Rules of Qurbani and Eid ul Adha – ঈদুল আযহা, যিলহজ্ব মাসের আমল ও কুরবানী : ফযীলত, গুরুত্ব ও আহকাম

 

কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সামর্থ্যবান নর-নারীর উপর কুরবানী ওয়াজিব। এটি মৌলিক ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। আদম আ. থেকে সকল যুগে কুরবানী ছিল। তবে তা আদায়ের পন্থা এক ছিল না। শরীআতে মুহাম্মাদীর কুরবানী মিল্লাতে ইবরাহীমীর সুন্নত। সেখান থেকেই এসেছে এই কুরবানী। এটি শাআইরে ইসলাম তথা ইসলামের প্রতীকি বিধানাবলির অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এর মাধ্যমে শাআইরে ইসলামের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এছাড়া গরীব-দুঃখী ও পাড়া-প্রতিবেশীর আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শর্তহীন আনুগত্যের শিক্ষা রয়েছে কুরবানীতে। পাশাপাশি আল্লাহ তাআলার জন্য ত্যাগ ও বিসর্জনের ছবকও আছে এতে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

فصل لربك وانحر

 (তরজমা) অতএব আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামায পড়ুন এবং কুরবানী আদায় করুন।

অন্য আয়াতে এসেছে-

قل ان صلاتى ونسكى ومحياى ومماتى لله رب العالمين.

 (তরজমা) (হে রাসূল!) আপনি বলুন, আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ (অর্থাৎ আমার সবকিছু) আল্লাহ রাববুল আলামীনের জন্য উৎসর্গিত। (সূরা আনআম : ১৬২)

পশু জবাই করে কুরবানী করার মধ্যে এই হিকমত ও ছবকও আছে যে, আল্লাহর মুহববতে নিজের সকল অবৈধ চাহিদা ও পশুত্বকে কুরবানী করা এবং ত্যাগ করা। সুতরাং কুরবানী থেকে কুপ্রবৃত্তির দমনের জযবা গ্রহণ করা উচিত। তাই কুরবানীর মধ্যে ইবাদতের মূল বিষয় তো আছেই, সেই সাথে তাকওয়ার অনুশীলনও রয়েছে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

لن ينال الله لحومها ولا دمائها ولكن يناله التقوى منكم

 (তরজমা) (মনে রেখো, কুরবানীর জন্তুর) গোশত অথবা রক্ত আল্লাহর কাছে কখনোই  পৌঁছে না; বরং তাঁর কাছে কেবলমাত্র তোমাদের পরহেযগারিই পৌঁছে। (সূরা হজ্ব : ৩৭)

 

ঈদুল আযহা ২০২২ কত তারিখে? কোরবানির ঈদ কত তারিখে 2022

 

ঈদুল আযহা অর্থ্যাৎ কোরবানির ঈদ বাংলাদেশে ১০ জুলাই ২০২২ মঙ্গলবার শুরু হবে এবং মধ্যপাচ্যের দেশে ৯ জুলাই সোমবার থেকে ঈদুল আযহা ২০২২ শুরু হবে।

 

Rules of Qurbani and Eid ul Adha – ঈদুল আযহা, যিলহজ্ব ও কুরবানী : ফযীলত, গুরুত্ব ও আহকাম

 

কুরআনে কারীমের ভাষ্যমতে চারটি মাস অধিক সম্মানিত। আল্লাহ তাআলা বলেন,

اِنَّ عِدَّةَ الشُّهُوْرِ عِنْدَ اللّٰهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِیْ كِتٰبِ اللّٰهِ یَوْمَ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ مِنْهَاۤ اَرْبَعَةٌ حُرُمٌ.

আল্লাহ যেদিন আসমান যমীন সৃষ্টি করেছেন সেইদিন থেকেই মাসসমূহের গণনা আল্লাহ তাআলার নিকট তাঁর বিধান মতে বারটি। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত সুরা তাওবা (৯) : ৩৬

এই চারটি মাসের অন্যতম হল যিলহজ্ব মাস। আর এ মাসের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও ফযীলতপূর্ণ সময় হল আশারায়ে যিলহজ্ব’ অর্থাৎ যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশক।

যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশকের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা আল্লাহ তাআলা এই দশকের রাত্রীর শপথ করেছেন কুরআনে কারীমে। ইরশাদ হয়েছেوَ الْفَجْرِۙ وَ لَیَالٍ عَشْرٍ শপথ ফযরেরশপথ দশ রাত্রির সূরা ফাজর (৮৯) : ১-২

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও মুজাহিদ রাহ.সহ অনেক সাহাবীতাবেঈ ও মুফাসসির বলেনএখানে দশ রাত্রি’ দ্বারা যিলহজ্বের প্রথম দশ রাতকেই বুঝানো হয়েছে। তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৫৩৫

এই দশ দিনের নেক আমল আল্লাহ তাআলার নিকট সবচেয়ে প্রিয়। হাদীস শরীফে এসেছেহযরত ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেনরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

مَا مِنْ أَيَّامٍ الْعَمَلُ الصَّالِحُ فِيهَا أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ هَذِهِ الْأَيَّامِ يَعْنِي أَيَّامَ الْعَشْرِ، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَلَا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ؟ قَالَ: وَلَا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، إِلَّا رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ، فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَيْءٍ.

অর্থাৎ আল্লাহর নিকট যিলহজ্বের দশ দিনের নেক আমলের চেয়ে অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেনইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও (এর চেয়ে উত্তম) নয়তিনি বললেননাআল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে হাঁসেই ব্যক্তির জিহাদের চেয়ে উত্তম যে নিজের জান-মাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য বের হয়েছে। অতপর কোনো কিছু নিয়ে ঘরে ফিরে আসেনি। সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৪৩৮সহীহ বুখারীহাদীস ৯৬৯জামে তিরমিযীহাদীস ৭৫৭সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ১৭২৭মুসনাদে আহমদহাদীস ১৯৬৮

আরেকটি হাদীসে এসেছেহযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

أَفْضَلُ أَيَّامِ الدُّنْيَا أَيَّامُ الْعَشْرِ، عَشْرِ ذِي الْحِجَّةِ، قَالَ: وَلَا مِثْلُهُنَّ فِي سَبِيلِ اللَّهِ؟ قَالَ: لَا مِثْلُهُنَّ فِي سَبِيلِ اللَّهِ , إِلَّا رَجُلٌ عَفَّرَ وَجْهَهُ فِي التُّرَابِ.

অর্থাৎ দুনিয়ার সর্বোত্তম দিনগুলো হলযিলহজ্বের দশদিন। জিজ্ঞাসা করা হলআল্লাহর রাস্তায়ও কি তার সমতুল্য নেইতিনি বললেনআল্লাহর রাস্তায়ও তার সমতুল্য নেই। তবে ঐ ব্যক্তি যার চেহারা ধুলিযুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ শাহাদাত লাভ করেছে। মুসনাদে বাযযারহাদীস ১১২৮মুসনাদে আবু ইয়ালাহাদীস ২০১০মাজমাউল যাওয়াইদ ৪/৮; (قال الهيثمي : إسناده حسن ورجاله ثقاتহাদিসটির সনদ হাসান

এসব হাদীসের কারণেই যিলহজ্বের প্রথম দশকের আমলকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই দশকের মধ্যে বেশ কয়েকটি আমল রয়েছে।

 

যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশকের আমল

 

যেমনঃ

  • ১. নখ-চুল না কাটা।
  • ২. রাত্রগুলোতে বেশি যিকর-তাসবীহ করা।
  • ৩. প্রথম নয় দিন রোযা রাখা।
  • ৪. আরাফার দিন অর্থাৎ নয় যিলহজ্ব রোযা রাখা।
  • ৫. তাকবীরে তাশরীক পড়া।
  • ৬. কুরবানী করা।
  • ৭. ঈদুল আযহার নামায পড়া।
  • ৮. ঈদ ও আইয়ামে তাশরীকে রোযা না রাখা।

নিম্নে এসব বিষয়ের হাদীস এবং সংশ্লিষ্ট মাসায়েল আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

 

 

নখ-চুল না কাটা

عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِذَا رَأَيْتُمْ هِلَالَ ذِي الْحِجَّةِ، وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ، فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعْرِهِ وَأَظْفَارِهِ.

অর্থ : উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিতনবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনযখন যিলহজ্বের দশক শুরু হবে তখন তোমাদের মধ্যে যে কুরবানী করবে সে যেন তার চুল নখ না কাটে। সহীহ মুসলিমহাদীস ১৯৭৭জামে তিরমিযীহাদীস ১৫২৩

এই হাদীসের উপর ভিত্তি করে ফকীহগণ কুরবানীকারীরর জন্য নখ-চুল না কাটাকে মুস্তাহাব বলেছেন। তবে এ হুকুম তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে যারা যিলকদের শেষে নখ-চুল কেটেছে। অন্যথায় নখ-চুল বেশি লম্বা হয়ে যাবে। যা সুন্নাতের খেলাফ। আর যে ব্যক্তি কুরবানী করবে না তার জন্য এ হুকুম প্রযোজ্য কি না এ ব্যাপারে কেউ কেউ বলেছেনএ হুকুম শুধুমাত্র কুরবানীকারীদের জন্য প্রযোজ্য। তাদের দলীল পূর্বোক্ত হাদীস। আর কেউ কেউ বলেনকুরবানী যারা করবে না তাদের জন্যও। তাদের দলীল হল :

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لِرَجُلٍ: أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى عِيدًا جَعَلَهُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لِهَذِهِ الْأُمَّةِ، فَقَالَ الرَّجُلُ: أَرَأَيْتَ إِنْ لَمْ أَجِدْ إِلَّا مَنِيحَةً أُنْثَى أَفَأُضَحِّي بِهَا؟ قَالَ: لَا، وَلَكِنْ تَأْخُذُ مِنْ شَعْرِكَ، وَتُقَلِّمُ أَظْفَارَكَ، وَتَقُصُّ شَارِبَكَ، وَتَحْلِقُ عَانَتَكَ، فَذَلِكَ تَمَامُ أُضْحِيَّتِكَ عِنْدَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ.

অর্থ : আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনআমাকে কুরবানীর দিবসে ঈদ (পালনের) আদেশ করা হয়েছে। যা আল্লাহ এ উম্মতের জন্য নির্ধারণ করেছেন। এক সাহাবী আরজ করলেনইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানিহা থাকে (অর্থাৎ অন্যের থেকে নেওয়া দুগ্ধ দানকারী উটনী) আমি কি তা কুরবানী করতে পারিনবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেননাতবে তুমি চুলনখ ও মোঁচ কাটবে এবং নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর দরবারে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে। সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৭৮৯সুনানে নাসায়ীহাদীস ৪৩৬৫

এই হাদীসে যেহেতু কুরবানীর দিন চুল-নখ কাটার কথা আছে তাহলে এর আগে না কাটার দিকে ইঙ্গিত বুঝা যায়।

২. ওলীদ বিন মুসলিম বলেনআমি মুহাম্মাদ বিন আজলানকে যিলহজ্বের দশকে চুল কাটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তখন তিনি বললেনআমাকে নাফে রাহ বলেছেন যে,

إن ابن عمر مر بامرأة تأخذ من شعر ابنها في الايام العشر فقال : لو أخرتيه إلى يوم النحر كان أحسن.

অর্থ : আব্দুল্লাহ ইবনে উমর এক নারীর নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। মহিলাটি যিলহজ্বের দশকের ভেতর তার সন্তানের চুল কেটে দিচ্ছিল। তখন তিনি বললেনযদি ঈদের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে তবে বড় ভাল হত। মুস্তাদরাকে হাকেমহাদীস ৭৫৯৫

৩. এ সম্পর্কে আরেকটি বর্ণনা হল,

قال مسدد وحدثنا المعتمر بن سليمان التيمي سمعت أبي يقول : كان ابن سيرين يكره إذا دخل العشر أن يأخذ الرجل من شعره حتى يكره أن يحلق الصبيان في العشر.

মুতামির ইবনে সুলাইমান আততাইমী  বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি যে ইবনে সীরীন রাহ. যিলহজ্বের দশকে চুল কাটা অপছন্দ করতেন। এমনকি এই দশকে ছোট বাচ্চাদের মাথা মুÐণ করাকেও অপছন্দ করতেন। আল মুহাল্লাইবনে হাযম ৬/২৮

এসব দলীলের কারণে কারো কারো মতে সকলের জন্যই যিলহজ্বের প্রথম দশকে নখগোফ ও চুল না-কাটা উত্তম। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেইএ বিধানটি কুরবানিদাতার জন্য তাকিদপূর্ণতার জন্য তা সুন্নত।

যিলহজ্বের প্রথম দশদিন বেশি বেশি ইবাদত ও যিকর করা

عَنْ ابْنِ عُمَرَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: ” مَا مِنْ أَيَّامٍ أَعْظَمُ عِنْدَ اللهِ وَلَا أَحَبُّ إِلَيْهِ الْعَمَلُ فِيهِنَّ مِنْ هَذِهِ الْأَيَّامِ الْعَشْرِ، فَأَكْثِرُوا فِيهِنَّ مِنَ التَّهْلِيلِ وَالتَّكْبِيرِ وَالتَّحْمِيدِ .

অর্থ : আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনআল্লাহ তাআলার নিকট আশারায়ে যিলহজ্বের আমলের চেয়ে অধিক মহৎ এবং অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সুতরাং তোমরা এই দিনগুলোতে বেশি বেশি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহআল্লাহু আকবার এবং আলহামদু লিল্লাহ পড়।মুসনাদে আহমদ ২/৫৭হাদীস ৫৪৪৬তবারানী কাবীর ১১/৬৮ হাদীস১১১১৬মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহাদীস ১৪১১০

 

যিলহজ্বের প্রথম নয় দিন রোযা রাখা

 

সুনানে আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমাদের একটি বর্ণনায় এসেছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই নয়টি দিবসে রোযা রাখতেন। সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৪৩৭মুসনাদে আহমদহাদীস ২২২৩৪সুনানে নাসাঈহাদীস ২৪১৬

এছাড়াও এ দিনগুলোর রোযা সম্পর্কে একাধিক বর্ণনা আছে। যেগুলোর প্রায় সবই জঈফ পর্যায়ের।  তবে সমষ্টিগত বিচারে তা আমলযোগ্য। অধিকাংশ ফকীহগণ এই নয় দিনে রোযা রাখা উত্তম বলেছেন।

 

নয় যিলহজ্ব রোযা রাখা মুস্তাহাব

 

عَنْ أَبِي قَتَادَةَ  قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ، وَالسَّنَةَ الَّتِي بَعْدَهُ.

অর্থাৎআবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেননবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনইয়াওমে আরাফার (নয় যিলহজ্ব) রোযার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদীতিনি এর দ্বারা এর আগের এক বছরের এবং পরের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন। সহীহ মুসলিমহাদীস ১১৬২জামে তিরমিযীহাদীস ৭৪৯সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৪২৫

প্রকাশ থাকে যেউক্ত হাদীসে বর্ণিত ইয়াওমে আরাফা দ্বারা যিলহজ্বের নয় তারিখ উদ্দেশ্য। এই তারিখের পারিভাষিক  নাম হচ্ছে ইয়াওমে আরাফা। কেননা এই রোযা আরাফার ময়দানের আমল নয় বরং আরাফার দিন তো হাজ্বীদের জন্য রোযা না রাখাই মুস্তাহাব। যেমন হাদীস শরীফে এসেছে,

عَنْ أُمِّ الْفَضْلِ بِنْتِ الْحَارِثِ، ” أَنَّ نَاسًا تَمَارَوْا عِنْدَهَا يَوْمَ عَرَفَةَ، فِي صِيَامِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ بَعْضُهُمْ: هُوَ صَائِمٌ، وَقَالَ بَعْضُهُمْ: لَيْسَ بِصَائِمٍ، فَأَرْسَلْتُ إِلَيْهِ بِقَدَحِ لَبَنٍ، وَهُوَ وَاقِفٌ عَلَى بَعِيرِهِ بِعَرَفَةَ، فَشَرِبَهُ “

উম্মুল ফযল বিনতে হারেছ বলেনতার নিকট কতক লোক ইয়াওমে আরাফায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রোযার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করছিল। কেউ কেউ বলছিল তিনি রোযা আছেন। আর কেউ কেউ বলছিল তিনি রোযা নেই। উম্মুল ফযল একটি পেয়ালাতে দুধ পাঠালেন। নবীজী তখন উটের উপর ছিলেন। তিনি দুধ পান করলেন। সহীহ মুসলিমহাদীস ১১২৩

আরাফার দিন আল্লাহর রাসূল রোযা রাখেননি। একারণে ফিকহবিদগণ হাজ্বীদের জন্য আরাফার দিন রোযা না রাখা উত্তম বলেছেন। আবু কাতাদা রা. -এর উক্ত হাদীস দ্বারা ইয়াওমে আরাফায় রোযা রাখা মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়। সুতরাং বুঝা গেল আবু কাতাদাহ রা.-এর হাদীসে ইয়াওমে আরাফা’ দ্বারা নয় যিলহজ্ব অর্থাৎ ঈদের আগের দিনই উদ্দেশ্য। সুতরাং আমাদের দেশের চাঁদের হিসেবে যেদিন নয় তারিখ হয় সে দিনই ইয়াওমে আরাফা হিসেবে রোযা রাখা মুস্তাহাব হবে। সৌদীর হিসাবে আরাফার দিন অনুযায়ী নয়। উল্লেখ্য তাকবীরে তাশরীক সংক্রান্ত নিন্মোক্ত হাদীসেও ইয়াওমে আরাফা দ্বারা নয় যিলহজ্বই উদ্দেশ্য। কেননা এ আমল ও আরাফার সাথে নির্দিষ্ট কোনো আমল নয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন মাসিক আলকাউসার জানুয়ারী ২০১৩ ঈ. (দুটি প্রশ্ন ও তার উত্তর)

 

তাকবীরে তাশরীক পড়া

 

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,

وَ اذْكُرُوا اللّٰهَ فِیْۤ اَیَّامٍ مَّعْدُوْدٰتٍ অর্থাৎ আর তোমরা আল্লাহকে স্মরণ কর (আইয়ামে তাশরীকের) নির্দিষ্ট দিনগুলোতে।সূরা বাকারা (১) : ২০৩

একাধিক সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে প্রমাণিত আছে যেতারা নয় তারিখ আরাফার দিন ফজর থেকে তের তারিখ আসর পর্যন্ত তাকবীর পড়তেন। তন্মধ্যে হলেনউমার ইবনুল খাত্তাবআলী ইবনে আবি তালিবআব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. যুহরীমাকহুলসুফিয়ান সাওরীসহ প্রমুখ সাহাবা-তাবেয়ীগণ।

তাকবীরে তাশরীকের জন্য বিভিন্ন শব্দ হাদীসে উল্লেখ হয়েছে। তন্মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বজনবিদিত পাঠ হল,

الله أكبر، الله أكبر، لا إله إلاالله والله أكبر، الله أكبر ولله الحمد.

মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহাদীস ৫৬৯৬-৯৯আল আওসাতইবনে মুনযির ৪/৩৪৯এলাউস সুনান ৮/১৫৬বাদায়েউস সানায়ে ১/৪৫৮

মাসআলা : নয় যিলহজ্ব হতে তের যিলহজ্ব আছর পর্যন্ত মোট তেইশ ওয়াক্তের নামাযের পর একবার করে তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব। জামাতে নামায পড়া হোক বা একাকিপুরুষ বা নারীমুকীম বা মুসাফির সকলের উপর ওয়াজিব।

মাসআলা : প্রত্যেক ফরয নামাযের সালামের পর পরই কোনো কথাবার্তা বা নামায পরিপন্থী কোনো কাজ করার আগেই তাকবীরে তাশরীক পড়তে হবে। মাসআলা : তাকবীরে তাশরীক পুরুষের জন্য জোরে পড়া ওয়াজিব। আস্তে পড়লে তাকবীরে তাশরীক পড়ার হক আদায় হবে না। আর মহিলাগণ নি¤œ আওয়াজে অর্থাৎ

নিজে শুনতে পায় এমন আওয়াজে পড়বে। রদ্দুল মুহতার ২/১৭৮এলাউস সুনান ৮/১৫২

মাসআলা : শুধু পাঁচ ওয়াক্ত ফরযের পর তাকবীরে তাশরীক পড়তে হবে। বিতরের পর এবং অন্য কোনো সুন্নাত বা নফলের পরে পড়ার নিয়ম নেই।

মাসআলা : ইমাম তাকবীর বলতে ভুলে গেলে মুক্তাদীগণ ইমামের জন্য অপেক্ষা না করে নিজেরা তাকবীর বলবেন।

মাসআলা : নয় তারিখ থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত কোনো নামায কাযা হয়ে গেলে এবং ঐ কাযা এই দিনগুলোর ভিতরেই আদায় করলে সে কাযা নামাযের পরও তাকবীরে তাশরীক পড়বে।

মাসআলা : হাজ্বীদের উপর ইহরাম অবস্থায় পূর্বোক্ত নিয়ম অনুযায়ী তাকবীরে তাশরীক পড়া ওয়াজিব।

তাকবীরে তাশরীক সংক্রান্ত মাসায়েলের জন্য দেখুন : রদ্দুল মুহতার ২/১৭৭-১৮০ফাতওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২আল বাহরুর রায়েক ২/১৬৪-১৬৫তাহতাবী আলাল মারাকী ২৯৪;

ঈদুল আযহার নামায

ঈদুল আযহার নামায প্রত্যেক সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন পুরুষের উপর ওয়াজিব। মেয়েদের উপর ওয়াজিব নয়। মেয়েরা ঈদের নামাযের জন্য ইদগাহে যাবে না। তেমনিভাবে নিজ গৃহে নিজেরা জামাত করেও পড়বে না।

عن نافع عن ابن عمر أنه كان لا يخرج نسائه في العيدين.

অর্থাৎ নাফে রাহ. বলেনআব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. তাঁর নারীদেরকে দুই ঈদে ঈদগাহে যেতে দিতেন না। আল আওসাত ৪/৩০১

অন্য বর্ণনায় এসেছে,

عن عروة عن أبيه أنه كان لا يدع امرأة من أهله تخرج إلى فطر ولا إلى أضحى.

উরওয়া তার পিতা (যুবাইর রা.) থেকে বর্ণনা করেন যেতিনি নিজ পরিবারের নারীদেরকে ঈদুল ফিতর ও ইদুল আযহাতে যেতে দিতেন না।  মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবাহাদীস ৫৮৪৬

ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আল আলআনসারী রাহ. (১৪৩ হি.) বলেন,

لا نعرف خروج المرأة الشابة عندنا في العيدين

অর্থাৎআমাদের সময়ে দুই ঈদের জন্য যুবতী নারীদের বের হওয়ার প্রচলন ছিল না। আল আওসাত ৪/৩০২উমদাতুল কারী ৩/৩০৫

ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন,

يكره خروج النساء في العيدين.

