রফ’আয়-ইয়াদাইন (Rafay-Yadain) না করার হাদীস সমূহ!


লিখেছেন: মাহবুব ওসমানী, প্রকাশক: Islamidawahcenter.com

ভূমিকা:
নামাজে রুকুতে যাওয়ার আগে ও রুকু থেকে ওঠার পর হাত উঠানো (রফ’আয়-ইয়াদায়ন) একটি সুন্নাত আমল, যা নিয়ে ফিকহি ইখতিলাফ বিদ্যমান। বহু সহীহ হাদীসে রফ’আয়-ইয়াদায়নের প্রমাণ থাকলেও, কিছু সাহাবী ও তাবেঈ থেকে রফ’আয়-ইয়াদায়ন না করার আমলও প্রমাণিত। এই প্রবন্ধে আমরা বিশেষভাবে সেইসব হাদীস ও বর্ণনাগুলো উপস্থাপন করবো, যেগুলোতে নামাজে রফ’আয়-ইয়াদায়ন না করার কথা এসেছে।


প্রথম হাদীস: ইবনু মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: أَلَا أُصَلِّي بِكُمْ صَلَاةَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ فَصَلَّى فَلَمْ يَرْفَعْ يَدَيْهِ إِلَّا فِي أَوَّلِ مَرَّةٍ.
(سنن الترمذي، رقم الحديث: ৩৪২)
শ্রেণিবিন্যাস: হাসান

বাংলা অনুবাদ:
আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন, “তোমাদেরকে আমি কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সালাত দেখাবো না?” অতঃপর তিনি সালাত আদায় করলেন এবং প্রথম তাকবীর ছাড়া আর কখনও হাত উঠাননি।


দ্বিতীয় হাদীস: বারা ইবনে আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا افْتَتَحَ الصَّلَاةَ رَفَعَ يَدَيْهِ إِلَى مَنْكِبَيْهِ ثُمَّ لَا يَعُودُ
(سنن أبي داود، رقم الحديث: ৭৪৮)
শ্রেণিবিন্যাস: হাসান

বাংলা অনুবাদ:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সালাত শুরু করতেন, তখন কাঁধ পর্যন্ত হাত তুলতেন, তারপর আর পুনরায় তুলতেন না।


তৃতীয় হাদীস: আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত (মুঅাল্লাক)

فَإِذَا رَكَعَ لَمْ يَرْفَعْ يَدَيْهِ
(مصنف عبد الرزاق، رقم الحديث: ২৫৩১)

বাংলা অনুবাদ:
তিনি যখন রুকু করতেন, তখন আর হাত তুলতেন না।


তাবেঈদের বর্ণনা:

ইবনু সিরীন (রহঃ) বলেন:

كَانَ أَبُو بَكْرٍ وَعُمَرُ لَا يَرْفَعَانِ أَيْدِيَهُمَا إِذَا رَكَعَا
(مصنف ابن أبي شيبة، رقم الحديث: ২৪৪৩)

বাংলা অনুবাদ:
আবু বকর ও উমর (রাঃ) রুকুতে যাওয়ার সময় হাত তুলতেন না।


ফিকহি আলোচনা:

ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর মাযহাব অনুযায়ী রফ’আয়-ইয়াদায়ন শুধুমাত্র তাকবীরের সময়ই সুন্নাত, এরপর আর নয়। তাঁর দলীল উপরের হাদীসগুলো।

অন্যদিকে, ইমাম শাফেয়ী, মালিক ও আহমাদ (রহঃ) রফ’আয়-ইয়াদায়নকে সব অবস্থায় সুন্নাত বলেছেন (রুকুতে যাওয়া ও রুকু থেকে ওঠার সময়ও)।


রফ’আয়-ইয়াদায়ন করার হাদীসসমূহ

১. হাদীস: আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ)

عَنْ عَابِدٍ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ الزُّبَيْرِ، قَالَ: كَانَ ابْنُ عُمَرَ إِذَا دَخَلَ فِي الصَّلَاةِ كَبَّرَ وَرَفَعَ يَدَيْهِ، وَإِذَا رَكَعَ، وَإِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنَ الرُّكُوعِ، رَفَعَ يَدَيْهِ، وَقَالَ: ” هَكَذَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَفْعَلُ “
উৎস: সহীহ বুখারী, হাদীস নং 735

