সুন্নতী পোশাকের নামে প্রতারণা!

islamic clothing

আলহামদুলিল্লাহ!
পোশাক একটি সভ্যতার অংশ এবং ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। ইসলামের মূলনীতি হলো পোশাকের মাধ্যমে সতর ঢাকা, ভূষণ হিসেবে পরিধান করা এবং অপচয় বা অহংকার থেকে বিরত থাকা।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে, ভারতীয় উপমহাদেশে কিছু ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট ধরনের পোশাককে “সুন্নতী পোশাক” আখ্যা দিয়ে অন্য মুসলিমদেরকে ফাসেক, গোমরাহ, কিংবা সুন্নত বিরোধী বলে অপবাদ দিচ্ছেন — যা ইসলামিক শরী‘আতের দৃষ্টিতে গুরুতর ভুল ধারণা।


সুন্নাহ ও মুবাহ-এর মধ্যে পার্থক্য

রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কাজ ও নির্দেশকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়ঃ
১️⃣ সুন্নাহ (আবশ্যিক অনুসরণীয়)
২️⃣ মুবাহ (ঐচ্ছিক/অনুমোদিত)

১. সুন্নাহ (আবশ্যিক অনুসরণীয়)

আল্লাহর আদেশে রাসূল ﷺ ওহীর ভিত্তিতে যা আদেশ বা নিষেধ করেছেন, যা নিজে করেছেন বা অন্যের কাজের অনুমোদন দিয়েছেন — তা-ই সুন্নাহ।
এটি সকল মুমিন-মুসলিমের জন্য অনুসরণীয়।

২. মুবাহ (ঐচ্ছিক)

ওহীর নির্দেশ ছাড়া রাসূল ﷺ মানুষ হিসেবে যে কাজগুলো করেছেন — যেমন খাদ্যাভ্যাস, বসবাস, সামাজিক রীতি ইত্যাদি — সেগুলো সুন্নাহ নয়, বরং মুবাহ
অর্থাৎ, কেউ করলে সওয়াব নেই, না করলে গুনাহও নেই।

উদাহরণ:

  • তাঁর দুধমাতার দুধ পান করা।
  • মাছ না খাওয়া (গন্ধ অপছন্দ হওয়ায়)।
  • হিরা গুহায় ধ্যান করা।
  • প্রথমবার একজন বিধবা মহিলাকে বিয়ে করা।
  • ২৫ বছর বয়সে বিবাহ করা।
  • ১১টি বিবাহ সম্পাদন করা।

এসবকে যদি কেউ “সুন্নত” মনে করে বিশেষ গুরুত্ব দেয়, তবে তা জ্ঞানের অভাব, এমনকি কখনো বিদ‘আতও হতে পারে।


পোশাক সম্পর্কে রাসূল ﷺ এর সুন্নাহ

রাসূলুল্লাহ ﷺ কোনো নির্দিষ্ট নকশা বা ডিজাইনের পোশাককে “সুন্নতী পোশাক” ঘোষণা করেননি।
বরং তিনি পোশাক পরিধানের কিছু নীতিমালা ও সীমারেখা দিয়েছেন, যা সব যুগের মুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য।

আরবদের পোশাক ছিল আঞ্চলিক ঐতিহ্য, ধর্মীয় নয়।
রাসূল ﷺ নবুওয়তের আগে ৪০ বছর এবং নবুওয়তের পর ২৩ বছর যেসব পোশাক পরিধান করেছেন, সেগুলো ছিল আরবদের প্রচলিত পোশাক। তখন আরবের মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান, এমনকি মুশরিকরাও একই ধরনের পোশাক পরত।

অর্থাৎ, পোশাকটি আরবের সংস্কৃতি, সুন্নাহ নয়।


ইসলামী শরী‘আতে পোশাকের মূলনীতি

ইসলামী শরী‘আতে পোশাক কোনো নির্দিষ্ট রঙ, কাপড়, বা ডিজাইনে সীমাবদ্ধ নয়। বরং মূলনীতি নির্ভর করে নিচের বিষয়ের ওপরঃ

১️⃣ সতর ঢাকা

২️⃣ শালীনতা ও সৌন্দর্য

৩️⃣ অপচয় বর্জন

৪️⃣ অহংকার থেকে বিরত থাকা

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

يَا بَنِي آدَمَ قَدْ أَنْزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُوَارِي سَوْآتِكُمْ وَرِيشًا ۖ وَلِبَاسُ التَّقْوَىٰ ذَٰلِكَ خَيْرٌ
“হে আদমসন্তান! আমি তোমাদের জন্য এমন পোশাক দান করেছি যা তোমাদের লজ্জাস্থান ঢেকে রাখে এবং অলংকারস্বরূপ। কিন্তু তাকওয়ার পোশাকই সর্বোত্তম।”
সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত ২৬