উভয় ঈদে মহিলাদের (নামাযের জন্য) বাইরে যাওয়া মাকরূহ। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৪/২৩৪

দেখুন : কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মাদীনা ১/২০১কিতাবুল আছার ২৪৭হেদায়া ১/১২৬বাদায়েউস সানায়ে ১/৬১৭আদ্দুররুল মুখতার ১/৫৬৬মাসাইলুল ইমাম  আহমদ ১১৫; আল মুদাওওয়ানা ১/১৫৫শরহুল মুহাযযাব ৫/১৩

 

ঈদের দিনের সুন্নতসমূহ

১. মিসওয়াকসহ অযু করে উত্তমরূপে গোসল করা। ২. নিজের উত্তম কাপড় পরা। ইবনে উমর রা. বলেননবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম দুই ঈদে উত্তম কাপড় পরতেন। ৩. সুগন্ধি ব্যবহার করা। ৪. কুরবানীর ঈদে নামাযের আগে কিছু না খাওয়া মুস্তাহাব। কোনো কোনো ফকীহের মতেযে কুরবানী করবে না তার জন্যও ঈদের নামাযের আগে খানা থেকে বিরত থাকা মুস্তাহাব। হাদীস শরীফে এসেছেরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরে কিছু না খেয়ে নামাযের জন্য বের হতেন নাআর কুরবানীর ঈদে নামাযের আগে কিছু খেতেন না। জামে তিরমিযী ১/৭১হাদীস ৫৪২;

শাবী রাহ. বলেনসুন্নত হলঈদুল ফিতরের দিন নামাযে যাওয়ার আগে খাওয়া আর ঈদুল আযহার দিন নামায পর্যন্ত খাবারকে বিলম্বিত করা। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৫৬৩৭

হযরত বুরাইদা রা. বলেন,

أن النبي صلى الله عليه وسلم كان لا يخرج يوم الفطر حتى يطعم وكان لا يأكل يوم النَّحْرِ شيأ حتى يرجع، فيأكل من أضحيته.

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের জন্য না খেয়ে বের হতেন না। আর ঈদুল আযহাতে নামাযের থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত কিছু খেতেন না। এরপর প্রথমে কুরবানীর গোস্ত খেতেন। মুসনাদে আহমদহাদীস ২২৯৮সুনানে দারাকুতনী ১/৪৫হাদীস ১৭১৫মেরকাত ৩/৪৯২মাআরিফুস সুনান ৪/৪৫১শরহে মুনয়া ৫৬৬রদ্দুল মুহতার ২/১৭৬ফাতওয়ায়ে হিন্দিয়া ১/২১১বাদায়েউস সানায়ে ১/৬২৪

৫. ওযর না থাকলে ঈদগাহে নামায পড়া। আবু সাঈদ রা. বলেননবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতর এবং আযহাতে ইদগাহে যেতেন। সহীহ বুখারী ১/১৩১

৬. রাস্তায় উচ্চস্বরে তাকবীরে তাশরীক পড়া।

৭. সম্ভব হলে এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া এবং অন্য রাস্তা দিয়ে আসা। সহীহ বুখারীহাদীস ৯৮৬

মাসআলা : ঈদের নামাযের পূর্বে কোথাও কোনো ধরনের নফল নামায না পড়া এবং নামাযের পর ঈদগাহেও না পড়া। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দুই রাকাত নামায পড়েছেনকিন্তু এর আগে বা পরে কোনো নামায পড়েননি। সহীহ বুখারীহাদীস ৯৬৪

 

কুরবানী করা

ঈদের নামাযের পর কুরবানী করা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَ انْحَرْ.

অর্থাৎ আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামায পড়ন এবং কুরবানী করুন।

হাদীস শরীফে এসেছে,

خَطَبَنَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ النَّحْرِ، قَالَ: إِنَّ أَوَّلَ مَا نَبْدَأُ بِهِ فِي يَوْمِنَا هَذَا أَنْ نُصَلِّيَ، ثُمَّ نَرْجِعَ، فَنَنْحَرَ فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَقَدْ أَصَابَ سُنَّتَنَا، وَمَنْ ذَبَحَ قَبْلَ أَنْ يُصَلِّيَ، فَإِنَّمَا هُوَ لَحْمٌ عَجَّلَهُ لِأَهْلِهِ لَيْسَ مِنَ  النُّسُكِ فِي شَيْءٍ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্যে খুৎবা দিলেন। তাতে বললেনআমাদের এই দিবসে প্রথম কাজ (ঈদের) নামায আদায় করা এরপর কুরবানী করা। সুতরাং যে এভাবে করবে তার কাজ আমাদের তরীকা মত হবে। আর যে (ঈদের নামাযের) আগেই যবেহ করবে (তার কাজ তরীকা মত হবে না) তা পরিবারের জন্য প্রস্তুতকৃত সাধারণ গোস্ত হবেকুরবানী নয়। সহীহ বুখারীহাদীস ৯৬৮সহীহ মুসলিমহাদীস ১৯৬০

হাদীসে এসেছে যেকোনো ব্যক্তি ঈদের নামাযের আগে কুরবানী করেছিলেনতখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে পুনরায় কুরবানী করার আদেশ দেন। সহীহ বুখারীহাদীস ৫৫০০সহীহ মুসলিমহাদীস ১৯৬০

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে কুরবানী করেছেন

ذَبَحَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ الذَّبْحِ كَبْشَيْنِ أَقْرَنَيْنِ أَمْلَحَيْنِ مُوجَأَيْنِ، فَلَمَّا وَجَّهَهُمَا قَالَ: إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ عَلَى مِلَّةِ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا، وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ، إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِين.َ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ، اللَّهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ، وَعَنْ مُحَمَّدٍ وَأُمَّتِهِ بِاسْمِ اللَّهِ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ. ثُمَّ ذَبَحَ.

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন দুটি সাদা কালো বড় শিংবিশিষ্ট খাসিকৃত দুম্বা যবেহ করেছেন। যখন যবেহ করার জন্য শোয়ালেনতখন বললেন,

إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَوَاتِ 

এরপর বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে যবাই করলেন। মুসনাদে আহমদ হাদীস ১৫০২২সুনানে আবু দাউদহাদীস ৩৮৬সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ২২৫

হযরত শাদ্দাদ বিন আওস রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

إِنَّ اللهَ كَتَبَ الْإِحْسَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ، فَإِذَا قَتَلْتُمْ فَأَحْسِنُوا الْقِتْلَةَ، وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأَحْسِنُوا الذَّبْحَ، وَلْيُحِدَّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَهُ، فَلْيُرِحْ ذَبِيحَتَهُ.

অর্থ : আল্লাহ তাআলা সব কিছু সুন্দরভাবে সম্পাদন করার নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা যখন হত্যা করবে তো সুন্দরভাবে হত্যা কর। যখন যবেহ করবে তখন উত্তমরূপে যবেহ কর। প্রত্যেকে যেন তার ছুরিতে শান দেয় এবং তার পশুকে শান্তি দেয়। সহীহ মুসলিমহাদীস ১৯৫৫সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৮১৫

সুতরাং পশু-কুরবানীর ক্ষেত্রে পশুর অতিরিক্ত কষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ছুরি ভালভাবে ধার করে নিতে হবে। পশু ঠাণ্ডা হওয়ার আগে তার হাত পা কাটা কিংবা চামড়া ছেলা থেকে বিরত থাকতে হবে। তদ্রূপ কেউ কেউ পশুকে যবহের অনেক আগে হাত পা বেঁধে ফেলে রাখে। এতে পশুর অতিরিক্ত কষ্ট হয়। তেমনি কোনো পশুর সামনে অন্য পশুকে যবেহ করবে না।

 

কুরবানীর গুরুত্বঃ কুরবানি কি ওয়াজিব, না সুন্নাহ?

 

কুরবানি যে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান সে ব্যাপারে সকল মুসলিম একমত। এ ব্যাপারে কারও কোন দ্বিমত নেই।[1] তবে, কুরবানির হুকুম কি? ওয়জিব না সুন্নাহ? এ বিষয়ে ফকিহদের মাঝে দু’টো মত রয়েছে।

প্রথম মত: কুরবানি ওয়াজিব। ইমাম আওযায়ি, ইমাম লাইস, ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুমুল্লাহ) প্রমুখের মত এটা। আর ইমাম মালিক ও ইমাম আহমাদের একটি মতেও কুরবানি ওয়াজিব।

দ্বিতীয় মত: কুরবানি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বা অত্যন্ত তাকিদপূর্ণ সুন্নাহ। এটা অধিকাংশ আলিমদের মত। ইমাম মালিক ও শাফিয়ির প্রসিদ্ধ মত। কিন্তু এ মতের প্রবক্তারা আবার বলেছেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি পরিত্যাগ করা মাকরুহ। যদি কোন জনপদের লোকেরা সমর্থ্য হওয়া সত্ত্বেও সম্মিলিতভাবে কুরবানি পরিত্যাগ করে তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। কেননা, কুরবানি হলো ইসলামের একটি শিয়ার বা মহান নিদর্শন।[2]

যারা কুরবানি ওয়াজিব বলেন তাদের দলিল

১. আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন,

﴿فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنۡحَرۡ﴾

‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো ও পশু কুরবানি করো।’[3]

আর আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো ব্যাপারে নির্দেশ দেন সাধারণত সেটা পালন করা ওয়াজিবই হয়ে থাকে।

২. আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

«مَنْ وَجَدَ سَعَةً فَلَمْ يُضَحِّ فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا»

‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারেকাছেও না আসে।’[4]

সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি পরিত্যাগকারীদের জন্য এটি একটি ধমকি ও সতর্কবাণী। আর সাধারণত এধরনের ধমকি উজুবাতের ক্ষেত্রেই আসে। তাই কুরবানি ওয়াজিব।

৩. মিখনাফ ইবনু মুসলিম থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

«يَا أَيُّهَا النَّاسُ عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِي كُلِّ عَامٍ أُضْحِيَّةٌ»

‘হে মানব সকল! প্রত্যেক পরিবারের দায়িত্ব হলো প্রতি বছর কুরবানি দেয়া।’[5]

যারা কুরবানি সুন্নাত বলেন তাদের দলিল

১. উম্মু সালামা (রা.) বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

«إِذَا رَأَيْتُمْ هِلالِ ذِي الْحِجَّةِ وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ ، فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعَرِهِ وَأَظْفَارِهِ»

‘তোমাদের মাঝে যে কুরবানি করতে চায়, যিলহয মাসের চাঁদ দেখার পর সে যেন কুরবানি সম্পন্ন করার আগে তার কোন চুল ও নাখ না কাটে।’[6]

এ হাদিসে ‘যে কুরবানি করতে চায়’ কথা দ্বারা বুঝা যায় এটা ওয়াজিব নয়।

২. রাসূল (সা.) তার উম্মতের যারা কুরবানি করেনি তাদের পক্ষ থেকে কুরবানি করেছেন। এদ্বারাও বোঝা যায়, কুরবানি ওয়াজিব নয়।

আল্লামা ইবনু উসাইমিন (রহ.) উভয় পক্ষের দলিল-প্রমাণ উল্লেখ করার পর বলেন, ‘এ সকল দলিল-প্রমাণ পরস্পর বিরোধী নয়; বরং একটা অন্যটার সম্পূরক।’ তাছাড়া, উভয়পক্ষের দলিল সমানভাবে বলিষ্ঠ। যাতে কোন একটার প্রতি পক্ষপাতিত্ব সহজ নয়। এ কারণে কিছু আলিম কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার পক্ষ সমর্থন করেন। তাদের মধ্যে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া অন্যতম। কিন্তু অধিকাংশ সাহাবা, তাবিয়িন এবং ফকিহগণের মতে কুরবানি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা (তাকিদপ্রাপ্ত সুন্নাত)। অবশ্য মুসলিমের জন্য উচিত হচ্ছে, সামর্থ্য থাকলে কুরবানি ত্যাগ না করা। উচিত নিজের ও পরিবার-পরিজনের তরফ থেকে কুরবানি করা। যাতে আল্লাহর আদেশ পালনে এবং মহানবির অনুকরণে বিরাট সওয়াবের অধিকারী হওয়া যায়।

চলবে…।

[1] ইবনু কুদামা, আলমুগনি, ১৩/৩৬০; আসকালানি, ফাতহুল বারি, ১০/৩

[2] ইবনু উসাইমিন, আহকামুল উদহিয়্যাহ, পৃ. ২৬

[3] সুরা কাওসার : ২

[4] আহমাদ, আলমুসনাদ : ১৬/৪৬৬; ইবনু মাজাহ, আসসুনান : ৩১২৩

[5] ইবনু মাজাহ, আসসুনান : ৩১২৫

[6] মুসলিম, আসসাহিহ : ১৯৭৭

কুরবানী করা ওয়াজিবঃ একটি দালিলীক বিশ্লেষণ

 মুফতি মীযানুর রহমান সাঈদ

কুরবানি করা ওয়াজিব না-কি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা এ ব্যাপারে ফকীহগণের মতবিরোধ অনেক আগ থেকেই। ইমাম আবু হানীফা রহ., ইমাম রাবিয়াতুর রায় রহ., ইমাম আওযাঈ, ইমাম লাইস বিন্ সা’দ মিশারি, ইমাম সুফিয়ান ছাওরী, ইব্রাহিম নাখয়ী এবং ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি সহ বিশ্বের বহু ইমাম-মুজতাহিদগণ কুরবানি করা ওয়াজিব বলে মত ব্যক্ত করেছেন। তাবেয়ীনদের মধ্যে ইমাম মুজাহিদ, ইমাম মাকহুল এবং ইমাম শা‘বী রহ.ও এ মত পোষণ করেছেন।

পক্ষান্তরে ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমদ রহ. সহ বহু তাবেয়ী ও ফকিহগণ এবং ইমাম মালিকের এক বর্ণনা রয়েছে যে, কুরবানি করা ওয়াজিব নয়; বরং সুন্নাত। (মুগনি, ইবনে কুদামা, মুহাল্লা, ইবনে হাযম)
উভয় পক্ষের ইমামগণ তাঁদের গবেষণা ও ইজতিহাদ অনুযায়ী স্ব-স্ব মতের পক্ষে কুরআন-সুন্নাহ’র দলিল পেশ করেছেন। তাঁরা কেউ-ই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরোধীতা বা কুরআন-সুন্নাহ’র বিপক্ষে গিয়ে কিছু বলেননি। যেহেতু এই বিষয়ের উপর কুরআন-সুন্নাহর মধ্যে যত প্রমাণাদি রয়েছে তাতে উভয় মতের সম্ভাবনা বিদ্যমান ছিলো। এইসব ক্ষেত্রে মুজতাহিদগণের দায়িত্ব নিজ-নিজ যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে সূক্ষ্ম দক্ষতার সাথে বিবেচনা করে আল্লাহ এবং রাসূলের বাণীর সঠিক মর্ম উদ্ঘাটন করে সে মতে ফতোয়া দেয়া। আর তাঁদের (মাযহাব) মতামত অনুসরণ করে ইসলামের উপর আমল করে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সচেষ্ট হওয়া-ই সাধারণ উম্মতের কর্তব্য।

কিন্তু বর্তমানে একদল আলেম ও স্ব-ঘোষিত প-িত দাবি করেন যে, পূর্ব যুগের মনীষীগণ ইজতিহাদ করে উম্মাহর জন্য যা করেছেন তা যথেষ্ট নয়; বরং নিজেরা সরাসরি কুরআন-হাদিসে নতুন করে গবেষণা করবেন এবং নিজেদের জ্ঞান অনুপাতে যা কিছু বুঝে আসে তা-ই বয়ান করবেন এবং তদানুযায়ী ফতোয়া জারি করবেন। উপরন্তু তারা যা কিছু উদ্ভাবন করে ব্যক্ত করবেন এটাই একমাত্র সঠিক ইসলাম। এর বাহিরে ইসলাম নেই, আছে শুধু ভ্রষ্টতা। নাউজুবিল্লাহ!

অথচ আধুনিককালের এসব প-িতগণের ইলমী যোগ্যতা এতই সীমিত যে, তাদের পক্ষে মুজতাহিদ ইমামগণের গবেষণামূলক বক্তব্যগুলো কয়েক লাইন পড়ে বোঝার সামর্থ্যও নেই; বরং বুঝাতো দূরের কথা, তাদের লিখনীর একাংশ সঠিকভাবে পড়ার যোগ্যতাও তাদের অনেকের নেই। এ ধরনের স্বল্প জ্ঞানীদের গবেষণামূলক উক্তি গুলো নিতান্তই হাস্যকর বলে মনে হয়। এরাই আবার নতুন করে মুসলিম মিল্লাতকে ইসলাম শেখান। মাযহাব অনুসরণ থেকে বের হয়ে উন্মুক্ত চিন্তাভাবনার দাওয়াত দেন। বিভিন্ন মীমাংসিত বিষয় নিয়ে নতুন কথা, নতুন ফতোয়া জারি করেন। একেক সময় একেক ধরনের কথা মাথায় আসে, যে যেভাবে মন চায় মিডিয়াতে বক্তব্য দিয়ে নতুন নতুন কথা শোনান। কথায় কথায় তারা কুরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি দেন। অথচ তাদের কথাগুলোই প্রকৃত অর্থে কুরআন-হাদিস পরিপন্থী। কুরবানি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়েও তারা চিরাচরিত আদর্শের ব্যতিক্রম করেননি। অনেক বিভ্রান্তিমূলক ফতোয়া দিচ্ছেন। এখানে আমরা তাদের কিছু মুক্ত চিন্তা ও গবেষণা নিয়ে কথা বলবো এবং তাদের আবিষ্কৃত ফতোয়ার দালিলিক আলোচনা করবো।

উল্লেখ্য, এ আলোচনা কোন মাযহাবের ইমামদের মতামত এর খ-ন নয়। কারণ সেগুলো হাজার বছর পূর্বেই মীমাংসিত। বরং এখানে শুধু বর্তমান গবেষক নামের নব্য মুজতাহিদদের বক্তব্য খ-ন করার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ।

আহলে হাদিস ভাইদের দাবি ও আমাদের দলিল:
আহলে হাদিসদের দাবি হলো, কোরবানি ঐচ্ছিক বিষয়, করলে সওয়াব পাবেন, না করলে কোনো গোনাহ নেই। অথচ কুরআন-সুন্নাহর মজবুত দলিল দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে যে, কুরবানি করা ওয়াজিব তথা বাধ্যতামূলক। সামর্থ্যবান ব্যক্তি কুরবানি না করলে গোনাহগার হবে।

কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার দলীল সমূহ:

প্রথম দলিল:

আল্লাহ তায়ালা বলেন-
إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ ‎﴿١﴾‏ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‎﴿٢﴾

অর্থ: নিশ্চয় আমি আপনাকে কাওসার দান করেছি। অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামায পড়ুন এবং কুরবানী করুন। (সূরা কাউসার:১-২)
এই আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা হলো, হে রাসূল! আপনাকে আমি ‘কাউসার’ নামক নেয়ামত দান করেছি। তাই আপনি ঈদের নামায আদায় করুন একমাত্র আপনার প্রভুর সন্তুষ্টির জন্য। ‘নাহর’ তথা কুরবানি করুন ওই প্রভুর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে এবং তাঁরই নামে। আল্লাহর এই নির্দেশের কারণে ঈদের নামায যেমন ওয়াজিব, কুরবানিও ওয়াজিব।
উল্লেখ্য, এ আয়াতের অত্যন্ত দুর্বল কিছু ব্যাখ্যাও রয়েছে যা বিচারের মাপকাঠিতে মোটেই ধর্তব্য নয়। যেমন, হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে দুটি হাদিস ইবনে হাতিম রহ. সংকলন করেছেন যে, فصل لربك وانحر এর অর্থ হচ্ছে, আপনি নামায পড়–ন আপনার রবের জন্য এবং নামায রত অবস্থায় ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে বুকের উপরের অংশ ও গলার নিচে রাখুন।

তাফসীরে কুরতুবীতে এসেছে:

قال علي رضي الله عنه ومحمد ابن كعب : المعنى وضع اليمنى على اليسرى حذاء النحر في الصلاة وروي عن ابن عباس أيضا وروي عن علي أيضا : أن يرفع يديه في التكبير إلى نحره وكذا قال جعفر بن علي : فصل لربك وأنحر قال : يرفع يديه أول ما يكبر للإحرام إلى النحر وعن علي رضي الله عنه قال : لما نزلت فصل لربك وأنحر قال النبي ( صلى الله عليه وسلم ) لجبريل : ) ما هذه النحيرة التي أمرني الله بها ) قال : ) ليست بنحيرة ولكنه يأمرك إذا تحرمت للصلاة أن ترفع يديك إذا كبرت وإذا رفعت رأسك من الركوع وإذا سجدت فإنها صلاتنا وصلاة الملائكة الذين هم في السماوات السبع وإن لكل شيء زينة وإن زينة الصلاة رفع اليدين عند كل تكبيرة)… وقال أنس : كان النبي ( صلى الله عليه وسلم ) ينحر ثم يصلي فأمر أن يصلي ثم ينحر ( الجامع لاحكام القران للقرطبي: ج١٠ ص ٤٤٤)

এ তাফসীরটির আগা-গোড়া কিছুই ঠিক নেই। উপরন্তু হাদিসদ্বয় সম্পর্কে প্রায় সকল তাফসীরকারকগণ অত্যন্ত দুর্বল বলেছেন। আর হাদিস বিশারদগণ হযরত আলী এবং ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আসারগুলোকে মারাত্মক দুর্বল বলেছেন। কেউ কেউ মওজু তথা জালও বলেছেন। প্রমাণস্বরূপ নিচে তাদের মতামত তুলে ধরা হলো।

আল্লামা ইবনুস সাআতি বলেন,

وقال ابن الساعاتي في الفتح الرباني في ترتيب مسند احمد للشيباني: نسبة هذا التفسير الى علي وابن عباس لا تصح.