বাংলা অনুবাদ:
ইবনে উমর (রাঃ) বলেন: “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে এমন করতে দেখেছি যে, তিনি নামাজ শুরু করার সময়, রুকুতে যাওয়ার সময় এবং রুকু থেকে উঠার সময় হাত তুলতেন।”


২. হাদীস: মালিক ইবনুল হুয়াইরিস (রাঃ)

عَن مَالِكِ بْنِ الْحُوَيْرِثِ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ إِذَا كَبَّرَ رَفَعَ يَدَيْهِ، وَإِذَا رَكَعَ، وَإِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنَ الرُّكُوعِ
উৎস: সহীহ মুসলিম, হাদীস নং 391

বাংলা অনুবাদ:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাকবীর বলতেন, রুকু করতেন এবং রুকু থেকে উঠতেন—তিনবারই হাত তুলতেন।


৩. হাদীস: নাফি’ (রহঃ) মারফু’ বর্ণনা

إِنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَرْفَعُ يَدَيْهِ حَذْوَ مَنْكِبَيْهِ إِذَا افْتَتَحَ الصَّلَاةَ، وَإِذَا كَبَّرَ لِلرُّكُوعِ، وَإِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنَ الرُّكُوعِ
উৎস: সহীহ বুখারী, হাদীস নং 736

বাংলা অনুবাদ:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজ শুরু করার সময়, রুকুতে যাওয়ার সময় এবং রুকু থেকে উঠার সময় কাঁধসমান পর্যন্ত হাত তুলতেন।


৪. হাদীস: আবু কিলাবা (রহঃ) মারফু’ বর্ণনা

عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ كَانَ يَرْفَعُ يَدَيْهِ إِذَا دَخَلَ فِي الصَّلَاةِ، وَإِذَا رَكَعَ، وَإِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنَ الرُّكُوعِ، حَتَّى تُرَى بَيَاضُ إِبْطَيْهِ
উৎস: সহীহ মুসলিম, হাদীস নং 390

বাংলা অনুবাদ:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজ শুরু করার সময়, রুকুতে যাওয়ার সময় এবং রুকু থেকে উঠার সময় হাত তুলতেন, এমনকি তাঁর বগলের শুভ্রতা পর্যন্ত দেখা যেত।


ফিকহি আলোচনা:

এই হাদীসসমূহ ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমাদ ও ইমাম মালিক (রহঃ)-এর মতে, রফ’আয়-ইয়াদায়ন সবসময় করার সুন্নত প্রমাণ করে। এই প্রক্রিয়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বহুবার বিভিন্ন সাহাবীর মাধ্যমে বিভিন্ন সময় পালন করেছেন।

রফ’আয়-ইয়াদায়নের হাদীসগুলো সংখ্যায়ও বেশি এবং সহীহতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ। এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুস্পষ্ট সুন্নাত। ফলে যারা নিয়মিত রফ’আয়-ইয়াদায়ন করেন, তারা একটি প্রমাণিত সুন্নাতের অনুসরণকারী। তবে যারা করেন না, তারা অন্য সহীহ আমলের অনুসরণ করছেন। তাই মুসলিমদের উচিত পারস্পরিক সহনশীলতা বজায় রাখা এবং উভয় মতকে সম্মান করা।


রফ’আয়-ইয়াদায়ন করার পক্ষে এবং না করার পক্ষে হাদীসসমূহের তুলনামূলক বিশ্লেষণ নিচে দেওয়া হলো, যা আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে—কোনটা অধিক শক্তিশালী এবং কেন।


প্রথমে বুঝে নিই দুই পক্ষের মূল অবস্থান:

রফ’আয়-ইয়াদায়ন করার পক্ষে:

  • অধিকাংশ হাদীস সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম-এ বর্ণিত।

  • সাহাবাদের মধ্যে বিশেষ করে ইবনে উমর (রাঃ), মালিক ইবন হুয়াইরিস (রাঃ), আবু হুমায়দ (রাঃ) প্রমুখ থেকে স্পষ্ট বিবরণ।

  • এই হাদীসগুলোতে বলা হয়েছে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজ শুরু করার সময়, রুকুতে যাওয়ার সময় এবং রুকু থেকে উঠার সময় হাত তুলতেন।

উল্লেখযোগ্য হাদীস:

  • সহীহ বুখারী: 735, 736

  • সহীহ মুসলিম: 390, 391

  • এগুলোকে “মুতাওয়াতির আমলি হাদীস” বলা হয়—অর্থাৎ বহু সাহাবী দ্বারা একযোগে বর্ণিত আমল।