আরও বলেনঃ

يَا بَنِي آدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِندَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ
“হে আদমসন্তান! প্রত্যেক সালাতে (মসজিদে) তোমরা তোমাদের সৌন্দর্য ও পোশাক গ্রহণ কর, খাও ও পান কর, কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।”
সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত ৩১

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ

كُلُوا وَاشْرَبُوا وَالْبَسُوا وَتَصَدَّقُوا فِي غَيْرِ سَرَفٍ وَلَا مَخِيلَةٍ
“খাও, পান কর, পোশাক পরিধান কর এবং সদকা কর; তবে যেন তাতে অপচয় বা অহংকার না থাকে।”
সহীহ মুসলিম, হাদীস নং 5287


রাসূল ﷺ এর পোশাক

রাসূলুল্লাহ ﷺ বিভিন্ন দেশীয় পোশাক পরিধান করতেন, যেমন—

  • ইয়ামানী চাদর
  • রোমান পশমী চাদর ও জুব্বা
  • লুঙ্গি (إزار)
  • কামিজ (قميص)

তিনি সাধারণ, সংযমী ও সুন্দর পোশাক পছন্দ করতেন।

আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেনঃ

كَانَ أَحَبُّ الثِّيَابِ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ ﷺ الْقَمِيصُ
“রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নিকট সবচেয়ে প্রিয় পোশাক ছিল কামিজ (শার্ট)।”
সহীহ বুখারী, হাদীস নং 5827


পোশাকের শর‘ঈ বিধান (৬টি নীতিমালা)

১️⃣ সতর ঢাকা

  • পুরুষের জন্য: নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত অংশ আবৃত রাখা ফরয। পায়ের গোড়ালির ওপর পর্যন্ত কাপড় রাখা এবং মাথা ঢেকে রাখা সুন্নাহ।
  • নারীর জন্য: মুখমণ্ডল ও হাতের পাতা ব্যতীত পুরো শরীর আবৃত রাখা আবশ্যক। মুখ ও হাত ঢেকে রাখা উত্তম।

২️⃣ অপচয় বর্জন
৩️⃣ অহংকার বর্জন
৪️⃣ বিপরীত লিঙ্গের অনুকরণ না করা
৫️⃣ অমুসলিমদের বিশেষ পোশাক পরিহার করা
৬️⃣ স্বচ্ছ বা টাইট কাপড় পরিহার করা

প্রমাণ:
সহীহ মুসলিম শরীফ, খণ্ড ৭, হাদীস নং ৫২৮৭;
সহীহ বুখারী শরীফ, খণ্ড ১০, হাদীস নং ৫৩৭১, ৫৩৭৪, ৫৩৭৫, ২৩৫৪ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন সংস্করণ)।


তথাকথিত “সুন্নতী পোশাক” নিয়ে প্রতারণা

ভারত উপমহাদেশে অনেকেই দীর্ঘ পাঞ্জাবি, সাদা কলিদার কুর্তা ইত্যাদিকে “সুন্নতী পোশাক” বলে দাবি করেন, যা ইতিহাস ও দলীল দ্বারা সম্পূর্ণ অমূলক।

🔸 ১. ঐতিহ্যের ভুল ব্যাখ্যা

“পাঞ্জাবি” শব্দটি থেকেই বোঝা যায় এটি পাঞ্জাব অঞ্চলের পোশাক
আরবের যুগে (১৪০০ বছর আগে) এর অস্তিত্বই ছিল না।
এটি মূলত হিন্দু জমিদার, রাজনীতিবিদ ও অমুসলিমদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ছিল।

অতএব, এটিকে “সুন্নতী পোশাক” বলা মানে রাসূল ﷺ-এর নামে মিথ্যা আরোপ করা।

🔸 ২. মুসলিম বিশ্বের বাস্তবতা

সৌদি আরব, কুয়েত, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ইউরোপ বা আমেরিকার কোনো মুসলিম দেশেই “পাঞ্জাবি”কে সুন্নতী পোশাক বলা হয় না।
প্রত্যেকে তাদের স্থানীয় সংস্কৃতি ও আবহাওয়াভিত্তিক পোশাক পরে। ইসলাম তাতে বাধা দেয় না।