হযরত আলী ও ইবনে আব্বাস রা. এর দিকে এ জাতীয় হাদিসের নিসবত করা মোটেও ঠিক নয়।

তাফসীর ইবনে কাসীরে রয়েছে-
يروى هذا عن على لا تصح . … وقد رواه ابن ابي حاتم ها هنا حديثا منكر جدا .
অর্থাৎ হযরত আলী রা. থেকে যে বর্ণনা করা হয় তা সঠিক নয়। ইবনে আবী হাতেম বলেন, এ বিষয়ের হাদিসটি অত্যন্ত মুনকার।

ইবনে কাসীর রহ. বলেন, সঠিক তাফসীর হচ্ছে- (و انحر) এর অর্থ: কুরবানি করা। সালাত অর্থ ঈদের নামায। এটাই যুগ যুগ ধরে বহু সালাফের কথা। তাই এসব তাফসীরের কোনো সত্যতা নেই। সঠিক হলো কুরবানি করা।

ইবনে কাসীর রহ. আরো বলেন :

رواه ابن أبي حاتم: وكل هذه الأقوال غريبة جداً, والصحيح القول الأول… فأخلص لربك صلاتك المكتوبة والنافلة ونَحْرَك، فاعبده وحده لا شريك له، وانحر على اسمه وحده لا شريك له… قال به ابن عباس، وعطاء، ومجاهد، وعكرمة، والحسن: … وغير واحد من السلف. (تفسير ابن كثير: ج৪، ص ৬৯১-৬৯২)

আল্লামা আলূসী রহ. তাফসীরে রুহুল মাআনীতে বলেন:

والاكثرون على أن المراد بالنحر نحر الاضاحي واستدل به بعضهم على وجوب للاضحية ( ثم ذكر روايات علي و بن عباس المذكورة ) وقال لعل في صحة الاحاديث عند الاكثرين مقالا والا فما قالوا الذي قالوا ….هذا في المستدرك بسند ضعيف وقال فيه ابن كثير انه حديث منكر جدا بل اخرجه ابن الجوزي في الموضوعات ( روح المعاني ج ١٤ ص ٦٦٥-٦٦٦ )

হযরত আলী রা. ও ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত এ সকল হাদিস এর সত্যতার মধ্যে অধিকাংশ আলেমদের চরম বিতর্ক রয়েছে। এমনকি ইবনুল কায়্যিম জাওযী রহমতুল্লাহি আলাইহি এগুলোকে موضوع তথা জাল বলেছেন। তিনি বলেন, অধিকাংশ মুফাসসিরগণ (انحر) দ্বারা নাহর (কুরবানি) করার অর্থকেই সঠিক বলেছেন। এই আয়াত দ্বারা অনেকে কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার উপর দলিল পেশ করেছেন।

ইমাম ইবনে জারীর তাবারী রহ. বলেন:
فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‎﴿٢﴾
এর সঠিক অর্থ হচ্ছেÑ হে রাসুল! আপনি আপনার নামাযকে খালিস আপনার রবের জন্য পড়–ন, মূর্তি-গাইরুল্লাহর জন্য নয় (যেমন মুশফিকরা করে থাকে)। ঠিক তেমনিভাবে আপনার কুরবানি ও খালিস রবের নামে করুন। অন্য কোন প্রতিমা ও মূর্তির নামে নয়। এটাই হবে কাউসার নামক নেয়ামতের প্রকৃত শোকর। অতঃপর তিনি মোহাম্মদ বিন কা‘ব আল-কোরাজি রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক এ আয়াতের তাফসীরও করেন যে, কিছু লোক গাইরুল্লাহর নামে উপাসনা ও কুরবানি করতো, যার পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত আয়াতগুলো নাযিল হয়।

আল্লামা তবারীর ভাষায় :

واولى هذه الأقوال عندي بالصواب قول من قال معنى ذلك فاجعل صلاتك كلها له بك خالصا دون ما سواه من الانداد والآلهة، وكذلك نحرك اجعله له دون الاوثان شكرا له على ما اعطاك .حدثني يونس قال اخبرنا ابن وهب قال حدثني ابو صخر عن محمد بن كعب القرظيস্ট انه كان يقول في هذه الاية .. ان اناسا كانوا يصلون لغير الله و ينحرون لغير الله فاذا اعطيناك الكوثر يا محمد فلا تكن صلاتك ونحرك الا له ( جامع البيان في تاويل القران للطبري ج ١٦ ص ٣٦١- ٣٦٢ )

নির্ভরযোগ্য যত তাফসীরের কিতাব দেখার সুযোগ হয়েছে সকল কিতাবেই وانحر অর্থ বুকে হাত রাখা বা রুকু-সেজদায় যেতে উঠতে হাত তোলার ব্যাপারটি জাল, ভিত্তিহীন, শিয়া বর্ণনাকারীর বর্ণনা ও মারাত্মক দুর্বল বলে আখ্যা দিয়েছেন। তার কারণ, ইবনে আব্বাস রা. এর হাদিসে روح بن المسيب নামক বর্ণনাকারী পরিত্যক্ত। সে জাল হাদীস বর্ণনাকারীও বটে। আর আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এর হাদিসটিতে (الأصبغ) বর্ণনাকারী শিয়া বলে প্রমাণিত। হাফেজ যাহাবী রহ. বলেন, সে আশ্চর্য কথা নকল করে, তার বর্ণনায় আস্থা রাখার কোন সুযোগ নেই। এসব কারণে মুহাদ্দিসীনে কিরাম বলেন, (انحر) এর তাফসীর হাত বাঁধা বা উঠানো বলে তাফসীর করা হবে সরাসরি আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করা।

তাঁদের ভাষায়:

فان اثر بن عباس في سنده روح بن المسيب متروك، قال ابن حبان يروي الموضوعات عن الثقات لا يحل الرواية عنه. وما روي عن علي رضي الله عنه في سنده ومتنه اضطراب جدا وفيه طريق اسماعيل ابن حاتم قال الذهبي صاحب عجائب لا يعتمد عليه، “واصبغ” شيعي متروك . قال ابن حبان: روي اسرائيل عن مقابل الموضوعات والاوابد والطاعات. (اعلاء السنن ج ١٦ ص ٧٩٤٧-٧٩٤٨)
وقال ايضا قلنا هذا هو القول على الله بغير علم. واغرب ابن حزم حيث عدل عن التفسير الصحيح الثابت الى التفسير الذي لا يصح ولم يثبت وهو الى التحريف اقرب الى التفسير (المرجع السابق )

মোদ্দাকথা:
কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার প্রধান দলিল হলো, সুরা কাউসারের উপরোক্ত আয়াত। যার মর্মার্থ অন্য আয়াতে এভাবে এসেছে-
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ‎﴿١٦٢﴾
আপনি বলুনঃ আমার নামায, আমার কুরবানি এবং আমার জীবন ও মরন বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে। (সূরা আনআম-১৬২)
উক্ত আয়াতের যদি ভিন্ন কোন দুর্বল ব্যাখ্যাও না থাকতো, তাহলে শরিয়া নীতিমালা অনুযায়ী এই আয়াতের কারণে কুরবানি ফরজ সাব্যস্ত হতো। সম্ভাব্য ভিন্ন অর্থের কারণে আল্লাহর (انحر) নির্দেশমূলক শব্দ দ্বারা ওয়াজিব প্রমাণিত হলো।

দ্বিতীয় দলিল

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস,

حدثنا ابو بكر بن ابي شيبة حدثنا زيد بن حباب حدثنا عبد بن عياش عن عبد الرحمن الاعرج عن ابي هريرة ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: من كان له سعة ولم يضح فلا يقربن مصلانا (رقم الحديث٣١٢٣) قال الامام ابن ماجه: وهذا خرج مخرج الوعيد على ترك الاضحية ولا وعيد الا بترك الواجب ( اخرجه احمد في مسنده ٨٢٧٣ ) والحاكم في المستدرك وصححه ووافق عليه الذهبي بقوله ” صحيح “( رقم الحديث ٧٥٦٥ ) وقال الحافظ في الفتح ورجاله ثقات وذكر العيني في البناية عن التنقيح ان رجاله رجال الصحيح سوي عبد الله بن عياش فانه من افراد مسلم. ورواه الدارقطني رقم ٤٧٤٣ ايضا .

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তির সামর্থ্য আছে অথচ সে কুরবানি করলো না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-৩১২৩)
ইমাম ইবনে মাজাহ রহ. বলেন, হাদীসটি কুরবানি ছেড়ে দেওয়া ব্যক্তিদের জন্য কঠিন ধমকি। আর এমনটি হয় ওয়াজিব তরককারিদের ক্ষেত্রে। হাদীসটিকে ইমাম হাকিম সহিহ বলেছেন। ইমাম যাহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি তালখিসেও সহিহ বলেছেন। ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি রহ. ফাতহুল বারিতে হাদিসটির সনদকে সহীহ বলেছেন।
আল্লামা আইনি রহ. বলেন, হাদীসটির সনদ বুখারী-মুসলিমের সমতুল্য। আব্দুল্লাহ বিন আইয়াশ মুসলিমের বর্ণনাকারী, তাই এতে আপত্তিকারীদের আপত্তি গৃহীত হবে না ।

কিছু আপত্তি ও তার খণ্ডন:
উপরোক্ত হাদীসটিকে ইমাম যাইলায়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি সহ কেউ কেউ “মওকুফ” বলেছেন। অর্থাৎ এটা রাসূল স. এর বাণী নয়; বরং আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর ফতোয়া।
উত্তর- হাদীসটি “মারুফ”। কেননা এটিকে রাসূল স. এর বাণী বলে বর্ণনা করেছেন আব্দুল্লাহ আল মকরি এবং হায়াত বিন শুরাইহসহ অনেকে।
* আর এরা অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য রাবি। তারা যখন রাসূলের বর্ণনা হিসেবে রেওয়ায়েত করেছেন সেটা নিশ্চিত গ্রহণযোগ্য। কেননা, হাদিসের নীতিমালা হলো- ‘ الزيادات من الثقات مقبولة ‘
* এতে কোন সমস্যা নেই। কারণ আবু হুরায়রা রা. একবার مرفوعا বর্ণনা করেছেন, আবার কখনো তিনি ফতোয়া হিসেবেও বক্তব্য দিয়েছেন। তাই এটা “موقوف” হাদিস হিসাবে আখ্যায়িত হয়েছে। কেউ উভয়টি বর্ণনা করেছেন, আবার কেউ একটি। এতে হাদিসের নীতিমালার দৃষ্টিতে কোন বৈপরিত্য পাওয়া যায় না।
* তাছাড়া যদি এটা আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বর্ণনা বা ফতোয়া বলে মেনে নেওয়া যায়, তবে হাদিস শাস্ত্রের মূলনীতি হিসেবে- (مثله لا يقال بالراي فيكون في حكم المرفوع) অর্থাৎ তা মারফু হাদিস হিসেবেই ধর্তব্য হবে।

আল্লামা যফর আহমদ উসমানী রহ. বলেন:

الرفع زيادة و الزيادة من الثقات مقبولة ، ولا تعارض بين الوقف والرفع لانه يمكن ان يكون ابو هريرة رفعه مرة وافتى به اخرى… فلا وجه لرد المرفوع ولو سلم الوقف فمثله لا يقال بالراي فيكون في حكم المرفوع ( اعلاء السنن ج ١٦ ص৭৯৩৯-৭৯৪৩)
وقول ابن حزم”ان عبد الله بن عياش ليس معروفا بالثقة” (قوله) مردود باخراج مسلم حديثه في صحيحه كما في التهذيب قال ابو حاتم ليس بالمتين صدوقا يكتب حديثه وذكره ابن حبان في”الثقات”فهو حسن الحديث صالح للاحتجاج به.(اعلاء السنن ج ١٦ص৭৯৩৯-৭৯৪৩)

উপরোক্ত বিশদ বর্ণনা ও মতামতের আলোকে প্রমাণিত হলো, এই হাদিসটি বহু হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে এবং হাদীসটি সহীহ এবং প্রমাণযোগ্য।
এর দ্বারা প্রমাণ হলো, কুরবানি করা ওয়াজিব। অন্যথায় এমন ধমকি কুরবানি তরককারির উপর হওয়ার কথা নয়।

 

তৃতীয় দলিল:

হযরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত-

اخبرني ابو الزبير انه سمع جابر بن عبد الله يقول صلى لنا النبي صلى الله عليه وسلم يوم النحر بالمدينه فتقدم رجال فنحروا وظنوا ان النبي قد نحر فامر النبي صلى الله عليه وسلم “من كان نحر قبله ان يعيد بنحر آخر، ولا ينحروا حتى ينحر النبي صلى الله عليه وسلم (رواه مسلم رقم الحديث ١٩٦٤ )

হযরত জাবের রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনাতে ঈদের নামায পড়িয়েছেন। কিছু লোক নামাযের পূর্বেই কুরবানি করে ফেলেছেন এ ধারণায় যে, হয়তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালামও কুরবানি করে ফেলেছেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিলেনÑ যারা নামাযের পূর্বে কুরবানি করেছে তারা অবশ্যই পূনরায় কুরবানি করতে হবে। তোমরা কেউ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্বে কুরবানি করবে না। (সহীহ মুসলিস, হাদিস নং ১৯৬৪)
যদি কুরবানি ওয়াজিব না-ই হতো, তাহলে তো পূনরায় কুরবানির নির্দেশ দিতেন না। এধরনের আরো হাদিস রয়েছে যেমন;

চতুর্থ দলিল:

হযরত জুনদুব আল বাজালি রা. বলেন:

قال شهد رسول الله صلى الله عليه وسلم يوم اضحى ثم خطب فقال من كان ذبح قبل ان يصلي فليعد مكانها…. ومن لم يكن ذبح فليذبح بسم الله )رواه مسلم رقم ١٩٦٠(

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের খুতবাতে ইরশাদ করেন, যারা নামাযের পূর্বে কুরবানি দিয়েছো তারা তার পরিবর্তে অবশ্যই পুনরায় কুরবানি করো। আর যারা তখন কুরবানি করোনি তারা আল্লাহর নামে কুরবানি করো। (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং-১৯৬০)
এ হাদিসেও পুনরায় কুরবানি করা এবং যারা আগে করেনি তাদেরকে কুরবানি করার নির্দেশ রাসুল সা. দিয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এমন নির্দেশমূলক বাণীও কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ বহন করে।

পঞ্চম দলিল:

হযরত বারা ইবনে আযেব রা. হতে বর্ণিত:

عَنِ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ أَنَّ خَالَهُ أَبَا بُرْدَةَ بْنَ نِيَارٍ ذَبَحَ قَبْلَ أَنْ يَذْبَحَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ هَذَا يَوْمٌ اللَّحْمُ فِيهِ مَكْرُوهٌ وَإِنِّى عَجَّلْتُ نَسِيكَتِى لأُطْعِمَ أَهْلِى وَجِيرَانِى وَأَهْلَ دَارِى. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- ্র أَعِدْ نُسُكًا গ্ধ. فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ عِنْدِى عَنَاقَ لَبَنٍ هِىَ خَيْرٌ مِنْ شَاتَىْ لَحْمٍ. فَقَالَ ্র هِىَ خَيْرُ نَسِيكَتَيْكَ وَلاَ تَجْزِى جَذَعَةٌ عَنْ أَحَدٍ بَعْدَكَ গ্ধ. (صحيح مسلم، رقم: ৫১৮২، الشاملة)

হযরত আবু বুরদা রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কুরবানির পূর্বেই সকাল-সকাল কুরবানি করে ফেলেছেন। কারণ, দিনের শেষে গোশতের আগ্রহ থাকে না। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু সালামকে বিষয়টি জিজ্ঞেস করলে রাসুল সালাম বলেন, অবশ্যই পুনরায় সঠিক সময়ে কুরবানি করতে হবে। তিনি বলেন, এখন আমার কাছে ছোট একটি বকরি অবশিষ্ট আছে মাত্র। তবে তা মোটাতাজা। রাসুল সালাম বললেন সেটা দিয়ে কুরবানি করো। তবে এ সুযোগটা শুধুই তোমার জন্য। অন্য কারো ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়। ছয় মাসের বকরি দিয়ে কুরবানি করা একমাত্র তোমার ক্ষেত্রে অনুমোদিত। (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং- ১৯৬১)
এ হাদীসে একবার কুরবানি করার পর তা সঠিক সময়ে না হওয়ায় রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম তার সাহাবীদের কুরবানি করার নির্দেশ দিলেন এবং তার কাছে কুরবানির উপযুক্ত বকরি না থাকা সত্ত্বেও কম বয়সের দ্বারা হলেও কুরবানি করার নির্দেশ স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, কুরবানি ওয়াজিব; মুস্তাহাব নয়।

 

ষষ্ট দলিল:

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত:

عن نافع عن عبد الله بن عمر رضي الله عنه : قال ” أقام رسول الله صلى الله عليه وسلم بالمدينة عشر سنين يضحي” اخرجه الترمذي و قال هذا حديث حسن (رقم الحديث ١٥٠٧ ومسند احمد ٤٩٣৫) قال المحقق اسناده صيحح.

হযরত ইবনে ওমর রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা শরীফে দশ বছর অবস্থানকালে কুরবানি করে গেছেন। তিরমিজি ১৫০৭, মুসনাদে আহমদ ৪৯৩৫। ইমাম তিরমিজি রহ. হাদিসটিকে হাসান বলেছেন।

মুহাক্কিক শুআইব আল-আরনাউত বলেন: হাদিসটির সনদ সহীহ। নিচে মুসনাদে আহমদের টীকা উল্লেখ করা হলো:

قال شعيب الارنؤوط : في هامش مسند احمد .. إسناده ضعيف فيه حجاج بن ارطاة ، مدلس وقد عنعن ولكن و له شاهد عن ابن عمر ان النبي النبي صلى الله عليه وسلم كان ينحر يوم الاضحى بالمدينه، اخرجه النسائي عن على بن عثمان عن سعيد ابن عيسى عن المفضل عن عبد الله بن سليمان عن نافع : وهذا اسناد حسن من اجل عبد الله بن سليمان وباقي الرجال ثقات لذا قال شعيب الارنؤوط :حديث صحيح، (رقم الحديث: ٦٤٠١ من مسند احمد.

শরীয়তের মূলনীতি হচ্ছে- যে কাজ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধারাবাহিকভাবে করেছেন কোনো দিন ছাড়েননি তখন কাজটি ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ বহন করে।
যেমনটি তাকমিলায়ে ফাথহুল মুলহিম-এ বলা হয়েছে:

وهذا يدل على المواظبة وان مواظبة النبي صلى الله عليه وسلم من غير ترك دليل للوجوب: تكملة فتح الملهم ٣٠٩

 

সপ্তম দলিল

হযরত জাবালা বিন সুহাইম থেকে বর্ণিত:

عن جبلة بن سحيم ان رجلا سأل ابن عمر عن الاضحية أ واجبة هي؟ فقال: ضحى رسول الله صلى الله عليه وسلم والمسلمون فاعادها عليه، فقال : أتعقل؟ ضحى رسول الله صلى الله عليه وسلم والمسلمون .(اخرجه الترمذي رقم الحديث: ١٥٠٦ و قال” هذا حديث حسن صحيح” وأخرجه ابن ماجه في الأضاحي، رقم الحديث ٣١٢٤(

ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু কে এক লোক জিজ্ঞেস করলো, কুরবানি কি ওয়াজিব? তিনি উত্তরে বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানি করেছেন এবং সকল মুসলমানরাও কুরবানি করেছেন। প্রশ্নকারী বারবার জিজ্ঞেস করলে ইবনে ওমর একই কথা বারবার পুনরাবৃত্তি করলেন। উক্ত হাদিসে হযরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম ও মুসলিম মিল্লাতের ধারাবাহিকভাবে কুরবানির কথা স্পষ্ট প্রমাণ করে যে এটি ওয়াজিব। একবারের জন্যও তিনি ওয়াজিব নয় বলেননি। অথচ প্রশ্নটি ছিল ওয়াজিব কি-না। হাঁ, তিনি স্পষ্ট “ওয়াজিব” না বলার কারণ হলো, যাতে কুরবানিকে ফরজ সমতুল্য মনে করা না হয়।

উল্লেখ্য, শরয়ী বিধানের স্তর বিন্যাসে ফকীহগণের পরিভাষা উদ্ভাবনের পূর্বে “ওয়াজিব” বলে ফরজ-ওয়াজিব উভয়টিকে বোঝানো হতো ।

শাইখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানি হাফি. তাকমিলাতু ফাতহুল মুলহিমে বলেন:

قال شيخنا في تكملة فتح الملهم : “ظاهر جواب ابن عمر انه اراد الدلالة على الوجوب لان السائل انما سأله عن الوجوب فلو كانت الاضحية غير واجبة لنفي الوجوب صراحة ولكنه ذكر مواظبة النبي صلى الله عليه وسلم والمسلمين وهو مما يدل على الوجوب، ولم يصرح بالوجوب كي لا يظن تحتمه كتحتم الفرائض) . التكملة ج ٣ ص ٣٠٩ (

অর্থ: ইবনে উমর রা. এর জবাবে কুরবানি ওয়াজিব হওয়ারই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কেননা, তাঁকে কুরবানি ওয়াজিব কি-না? এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছিলো। যদি সত্যিই কুরবানি ওয়াজিব না-ই হতো, তবে তিনি স্পষ্ট ওয়াজিব নয় বলতে পারতেন। তিনি তা না করে রাসূল স. এর আমলের ধারাবাহিকতা উল্লেখ করেছেন, যা ওয়াজিব হওয়ার উপর প্রমাণ বহন করে। আর স্পষ্ট ওয়াজিব বলেননি যাতে কেউ ফরজ ভেবে না বসে। (তাকমিলাতুল ফাতহুল মুলহিম: ৩/৩০৯)

 

অষ্টম দলিল:

মিখনাফ বিন সুলাইমান রা. হতে বর্ণিত-

أَخْبَرَنَا مِخْنَفُ بْنُ سُلَيْمٍ قَالَ وَنَحْنُ وُقُوفٌ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- بِعَرَفَاتٍ قَالَ ্র يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِى كُلِّ عَامٍ أُضْحِيَةً وَعَتِيرَةً أَتَدْرُونَ مَا الْعَتِيرَةُ هَذِهِ الَّتِى يَقُولُ النَّاسُ الرَّجَبِيَّةُ গ্ধ. قَالَ أَبُو دَاوُدَ الْعَتِيرَةُ مَنْسُوخَةٌ هَذَا خَبَرٌ مَنْسُوخٌ. (ابو داود ٢٧٨٨ الترمذي ١٥١٨ و النسائي ٤٢٢٤ و ابن ماجه ٣١٣٥ )

মিখনাফ বিন সুলাইম রা. বলেন, আমরা আরাফাতের ময়দানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ঊকুফ করছিলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করেন, হে মানুষ সকল! প্রত্যেক পরিবারের কর্তার উপর প্রতি বছর কুরবানি করা আবশ্যক এবং আতিরাও।
হাদীসটি সুনানে তিরমিযি, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসাঈ ও সুনানে ইবনে মাজাহ সহ সুনানের প্রায় কিতাবে এসেছে। ইবনে হাজার আসকালানি রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, হাদিসটি সনদের বিচারে খুব মজবুত। আলবানী সাহেবও হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। (মিশকাত, হাদিস নং-১৪৭৮)
এ হাদীসে উল্লিখিত “আতিরা” সর্বসম্মতিক্রমে রহিত হয়ে গেছে। কুরবানির বিধান বলবৎ। “على” শব্দ এ জাতীয় ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। যার অর্থ দাঁড়ায় কমপক্ষে ওয়াজিব।

 

আসুন হাদীস মানি, কুরবানিকে ওয়াজিব বলি

এখানে মাত্র আটটি হাদিস পেশ করা হলো। যাতে প্রমাণিত হলো, সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কুরবানি করা ওয়াজিব ও বাধ্যতামূলক। যারা বলে বেড়াচ্ছেন যে, কুরবানি না করলে কোনো গোনাহ নেই, এটা শুধু নেকির কাজ, করলে ছাওয়াব না করলে গোনাহ নেই, তাদের কাছে আমার প্রশ্নÑ তারা এই আটটি দলিলের কী জবাব দিবেন। কুরআনে আল্লাহর নির্দেশ, হাদিসে রাসূলের নির্দেশ, অমান্যকারীকে ঈদগাহে না আসার ধমকি, কুরবানি সঠিক সময়ে না করলে পুনরায় কুরবানি করার নির্দেশ। আরাফাতের স্পষ্ট ঘোষণা যে, কুরবানি বাধ্যতামূলক। সারাজীবন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধারাবাহিকভাবে কুরবানি করা, একবারও কুরবানি থেকে বিরত না থাকা, এসব বিষয়গুলো কী প্রমাণ করে? কুরবানি না করলে কোনো গোনাহ নেই??
একটি হাদিস/আয়াত দেখাতে পারবেন যে, সামর্থ্যবানদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানি হতে বিরত থাকার অনুমতি বা ঘোষণা দিয়েছেন? আসুন! চ্যালেঞ্জ কবুল করুন! আপনাকে দেখাতে হবে সামর্থ্যবান কোনো সাহাবীকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম না করার অনুমতি দিয়েছেন।

