسول الله صلى الله عليه وسلم فقولوا بسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم، ودعوا ما قلت”**
“তোমরা যদি আমার বইয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহর বিপরীত কিছু পাও, তবে রাসূলের সুন্নাহ অনুযায়ী চলো এবং আমার কথা পরিত্যাগ করো।”
— [আল-মাজমু’, ইমাম নববী]
এ থেকে বোঝা যায়, ইমাম শাফি’ই সহীহ হাদীসের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন এবং অন্ধ অনুসরণ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)
ইমাম আহমদ বলেন:
> **”لا تقلدني ولا تقلد مالكاً ولا الشافعي ولا الأوزاعي ولا الثوري، وخذ من حيث أخذوا”**
“আমাকে অনুসরণ করো না, মালিক, শাফি’ই, আওযাঈ বা সাওরীকেও না; বরং তারা যেখান থেকে নিয়েছেন, সেখান থেকে গ্রহণ করো।”
— [আল-ইলামের মুকাদ্দিমা, ইবনুল কাইয়্যিম]
তিনি আরও বলেন:
> **”رأي الأوزاعي ورأي مالك ورأي أبي حنيفة كله رأي، وهو عندي سواء، وإنما الحجة في الأحاديث”**
“আওযাঈ, মালিক ও আবু হানিফার মতামত সবই মতামত, আমার কাছে সব সমান; প্রকৃত দলীল হলো হাদীস।”
— [আল-ইলামের মুকাদ্দিমা, ইবনুল কাইয়্যিম]
এ থেকে স্পষ্ট, ইমাম আহমদ হাদীসের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং অন্ধ অনুসরণ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন।
চার ইমামই কুরআন ও সহীহ হাদীসের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং অন্ধ অনুসরণ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। তারা সকলেই বলেছেন, যদি তাদের মতামত কুরআন ও সুন্নাহর বিপরীত হয়, তবে তা পরিত্যাগ করতে হবে। তাই, প্রয়োজনে ভিন্ন মাযহাবের মত গ্রহণ করা শরীয়তসম্মত, যদি তা কুরআন ও সুন্নাহর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়।
উপসংহার
উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায়, ইসলামী শরীয়তে শুধুমাত্র একটি মাযহাব অনুসরণ বাধ্যতামূলক নয়। প্রয়োজনে, শরীয়তের মূলনীতির পরিপন্থী না হলে, ভিন্ন মাযহাবের মতামত গ্রহণ করা যায়। তবে এটি করা উচিত জ্ঞানী আলেমদের পরামর্শ নিয়ে এবং খেয়াল-খুশির ভিত্তিতে নয়।
উৎসসমূহ:
1. কোরআন মাজীদ, সূরা আন-নাহল, ১৬:৪৩
2. সুনান আবু দাউদ, হাদীস: ৪৬০৭
3. আল-যাখিরাহ, ইমাম কারাফি, ১৩/৩৬৩
4. ইবনে বায ফাতাওয়া, ফাতওয়া নং: ৮৪২৬
5. ইসলাম ওয়েব ফাতওয়া নং: ৩৪৩৬৭২
প্রশ্নঃ মুসলমানদের এই দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে এমন কোন উচ্চ পর্যায়ের বিখ্যাত আলেম, ফকীহ বা আল্লাহর ওলী দেখাতে পারবেন যিনি একইসাথে দুই মাযহাব অনুসরণ করেছেন?

উত্তরঃ

একইসাথে দুই মাযহাব অনুসরণ: ইসলামী ইতিহাস ও শরীয়তের দৃষ্টিকোণ

ভূমিকা

ইসলামী শরীয়তের গভীর গবেষণা ও চর্চার ধারায় চারটি স্বীকৃত ফিকহ মাযহাব গড়ে উঠেছে: হানাফী, মালিকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী। এই মাযহাবগুলোর মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও তারা সকলেই কুরআন, হাদীস, ইজমা (সম্মিলিত মতামত) ও কিয়াস (আনুমানিক সিদ্ধান্ত)-এর উপর ভিত্তি করে গঠিত। বহু মুসলিমের মনে প্রশ্ন জাগে—একজন আলেম বা সাধক কি একইসাথে একাধিক মাযহাব অনুসরণ করতে পারেন?