রফ’আয়-ইয়াদায়ন না করার পক্ষে:

  • প্রধান রেওয়ায়েত আসছে আবু হুরাইরা (রাঃ), আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এবং কিছু তাবেঈদের থেকে।

  • সাধারণত এসব হাদীস সুনান গ্রন্থসমূহে (আবু দাউদ, তিরমিযি) পাওয়া যায়।

  • কিছু হাদীসে বলা হয়েছে: “নবী (সা.) রুকুতে যাওয়ার সময় হাত তুলতেন না।”

উল্লেখযোগ্য হাদীস:

  • সুনান আবু দাউদ: 748

  • সুনান তিরমিযি: 342

  • তবে এই হাদীসগুলোর কিছু ইসনাদ দুর্বল অথবা মুখতালিফ (বিরোধপূর্ণ)


তুলনামূলক বিশ্লেষণ:

বিষয় রফ’আয়-ইয়াদায়ন করার পক্ষে রফ’আয়-ইয়াদায়ন না করার পক্ষে
হাদীসের গ্রন্থ সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম সুনান আবু দাউদ, তিরমিযি ইত্যাদি
রাবিদের শক্তি ইবনে উমর (রাঃ), মালিক ইবন হুয়াইরিস (রাঃ), নাফি’, যোহরি প্রমুখ ইবনে মাসউদ (রাঃ), আবু হুরাইরা (রাঃ)
সংখ্যা ও শুদ্ধতা বহু সহীহ সনদে, বারবার সীমিত এবং অনেকসময় দুর্বল সনদ
ফিকহি মত ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমাদ, ইমাম বুখারী ইমাম আবু হানিফা (রহ.)
সালাফদের আমল অধিকাংশ সাহাবী নিয়মিত করতেন কিছু সাহাবী করতেন না

ফিকহি বিশ্লেষণ:

  • ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেন:

    “রফ’আয়-ইয়াদায়ন করা সুন্নাত এবং তা কোনো সময় পরিত্যাগ করা উচিত নয়।”

  • ইমাম বুখারী (রহঃ) এক স্বতন্ত্র কিতাব লিখেছেন: “جزء رفع اليدين”, যেখানে তিনি বহু প্রমাণ সহ রফ’আয়-ইয়াদায়নের পক্ষে দলীল উপস্থাপন করেছেন।

  • ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-এর মাযহাবে রফ’আয়-ইয়াদায়ন একসময় ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে তা মансুখ (বাতিল) হয়েছে বলে মত দেওয়া হয়, তবে সে বিষয়ে স্পষ্ট সহীহ হাদীস অনুপস্থিত।


সিদ্ধান্ত:

রফ’আয়-ইয়াদায়ন করার পক্ষে দলীলসমূহ অধিক সংখ্যক, সহীহ, এবং প্রধান হাদীস সংকলনগুলোতে স্থান পেয়েছে।
অন্যদিকে, রফ’আয়-ইয়াদায়ন না করার হাদীস সংখ্যা ও মানের দিক দিয়ে দুর্বল ও সীমিত।

সুতরাং:

রফ’আয়-ইয়াদায়ন করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রমাণিত সুন্নাত এবং অধিক শক্তিশালী দলীলের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।

উপসংহার:

রফ’আয়-ইয়াদায়ন একটি ইখতিলাফি মাসআলা। কেউ করলে সুন্নাত অনুযায়ী করছেন, না করলেও তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্য প্রমাণিত আমলের অনুসরণ করছেন। আমরা মুসলিম হিসেবে কারো আমলকে বিদআত বা বাতিল বলা থেকে বিরত থাকি এবং পারস্পরিক ইখতিলাফকে সহনশীলতার সাথে মেনে চলি।


সম্পাদনা ও উপস্থাপনা: মাহবুব ওসমানী
সূত্র: সহীহ হাদীস সংকলন: তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনু আবী শাইবা, আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ।
প্রকাশিত: https://islamidawahcenter.com

🖋️ লেখক পরিচিতি:
মাহবুব ওসমানী — একজন ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক এবং Islamidawahcenter.com এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি কুরআন ও সহীহ হাদীসভিত্তিক বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

To learn more, comment below or message us on wa.me/+966549485900 / wa.me/+8801716988953 or call us at +44-73801-27019. Email at hi@islamidawahcenter.com

 

আইডিসির সাথে যোগ দিয়ে উভয় জাহানের জন্য ভালো কিছু করুন।