 

(নবম দলিল)
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অভিমত

আহলে হাদিস ভাইদের সর্বাধিক মান্যবর মহান ব্যক্তিত্ব, শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি এর مجموعة الفتاوي এর ১২ নং খন্ডের ৯৩ নং পৃষ্ঠা খুলে দেখা যেতে পারে। তাঁর দলিলভিত্তিক শক্তিশালী মতামত হচ্ছেÑ কুরবানি করা ওয়াজিব। তিনি তাঁর এই বিখ্যাত ফতোয়ায় কুরআনের বহু আয়াতের উপর ভিত্তি করে কুরবানি ওয়াজিব সাব্যস্ত করেছেন।

তাঁর ভাষায় শুনুন :

واما الاضحية ، فالأظهر وجوبها ، فانها من اعظم شعائر الاسلام وهي النسك العام في جميع الامصار، والنسك مقرون بالصلاة في قوله : قُلْ إِنَّ صَلاَتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ (১৬২)
وقد قال تعالى: فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ (২) فامر بالنحر كما امر بالصلاة.
وقد قال الله تعالى: * وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنسَكًا لِّيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ ۗ
* والْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُم مِّن شَعَائِرِ اللَّهِ لَكُمْ فِيهَا خَيْرٌ ۖ فَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهَا صَوَافَّ ۖ
* لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ التَّقْوَىٰ مِنكُمْ ۚ كَذَٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَاكُمْ ۗ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ ‎﴿٣٧﴾‏

অর্থাৎ কুরবানি যে ওয়াজিব, তা দলিলের বিচারে সর্বাধিক স্পষ্ট মত। তার কারণ-
এক. কুরবানি হচ্ছেÑ ইসলামের সর্ববৃহৎ ও ব্যাপক নিদর্শন। এটা গোটা উম্মতের জন্য ওয়াজিব হওয়ার-ই দাবী রাখে।
দুই. কুরবানিকে আল্লাহ তায়ালা নামাযের সাথে যুক্ত করেই পেশ করেছেন। যেমনÑ সূরা আনআমের ১৬২নং আয়াতে রয়েছে: নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কুরবানি একমাত্র রাব্বুল আলামীনের জন্য।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে কুরবানি করার নির্দেশ করেছেন। তাঁর নির্দেশ মান্য করা ওয়াজিব। সূরা কাওসার এর দুই নং আয়াতে নামায ও কুরবানি উভয়ের জন্য আদেশ এসেছে। তাই নামায যেমন বাধ্যতামূলক, তেমনি কুরবানিও।
সূরা হজ্জের ৩৪, ৩৬, ৩৭ এ তিনটি আয়াতেও আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট পশু জবাই করতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।

সুতরাং পাঁচটি আয়াতেই কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।

অতঃপর ইবনে তাইমিয়া রহ. আরো বলেন,

وقد جاءت الاحاديث بالامر بها وقد خرج وجوبها قولا في مذهب احمد ، وهو قول ابي حنيفه واحد القولين في مذهب مالك او ظاهر مذهب مالك

অর্থাৎ বহু হাদিস শরীফে কুরবানি করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। এটাই ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. এর একটি মত। এটা ইমাম আবু হানিফা রহ. এর মাযহাব এবং ইমাম মালেক এর মূল মাযহাব। অতঃপর শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহমাতুল্লাহি আলাইহি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেনÑ যারা কুরবানি ওয়াজিব বলতে চায় না, তাদের পক্ষে কোনো দলিল-প্রমাণ নেই। তারা সবচাইতে বড় দলিল বলে যে হাদীসটি পেশ করেন, সেটা তাদের দলিল বহন করে না।

তিনি আরো বলেন:

ونفاة الوجوب ليس معهم نص فان عمدتهم قوله صلى الله عليه وسلم : من اراد ان يضحي ودخل العشر فلا ياخذ من شعره و من اظفاره. وهذا كلام مجمل فان الواجب لا يوكل الى ارادة العبد… الخ( مجموعه الفتاوى لابن تيميه: ج ١٢ ص ٩٣-٩٤ )

অতএব, নব্য আহলে হাদিস ভাইদের অনুরোধ করবো, আপনাদের মহান গুরু ও মান্যবর ব্যক্তির উপরোক্ত বয়ান ভাল করে পড়–ন! তাহলেই আপনাদের বিভ্রান্তির কারণ বুঝতে পারবেন। ইনশাআল্লাহ।

 

(দশম দলিল)
শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসাইমিন রহ. এর অভিমত

বর্তমান সময়ের সৌদি আরবের বিখ্যাত মুফতি ও শাইখ, আহলে হাদিস ভাইদের অত্যন্ত মান্যবর ব্যক্তিত্ব, শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসাইমিন احكام الأضحية والزكاة নামে একটি কিতাব লিখেছেন।
এই কিতাবে তিনি লেখেন:

قال الشيخ ابن عثيمين رحمه الله وعندي ان التفويض الى الاراده لا ينافي الوجوب اذا قام عليه الدليل فقد قال النبي صلى الله عليه و سلم في المواقيت هن لهن اتى عليهن ، من غير اهلهن ممن يريد الحج والعمرة ، ولم يمنع ذلك من وجوب الحج والعمرة بدليل اخر . فصح تقسيم الناس فيها الى مريد و غير مريد لان الاضحيه لا تجب على المعسر. (ثم نقل الشيخ قول شيخ الاسلام ابن تيميه مفصلا وذكر جميع الادله لنفات الوجوب واجاب واحد عن واحد واتي بادلة الوجوب فاجاب عما ورد فيها حديثا عن حديث) ثم قال: هذه آراء العلماء وادلتهم سقناها ليبين شان الاضحيه واهميتها في الدين. والادله فيها متكافية ، و سلوك الاحتياط ان لا يدع مع القدره عليها لما فيها من تعظيم الله وذكره و براءة الذمة بيقين انتهي . (احكام الاضحية والزكاة ص ٤٧ (

শাইখ ইবনে উসাইমিন রহ. উপরোক্ত বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার পক্ষের দলিলসমূহ প্রাধান্য পাবে। তিনি দলিলগুলোর উপর আরোপিত সব অভিযোগের জবাবও দিয়েছেন। পক্ষান্তরে যারা ওয়াজিব বলেন না, তাদের দলিলগুলো একটা একটা করে খ-নও করেছেন এবং বলেছেন, এর অধিকাংশ দলিলই দুর্বল। যেটা সহীহ সেটা কিন্তু ওয়াজিবের পরিপন্থী নয়। পরিশেষে বলেছেন, যথেষ্ট পরিমাণে দলিল উল্লেখ করলাম কুরবানির গুরুত্ব ও ইসলামের নির্দেশনা বোঝানোর জন্য। সব দলিলের বিবেচনায় অতি সাবধানতা হচ্ছেÑ সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কুরবানি না করার কোন সুযোগ নেই। ইসলামের নিদর্শন হিসাবে এটাই দাবি রাখে। (আহকামুল উযহিয়্যাহ ও যাকাত ৪৭)

ওয়াজিব অমান্যকারীদের দলিল ও তার সংক্ষিপ্ত খণ্ডন:

ওয়াজিব অমান্যকারীদের প্রথম দলিল:
তাদের সবচাইতে মজবুত দলিল হচ্ছে- মুসলিম শরীফের হাদিস। হাদিসটি সহীহ। কিন্তু কুরবানি ওয়াজিব না হওয়ার কোন বিষয় হাদিসে নেই।

হযরত উম্মে সালমা রা. সূত্রে বর্ণিত:

عن ام سلمه ان النبي صلى الله عليه وسلم قال : اذا دخلت العشر واراد احدكم اي يضحي فلا يمس من شعره وبشره شيئا قيل لسفيان فان بعضهم لا يرفعه، قال انا ارفعه. (صحيح مسلم، رقم الحديث ١٩٧٧، واخرجه ابو داود والترميذي والنسائي وابن ماجه)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এরশাদ করেন, যখন জিলহজের প্রথম দশদিনের আগমন ঘটবে, তখন তোমাদের মধ্যে যারা কুরবানি করার ইচ্ছা করবে তারা চুল-নখ ইত্যাদি কাটবে না। এ হাদিসে اراد احدكم রয়েছে। অর্থাৎ যারা কুরবানির ইচ্ছা পোষণ করবে। বোঝা গেল, কুরবানি ঐচ্ছিক বা ইচ্ছাধীন ব্যাপার। চাইলে করাও যায়, আবার নাও করা যায়।

খণ্ডন-১:
শাইখ ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, বান্দার ইরাদা বা ইচ্ছার সাথে কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার বিষয়টি যুক্ত হতে পারে না। একটি বিধান ওয়াজিব হওয়ার পর মানুষ যখন তা পালন করার ইচ্ছা করে, সে যেন নখ-চুল ইত্যাদি না কাটে। এই অর্থই গ্রহণযোগ্য।
এর প্রমাণ হাদিসে প্রচুর রয়েছে। যেমনÑ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: من اراد الحج فليتعجل যে হজের ইরাদা করবে, সে যেন তাড়াতাড়ি করে। এই হাদিসের অর্থে কি কেউ বলবে যে, হজ একটি ঐচ্ছিক ব্যাপার? এটি ফরজ নয়? (মাজমুআতুল ফাতাওয়া: খন্ড ১৩ পৃষ্ঠা ৯২)

শাইখ ইবনে তাইমিয়ার ভাষায়:

وهذا كلام مجمل، فان الواجب لا يوكل الى ارادة العبد… بل قد يتعلق الواجب بالشرط لبيان حكم من الاحكام كقوله: “اذا قمتم الى الصلاه فاغسلوا ” (المائدة) وايضا فليس كل احد يجب عليه ان يضحي. وانما تجب علي القادر فهو الذي يريد ان يضحي كما قال : من اراد الحج فليتعجل الى اخره والحج فرض على المستطيع، قوله “من اراد ان يضحي” كقوله:”من اراد الحج فليتعجل” ووجوبها حينئذ مشروط بان يقدر عليها فاضلا عن حوائجه الأصلية كصدقة الفطر . (مجموعة الفتاوي: ج ١٢ ص ٩٤)

খণ্ডন-২
এই হাদিসের ব্যাপারে শাইখ ইবনে উসাইমিন রহ. বলেন: হাদিসটি কুরবানি ওয়াজিব হওয়়ার বিপক্ষে নয়। কারণÑ ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ বিদ্যমান থাকায় এই হাদিসটাকে তার বিরোধী সাব্যস্ত করা যায় না। যেমন, হাদিস শরীফে আসছে, মিকাত সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন;

” هن لهن ولمن اتى عليهن من غير اهلهن ممن يريد الحج والعمرة “

অর্থাৎ শরীয়ত নির্ধারিত মিকাতসমূহ তাদের জন্য প্রযোজ্য, যারা হজ ও ওমরা করার ইরাদা বা ইচ্ছা করেন। চাই তারা ওই স্থানে বসবাস করেন বা যারা ওই স্থানের বাসিন্দা না হলেও ওই স্থানগুলো অতিক্রম করে থাকেন।
তিনি বলেন, এ হাদিসে হজ্জ-ওমরার ইরাদাকারী বলার দ্বারা কি হজ্জ-ওমরা ওয়াজিব হওয়ার বিপক্ষে হাদিসটিকে দাঁড় করানো যাবে? অথচ দলিল দ্বারা হজ্জ ফরজ হওয়া সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। উপরোক্ত হাদিসে ‘যে কুরবানির ইরাদা করে’ বাক্যটির মর্ম হলো, অক্ষম ও সক্ষম ব্যক্তিদের মধ্যে পার্থক্য করা। সক্ষম ব্যক্তিরাতো কুরবানি করবেই, কিন্তু যারা অক্ষম তারপরও কুরবানি করার ইরাদা রাখে, তাদের কেউ যেন শরীরের পশম-নখ ইত্যাদি কর্তন না করে। (আহকামুল উযহিয়্যা ও যাকাত: পৃষ্ঠা-৪৭)

শাইখ ইবনে উসাইমিন আরো বলেন:

قال الشيخ ابن عثيمين رحمه الله وعندي ان التفويض الى الإرادة لا ينافي الوجوب اذا قام عليه الدليل. فقد قال النبي صلى الله عليه وسلم في المواقيت( هن لهن و لمن اتي عليهن من غير اهلهن ممن يريد الحج والعمرة) ولم يمنع ذلك من وجوب الحج والعمره بدليل اخر… والاضحيه لا تجب على المعسر فهو غير واجب فصح تقسيم الناس فيها الى مريد وغير مريد باعتبار اليسار و الإعسار . )احكام الاضحيه والزكاة ص ٤٧(

খণ্ডন-৩
মুহাদ্দিসীনে কিরামের অনেকে হাদিসটির ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এই হাদিসে من اراد (যে ইচ্ছা করবে) বাক্যটি কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার বিপক্ষে নয়। কারণ, সকল শরয়ী বিধান পালনের ক্ষেত্রে ইরাদা বা ইচ্ছা বা নিয়ত শর্ত। শুধু কুরবানি করার সাথে ইরাদাটি সীমাবদ্ধ নয়। হাদিসে “ইরাদা” করার বিষয়ে এর সাথে আরেকটা মাসআলা যুক্ত, তা হলো, যাদের কুরবানি করার সামর্থ্য নেই তাদের জন্য চুল, পশম, নখ ইত্যাদি কর্তন নিষেধ নয়। এই ইরাদা বা ইচ্ছা বাক্যটি বহু ক্ষেত্রে ফরয-ওয়াজিব এর জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে।
যেমন, من اراد الحج فليلب যে হজ্জ পালনের ইরাদা করবে সে যেনো তালবিয়া পড়ে। এটা স্বত:সিদ্ধ যে, তালবিয়া পড়া ওয়াজিব।
বহু ক্ষেত্রে সুন্নাত-মুস্তাহাবের জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, من اراد الجمعة فاليغتسل যে জুমার নামায আদায় করার ইরাদা করবে সে যেন গোসল করে।
من اراد الحج فليتعجل যে হজ্জ পালনের ইরাদা করে সে যেন ত্বরান্বিত করে। (ইলাউস সুনান খন্ড নাম্বার ১৬ পৃষ্ঠা ৭৯৫১)
সুতরাং বোঝা গেল, এই হাদিস দ্বারা যদি কুরবানি ওয়াজিব না মেনে মুস্তাহাব সাব্যস্ত করা হয়, তাহলে হজ্জ, জুমাসহ অনেক ফরজ বিধানকেও অস্বীকার করে মুস্তাহাব বা ঐচ্ছিক বলতে হবে। নাউজুবিল্লাহ।

আল্লামা যফর আহমদ উসমানী রহ. লিখেন:

وذكر الارادة في حديث ام سلمة لا ينفي الوجوب لان الارادة شرط لجميع الفراءض وليس كل احد يريد التضحية (وانما يريدها من وجد سعة و كان معسرا فهو قيد للاحتراز عن المعسرين الذين لا يريدون) وقد استعمل ذلك في الواجبات كقولهم من اراد الحج فليلب ، و قوله عليه السلام من اراد الجمعة فليغتسل ، ومن اراد الحج فليتعجل. ( اعلاء السنن ج ١٢ ص ٧٩٥١ نقلا عن” الجوهرالنقي ، و تكملة فتح الملهم ج ٣ ص ٣١٠ )

ওয়াজিব অমান্যকারীদের দ্বিতীয় দলিল:
ইবনে আব্বাস রা. ও আনাস রা. হতে বর্ণিত:

اخبارنا ابو علي، و ابو الحسين بن بشران قالا : اخبرنا اسماعيل بن محمد الصفا حدثنا السعدان بن النصر حدثنا ابو بدر حدثنا ابو جناب الكلبي عن عكرمة عن ابن عباس رضي الله عنه ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ثلاث هن على فرائض وهن لكم تطوع النحر والوتر وركعتي الضحى .(السنن الكبرى للبيهقي رقم الحديث ١٩٠٣٠ وكذا اخرجه احمد في مسنده رقم الحديث ٢٠٥٠)

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম বলেছেন: তিনটি কাজ আমার উপর ফরয আর তোমাদের জন্য নফল। (১) কুরবানি (২) সালাতুল বিতর (৩) সালাতুত দোহা। (বাইহাকি-১৯০৩০, মুসনাদে আহমদ-২০৫০)

খণ্ডন: (এক)
হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল কিংবা জাল। এমন হাদিস শরীয়তের কোনো বিধান প্রমাণের ক্ষেত্রে পেশ করা উলামাদের সর্বসম্মতিক্রমে অবৈধ। শাইখ শুয়াইব আল-আরনাউত সহ সকল মুহাদ্দিসগণ এই হাদিসকে বহুবিধ কারণে জয়ীফ বলেছেন। ইমাম ইবনুল জাওযি রহ. জাল/মাওজু বলেছেন। আর আহলে হাদিসদের হাদিস জগতের একমাত্র কা-ারী শাইখ নাসির উদ্দিন আলবানীও হাদীসটিকে মওজু তথা জাল বলেছেন। তাই এ পর্যায়ের একটি মারাত্মক জয়ীফ বরং মওজু তথা জাল হাদিস দ্বারা ওয়াজিব এর বিরুদ্ধে দলিল দেওয়া হাস্যকর বা বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।

মুহাক্কিক উলামাদের ভাষায়:

قال ابن الجوزي في العلل المتناهية في الاحاديث الواهيه : بعد اخراج الحديثين عن عباس وانس: هذان حديثان لا يثبتان، اما الاول ففيه وضاح بن يحيى، وقال ابن حبان كان يروي عن الثقات الاحاديث المقلوبات التي كانها معمولة فلا يحتج به قال احمد: “ومسنده”ضعيف واما الثاني ففيه عبد الله بن محرر. قال ابن حبان كان يكذب( ج ١ ص ٤٥٠ رقم الحديث: ৭৭০-৭১)
قال المحقق شعيب الارنؤوط في هامش مسند احمد: اسناد ضعيف ، أبو جناب الكلبي ضعفه ابن سعد و القطان، ابن معين وابو حاتم وغيره …وقال الذهبي : وهو غريب منكر .
وفي طريق الطبراني والبيهقي : قال المحقق: هذان اسنادان ضعيفان ، حماد بن عبد الرحمن الكلبي ضعيف والمبارك بن ابي حمزة مجهول واسماعيل وشريك القاضي سيئا الحفظ. (هامش مسند احمد ، رقم الحديث ٢٠٥٠ ، ٢٠٦٥ ، ٢٠٨١ )
قال الالباني (موضوع) انظر (سلسلة الاحاديث الضعيفه ٢٩٣٧) وقال الحافظ ابن حجر وهو حديث ضعيف وصححه الحاكم فذهل. ( فتح الباري ج ١٠ ص ٤ )

খণ্ডন: (দুই)
আল্লামা কাসানি রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, যদি হাদিসটা সহীহ মেনেও নেওয়া যায়, তাহলে তার অর্থ হচ্ছেÑকুরবানি নবীজির উপর ছিলো ফরজ আর উম্মতের উপর ফরয নয়। এখানে ওয়াজিবও নয় এমন কথা তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেননি। তাহলে এটা ওয়াজিব হওয়ার বিপক্ষে কীভাবে দলিল হতে পারে?

قال الكاساني فتقول ان الاضحيه ليست بمكتوبة علينا ( كما جاء في الرواية كتبت علي ولم يكتب عليكم ) ولكنها واجبة ، و فرق ما بين الواجب والفرض كفرق بين السماء والارض على ما عرف في اصول الفقه. (بدائع الصنائع: ج ٦ ص ٢٦٨ )

 

ওয়াজিব অমান্যকারীদের তৃতীয় দলিল:
ওয়াজিব এর বিপক্ষে সেসব হাদিস দিয়ে দলিল দেওয়া হয় যে হাদিসসমূহে কুরবানির ব্যাপারে (سنة المسلمين سنة ابراهيم سنة المعروفه) সুন্নাতে ইব্রাহিম, সুন্নাতুল মুসলিমিন, সুন্নাতে মারুফা ইত্যাদি শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে।
যেমন-
১/ বুখারি শরীফে কুরবানি সংক্রান্ত হাদিসের টীকায় বলা আছে: ইবনে উমর রা. বলেন, এটা (কুরবানি) হলো সুন্নাতে মা’রুফা তথা প্রসিদ্ধ রীতি।

وقال ابن عمر”هي سنة معروفة” (صحيح البخاري، باب سنة الاضاحي: رق الحديث:٥٥٤٥)

২/ বুখারি শরীফে হযরত বারা ইবনে আযেব রা. সূত্রে বর্ণিত হাদীসে এসেছে:

من فعله فقد اصاب سنتنا ومن ذبح قبل فان ما هو لحم قدمه لاهله .(رقم الحديث ٥٥٤٥ )

যারা নামাযের পর কুরবানি করেছে তারা সঠিকভাবে আমাদের সুন্নাতের উপর আমল করলো।

৩/ বুখারি শরীফে হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এর হাদীসে এসেছে;

من ذبح بعد الصلاه فقد تم نسكه واصاب سنه المسلمين (رقم الحديث: ٥٥٤٦)

খণ্ডন:
এসব হাদিসগুলো সহীহ এবং জয়ীফ উভয় ধরনের সনদে বর্ণিত আছে। উপরে সহীহ সনদে বর্ণিত বুখারি শরীফের হাদিস উদাহরণস্বরূপ পেশ করা হলো।
এগুলোর জবাবে স্বয়ং হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহমাতুল্লাহি আলাইহি নিজেই বলেছেন এসব হাদিসে ” سنة ” সুন্নাহ শব্দের অর্থ ফকিহদের পরিভাষার সুন্নাত নয়, যা ওয়াজিবের পরিপন্থী; বরং সুন্নাহ শব্দের অর্থ হাদিসসমূহে “তরিকা” ” الطريقة المسلوكة ” পন্থা, পদ্ধতি, নিয়ম বা তরিকা-ই উদ্দেশ্য। আর এটা ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত ও মুস্তাহাব সব ধরনের বিধানকে শামিল করে। তাই শব্দগুলোর বাহ্যিক অর্থ নিয়ে ওয়াজিব এর বিপক্ষে দাঁড় করানোর কোনো সুযোগ নেই। বিভিন্ন দলিলে যা ওয়াজিব প্রমাণিত সেগুলো ‘সুন্নাহ’। আর যে সব বিধান সুন্নাত বা মুস্তাহাব প্রমাণিত সেগুলোও ‘সুন্নাহ’।

ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেন:

المراد بالسنة هذا في الحديثين معا “الطريقة” لا السنة بالاصطلاح التي تقابل الوجوب والطريقة اعم من ان تكون للوجوب او للندب ( فتح الباري ج ١٠ ص ٥ )

আল্লামা থানভী রহ. বলেন:

و ما في حديث البراء عن الشيخين : من ذبح بعد الصلاة فقد تم نسكه واصاب سنة المسلمين ، فلا ينافي الوجوب لان المراد سيرة المسلمين وطريقتهم ، وذلك قدر مشترك بين الواجب والسنة المصطلح عليها ومثله قوله صلى الله عليه وسلم “سنوا بهم سنة اهل الكتاب” وقوله صلى الله عليه وسلم عليكم بسنتي وسنةالخلفاء الراشدين المهديين ، ولم تكن السنة المصطلح عليها معروفة اذ ذاك وقد قال البيهقي في قول ابن عباس : الختان سنة ، أراد سنة النبيদ্ধ الموجبة .(اعلاء السنن ج ١٠ ص ٧٩٤٥ بدائع الصنائع للكاساني: ج ٦ ص ٢٦٧)