ইসলামী ইতিহাসে বাস্তবতা

১. ইমামগণের অবস্থান

চার মাযহাবের ইমামগণ কখনোই একসাথে দুই মাযহাব অনুসরণ করেননি এবং অন্যদেরকেও তা করতে বলেননি।

  • ইমাম আবু হানিফা (রহ.), ইমাম মালিক (রহ.), ইমাম শাফেয়ী (রহ.), ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)—এদের প্রত্যেকেই আলাদা ইজতিহাদী মূলনীতি স্থাপন করেছেন এবং নিজেদের মাযহাব প্রচার করেছেন।

২. মাযহাব পরিবর্তনের নজির

ইমাম শাফেয়ী (রহ.) জীবনের এক পর্যায়ে মালিকি মাযহাব অনুসরণ করতেন। পরে তিনি নিজস্ব ফিকহি চিন্তাধারা অনুযায়ী শাফেয়ী মাযহাব গঠন করেন। কিন্তু কখনোই দুই মাযহাব একত্রে অনুসরণ করেননি।


একইসাথে দুই মাযহাব অনুসরণের বিধান

১. তালফিকের (মিশ্রণ) নিষিদ্ধতা

তালফিক বলতে বোঝায়—নানা মাযহাব থেকে বিভিন্ন বিষয়ে সুবিধাজনক মত বেছে নিয়ে নিজের জন্য একটি নতুন ধারা তৈরি করা।

দলীল:
  • ইমাম নববী (রহ.) বলেন:

    “যে ব্যক্তি বিভিন্ন মাযহাব থেকে শুধু নিজের সুবিধামত মাসআলা গ্রহণ করে, সে ফাসিক এবং শরীয়তের কাঠামো ভঙ্গকারী।”
    — (আল-মাজমু’ শারহুল মুহাযযাব, ইমাম নববী)

  • ইবনে আবেদীন (রহ.) বলেন:

    “একই ব্যক্তির জন্য একসাথে দুই মাযহাবের অনুসরণ করা বৈধ নয়। এটি শরীয়তের নিয়মভঙ্গ।”
    — (রদ্দুল মুখতার, ভলিউম ১)

২. ইজমা (সম্মিলিত মত) এর দলীল

উলামায়ে কেরাম সর্বসম্মতভাবে বলেন, একজন সাধারণ মুসলমানের জন্য একটি নির্দিষ্ট মাযহাব অনুসরণ করা উত্তম ও নিরাপদ। ফিকহি বিশৃঙ্খলা রোধে এটি প্রয়োজন।


ওলীদের অবস্থান

প্রখ্যাত ওলী ও সুফিগণ—যেমন:

  • হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) — হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী

  • হযরত মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.) — হানাফী

  • ইমাম গাযযালী (রহ.) — শাফেয়ী

  • শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহ.) — হানাফী

এঁরা সকলেই নির্দিষ্ট একটি মাযহাব অনুসরণ করতেন। কেউই দুইটি মাযহাব একত্রে গ্রহণ করেননি।


উপসংহার

✅ সিদ্ধান্ত:

ইসলামী ইতিহাস, উলামায়ে কেরামের ইজমা এবং ফিকহি দলীল দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত যে, একজন মুসলিমের জন্য একসাথে দুই মাযহাব অনুসরণ করা শরীয়তসম্মত নয়। এমন কোনো বিখ্যাত আলেম বা ওলী নেই যিনি তা করেছেন।

📌 সুপারিশ:

একটি নির্দিষ্ট মাযহাব অনুসরণ করে থাকলে, সেটার মধ্যেই থাকা উত্তম। কোন বিষয়ে শক্ত দলীল বা বিশেষ প্রয়োজনে অন্য মাযহাবের মত গ্রহণ করতে হলে, তা আলেমদের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট সীমার মধ্যে হতে হবে।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ পোস্টের টাইটেল দেখে কন্টাডিকশন মনে হতে পারে, তবে যদি আপনি সুক্ষ ভাবে চিন্তা করেন, দেখবেন ১ টি মাঝহাব অনুস্মরণ করাই বেশি উত্তম, তাই আমরা সবাই উত্তম টা মানার চেস্টা করবো, তবে তা একিবারে ফরজ বা বাধ্যতামুলক কিছু নয়। আর আপনি মুজতাহিদ লেভেলের কেউ না হলে অবশ্যই ১ টি মাঝহাব আপনাকে ফলো করতে হবে, তাহলে আমি অথবা আপনি বেশি সেইফ থাকতে পারব, যেমন আমি ( মাহবুব ওসমানী ) হানাফি মাঝহাব ফলো করি। তবে একদম বিপদে পড়ে গেলে অন্য মাঝহাব থেকে কিছু ফতোয়া নিতে হয়, যা আমার “মাহাদুল ইকতিসাদ ওয়াল ফিকহুল ইসলামী”র ইফতা বিভাগের প্রধান উস্তাদ “মুফতি কামাল উদ্দিন রাশেদি সাহেব” আমাদেরকে অনুমতি দিয়েছেন।

اللَّهُمَّ فَقِّهْنِي فِي الدِّينِ وَعَلِّمْنِي التَّأْوِيلَ

আইডিসির সাথে যোগ দিয়ে উভয় জাহানের জন্য ভালো কিছু করুন।