🔸 ৩. বিদ‘আতের হাতিয়ার

দুঃখজনকভাবে কিছু পীর ও মৌলভী এই তথাকথিত “সুন্নতী পোশাক” ব্যবহার করে মিলাদ, চল্লিশা, ওরশ ইত্যাদি বিদ‘আতপূর্ণ কার্যক্রমে অংশ নেন এবং অর্থ উপার্জনের মাধ্যম বানিয়ে ফেলেছেন।

এটি ইসলামের মৌলিক নীতির পরিপন্থী, কারণ ইসলাম পাদ্রি বা পুরোহিত শ্রেণি প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয় না।


বিভাজন ও ভুল ফতোয়া

এই পোশাক না পরলে অনেককে “সুন্নত বিরোধী”, “ওয়াহাবী”, “ইহুদি দালাল” বলে অপবাদ দেওয়া হয়।
অনেক সময় কুরআন-হাদীসভিত্তিক বক্তব্যও কেবল পোশাকের কারণে অগ্রাহ্য করা হয়।

এমন আচরণ ইসলাম সম্পর্কে চরম অজ্ঞতার পরিচায়ক।

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

مَنْ دَعَا رَجُلًا بِالْكُفْرِ أَوْ قَالَ عَدُوَّ اللَّهِ وَلَيْسَ كَذَلِكَ إِلَّا حَارَ عَلَيْهِ
“যে ব্যক্তি অন্য কাউকে কাফের বা আল্লাহর শত্রু বলে ডাকে অথচ সে তেমন নয়, তবে সে কথাই তার নিজের ওপর ফিরে আসে।”
সহীহ বুখারী, হাদীস নং 6104


ইসলামে পোশাকের স্বাধীনতা ও শালীনতা

ইসলাম কোনো রঙ, কাপড়, বা সংস্কৃতিগত পোশাকে জোর দেয় না।
বরং মূল উদ্দেশ্য হলো শালীনতা ও তাকওয়া।

রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজে বিভিন্ন দেশীয় পোশাক পরতেন এবং অন্যদেরও তাদের পোশাক সংস্কৃতি বজায় রাখতে নিষেধ করেননি।


💬 রাসূল ﷺ বলেছেন

إِنَّ اللَّهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্যকেই ভালোবাসেন।”
সহীহ মুসলিম, হাদীস নং 91

অতএব, পোশাকের সৌন্দর্য, পরিচ্ছন্নতা ও শালীনতা বজায় রাখা ইসলামী গুণ।
কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট পোশাককে সুন্নত ঘোষণা করা বা অন্যদের হেয় করা — তা ইসলামের বিপরীত।


উপসংহার

সুন্নতী পোশাক বলতে নির্দিষ্ট রঙ বা নকশার জামা বোঝায় না।
ইসলামে পোশাকের উদ্দেশ্য হলো সতর ঢাকা, শালীনতা, সৌন্দর্য, অপচয় ও অহংকার থেকে দূরে থাকা।

যে কেউ তার ব্যক্তিগত রুচি অনুযায়ী জুব্বা, পাঞ্জাবি বা পায়জামা পরতে পারেন —
কিন্তু সেটিকে সুন্নত বলে দাবি করা বা অন্যদের নিন্দা করা ভুল, এমনকি বিদ‘আতের শামিল হতে পারে।

ভুল বুঝবেন না প্লিজ — আমিও জুব্বা ও পায়জামা পরি, কারণ এটি আমার ভালো লাগে, ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার কারণে নয়।


লিখেছেন: মাহবুব ওসমানী – প্রকাশনা: Islamidawahcenter.com

Mahbub Osmane — একজন ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক এবং IslamiDawahCenter.com এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি কুরআন ও সহীহ হাদীসভিত্তিক বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। 

To learn more, comment below or message us on wa.me/+966549485900 or  wa.me/+8801716988953 or call us at +44-73801-27019. Email at hi@islamidawahcenter.com

আইডিসির সাথে যোগ দিয়ে উভয় জাহানের জন্য ভালো কিছু করুন।

ইসলামিক বিষয়ে জানতে এবং জানাতে এই গ্রুপে জয়েন করুন।

আইডিসি এবং আইডিসি ফাউন্ডেশনের ব্যপারে বিস্তারিত জানতে  লিংক০১ ও লিংক০২ ভিজিট করুন।

আইডিসি  মাদরাসার ব্যপারে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। 

আইডিসি এতীমখানা ও গোরাবা ফান্ডে দান করে  দুনিয়া এবং আখিরাতে সফলতা অর্জন করুন।

কুরআন হাদিসের আলোকে বিভিন্ন কঠিন রোগের চিকিৎসা করাতেআইডিসি ‘র সাথে