সুতরাং সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়ে গেল যে, হাদিসে “সুন্নাহ” শব্দ দিয়ে কুরবানিকে ফিকহের ভাষায় “সুন্নাত” তথা ওয়াজিব নয় বলার কোনো সুযোগ নেই। কারণ পরবর্তী ‘সুন্নাত তথা ওয়াজিব নয়’ পরিভাষাটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে বিদ্যমান ছিলো না; বরং সুন্নাহের অর্থ হলো: তরিকা, পদ্ধতি, সিরাত যা ফরজ-ওয়াজিব-সুন্নত এবং মুস্তাহাব সবটিকে শামিল করে।

 

ওয়াজিব অমান্যকারীদের চতুর্থ দলিল:
হযরত জাবালা বিন সুহাইম রা. থেকে বর্ণিত:

أن رجلا سأل إبن عمر عن الأضحية أهي واجبة فقال ضحى رسول الله والمسلمون بعده).رواه الترمذي رقم ١٥٠٦ قال حديث حسن صحيح(

হযরত ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, কুরবানি কি ওয়াজিব? জবাবে তিনি نعم শব্দ বলেননি: বরং বলেছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানি করতেন, তারপর সাহাবায়ে কিরাম তথা মুসলমানগণও কুরবানি করতেন।
শুধু রাসুলের আমল ও মুসলমানদের আমলের কথা বলার দ্বারা বিষয়টি ওয়াজিব প্রমাণিত হয় না।

খণ্ডন:
সপ্তম হাদিসের আলোচনায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধারাবাহিক আমল ও গোটা মুসলিম উম্মাহর নিরবচ্ছিন্ন আমলকে মুহাদ্দিসগণ تعامل ও توارث বলেন। এমন আমল দ্বারা শুধু ওয়াজিব প্রমাণিত হয়, সুন্নাত নয়। বিশেষ করে কুরআনের একাধিক আয়াত ও রাসুলের বহু সহিহ হাদিস দ্বারা কুরবানি ওয়াজিব প্রমাণিত হওয়ায় এটাই প্রমাণ করছে যে, ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর উক্ত বক্তব্য দ্বারা কুরবানি ওয়াজিব প্রমাণিত হচ্ছে।
সুতরাং উক্ত হাদিসে ‘ওয়াজিব নয়’ এমন কোন মর্ম উদঘাটন করা মারাত্মক ভুল। রইল “نعم” “হাঁ ওয়াজিব” এভাবে বললেন না কেন? তার উত্তরে ‘হাঁ’ বললে তা ফরজ হয়ে যেতো। কারণ ওয়াজিব শব্দ দ্বারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তখন ফরজ বোঝানো হতো। (ই’লাউস সুনান:১৬/৭৯৪৬)

আল্লামা যফর আহমদ উসমানী রহ. বলেন:

قال العثماني قلت لا دلالة فيه على عدم الوجوب، فانه نظير قوله وسئل عن الوتر أ واجب هو فقال اوتر رسول الله و اوتر المسلمون . قال العيني في عمدة القاري فيه دلالة على وجوب الوتر إذ كلامه يدل على انه صار سبيلا للمسلمين فمن تركه فقد دخل في قوله تعالى: “ويتبع غير سبيل المؤمنين” وانما لم يصرح بالوجوب كي لا يظن تحتمه كتحتم الفرائض فكذلك هاهنا (اعلاء السنن ج ١٦ ص ٧٩٤٥)

 

ওয়াজিব অমান্যকারীদের পঞ্চম দলিল:
কিছু সাহাবাদের আমলের ব্যাপারে আসার “آثار” বর্ণিত হয়েছে। যেমন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু। তাঁরা কুরবানি করতেন না। কোনো বর্ণনায় আছে, তাঁরা তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানি করতেন না। যাতে অন্যদের জন্য তা আদর্শ না হয়ে বসে। তেমনিভাবে সাহাবী আবু মাসউদ আনসারী রাদিআল্লাহু আনহু বলেন: আমি কুরবানি করতাম না, অথচ আমার সামর্থ্য ছিল।
এসব হাদিস ও আসার প্রমাণ করে যে, কুরবানি বাধ্যতামূলক ছিলো না; বরং ঐচ্ছিক ছিলো।
হাদিসগুলো হচ্ছে:

(السنن الكبرى للبيهقي: رقم: ১৯০৩৪، ১৯০৩৫)عَنِ الشَّعْبِىِّ عَنْ أَبِى سَرِيحَةَ الْغِفَارِىِّ قَالَ : أَدْرَكْتُ أَبَا بَكْرٍ أَوْ رَأَيْتُ أَبَا بَكْرٍ وَعُمَرَ رَضِىَ اللَّهُ عَنْهُمَا لاَ يُضَحِّيَانِ فِى بَعْضِ حَدِيثِهِمْ كَرَاهِيَةَ أَنْ يُقْتَدَى بِهِمَا.
* عَنْ أَبِى وَائِلٍ عَنْ أَبِى مَسْعُودٍ الأَنْصَارِىِّ رَضِىَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ : إِنِّى لأَدَعُ الأَضْحَى وَإِنِّى لَمُوسِرٌ مَخَافَةَ أَنْ يَرَى جِيرَانِى أَنَّهُ حَتْمٌ عَلَىَّ. (السنن الكبرى للبيهقي: رقم: ১৯০৩৮-১৯০৩৯) قال المحقق في هامش البيهقي: الحديثان الأولان ضعيف والأخير صحيح، هي قول ابي مسعود .

খণ্ডন:
(ক) মুহাদ্দিসীনে কিরাম হুযাইফা বিন উসাইদ রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত হাদিসগুলো জয়ীফ ও দুর্বল বলে মত দিয়েছেন। যেমনটি সুনানে বাইহাকীতে মুহাক্কিক বলেছেন:

ضعيف لأن إسماعيل بن أبي خالد يدلس عن الشعبي وقد صحح إسناده الألباني في الأرواء و العلم عند الله .

কিন্তু আলবানী সাহেব একটি সনদকে সহীহও বলেছেন। আর সাহাবী আবু মাসউদ রা. এর হাদিসটিকে মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক এর সূত্রে অনেকে সহীহ বলেন।
(খ) কোনো সাহাবী কুরবানি না করার আমল দ্বারা কি তা মুস্তাহাব হয়ে যাবে? অথচ হযরত ইবনে উমর রা. এর হাদিসে এসেছে:

” ضحى رسول الله صلى الله عليه وسلم والمسلمون “

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সকল উম্মতে মুসলিমা কুরবানি ধারাবাহিকভাবে করে আসছেন। রাসূল সা. সহ সকল মুসলিম উম্মাহর ধারাবাহিক আমল আহলে হাদিস ভাইদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো না! শুধু তিনজন সাহাবী এরচে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো? (!)

(গ) কুরবানি কি সকলের উপর ওয়াজিব? না তার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে? উত্তর হলো ঢালাওভাবে ওয়াজিব নয়; বরং শর্ত সাপেক্ষে ওয়াজিব। এক নাম্বার শর্ত হলো, সামর্থ্যবান হওয়া। হযরত আবু বকর ও উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে যে ওয়াজিফা পেতেন তা দিয়ে কোনোরকম ঘরের প্রয়োজন পূরণ হতো। এর বেশি তাঁরা নিতেন না। তাই তাদের নিকট কুরবানি করার মত প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ ছিল না। সে কারণে কুরবানি করতেন না। এটা হাদিস বিশারদগণের ব্যাখ্যা। নতুবা যে কাজ রাসূল স. কখনো ছাড়েননি। দুই খলীফায়ে রাশেদ এই মুবারক কাজ ছাড়ার প্রশ্নই আসে না।
হাঁ, আবু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করেননি। হতে পারে এটা তাঁর ইজতিহাদ। বিষয়টি যে পূর্ব থেকেই মতবিরোধপূর্ণ তা ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
শুধু আবু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এর আমল কুরআন-হাদিসের উপরোক্ত মজবুত দলিলের বিপক্ষে কীভাবে দাঁড় করানো সম্ভব? অথচ এই সম্ভাবনাও থাকছে যে, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং আবু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানি করতেন না।
কানযুল উম্মাল গ্রন্থে এই সম্ভাবনার প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। আর আবু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এর ব্যাপারে এও সম্ভাবনা রয়েছে যে, তিনি সামর্থ্যবান ছিলেন, তবে ঋণগ্রস্থ থাকায় কুরবানি করতেন না। যাতে শরয়ী মাসআলার ব্যাপারে কেউ ভুল না বুঝে। কিছু হাদিস বিশেষজ্ঞগণ এই সম্ভাবনার কথাও উল্লেখ করেছেন।

বিষয়গুলো ইমাম কাসানি রহ. এভাবে উল্লেখ করেন:

أما حديث سيدنا أبي بكر وسيدنا عمر فيحتمل أنهما كانا لا يضحيان السنة و السنتين لعدم غناهما لماّ كان لا يفضل رزقهما الذي كان في بيت المال عن كفايتهما ، والغني شرط الوجوب في هذا النوع .
وقول ابي مسعود رضي الله عنه لا يصلح معارضا للكتاب الكريم و السنة مع ما أنه يحتمل أنه كان عليه دين فخاف على جاره لو ضحى أن يعتقد وجوب الأضحية مع قيام الدين… فلا يكون حجة مع الاحتمال او يحمل على ما قلنا توفيقا بين الدلائل صيانة لها على التناقض” (بدائع الصنائع: ج ٦ ص ٢٩٧)
و ما قال ابن حزم عن ابي سريحة الغفاري لقد رايت ابا بكر وعمر وما يضحيان كراهية اي يقتدي بهما فهو محمول على انهما كانا لا يضحيان عن اهلهما كما في كنز العمال: ج ٣ ص ٤٥ . (راجع اعلاء السنن ج ১٦ ص ٧٩٤٢)

 

সারকথা:

কুরবানি করা বিশুদ্ধ মতে বহু দলিলের ভিত্তিতে ওয়াজিব ও আবশ্যকীয়। তবে তা কেবল সামর্থ্যবান মুকিম ও বালেগ মুসলমানের উপর। ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ রহ. এর এক বর্ণনা অনুযায়ী তা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা, ওয়াজিব নয়। তবে ইসলামের বিশাল নিদর্শন। এটাই বিশ্ব মুসলিমের কর্মপন্থা ও আবশ্যিক করনীয়। শরয়ী ওজর ছাড়া কুরবানি ছাড়া যাবে না। অথচ বর্তমান আহলে হাদিসদের অনেকের মতে কুরবানি ঐচ্ছিক বিষয়। না করলে কোনো গোনাহ নেই।

কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার দলিলসমূহের নির্যাস:

এক. সূরা কাউসারে ‘নাহর’ (কুরবানি) করার জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন:

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‎﴿٢﴾

অর্থ: অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামায পড়ুন এবং কুরবানি করুন। (সূরা কাউসার-২)
এ নির্দেশ পালন অবশ্যই ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ বহন করে।

দুই. সূরা হজের ৩৪ নং আয়াতে কুরবানিকে আল্লাহ সকল উম্মতের জন্য ধার্য্য করেছেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন:

وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنسَكًا لِّيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ ۗ

অর্থ: আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানি নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ কারার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।… (সূরা হজ্জ-৩৪)
এমন আমল যা সকল উম্মতের জন্য অবধারিত তা অবশ্যই ওয়াজিব হওয়ার-ই প্রমাণ বহন করে।

তিন. কুরআনুল কারিমে একাধিক জায়গায় কুরবানিকে নামাযের সাথে যুক্ত করে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন:

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ‎﴿١٦٢﴾

অর্থ: আপনি বলুনঃ আমার নামায, আমার কুরবানি এবং আমার জীবন ও মরন বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে। (সূরা আনআম-১৬২)
এতে একথা প্রমাণ হয় যে, নামায যেমন আবশ্যকীয়, কুরবানিও তাই। অতএব, কুরবানি ওয়াজিব বলেই সাব্যস্ত হবে।

চার. একাধিক আয়াতে কুরবানির পশুর উপর আল্লাহর নাম নিয়ে জবাই করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে:

لِّيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ ۗ

এবং

وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُم مِّن شَعَائِرِ اللَّهِ لَكُمْ فِيهَا خَيْرٌ ۖ فَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهَا صَوَافَّ ۖ

অন্য আয়াতে এসেছে:

كَذَٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَاكُمْ ۗ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ ‎﴿٣٧﴾‏

এ আয়াতগুলোতে কুরবানির জন্তুর উপর আল্লাহর নাম নিয়ে জবাই করতে বলা প্রমাণ করে যে, বিষয়টি কমপক্ষে ওয়াজিব পর্যায়ের হবে।

পাঁচ. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বহু হাদিসে “ضحوا” বলে কুরবানি করার নির্দেশ দিয়েছেন। রাসুলের ব্যাপক আদেশ দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, কুরবানি ওয়াজিব।

ছয়. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা কুরবানি করবে না’ তাদের প্রতি ঈদগাহে না আসার হুশিয়ারি উচ্চারণও প্রমাণ করে কুরবানি ওয়াজিব।

সাত. যারা ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানি দিয়েছে তাদেরকে রাসূল স. পুনরায় কুরবানি আদায় করার নির্দেশ প্রদান করেন। এটা প্রমাণ করে যে, কুরবানি ওয়াজিব ও আবশ্যকীয় আমল।

আট. রাসূল স. মদীনার জীবনে কোনোদিন কুরবানি ছাড়েননি। তাঁর এই ধারাবাহিক আমল (مواظبة النبي) কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ।

নয়. ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কুরবানি ওয়াজিব কি-না? প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, এটা রাসূল স. এবং সমস্ত মুসলিম উম্মাহর ধারাবাহিক আমল। এমন (توارث ও تعامل ) প্রমাণ করে যে, কুরবানি ওয়াজিব।

দশ. وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ.. আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, পুরো উম্মতের আদর্শ ও পথ-পন্থা গ্রহণ না করা মারাত্মক অপরাধ হিসাবে স্বীকৃত। এজাতীয় আমল অবশ্যই ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ বহন করে।

এগার. শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া ও শাইখ ইবনে উসাইমিন রহ. মাযহাবগত হাম্বলী হওয়া সত্ত্বেও নিজ মাযহাব ছেড়ে দলিলের বিচারে ওয়াজিব হওয়ার ফতোয়া দিয়েছেন এবং ইবনে তাইমিয়া রহ. এটাও বলেছেন যে, কুরবানি ঐক্যবদ্ধভাবে তরক করা হজ্জ বর্জন করার মতো অপরাধ।

পরিশেষে বলতে চাই, আজকে আহলে হাদিস ভাইগণ কুরবানিকে সুন্নাত বলেন, আর কুরবানি না করলে কোন সমস্যা নেই বলে এই পবিত্র ইবাদত থেকে সাধারন মুসলমানকে বিরত রাখার পথ সুগম করে থাকেন! অথচ তাদের দৃষ্টিতে নামাযে আমিন উচ্চস্বরে বলা, রফয়ে ইয়াদাইন করাসহ বহু বিষয়ও সুন্নাত। তা সত্ত্বেও এ সুন্নাতগুলো পালন করার প্রতি খুব জোর দেন। এমনকি কেউ যদি তার মাযহাব অনুসারে আমিন নিম্নস্বরে বলে, হাত উত্তোলন না করে, তাদেরকে বিদআতী-গোমরাহ ইত্যাদি নামে সম্বোধন করে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ান। অথচ কুরবানিকে সুন্নাত মানা সত্ত্বেও এটার ব্যাপারে মানুষকে নিরুৎসাহিত করেন। এই সাংঘর্ষিক কর্মকা-ের পিছনে কি রহস্য লুকিয়ে আছে? তা উদঘাটন করা আজ মুসলিম উম্মাহর প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মুসলিমাকে প্রভৃত্তির পুঁজা ও ব্যক্তি স্বার্থ বাদ দিয়ে কুরআন-সুন্নাহর ব্যখ্যায় ইনসাফ প্রদর্শনের তাওফীক দান করুন। ইসলামের অন্যতম শিআর তথা কুরবানিকে যথাযথ গুরুত্ব ও মর্যাদার সাথে পালন করার তাওফীক দান করুন। আমীন ॥

প্রবন্ধকারঃ মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ, লেখক, গবেষক ও বিশিষ্ট দায়ী, ১৭/০৭/২০২১ইং

 

কুরবানীর ফাযায়েল ও মাসায়েল

 

কুরবানীর ফযীলত

 

عن عائشة رضي الله تعالى عنها أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : ما عمل آدمي من عمل يوم النحر أحب إلى الله من إهراق الدم، إنه ليأتي يوم القيامة بقرونها وأشعارها وأظلافها، وإن الدم ليقع من الله بمكان قبل أن يقع من الأرض، فطيبوا بها نفسا.

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কুরবানীর দিনের আমলসমূহের মধ্য থেকে পশু কুরবানী করার চেয়ে কোনো আমল আল্লাহ তাআলার নিকট অধিক প্রিয় নয়। কিয়ামতের দিন এই কুরবানীকে তার শিং, পশম ও ক্ষুরসহ উপস্থিত করা হবে। আর কুরবানীর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহ তাআলার নিকট কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কুরবানী কর। (জামে তিরমিযী, হাদীস : ১৪৯৩)

সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি এই ইবাদত পালন করে না তার ব্যাপারে হাদীস শরীফে কঠোর ধমকি এসেছে,

عن أبي هريرة قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : من وجد سعة لأن يضحي فلم يضح فلا يقربن مصلانا.

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যার কুরবানীর সামর্থ্য আছে তবুও সে কুরবানী করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’-মুসনাদে আহমদ ২/৩২১; মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস : ৭৬৩৯; আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব ২/১৫৫

ইবাদতের মূলকথা হল আল্লাহ তাআলার আনুগত্য এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন। তাই যেকোনো ইবাদতের পূর্ণতার জন্য দুটি বিষয় জরুরি। ইখলাস তথা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পালন করা এবং শরীয়তের নির্দেশনা মোতাবেক মাসায়েল অনুযায়ী সম্পাদন করা। এখানে কুরবানীর কিছু জরুরি মাসায়েল উপস্থাপিত হল।

 

কার উপর কুরবানী ওয়াজিব

 

মাসআলা : . প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ যিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজন অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলঙ্কার, বর্তমানে বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।

আর নিসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি। টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্ত্তর ক্ষেত্রে নিসাব হল সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্ত্ত মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। যেমন কারো নিকট কিছু স্বর্ণ ও কিছু টাকা আছে, যা সর্বমোট সাড়ে বায়ান্ন তোলা চাঁদির মূল্য সমান হয় তাহলে তার উপরও কুরবানী ওয়াজিব। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

فصل لربك وانحر

 (তরজমা) অতএব আপনি আপনার রবব-এর উদ্দেশ্যে নামায পড়ুন এবং কুরবানী আদায় করুন। (সূরা কাউসার : ২)

এছাড়া ইতিপূর্বে উল্লেখিত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদীসটিও কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার দলিল।-আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫

 

মাসআলা : . একান্নভুক্ত পরিবারের মধ্যে একাধিক ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্ত পাওয়া গেলে অর্থাৎ তাদের কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে তাদের প্রত্যেকের উপর ভিন্ন ভিন্ন কুরবানী ওয়াজিব।

পরিবারের যত সদস্যের উপর কুরবানী ওয়াজিব তাদের প্রত্যেককেই একটি করে পশু কুরবানী করতে হবে কিংবা বড় পশুতে পৃথক পৃথক অংশ দিতে হবে। একটি কুরবানী সকলের জন্য যথেষ্ট হবে না।

 

নেসাবের মেয়াদ

 

মাসআলা . কুরবানীর নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কুরবানীর তিন দিন থাকলে এমনকি ১২ তারিখ সূর্যাস্তের কিছু আগে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে গেলেও কুরবানী ওয়াজিব হবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩১২

নাবালেগের কুরবানী

মাসআলা : . নাবালেগ শিশু-কিশোর তদ্রূপ যে সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন নয়, নেসাবের মালিক হলেও তাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। অবশ্য তার অভিভাবক নিজ সম্পদ দ্বারা তাদের পক্ষে নফল কুরবানী করতে পারবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩১৬

 

মুসাফিরের জন্য কুরবানী

 

মাসআলা : .  যে ব্যক্তি কুরবানীর দিনগুলোতে মুসাফির থাকবে (অর্থাৎ ৪৮ মাইল বা প্রায় ৭৮ কিলোমিটার দূরে যাওয়ার নিয়তে নিজ এলাকা ত্যাগ করেছে) তার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। -ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৪, বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৫, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৫

 

দরিদ্র ব্যক্তির কুরবানীর হুকুম

মাসআলা : . নেসাব পরিমাণ সম্পদ নেই এমন দরিদ্র ব্যক্তির উপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয়; কিন্তু সে যদি কুরবানীর নিয়তে কোনো পশু কিনে তাহলে তা কুরবানী করা ওয়াজিব হয়ে যায়। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯২

 

কুরবানীর সময়

 

যিলহজ্ব মাসের  ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত মোট তিন দিন কুরবানীর সময়। তবে সবচেয়ে উত্তম হল প্রথম দিন কুরবানী করা। এরপর দ্বিতীয় দিন এরপর তৃতীয় দিন।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৮; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৫

عن البراء عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : إن أول ما نبدأ به في يومنا هذا أن نصلي ثم نرجع فننحر، فمن فعل ذلك فقد أصاب سنتنا، ومن ذبح قبل فإنما هو لحم قدمه لأهله، ليس من النسك في شيء.

বারা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ঈদের দিন আমরা প্রথমে নামায আদায় করি। অতপর ফিরে এসে কুরবানী করি। যে ব্যক্তি এভাবে আদায় করবে সে আমাদের নিয়ম মতো করল। আর যে নামাযের আগেই পশু জবাই করল সেটা তার পরিবারের জন্য গোশত হবে, এটা কুরবানী হবে না।-সহীহ মুসলিম ২/১৫৪

 

প্রথম দিন কখন থেকে কুরবানী করা যাবে

 

মাসআলা : . যেসব এলাকার লোকদের উপর জুমা ও ঈদের নামায ওয়াজিব তাদের জন্য ঈদের নামাযের আগে কুরবানী করা জায়েয নয়। অবশ্য বৃষ্টিবাদল বা অন্য কোনো ওজরে যদি প্রথম দিন ঈদের নামায না হয় তাহলে ঈদের নামায আদায় পরিমাণ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম দিনেও কুরবানী করা জায়েয।-সহীহ বুখারী ২/৮৩২, কাযীখান ৩/৩৪৪, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৮; সহীহ মুসলিম ২/১৫৪

روى الشيخان عن الرسول صلى الله عليه وسلم قال : من ذبح قبل الصلاة فإنما يذبح لنفسه ومن ذبح بعد الصلاة فقد تم نسكه وأصاب سنة المسلمين.

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানীর পশু জবাই করবে সেটা তার নিজের জন্য সাধারণ জবাই হবে। আর যে নামায ও খুতবার পর জবাই করবে তার কুরবানী পূর্ণ হবে এবং সে-ই মুসলমানদের রীতি অনুসরণ করেছে।-সহীহ বুখারী ২/৮৩৪; সহীহ মুসলিম ২/১৫৪

 

রাতে কুরবানী করা

মাসআলা : ১০.  ১০ ও ১১ যিলহজ্ব দিবাগত রাতেও কুরবানী করা জায়েয। তবে দিনে কুরবানী করাই ভালো।-মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২২, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২০, কাযীখান ৩/৩৪৫, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩

কুরবানীর উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত পশু সময়ের পর যবাই করলে

কুরবানী করতে না পারলে

মাসআলা : ১০. কেউ যদি কুরবানীর দিনগুলোতে ওয়াজিব কুরবানী দিতে না পারে তাহলে কুরবানীর পশু ক্রয় না করে থাকলে তার উপর কুরবানীর উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। আর যদি পশু ক্রয় করেছিল, কিন্তু কোনো কারণে কুরবানী দেওয়া হয়নি তাহলে ঐ পশু জীবিত সদকা করে দিবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৪, ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৫

মাসআলা : ১১. কুরবানীর দিনগুলোতে যদি জবাই করতে না পারে তাহলে খরিদকৃত পশুই সদকা করে দিতে হবে। তবে যদি (সময়ের পরে) জবাই করে ফেলে তাহলে পুরো গোশত সদকা করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে গোশতের মূল্য যদি জীবিত পশুর চেয়ে কমে যায় তাহলে যে পরিমাণ মূল্য হ্রাস পেল তা-ও সদকা করতে হবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০২, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২০-৩২১

 

কোন কোন পশু দ্বারা কুরবানী করা যাবে

 

মাসআলা : ১২.  উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। তদ্রূপ হাঁস-মুরগি বা কোনো পাখি দ্বারাও কুরবানী জায়েয নয়।-কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

ولكل امة جعلنا منسكا ليذكروا اسم الله على ما رزقهم من بهيمة الأنعام

 (তরজমা) আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানীর নির্দেশ দিয়েছি। আল্লাহ তাদের রুযি হিসেবে যেসব গৃহপালিত পশু দিয়েছেন তার উপর তারা যেন (জবাই করার সময়) আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে।-সূরা হজ্ব : ৩৪

 

নর  মাদা পশুর কুরবানী

মাসআলা : ১৩. যেসব পশু কুরবানী করা জায়েয সেগুলোর নর-মাদা দুটোই কুরবানী করা যায়। -কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫

 

কুরবানীর পশুর বয়সসীমা

মাসআলা : ১৪. উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী করা জায়েয। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে।

উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানী জায়েয হবে না। (কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬)

জাবের রা. থেকে বর্ণিত,

أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : لا تذبحوا إلا مسنة، إلا أن يعسر عليكم فتذبحوا جذعة من الضأن.

তোমরা (কুরবানীর জন্য) মুসিন্নাহ ব্যতীত যবাই করো না। (মুসিন্নাহ হল, ৫ বছর বয়সী উট, ২ বছরের গরু ও ছাগলের ক্ষেত্রে ১ বছর [শরহুন নববী]) যদি সম্ভব না হয় তবে ছয় মাস বয়সী ভেড়া বা দুম্বা।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৯৬৩

 

এক পশুতে শরীকের সংখ্যা

 

মাসআলা : ১৫. একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা শুধু একজনই কুরবানী দিতে পারবে। এমন একটি পশু দুই বা ততোধিক ব্যক্তি মিলে কুরবানী করলে কারোটাই সহীহ হবে না। আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাত জন শরীক হতে পারবে। সাতের অধিক শরীক হলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৩১৮, মুয়াত্তা মালেক ১/৩১৯, কাযীখান ৩/৩৪৯, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭-২০৮)

وعن جابر قال : أمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم أن نشترك في الإبل والبقر كل سبعة منا في بدنة.

জাবির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নির্দেশ করেছেন যে, আমরা একটি গরু এবং একটি উটে সাতজন করে শরীক হয়ে যাই।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১২১৮

 

সাত শরীকের কুরবানী

 

মাসআলা : ১৬. সাতজনে মিলে কুরবানী করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। কারো অংশ এক সপ্তমাংশের কম হবে না। যেমন কারো আধা ভাগ, কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরীকের কুরবানী সহীহ হবে না।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭

মাসআলা : ১৭. উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কুরবানী করা জায়েয। -সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৩১৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭

 

কোনো অংশীদারের গলদ নিয়ত হলে

 

মাসআলা : ১৮. যদি কেউ আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কুরবানী না করে শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কুরবানী করে তাহলে তার কুরবানী সহীহ হবে না। তাকে অংশীদার বানালে শরীকদের কারো কুরবানী হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শরীক নির্বাচন করতে হবে। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৮, কাযীখান ৩/৩৪৯

 

কুরবানীর পশুতে আকীকার অংশ

 

মাসআলা : ১৯. কুরবানীর গরু, মহিষ ও উটে আকীকার নিয়তে শরীক হতে পারবে। এতে কুরবানী ও আকীকা দুটোই সহীহ হবে। ছেলের জন্য দুই অংশ আর মেয়ের জন্য এক অংশ দিতে হবে।

 শৈশবে আকীকা করা না হলে বড় হওয়ার পরও আকীকা করা যাবে। যার আকীকা সে নিজে এবং তার মা-বাবাও আকীকার গোশত খেতে পারবে।-ইলাউস সুনান ১৭/১২৬

কেউ কেউ কুরবানীর পশুর সাথে আকীকা দিলে আকীকা সহীহ হবে না বলে মত দেন। কিন্তু নির্ভরযোগ্য আলেমগণ এ মতটি গ্রহণ করেননি। কোনো হাদীসে কুরবানীর সাথে আকীকা করতে নিষেধ করা হয়নি; বরং কুরবানীর সাথে হজ্বের কুরবানী, জরিমানা দম একত্রে এক পশুতে দেওয়ারও প্রমাণ আছে। অর্থাৎ কুরবানীর পশুতে অন্য ইবাদতের নিয়তে শরিক হওয়া জায়েয। সুতরাং আকীকার নিয়তে শরিক হওয়াও জায়েয। আতা ইবনে আবী রবাহ রাহ. বলেছেন, উট-গরু সাতজনের পক্ষ হতে কুরবানী হতে পারে। আর এতে শরিক হতে পারে কুরবানীকারী, তামাত্তু হজ্বকারী এবং হজ্বের ইহরাম গ্রহণের পর হজ্ব আদায়ে অপারগ ব্যক্তি। (আসসুনান, সায়ীদ ইবনে মানসূর-আলকিরা লী কাসিদি উম্মিল কুরা ৫৭৩)

এছাড়া ফাতাওয়া শামীসহ ফিকহ-ফাতাওয়ার কিতাবাদিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কুরবানীর সাথে আকীকা সহীহ। দেখুন : রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৬; হাশিয়াতুত তহতাবী আলাদ্দুর ৪/১১৬

মাসআলা : ২০. কুরবানী করতে হবে সম্পূর্ণ হালাল সম্পদ থেকে। হারাম টাকা দ্বারা কুরবানী করা সহীহ নয় এবং এক্ষেত্রে অন্য শরীকদের কুরবানীও সহীহ হবে না।

মাসআলা : ২১. যদি কেউ গরু, মহিষ বা উট একা কুরবানী দেওয়ার নিয়তে কিনে আর সে ধনী হয় তাহলে তার জন্য এ পশুতে অন্যকে শরীক করা জায়েয। তবে এতে কাউকে শরীক না করে একা কুরবানী করাই শ্রেয়। শরীক করলে সে টাকা সদকা করে দেওয়া উত্তম। আর যদি ওই ব্যক্তি এমন গরীব হয়, যার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয়, তাহলে যেহেতু কুরবানীর নিয়তে পশুটি ক্রয় করার মাধ্যমে লোকটি তার পুরোটাই আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করে নিয়েছে তাই তার জন্য এ পশুতে অন্যকে শরীক করা জায়েয নয়। যদি শরিক করে তবে ঐ টাকা সদকা করে দেওয়া জরুরি হবে। কুরবানীর পশুতে কাউকে শরীক করতে চাইলে পশু ক্রয়ের সময়ই নিয়ত করে নিতে হবে।-কাযীখান ৩/৩৫০-৩৫১, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১০

 

কুরবানীর উত্তম পশু

 

মাসআলা : ২২. কুরবানীর পশু হৃষ্টপুষ্ট হওয়া উত্তম।-মুসনাদে আহমদ ৬/১৩৬, আলমগীরী ৫/৩০০, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩

ত্রুটিযুক্ত পশুর কুরবানীর হুকুম

রুগ্ন  দুর্বল পশুর কুরবানী

মাসআলা : ২৪. এমন শুকনো দুর্বল পশু, যা জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না তা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। -জামে তিরমিযী ১/২৭৫, আলমগীরী ৫/২৯৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৪

দাঁত নেই এমন পশুর কুরবানী

মাসআলা : ২৫. যে পশুর একটি দাঁতও নেই বা এত বেশি দাঁত পড়ে গেছে যে, ঘাস বা খাদ্য চিবাতে পারে না এমন পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৫, আলমগীরী ৫/২৯৮

যে পশুর শিং ভেঙ্গে বা ফেটে গেছে

মাসআলা : ২৬. যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙ্গে গেছে, যে কারণে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে পশুর কুরবানী জায়েয নয়। পক্ষান্তরে যে পশুর অর্ধেক শিং বা কিছু শিং ফেটে বা ভেঙ্গে গেছে বা শিং একেবারে উঠেইনি সে পশু কুরবানী করা জায়েয। -জামে তিরমিযী ১/২৭৬, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৩৮৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৪, আলমগীরী ৫/২৯৭

 

কান বা লেজ কাটা পশুর কুরবানী

 

মাসআলা : ২৭. যে পশুর লেজ বা কোনো কান অর্ধেক বা তারও বেশি কাটা সে পশুর কুরবানী জায়েয নয়। আর যদি অর্ধেকের বেশি থাকে তাহলে তার কুরবানী জায়েয। তবে জন্মগতভাবেই যদি কান ছোট হয় তাহলে অসুবিধা নেই। -জামে তিরমিযী ১/২৭৫, মুসনাদে আহমদ ১/৬১০, ইলাউস সুনান ১৭/২৩৮, কাযীখান ৩/৩৫২, আলমগীরী ৫/২৯৭-২৯৮

আলী রা. বলেন, আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করেছেন, আমরা যেন কুরবানীর পশুর চোখ ও কান ভালো করে দেখে নিই এবং কান কাটা, কান ছেঁড়া বা কানে গোলাকার ছিদ্র করা পশু দ্বারা কুরবানী না করি। (মুসনাদে আহমদ ১/৮০; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৮০৪)

অন্ধ পশুর কুরবানী

মাসআলা : ২৮. যে পশুর দুটি চোখই অন্ধ বা এক চোখ পুরো নষ্ট সে পশু কুরবানী করা জায়েয নয়। -জামে তিরমিযী ১/২৭৫, কাযীখান ৩/৩৫২, আলমগীরী ২৯৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৪

বারা ইবনে আযেব রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

أربع لا يضحى بهن العوراء البين عورها والمريضة البين مرضها والعرجاء البين ضلعها والعجفاء التي لا تنتقي

অর্থাৎ চার ধরনের পশু দ্বারা কুরবানী করা যাবে না। যে পশুর চোখের জ্যোতি ক্ষতিগ্রস্ত, যে পশু অতি রোগাক্রান্ত, যে পশু বেশি খোঁড়া আর যে পশু অতি শীর্ণকায়। (মুয়াত্তা ইমাম মালেক ২/৪৮২; জামে তিরমিযী, হাদীস : ১৪৯৭

 

খোড়া পশুর কুরবানী

 

মাসআলা : ২৩. যে পশু তিন পায়ে চলে, এক পা মাটিতে রাখতে পারে না বা ভর করতে পারে না এমন পশুর কুরবানী জায়েয নয়। -জামে তিরমিযী ১/২৭৫, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৩৮৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৪, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৩, আলমগীরী ৫/২৯৭

 

নতুন পশু ক্রয়ের পর হারানোটা পাওয়া গেলে

 

মাসআলা : ২৯. কুরবানীর পশু হারিয়ে যাওয়ার পরে কুরবানীদাতা ধনী হলে দুটির একটি কুরবানী করলেই চলবে। তবে দুটি কুরবানী করাই উত্তম। উল্লেখ্য যে, গরীব ব্যক্তির ক্রয়কৃত পশু হারিয়ে গেলে তার জন্য আরেকটি পশু কুরবানী করা আবশ্যকীয় নয়, তারপরও যদি সে আরেকটি পশু কুরবানীর জন্য কিনে ফেলে তবে সেটি জবাই করা জরুরি হয়ে যায় এবং হারানোটি পাওয়া গেলে তাও জবাই করতে হবে।-সুনানে বায়হাকী ৫/২৪৪, ইলাউস সুনান ১৭/২৮০, বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৯, কাযীখান ৩/৩৪৭

 

গর্ভবতী পশুর কুরবানী

 

মাসআলা : ৩০. গর্ভবতী পশু কুরবানী করা জায়েয। তবে প্রসবের সময় আসন্ন হলে সে পশু কুরবানী করা মাকরূহ। জবাইয়ের পর যদি বাচ্চা জীবিত পাওয়া যায় তাহলে সেটাও জবাই করতে হবে এবং কেউ চাইলে এর গোশতও খেতে পারবে।-কাযীখান ৩/৩৫০

 

পশু কেনার পর দোষ দেখা দিলে

 

মাসআলা : ২৯. কুরবানীর নিয়তে ভালো পশু কেনার পর যদি তাতে এমন কোনো দোষ দেখা দেয় যে কারণে কুরবানী জায়েয হয় না তাহলে ওই পশুর কুরবানী সহীহ হবে না। এর স্থলে আরেকটি পশু কুরবানী করতে হবে। তবে ক্রেতা গরীব হলে ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারাই কুরবানী করতে পারবে। -খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩১৯, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬, ফাতাওয়া নাওয়াযেল ২৩৯, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৫

 

পশুর বয়সের ব্যাপারে বিক্রেতার কথা

 

মাসআলা : ১৬. যদি বিক্রেতা কুরবানীর পশুর বয়স পূর্ণ হয়েছে বলে স্বীকার করে আর পশুর শরীরের অবস্থা দেখেও তাই মনে হয় তাহলে বিক্রেতার কথার উপর নির্ভর করে পশু কেনা এবং তা দ্বারা কুরবানী করা যাবে।-আহকামে ঈদুল আযহা, মুফতী শফী রাহ., পৃষ্ঠা ৫

 

বন্ধ্যা পশুর কুরবানী

 

মাসআলা : ৩৩. বন্ধ্যা পশুর কুরবানী জায়েয। -রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৫

 

জবাই সংক্রান্ত মাসআলা

 

কুরবানীর পশু নিজে জবাই করা

মাসআলা : ৩৪. কুরবানীর পশু নিজে জবাই করা উত্তম। তবে অন্যকে দিয়েও জবাই করাতে পারবে। এক্ষেত্রে কুরবানীদাতা পুরুষ হলে জবাইস্থলে তার উপস্থিত থাকা ভালো। -মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২২৬৫৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২২-২২৩, আলমগীরী ৫/৩০০, ইলাউস সুনান ১৭/২৭১-২৭৪

 

জবাইয়ে একাধিক ব্যক্তি শরীক হলে

 

মাসআলা : ৩৫. অনেক সময় জবাইকারীর জবাই সম্পন্ন হয় না, তখন কসাই বা অন্য কেউ জবাই সম্পন্ন করে থাকে। এক্ষেত্রে অবশ্যই উভয়কেই নিজ নিজ যবাইয়ের আগে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ পড়তে হবে। যদি কোনো একজন না পড়ে তবে ওই কুরবানী সহীহ হবে না এবং জবাইকৃত পশুও হালাল হবে না। -রদ্দুল মুহতার ৬/৩৩৪

 

কুরবানীর পশু থেকে জবাইয়ের আগে উপকৃত হওয়া

 

মাসআলা : ৩৬. কুরবানীর পশু কেনার পর বা নির্দিষ্ট করার পর তা থেকে উপকৃত হওয়া জায়েয নয়। যেমন হালচাষ করা, আরোহণ করা, পশম কাটা ইত্যাদি। সুতরাং কুরবানীর পশু দ্বারা এসব করা যাবে না। যদি করে তবে পশমের মূল্য, হালচাষের মূল্য ইত্যাদি সদকা করে দিবে।-মুসনাদে আহমদ ২/১৪৬, নায়লুল আওতার ৩/১৭২, ইলাউস সুনান ১৭/২৭৭, কাযীখান ৩/৩৫৪, আলমগীরী ৫/৩০০

 

কুরবানীর পশুর দুধ পান করা

 

মাসআলা : ৩৭. কুরবানীর পশুর দুধ পান করা যাবে না। যদি জবাইয়ের সময় আসন্ন হয় আর দুধ দোহন না করলে পশুর কষ্ট হবে না বলে মনে হয় তাহলে দোহন করবে না। প্রয়োজনে ওলানে ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে দেবে। এতে দুধের চাপ কমে যাবে। যদি দুধ দোহন করে ফেলে তাহলে তা সদকা করে দিতে হবে। নিজে পান করে থাকলে মূল্য সদকা করে দিবে। -মুসনাদে আহমদ ২/১৪৬, ইলাউস সুনান ১৭/২৭৭, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৯, কাযীখান ৩/৩৫৪, আলমগীরী ৫/৩০১

 

কোনো শরীকের মৃত্যু ঘটলে

 

মাসআলা : ৩৬. কয়েকজন মিলে কুরবানী করার ক্ষেত্রে জবাইয়ের আগে কোনো শরীকের মৃত্যু হলে তার ওয়ারিসরা যদি মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করার অনুমতি দেয় তবে তা জায়েয হবে। নতুবা ওই শরীকের টাকা ফেরত দিতে হবে। সেক্ষেত্রে তার স্থলে অন্যকে শরীক করা যাবে। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৯, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২৬, কাযীখান ৩/৩৫১

 

কুরবানীর পশুর বাচ্চা হলে

 

মাসআলা : ৩১. কুরবানীর পশু ক্রয়ের পর জবাইয়ের আগে বাচ্চা দিলে ওই বাচ্চার গোশত খাওয়া যাবে না। পুরো গোশত সদকা করে দিতে হবে। তবে ওই বাচ্চা জবাই না করে জীবিত সদকা করে দেওয়া উত্তম।-কাযীখান ৩/৩৪৯, আলমগীরী ৫/৩০১, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৩

 

মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী

 

মাসআলা : ৪০মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করা জায়েয। মৃত ব্যক্তি যদি ওসিয়ত না করে থাকে তবে সেটি নফল কুরবানী হিসেবে গণ্য হবে। কুরবানীর স্বাভাবিক গোশতের মতো তা নিজেরাও খেতে পারবে এবং আত্মীয়-স্বজনকেও দিতে পারবে। আর যদি মৃত ব্যক্তি কুরবানীর ওসিয়ত করে গিয়ে থাকে তবে এর গোশত নিজেরা খেতে পারবে না। গরীব-মিসকীনদের মাঝে সদকা করে দিতে হবে। -মুসনাদে আহমদ ১/১০৭, হাদীস ৮৪৫, ইলাউস সুনান ১৭/২৬৮, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৬, কাযীখান ৩/৩৫২

 

কুরবানীর গোশত জমিয়ে রাখা

 

মাসআলা : ৪১. কুরবানীর গোশত ফ্রিজে রাখা বা প্রক্রিয়াজাত করে রাখা জায়েয।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪, সহীহ মুসলিম ২/১৫৯, মুয়াত্তা মালেক ১/৩১৮, ইলাউস সুনান ১৭/২৭০

 

কুরবানীর গোশত বণ্টন

 

মাসআলা : ৪২. শরীকে কুরবানী করলে ওজন করে গোশত বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েয নয়।-আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৭, কাযীখান ৩/৩৫১

মাসআলা : ৪৩. কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ গরীব-মিসকীনকে এবং এক তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দেওয়া উত্তম। অবশ্য পুরো গোশত নিজে রেখে দেওয়াও নাজায়েয নয়।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪, আলমগীরী ৫/৩০০

 

গোশতচর্বি বিক্রি করা

 

মাসআলা : ৪৪. কুরবানীর গোশত, চর্বি ইত্যাদি বিক্রি করা জায়েয নয়। বিক্রি করলে প্রাপ্ত মূল্য সদকা করে দিতে হবে। -ইলাউস সুনান ১৭/২৫৯, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৫, কাযীখান ৩/৩৫৪, আলমগীরী ৫/৩০১

 

জবাইকারীকে চামড়াগোশত দেওয়া

 

মাসআলা : ৪৫. জবাইকারী, কসাই বা কাজে সহযোগিতাকারীকে চামড়া, গোশত বা কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েয হবে না। অবশ্য নির্ধারিত পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পূর্বচুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসাবে গোশত বা তরকারী দেওয়া যাবে।-আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২৮

 

জবাইয়ের অস্ত্র

 

মাসআলা : ৩৬. ধারালো অস্ত্র দ্বারা জবাই করা উত্তম।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩

 

পশু নিস্তেজ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা

 

মাসআলা : ৩৭. জবাইয়ের পর পশু

নিস্তেজ হওয়ার আগে চামড়া খসানো বা অন্য কোনো অঙ্গ কাটা মাকরূহ। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩; আদ্দুররুল মুখতার ৬/২৯৬

 

অন্য পশুর সামনে জবাই করা

 

মাসআলা : ৩৯. এক পশুকে অন্য পশুর সামনে জবাই করবে না। জবাইয়ের সময় প্রাণীকে প্রয়োজনের অধিক কষ্ট দিবে না।

 

কুরবানীর গোশত বিধর্মীকে দেওয়া

 

মাসআলা : ৪৯. কুরবানীর গোশত হিন্দু ও অন্য ধর্মাবলম্বীকে দেওয়া জায়েয।-ইলাউস সুনান ৭/২৮৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০০

 

অন্য কারো ওয়াজিব কুরবানী আদায় করতে চাইলে

 

মাসআলা : ৫০. অন্যের ওয়াজিব কুরবানী দিতে চাইলে ওই ব্যক্তির অনুমতি নিতে হবে। নতুবা ওই ব্যক্তির কুরবানী আদায় হবে না। অবশ্য স্বামী বা পিতা যদি স্ত্রী বা সন্তানের বিনা অনুমতিতে তার পক্ষ থেকে কুরবানী করে তাহলে দেশীয় প্রচলনের কারণে তাদের কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। তবে অনুমতি নিয়ে আদায় করা ভালো।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১১

 

কুরবানীর পশু চুরি হয়ে গেলে বা মরে গেলে

 

মাসআলা : ৫১. কুরবানীর পশু যদি চুরি হয়ে যায় বা মরে যায় আর কুরবানীদাতার উপর পূর্ব থেকে কুরবানী ওয়াজিব থাকে তাহলে আরেকটি পশু কুরবানী করতে হবে। গরীব  হলে (যার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়) তার জন্য আরেকটি পশু কুরবানী করা ওয়াজিব নয়।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬, খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩১৯

 

পাগল পশুর কুরবানী

 

মাসআলা : ৫২. পাগল পশু কুরবানী করা জায়েয। হযরত হাসান রা. বলেন, পাগল পশুর কুরবানী জায়েয।

তবে যদি এমন পাগল হয় যে, ঘাস পানি দিলে খায় না এবং মাঠেও চরে না তাহলে সেটার কুরবানী জায়েয হবে না। -আননিহায়া ফী গরীবিল হাদীস ১/২৩০, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬, ইলাউস সুনান ১৭/২৫২

 

নিজের কুরবানীর গোশত খাওয়া

 

মাসআলা : ৫৩. কুরবানীদাতার জন্য নিজ কুরবানীর গোশত খাওয়া মুস্তাহাব। -সূরা হজ্ব ২৮, সহীহ মুসলিম ২২/১৫৯, মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৯০৭৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪

 

ঋণ করে কুরবানী করা

 

মাসআলা : ৫৪. কুরবানী ওয়াজিব এমন ব্যক্তিও ঋণের টাকা দিয়ে কুরবানী করলে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। তবে সুদের উপর ঋণ নিয়ে কুরবানী করা যাবে না।

 

হাজীদের উপর ঈদুল আযহার কুরবানী

 

মাসআলা : ৫৫. যেসকল হাজী কুরবানীর দিনগুলোতে মুসাফির থাকবে তাদের উপর ঈদুল আযহার কুরবানী ওয়াজিব নয়। কিন্তু যে হাজী কুরবানীর কোনো দিন মুকীম থাকবে সামর্থ্যবান হলে তার উপর ঈদুল আযহার কুরবানী করা জরুরি হবে। এটি সে নিজ এলাকায়ও করতে পারবে-ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৩, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৫, বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৫, ইমদাদুল ফাতাওয়া ২/১৬৬

 

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে কুরবানী করা

 

মাসআলা : ৫৬. সামর্থ্যবান ব্যক্তির রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে কুরবানী করা উত্তম। এটি বড় সৌভাগ্যের বিষয়ও বটে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রা.কে তার পক্ষ থেকে কুরবানী করার ওসিয়্যত করেছিলেন। তাই তিনি প্রতি বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকেও কুরবানী দিতেন। -সুনানে আবু দাউদ ২/২৯, জামে তিরমিযী ১/২৭৫, ইলাউস সুনান ১৭/২৬৮, মিশকাত ৩/৩০৯

 

কোন দিন কুরবানী করা উত্তম

 

মাসআলা : ৫৭. ১০, ১১ ও ১২ এ তিন দিনের মধ্যে প্রথম দিন কুরবানী করা অধিক উত্তম। এরপর দ্বিতীয় দিন, এরপর তৃতীয় দিন। -রদ্দুল মুহতার ৬/৩১৬

 

খাসীকৃত ছাগল দ্বারা কুরবানী

 

মাসআলা : ৫৮. খাসিকৃত ছাগল দ্বারা কুরবানী করা জায়েয; বরং ক্ষেত্রবিশেষে উত্তম।-ফাতহুল কাদীর ৮/৪৯৮, মাজমাউল আনহুর ৪/২২৪, ইলাউস সুনান ১৭/৪৫৩

 

জীবিত ব্যক্তির নামে কুরবানী

 

মাসআলা : ৫৯. যেমনিভাবে মৃতের পক্ষ থেকে ঈসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কুরবানী করা জায়েয তদ্রূপ জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার ইসালে সওয়াবের জন্য নফল কুরবানী করা জায়েয। এ কুরবানীর গোশত দাতা ও তার পরিবারও খেতে পারবে।-রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৬

 

বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির কুরবানী অন্যত্রে করা

 

মাসআলা : ৬০. বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির জন্য নিজ দেশে বা অন্য কোথাও কুরবানী করা জায়েয।

 

কুরবানীদাতা ভিন্ন স্থানে থাকলে কখন জবাই করবে

 

মাসআলা : ৬১. কুরবানীদাতা এক স্থানে আর কুরবানীর পশু ভিন্ন স্থানে থাকলে কুরবানীদাতার ঈদের নামায পড়া বা না পড়া ধর্তব্য নয়; বরং পশু যে এলাকায় আছে ওই এলাকায় ঈদের জামাত হয়ে গেলে পশু জবাই করা যাবে। -আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৮

 

কুরবানীর চামড়া বিক্রির অর্থ সাদকা করা

 

মাসআলা : ৬২. কুরবানীর চামড়া কুরবানীদাতা নিজেও ব্যবহার করতে পারবে। তবে কেউ যদি নিজে ব্যবহার না করে বিক্রি করে তবে বিক্রিলব্ধ মূল্য পুরোটা সদকা করা জরুরি। -আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২৮, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০১

 

কুরবানীর চামড়া বিক্রির নিয়ত

 

মাসআলা : ৬৩. কুরবানীর পশুর চামড়া বিক্রি করতে চাইলে মূল্য সদকা করে দেওয়ার নিয়তে বিক্রি করবে। সদকার নিয়ত না করে নিজের খরচের নিয়ত করা নাজায়েয ও গুনাহ। নিয়ত যা-ই হোক বিক্রিলব্ধ অর্থ পুরোটাই সদকা করে দেওয়া জরুরি। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০১, কাযীখান ৩/৩৫৪

 

কুরবানীর শেষ সময়ে মুকীম হলে

 

মাসআলা : ৬৪. কুরবানীর সময়ের প্রথম দিকে মুসাফির থাকার পরে ৩য় দিন কুরবানীর সময় শেষ হওয়ার পূর্বে মুকীম হয়ে গেলে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। পক্ষান্তরে প্রথম দিকে মুকীম ছিল অতপর তৃতীয় দিনে মুসাফির হয়ে গেছে এক্ষেত্রে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব থাকবে না। অর্থাৎ সে কুরবানী না দিলে গুনাহগার হবে না। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, ফাতাওয়া খানিয়া ৩/৩৪৬, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৯

 

কুরবানীর পশুতে ভিন্ন ইবাদতের নিয়তে শরীক হওয়া

 

মাসআলা : ৬৫. এক কুরবানীর পশুতে আকীকা, হজ্বের কুরবানীর নিয়ত করা যাবে। এতে প্রত্যেকের নিয়তকৃত ইবাদত আদায় হয়ে যাবে। এ পশু হেরেম এলাকায় জবাই করতে হবে। অন্যথায় হজ্বের কুরবানী আদায় হবে না।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৯, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৬, আলমাবসূত সারাখছী ৪/১৪৪, আলইনায়া ৮/৪৩৫-৩৪৬, আলমুগনী ৫/৪৫৯

 

কুরবানীর গোশত দিয়ে খানা শুরু করা

 

মাসআলা : ৬৬. ঈদুল আযহার দিন সম্ভব হলে সর্বপ্রথম নিজ কুরবানীর গোশত দিয়ে খানা শুরু করা সুন্নত। অর্থাৎ সকাল থেকে কিছু না খেয়ে প্রথমে কুরবানীর গোশত খাওয়া সুন্নত। এই সুন্নত শুধু ১০ যিলহজ্বের জন্য। ১১ বা ১২ তারিখের গোশত দিয়ে খানা শুরু করা সুন্নত নয়। -জামে তিরমিযী ১/১২০, শরহুল মুনয়া ৫৬৬, আদ্দুররুল মুখতার ২/১৭৬, আলবাহরুর রায়েক ২/১৬৩

 

কুরবানীর পশুর হাড় বিক্রি 

 

মাসআলা : ৬৭. কুরবানীর মৌসুমে অনেক মহাজন কুরবানীর হাড় ক্রয় করে থাকে। টোকাইরা বাড়ি বাড়ি থেকে হাড় সংগ্রহ করে তাদের কাছে বিক্রি করে। কিন্তু কোনো কুরবানীদাতার জন্য নিজ কুরবানীর কোনো কিছু এমনকি হাড়ও বিক্রি করা জায়েয হবে না। করলে মূল্য সদকা করে দিতে হবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৫, কাযীখান ৩/৩৫৪, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০১

 

রাতে কুরবানী করা

 

মাসআলা : ৬৮.  ১০ ও ১১ তারিখ দিবাগত রাতে কুরবানী করা জায়েয। তবে রাতে আলোস্বল্পতার দরুণ জবাইয়ে ত্রুটি হতে পারে বিধায় রাতে জবাই করা অনুত্তম। অবশ্য পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকলে রাতে জবাই করতে কোনো অসুবিধা নেই। -ফাতাওয়া খানিয়া ৩/৩৪৫, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২০, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৬, আহসানুল ফাতাওয়া ৭/৫১০

 

কাজের লোককে কুরবানীর গোশত খাওয়ানো

 

মাসআলা : ৬৯কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া জায়েয নয়। গোশতও পারিশ্রমিক হিসেবে কাজের লোককে দেওয়া যাবে না। অবশ্য এ সময় ঘরের অন্য সদস্যদের মতো কাজের লোকদেরকেও গোশত খাওয়ানো যাবে।-আহকামুল কুরআন জাস্সাস ৩/২৩৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪, আলবাহরুর রায়েক ৮/৩২৬, ইমদাদুল মুফতীন

 

জবাইকারীকে পারিশ্রমিক দেওয়া

 

মাসআলা : ৭০. কুরবানী পশু জবাই করে পারিশ্রমিক দেওয়া-নেওয়া জায়েয। তবে কুরবানীর পশুর কোনো অংশ পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া যাবে না। -কিফায়াতুল মুফতী ৮/২৬৫

 

মোরগ কুরবানী করা  

 

মাসআলা : ৭১. কোনো কোনো এলাকায় দরিদ্রদের মাঝে ঈদের দিন মোরগ কুরবানী করার প্রচলন আছে। এটি না জায়েয। কুরবানীর দিনে মোরগ জবাই করা নিষেধ নয়, তবে কুরবানীর নিয়তে করা যাবে না। -খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩১৪, ফাতাওয়া বাযযাযিয়া ৬/২৯০, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২০০ 

 

একটি ভুল ধারণা : কুরবানীর ঈদের দিন কি দু’ পা বিশিষ্ট প্রাণী (হাস-মুরগি ইত্যাদি) যবেহ করা নিষেধ?

উত্তরঃ কিছু কিছু মানুষ মনে করে, কুরবানীর ঈদের দিন হাস-মুরগি ইত্যাদি দু’ পা বিশিষ্ট প্রাণী যবেহ করা যাবে না। এটি একটি অমূলক ধারণা, এর কোনো ভিত্তি নেই। তারা হয়ত মনে করে যে, কুরবানী  যেহেতু চার পা বিশিষ্ট প্রাণী দিয়ে করতে হয়; দু’ পা বিশিষ্ট প্রাণী দ্বারা কুরবানী করা যায় না, সুতরাং এ দিনে দুই পা  বিশিষ্ট প্রাণী যবেহও করা যাবে না।  আসলে অজ্ঞতার কারণে এ  ধরনের অমূলক ধারণার সৃষ্টি হয় এবং সমাজে  এগুলোর প্রচলন হয়ে থাকে। এ ধরনের অমূলক ধারণা থেকে বেঁচে থাকতে হবে।

 

স্ত্রীর কুরবানীর টাকা সংগ্রহ করা কার দায়িত্ব? সাহেবে নিসাব বলতে কী বুঝায়?

০১ প্রশ্নঃ আসসালামু আলাইকুম, মোহতারাম মুফতি সাহেব, সাহেবে নেসাব কাকে বলে, বিস্তারিত জানালে উপকৃত হতাম,

০২ প্রশ্নঃ স্ত্রী কোরবানীর টাকা দেয়ার যিম্মাদার কে? (স্ত্রী নিকট ক্যাশ টাকা নাই,কিন্তু অলংকার আছে) মু.কাওসার

উত্তরঃ وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

১ । কুরবানীর ক্ষেত্রে সাহেবে নিসাব ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, কুরবানীর দিনসমূহে আবশ্যকীয় প্রয়োজন অতিরিক্ত যার কাছে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা এর সমমূল্য পরিমাণ সম্পদ থাকে, তার উপর কুরবানী করা আবশ্যক। আর উক্ত ব্যক্তিকে কুরবানীর জন্য সাহেবে নিসাব বলবে।

যেমন এক ব্যক্তির কাছে কয়েক ভরি স্বর্ণ আছে, সেই সাথে কিছু টাকাও আছে, যার পুরোটার মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা সমপরিমাণ যা বর্তমান বাজারে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। এ সম্পদ যদি প্রয়োজন অতিরিক্ত হয়, তাহলে সে সাহেবে নিসাব, তার উপর কুরবানী করা আবশ্যক।

(وَأَمَّا) (شَرَائِطُ الْوُجُوبِ) : مِنْهَا الْيَسَارُ وَهُوَ مَا يَتَعَلَّقُ بِهِ وُجُوبِ صَدَقَةِ الْفِطْرِ دُونَ مَا يَتَعَلَّقُ بِهِ وُجُوبُ الزَّكَاةِ،………. وَالْمُوسِرُ فِي ظَاهِرِ الرِّوَايَةِ مَنْ لَهُ مِائَتَا دِرْهَمٍ أَوْ عِشْرُونَ دِينَارًا أَوْ شَيْءٌ يَبْلُغُ ذَلِكَ سِوَى مَسْكَنِهِ وَمَتَاعِ مَسْكَنِهِ وَمَرْكُوبِهِ وَخَادِمِهِ فِي حَاجَتِهِ الَّتِي لَا يَسْتَغْنِي عَنْهَا، فَأَمَّا مَا عَدَا ذَلِكَ مِنْ سَائِمَةٍ أَوْ رَقِيقٍ أَوْ خَيْلٍ أَوْ مَتَاعٍ لِتِجَارَةِ أَوْ غَيْرِهَا فَإِنَّهُ يُعْتَدُّ بِهِ مِنْ يَسَارِهِ،(الفتاوى الهندية، كتاب الأضحية، فصل شرائط الوجوب-5/292، رد المحتار، كتاب الاضحية-9/452-453، مجمع الانهر-4/167

২। ইবাদত সম্পর্কিত বিষয়াদী প্রতিটি ব্যক্তির উপর আলাদাভাবে আবশ্যক হয়। একজনের দায়িত্ব অপরজনের উপর বর্তায় না। শুধুমাত্র নাবালেগ শিশু ব্যতীত। যেহেতু তাদের দায়িত্ব অভিভাবকদের হাতে। তাই তাদের সদকায়ে ফিতির অভিভাবকদের দিতে হয়। এছাড়া বাকি সকল আকেল বালেগ ব্যক্তিদের নিজস্ব ইবাদত নিজেরই আদায় করা আবশ্যক হয়।

সেই হিসেবে কোন মহিলার উপর যদি কুরবানী আবশ্যক হয়, তাহলে টাকা পয়সার ব্যবস্থা করা তারই দায়িত্ব। তবে এক্ষেত্রে স্বামী যেহেতু তার অভিভাবক তাই তার সহযোগিতা নিতে পারে। এবং স্বামী এ দায়িত্ব নেয়াটাও নৈতিক দায়িত্ব।

أَلَّا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَىٰ [٥٣:٣٨

কিতাবে এই আছে যে,কোন ব্যক্তি কারও বোঝা নিজে বহন করবে না। [সূরা নাজম-৩৮}

فتجب التضحية على حر مسلم مقيم موسر (تنوير الأبصار مع الدر-9/452-453

الأضحية واجبة على كل حر مسلم مقيم موسر فى يوم الأضحى عن نفسه (الهداية-4/443

ثم النفقة إنما تجب على قدر يسار الرجل وعسرته (خانية مع الهندية-1/426، الفتاوى التاتارخانية-5/399)

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনেঃ লুৎফুর রহমান ফরায়েজী, পরিচালক ও প্রধান মুফতী – মা’হাদুত তালীম ওয়াল  বুহুসিল ইসলামী ঢাকা।, উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম আমীনবাজার ঢাকাউস্তাজুল ইফতা– জামিয়া ফারূকিয়া দক্ষিণ বনশ্রী ঢাকা।

 

তাকবীরে তাশরীক ফরজ নামাযের পর কতবার বলবে? একবার না তিনবার?

প্রশ্ন: আসসালামুআলাইকুম, হযরত, আমার একটি বিষয় জানা দরকার। কোরবানির কয়েকদিন শুরু থেকে কয়েকদিন পরে পর্যন্ত প্রতি নামাজের পরে সবাই তাকবির বলে  “আল্লাহুআকবার, আল্লাহুআকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহুআকবার,আল্লাহুআকবার অলিল্লাহিলহামদ” এখানে আবার লেখার ক্ষেত্রে বা বলার ক্ষেত্রে উচ্চারগত সমস্যা হতে পারে, যদি ভুল হয় ক্ষমার দৃস্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। এখানে আমার প্রশ্ন হলো এই তাকবির প্রতি ফরজ নামের পরে কতবার বলতে হবে? একবার নাকি তিনবার? অনেকেই বলে এই তাকবির ৩বার বলতে হবে। কিন্তু আমাদের এখানের ঈমাম সাহেব বছর খানেক আগে বলেছিলো, এই তাকবির চাইলে সারাদিনও পরতে পারবে কোন সমস্যা নেই,কিন্তু ফরজ নামাজের পরে ৩ বার বলা সুন্নত, এটা কোন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়, এমনিতে চাইলে সে পড়তে পারবে, কিন্তু সুন্নত মনে করে ৩বার পড়তে পারবে না। তবে একবার পড়া ওয়াজিব। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি,৩বার সুন্নত এটা কি ঠিক? নাকি ৩বার পড়া সুন্নত এটার কোন ভিত্তি নেই?

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

আপনাদের এলাকার ইমাম সাহেব যা বলেছেন তা সম্পূর্ণ সঠিক। তাকবীরে তাশরীক নির্ধারিত দিনসমূহে প্রতি ফরজের পর শব্দ করে একবার পড়া ওয়াজিব। তিনবার বলার কোন ভিত্তি নেই। সুন্নত মনে করে পড়লে মাকরূহ হবে। [ফাতাওয়া নাওয়াজেল-১৪/৫৯৪]

عن جابر بن عبد الله رضى الله عنه قال: كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا صلى الصبح من غداة عرفة يقبل على أصحابه، فيقول: على مكانكم، ويقول: “الله أكبر الله اكبر، لا إله إلا الله، والله أكبر الله أكبر ولله الحمد” فيكبر من غداة عرفة إلى صلاة العصر من آخر أيام التشريق، (سنن الدار قطنى، باب العيدين-2/38، رقم-1721)

أما صفته فإنه واجب وأما عدده وما هيته فهو أن يقول مرة واحدة: “الله أكبر الله اكبر، لا إله إلا الله، والله أكبر الله أكبر ولله الحمد” (الفتاوى الهندية-1/102)

والتكبير أن يقول مرة واحدة: “الله أكبر الله اكبر، لا إله إلا الله، والله أكبر الله أكبر ولله الحمد” وهو عقيب الصلاة المفروضات على المقيمين فى الأمصار فى الجماعات المستحبة عند ابى حنيفة (الهداية-1/175)

والتكبير أن يقول: مرة واحدة، وهو قول عمر بن الخطاب وابن مسعود، وقولنا: هو مذهب عمر بن الخطاب وعبد الله بن مسعود (عينى شرح الهداية-1/1030)

وياتى به مرة وما زاد فهو مستحب، قاله العينى فى شرح التحفة، واقره فى الدر، وفى الحموى عن القراحصارى: الإتيان به مرتين خلاف السنة، (حاشية الطحطاوى على مراقى الفلاح، كتاب الصلاة، باب احكام العيدين-539)

(وَيَجِبُ تَكْبِيرُ التَّشْرِيقِ) فِي الْأَصَحِّ لِلْأَمْرِ بِهِ (مَرَّةً) وَإِنْ زَادَ عَلَيْهَا يَكُونُ فَضْلًا قَالَهُ الْعَيْنِيُّ.

وفى رد المحتار: (قَوْلُهُ وَإِنْ زَادَ إلَخْ) أَفَادَ أَنَّ قَوْلَهُ مَرَّةً بَيَانٌ لِلْوَاجِبِ، لَكِنْ ذَكَرَ أَبُو السُّعُودِ أَنَّ الْحَمَوِيَّ نَقَلَ عَنْ الْقَرَاحَصَارِيِّ أَنَّ الْإِتْيَانَ بِهِ مَرَّتَيْنِ خِلَافُ السُّنَّةِ، (رد المحتار، كتاب الصلاة، باب العيدين-3/61-62)

وفى مجمع الأنهر: إن زاد فقد خالف السنة ولعل محله إذا أتى به على أنه سنة، واما إذا أتى به على أنه ذكر مطلق فلا، (حاشية الطحطاوى على مراقى الفلاح، كتاب الصلاة، باب احكام العيدين-539

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনেঃ লুৎফুর রহমান ফরায়েজী, পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা। উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

 

আশরায়ে যিলহজ্ব ও আইয়ামে তাশরীক : তাওহীদের উচ্চারণে পরিশুদ্ধ হোক আমাদের জীবন

আশরায়ে যিলহজ্ব ও আইয়ামে তাশরীক : তাওহীদের উচ্চারণে পরিশুদ্ধ হোক আমাদের জীবন – মুহাম্মাদ ত্বহা হোসাইন

 

সময়ের প্রতিটি অংশই মূল্যবান। কোনো অংশই অবহেলা করার মতো নয়। সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর দ্বারাই সফলতা অর্জন করা সম্ভব। এটা যেমন পার্থিব ক্ষেত্রে সত্য তেমনি সত্য আখিরাতের ক্ষেত্রেও। তাই জীবনের প্রতিটি দিনপ্রতিটি রাত অত্যন- মূল্যবান। তবে আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহ যেতিনি বান্দার ফায়েদার জন্য কিছু সময়কে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। তাই কিছু সময়কিছু দিন এমন রয়েছেযা অন্য সময়ের চেয়ে অধিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও মহিমাময়। আসন্ন আশরায়ে যিলহজ্ব’ ও আইয়ামে তাশরীক’ অর্থাৎ যিলহজ্বের প্রথম তেরটি দিন এমনি মহিমান্বিত ও অর্জনের মৌসুম।

 

আশরায়ে যিলহজ্ব’ বছরের শ্রেষ্ঠ দশক

 

যিলহজ্বের প্রথম দশককে পরিভাষায় আশরায়ে যিলহজ্ব’ বলে। এই দশ দিন হচ্ছে বছরের সর্বোত্তম দশ দিন। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে এই দশকের রজনীগুলোর শপথ করে বলেছেন, (তরজমা) ভোর বেলার কসম আর কসম দশ রাত্রির।-সূরা ফজর : ১-২ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা. ও মুজাহিদ রাহ.সহ অধিকাংশ সাহাবীতাবেয়ী ও মুফাসসিরের মতে এখানে দশ রাত্রি দ্বারা আশরায়ে যিলহজ্বই উদ্দেশ্য।

হাফেয ইবনে কাসীর রাহ. বলেনএটিই বিশুদ্ধ মত।-তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৫৩৫-৫৩৬

তাই অনেক ওলামায়ে কেরামের মতে পুরো বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ দশক’ হল আশরায়ে যিলহজ্ব। রমযানের শেষ দশকের চেয়েও যার ফযীলত ও গুরুত্ব বেশি। কেননা যিলহজ্বের এই প্রথম দশকে এমন দুটি ইবাদত রয়েছে যা পুরো বছরের অন্য কোনো সময় আদায় করা সম্ভব নয়। এমনকি রমযানেও নয়। এই দুটি ইবাদতের জন্য আল্লাহ তাআলা আশরায়ে যিলহজ্বকেই নির্বাচন করেছেন। এই দুটি ইবাদতের একটি হল হজ্বআর দ্বিতীয়টি কুরবানী। কুরবানী যদিও ১১ ও ১২ যিলহজ্বেও দেওয়া যায়কিন্তু বছরের অন্য কোনোদিন এই ওয়াজিব কুরবানী সম্ভব নয়। এই ক্ষেত্রে রমযানের শেষ দশকের চেয়ে আশরায়ে যিলহজ্বের হজ্ব ও কুরবানীর রয়েছে বাড়তি ফযীলত। আবার অনেক ওলামায়ে কেরামের মতে রমযানের শেষ দশকই উত্তম। কারণ তাতে রয়েছে হাজার মাসের চাইতে উত্তম লাইলাতুল কদরের মতো মহিমান্বিত রজনী। ওলামায়ে কেরামের এই দুটি মতের সমন্বয় সাধন করতে গিয়ে অনেক মুহাক্কিক আলেম বলেছেনআশরায়ে যিলহজ্বের দিন ও রমযানের শেষ দশকের রাত্রি উত্তম। এভাবে উভয় দলীলের মাঝে সমন্বয় করা যেতে পারে।-তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩/২৩৯ইসলাহী খুতবাত ২/১২২-১২৪লাতায়িফুল মাআরিফ ২৯৫-২৯৬

যাই হোকরমযানের পরে আশরায়ে যিলহজ্বের চেয়ে শ্রেষ্ঠতম কোনো দিন নেই-এটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় এবং এতে সকলেই একমত। হযরত জাবির রা. হতে বর্ণিত একটি সহীহ হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (তরজমা)আশরায়ে যিলহজ্বের দিনের চেয়ে কোনো দিনই আল্লাহর নিকট উত্তম নয়।’-সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস ৩৮৫৩ আর যিলহজ্বের প্রথম দশকের মধ্যে শেষ দুদিন নবম তারিখ ও দশম তারিখ হল পুরো বছরের সর্বোৎকৃষ্ট দিন। যাকে হাদীসের ভাষায় ইয়াওমে আরাফা ও ইয়াওমে নাহর বলা হয়। -সহীহ ইবনে হিব্বানহাদীস : ৩৮৫৩মুসনাদে আহমদ ৪/৩৫০ হাদীস : ১৯০৭৫

 

আশরায়ে যিলহজ্বের সর্বোৎকৃষ্ট আমল

 

কুরআন-সুন্নাহে আশরায়ে যিলহজ্বের এই আলাদা গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্যের দরুণ এ দশটি দিন হল অর্জনের ভরপুর মৌসুম। এই দিনগুলোতে করা ইবাদত-বন্দেগী আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয়।

হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-(তরজমা) আশরায়ে যিলহজ্বের নেক আমলের চেয়ে আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিন (এর কোনো আমল) নেই।’ –সহীহ বুখারী হাদীস : ৯৬৯মুসনাদে আহমদহাদীস : ১৯৬৮ এই হাদীস দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায়আশরায়ে যিলহজ্বের যে কোনো নেক আমলের চাইতে উত্তম কোনো আমল হতে পারে না। যেহেতু সাহাবায়ে কেরাম জানতেন যেআল্লাহর রাস্তায় জিহাদের চেয়ে উত্তম কোনো আমল নেই তাই আশরায়ে যিলহজ্বের আমলের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা শোনার পর তারা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘জিহাদও কি এই দশ দিনের আমলের চেয়ে উত্তম নয়?’ নবীজী জবাব দিলেননা। জিহাদও উত্তম নয়। তবে হ্যাঁসেই ব্যক্তির জিহাদ এই দশদিনের আমলের চেয়ে উত্তম হতে পারে যে স্বীয় জান-মাল নিয়ে আল্লাহর রাস-ায় জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হল। অতঃপর জিহাদের ময়দানে জান-মাল সবকিছু বিসর্জন করে দিয়ে কিছু নিয়েই ঘরে ফিরে এল না।-সহীহ বুখারীহাদীস : ৯৬৯সুনানে আবু দাউদহাদীস : ২৪৩৮জামে তিরমিযীহাদীস : ৭৫৮ফাতহুল বারী ২/৫৩১-৫৩২

এর দ্বারা স্পষ্ট বোঝা গেল যেএই দশ দিনে করা যে কোনো নেক আমল সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোত্তম আমল। পুণ্য অর্জনের এর চেয়ে উপযোগী সময় আর কী হতে পারেএখন প্রশ্ন হলমুমিনরা কী কী আমল দ্বারা এই দশ দিনকে জীবন- ও প্রণবন- করে তুলতে পারে?

 

আশরায়ে যিলহজ্বের আমল

 

আমরা আগেই বলেছি এবং হাদীসের দ্বারা বুঝা যায় যেএই দশ দিনের যে কোনো আমল চাই নফল নামায-রোযা হোক বা যিকির-তাহাজ্জুদতা আল্লাহর নিকট খুবই প্রিয় ও অতি পছন্দনীয়। তাই যে কোনো নফল ইবাদত যেমন নামায-রোযাযিকির-তাহাজ্জুদদান-খয়রাত ইত্যাদি এই দশ দিনে করা হলে তার ফযীলত ও মর্যাাদা বছরের অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া যাবে। তাই এই কদিন সাধ্যমতো নফল ইবাদতের প্রতিও মনোযোগী হওয়া উচিত। এছাড়া বিভিন্ন হাদীসে এই দশ দিনের বিশেষ কিছু আমলের কথাও বলা হয়েছে। যেমন-

ক) যিলহজ্বের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানী করার আগ পর্যন্ত- স্বীয় নখ ও চুল না কাটা। এটি মুস্তাহাব।

হযরত উম্মে সালমা রা. হতে বর্ণিতনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনতোমরা যদি যিলহজ্বের চাঁদ দেখতে পাও আর তোমাদের কেউ যদি কুরবানী করার ইচ্ছা করে থাকে তবে সে যেন স্বীয় চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।-সহীহ মুসলিমহাদীস : ১৯৭৭মুসনাদে আহমদ ৬/২৮৯

আল্লাহ তাআলা এই দিনগুলোতে হজ্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও মহিমান্বিত একটি ইবাদত মুসলমানের উপর ফরয করেছেন। সামর্থ্যবান আশিকে রব’ এই দিনে ইহরামের শুভ্র লেবাস পরিধান করে যখন বাইতুল্লাহ অভিমুখী হয় তখন তার উপর বিভিন্ন বিধি-নিষেধ আরোপিত হয়। তন্মধ্যে চুল ও নখ কাটতে না পারাও একটি। কিন‘ বাইতুল্লাহর যিয়ারতের সৌভাগ্য যারা অর্জন করতে পারেনিপারেনি কাবার কালো গিলাফের ছায়ার কাছে যেতেপৃথিবীর দূর-দূরানে- ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব অভাগা’ মুমিনদের প্রতিও আল্লাহর রহমত ও মেহেরবানীকে আকৃষ্ট করতে আদেশ করা হয়েছে যেতোমরা ভাগ্যবান’ হাজ্বীদের সাদৃশ্য অবলম্বন কর। তোমরাও নখ-চুল কেটো না। আল্লাহর রহমতের বারিধারা তোমাদেরও স্নাত করে তুলতে পারে।-ইসলাহী খুতবাত ২/১২৪-১২৫

খ) আশরায়ে যিলহজ্বের দ্বিতীয় বিশেষ আমলটি হলঈদুল আযহার দিন ব্যতীত প্রথম নয় দিন রোযা রাখা। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যেনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দিনগুলোতে রোযা রাখতেন।-সুনানে আবু দাউদহাদীস : ২৪৩৭মুসনাদে আহমদ ৬/২৮৭হাদীস : ২৫৯২০সুনানে নাসায়ীহাদীস : ২৪১৬মাআরিফুস সুনান ৫/৪১-৪৪

অন্য দুটি যয়ীফ বর্ণনায় এসেছে যেএই দিনগুলোর একেকটি রোযায় রয়েছে এক বছরের রোযার সমান ছওয়াব।-জামে তিরমিযীহাদীস : ৭৫৮বায়হাকী-শুআবুল ঈমান ৩/৩৫৬ হাদীস : ৩৭৫৮তারগীব হাদীস : ১৭৩১আত তারীফ ৫/৫১৫-৫১৭ হাদীস : ৮৩৫

গ) এই নয়দিনের রোযার মধ্যে নবম তারিখ বা আরাফার দিনের রোযা সর্বাধিক ফযীলতপূর্ণ। অতএব পুরো নয়টি রোযা রাখতে না পারলে এই একটি রোযা থেকে কারো বঞ্চিত হওয়া উচিত নয়। সহীহ হাদীসে হযরত আবু কাতাদা রা. হতে বর্ণিতনবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনআরাফার দিন অর্থাৎ নবম তারিখের রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর নিকট আশাবাদী যেতিনি এর দ্বারা বিগত এক বছর ও আগামী এক বছরের গুনাহ মিটিয়ে দেবেন।-সহীহ মুসলিমহাদীস : ১১৬২জামে তিরমিযীহাদীস : ৭৪৯

তবে মনে রাখা উচিতঅনেক ওলামায়ে কেরামের মতে হাজীদের জন্য এই দিনে আরাফার ময়দানে ওকূফ ও মুজাহাদার শক্তি অর্জনের নিমিত্তে রোযা না রাখা উত্তম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীন হজ্বের মধ্যে এই দিনের রোযা রাখতেন না।-সহীহ মুসলিমহাদীস : ১১২৩১১২৪জামে তিরমিযীহাদীস : ৭৫০-৭৫১সুনানে আবু দাউদহাদীস : ২৪১৯মাআরিফুস সুনান ৫/৪৩০-৪৩১

 

যিকর ও তাকবীর প্রসঙ্গ

 

আশরায়ে যিলহজ্বের পরবর্তী তিন দিন অর্থাৎ এগারবার ও তের তারিখকে পরিভাষায় আইয়ামে তাশরীক’ বলে। আশরায়ে যিলহজ্বের দশ দিন ও আইয়ামে তাশরীকের তিনদিন সর্বমোট যিলহজ্বের এই প্রথম তের দিনের একটি আমল রয়েছে। তা হচ্ছে বেশি বেশি আল্লাহর যিকির ও তাকবীর পাঠ। আল্লাহ তাআলার যিকির এবং তাওহীদের চেতনায় সর্বদা উজ্জীবিত থাকা এবং শিরকের পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত তাওহীদের শিক্ষায় উদ্ভাসিত ঈমানী যিন্দেগী গঠনের লক্ষ্যে সম্ভব সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করা প্রত্যেক মুমিনের সার্বক্ষণিক কর্তব্য। কারণ দ্বীন-ধর্ম ও আমল আখলাক সবকিছুর মূল হলনির্ভেজাল তাওহীদ। আল্লাহর একত্ব ও মহত্বের উপর সকল মুমিনের বিশ্বাস হতে হবে সুদৃঢ় ও মজবুত। এই বিশ্বাসে খুঁত থাকলে পর্বতসম আমলেরও কোনো মূল্য নেই। তাইতো মুমিনের দিলে তাওহীদের শিক্ষাকে আরো মজবুত আরো শাণিত করতেই এই দিনগুলোতে অধিক পরিমাণে আল্লাহর যিকির করতে বারবার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। শ্রদ্ধাভক্তি ও বিশ্বাসের সবটুকু মিশিয়ে মুমিন বলবে আল্লাহু আকবারওয়াহদাকা লা-শারীকা লাকা।

আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন- (তরজমা) তোমরা কয়েকটি নির্দিষ্ট দিনে আল্লাহকে (বেশি বেশি) স্মরণ কর।-সূরা বাকারা : ২০৩

অন্য আয়াতে ইরশাদ করেছেন- (তরজমা) যাতে তারা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে।’-সূরা হজ্ব : ২৮

এই আয়াতে নির্দিষ্ট দিনগুলির দ্বারা প্রায় সকলের মতে আশরায়ে যিলহজ্ব ও আইয়ামে তাশরীকের এই তেরটি দিনই উদ্দেশ্য। বিশেষ করে এই দিনগুলোতে আল্লাহর যিকিরের প্রতি আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়ার কারণ সম্পর্কে আল্লামা খাত্তাবী রাহ. বলেনজাহেলী যুগের লোকেরা যুগ যুগ ধরে তাদের কথিত প্রভুদের নামে পশু-প্রাণী উৎসর্গ করত। এর প্রতি উত্তরে মুমিনদের প্রতি আদেশ করা হয়েছে তারা যেন আল্লাহর যিকির ও তাকবীরের মাধ্যমে তাওহীদ ও আনুগত্যের ঘোষণা দান করে। আল্লাহই একমাত্র ইলাহ। তাঁর কোনো শরীক নেই। তিনি ছাড়া কারো নামে প্রাণী উৎসর্গ করা যাবে না। কারণ তা সুস্পষ্ট শিরক।-ফাতহুল বারী ২/৫৩৫

সাহাবায়ে কেরাম এই দিনগুলোতে সর্বদা আল্লাহু আকবারের ধ্বনি তুলতেন। হযরত ইবনে উমর রা. ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বাজারে গিয়ে তাকবীরের আওয়াজ তুলতেন। শুনে শুনে লোকেরাও তাদের সাথে তাকবীরের সুর তুলত। ইবনে ওমর রা. পথে-ঘাটেহাঁটা-বসায়বাজারে-ঘরে এবং নামাযের পরে শুধুই তাকবীর বলতে থাকতেন। মিনার দিনগুলোতো তার তাকবীরের সাথে সমস্বরে মানুষের তাকবীরে মিনার পুরো অঙ্গন মুখরিত হয়ে উঠত। মহিলারাও (নিচু স্বরে) তাকবীর বলতে থাকতেন।-বুখারী-ফাতহুল বারী ২/৫৩০-৫৩৬

সার্বক্ষণিক যিকির ও তাকবীরের আমল ছাড়াও এই তের দিনের প্রায় প্রতিটি ইবাদত ও আমলের সাথে যিকির ও তাকবীরকে এমনভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে যেন সব আমল-ইবাদতের মূল কথা হল যিকরুল্লাহতাকবীর ও তাওহীদ। বাস-বেও তাই। এজন্য সকল ইবাদতের পরতে পরতে রয়েছে তাওহীদে খালেসের উপসিতি। তবে যে কোনো ধরনের যিকির এই সময়গুলোর সার্বক্ষণিক ওযীফা হলেও ক্ষেত্র বিশেষে এর ধরন ও নিয়ম রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন। যেমন-

১। হাজীরা হজ্বের ইহরাম বাঁধার সময় হতে সার্বক্ষণিক জপবেন তালবিয়া ধ্বনি-লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইকলা শারীকা লাকা লাব্বাইক …।

২। আশরায়ে যিলহজ্বের শুরু হতে বেশি বেশি যিকিরের যে আদেশ কুরআনে এসেছে এ ব্যাপারে হযরত ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে যেনবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনআল্লাহর নিকট আমলের দিক থেকে আশরায়ে যিলহজ্ব হতে শ্রেষ্ঠ ও অধিক প্রিয় কোনো দিন নেই। অতএব তোমরা এতে তাহলীলতাকবীরতাহমীদ ও তাসবীহ বেশি বেশি করো।-মুসনাদে আহমদ ২/৭৫ হাদীস : ৫৪৪৬তাবারানী মুজামে কাবীরহাদীস : ১১১১৬

তাসবীহতাহমীদতাহলীল ও তাকবীর এক সাথে আদায় করতে বলা যায়-সুবহানাল্লাহওয়াল হামদুলিল্লাহওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’ এই দিনগুলোতে এ ওযীফা বেশি বেশি জপা যায়।

৩। কুরবানীর পশু জবাইয়ের সময়ও বলতে হবে : বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার।

৪। হাজীরা জামরায় কংকর নিক্ষেপের সময় দরাজ কণ্ঠে বলবেন : আল্লাহু আকবার।

৫। এই দিনগুলোর মধ্যে আরেকটি অবশ্য করণীয় আমল হলতাকবীরে তাশরীকের আমল। এই সম্পর্কে একটু বিস্তারিত আলোকপাত করা হল।

 

কবীরে তাশরীক সংক্রান্ত কয়েকটি মাসআলা

 

১। প্রত্যেক মুসল্লীর জন্য যিলহজ্বের নয় তারিখের ফজর হতে তের তারিখের আসর পর্যন- প্রত্যেক ফরয নামায আদায় করে সালাম ফিরানোর সাথে সাথে উচ্চস্বরে একবার তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব।-সূরা বাকারা : ২০৩মুসতাদরাকে হাকেম ১/২৯৯হাদীস : ১১৫২-১১৫৭ইবনে আবী শায়বা ৪/১৯৫ হাদীস : ৫৬৭৭৫৬৭৮৫৬৯২সুনানে দারাকুতনী ২/৪৯-৫০ হাদীস : ২৫-২৯ইলাউস সুনান ৮/১৪৮-১৬২আদ্দুররুল মুখতার ৩/১৭৭-১৭৮

২। তাকবীরে তাশরীকের জন্য বিভিন্ন শব্দ হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে। তন্মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বজন বিদিত শব্দ হল- -তাবারানী মুজামে কাবীর হাদীস : ৯৫৩৮মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ৫৬৭৯৫৬৯৬৫৬৯৭৫৬৯৯ইলাউস সুনান ৮/১৫৬বাদায়েউস সানায়ে ১/৪৫৮

৩। ইমাম আবু হানীফার রাহ-এর মতে একাকী নামায আদায়কারী ও মুসাফির ব্যক্তি এবং মহিলাদের উপর তাকবীরে তাশরীক যদিও ওয়াজিব নয়কিন‘ সাহেবাইনের মতে তাদের উপরও তাকবীর বলা ওয়াজিব। এক্ষেত্রে সাহেবাইনের কথার উপরই ফতওয়া।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৪/২৪০-২৪১২৫১ইলাউস সুনান ৮/১৫৯রদ্দুল মুহতার ২/১৮০ইমদাদুল আহকাম ১/৭৬৩-৭৬৫৭৭৯-৭৮০

৪। সুন্নতনফলবিতর নামাযের পর তাকবীর ওয়াজিব নয়।-বাদায়েউস সানায়ে ১/৪৬২মাবসূত সারাখসী ২/৪৪ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২

৫। উচ্চস্বরে একবারই তাকবীর বলা ওয়াজিব।-ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২রদ্দুর মুহতার ২/১৭৮

৬। কোনো সময় সকলেই বা কেউ কেউ তাকবীর বলতে ভুলে গিয়ে মসজিদ থেকে বের না হয়ে গেলে তাকবীর আদায় করে নিবে। আর যদি মসজিদ থেকে বের হয়ে যায় তাহলে এই ওয়াজিব ছুটে যাবে। এই ওয়াজিবের কোনো কাযা নেই এবং ওয়াজিব ছেড়ে দেওয়ার কারণে ঐ ব্যক্তি গুনাহগার হবে।-মাবসূত সারাখসী ২/৪৫আলমুহীতুল বুরহানী ২/৫০৯-৫১১বাদায়েউস সানায়ে ১/৪৬০-৪৬১রদ্দুল মুহতার ২/১৮১ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২১৬

৭। আইয়ামে তাশরীকের কোনো নামায কাযা হয়ে গেলে ঐ দিনগুলোর মধ্যে তার কাযা আদায় করলে তাকবীর বলা ওয়াজিব। কিন‘ এই কাযা পরবর্তী অন্য সময় আদায় করলে বা আইয়ামে তাশরীকের আগের কাযা নামায ঐ দিনগুলোতে আদায় করলে তাকবীর বলা ওয়াজিব নয়।-বাদায়েউস সানায়ে ১/৪৬৪ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২আলমুহীতুল বুরহানী ২/৫১১-৫১৩

৮। ঈদুল আযহায় ঈদগাহে পৌঁছার আগ পর্যন- পথে পথে উচ্চস্বরে তাকবীর বলে বলে যাবে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৪/১৯২-১৯৪দারাকুতনী ২/৪৪-৪৫ইলাউস সুনান ৮/১১৪-১১৯বাদায়েউস সানায়ে ১/৬২৫আলমুহীতুল বুরহানী ২/৫১৩ফাতাওয়া খানিয়া ১/১৮৩

৯। কোনো ব্যক্তি নামাযে মাসবুক হলে ইমাম সাহেব সালাম ফিরানোর পর দাঁড়িয়ে স্বীয় নামায আদায় করার পর তাকবীরে তাশরীক বলবে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৪/২৩৯-২৪০বাদায়েউস সানায়ে ১/৪৬২রদ্দুল মুহতার ২/১৮০ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২

১০। মহিলারা এই তাকবীরে তাশরীকটি নিচু স্বরে আদায় করবে। উচ্চ স্বরে নয়।-রদ্দুল মুহতার ২/১৭৯হাশিয়া তাহতাবী ১/৩৫৭হিন্দিয়া ১/১৫২

এত গেল তাকবীরে তাশরীফ সংক্রান্ত কিছু মাসআলা। তবে এই তাকবীর সংক্রান্ত যে কয়েকটি গাফলতি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় তন্মধ্যে একটি হল মহিলাদের এই আমলের প্রতি যত্নবান না হওয়া। হয়তোবা এর কারণ এও হতে পারে যেতাদের এই তাকবীরের কথা স্মরণ থাকে না। তা স্বাভাবিকও বটে। কারণ পুরুষরা মসজিদে জামাতে নামায আদায় করে বিধায় খেয়াল না থাকলেও অন্যের দেখাদেখি এই আমল করতে পারে। কিন‘ মহিলাদের তো এই সুযোগ নেই। তাই মহিলাদের উচিত ঘরের যে স্থানে তারা নামায আদায় করে সেখানে পাঁচ দিনের জন্য একটি কাগজ লিখে ঝুলিয়ে রাখা। যাতে জায়নামাযে এলেই তা নজরে পড়ে।

দ্বিতীয় যে গাফলতিটি নজরে পড়ে তা এই যেঈদুল আযহার ঈদগাহে যাওয়ার পথে ও পাঁচ দিনের ফরজ নামাযের পর তাকবীরে তাশরীক আদায় করলেও অনেক পুরুষ তা পড়ে থাকেন মনে মনে বা খুব নিচু স্বরে। অথচ পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যেসাহাবায়ে কেরামের এই তাকবীর ধ্বনিতে পুরো আশপাশ কেঁপে উঠত। আর এই তাকবীর উচ্চ স্বরে বলার একটি হিকমত তো এও যেএর দ্বারা ইসলামের তাওহীদের ঘোষণা প্রকাশ্যে উচ্চস্বরে দেওয়া হবে। গুনগুন শব্দে এর বহিঃপ্রকাশ কি সম্ভব?-ইসলাহী খুতবাত ২/১২৬-১২৯

পরিশেষে আসুন নির্ভেজাল তাওহীদদৃঢ় আক্বীদা ও আল্লাহর মহত্ত্বের উপর অটুট আস্থা স্থাপনের মাধ্যমে গড়ে তুলি একটি আদর্শ সমাজযা হবে শিরকের পঙ্কিলতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত তাওহীদের সমাজ। পুণ্যময় তেরটি দিনের এটিই মৌলিক বাণী। তাকবীরে তাশরীকের এটিই মহান শিক্ষা।

 

এক পরিবারে সামর্থবান একাধিক ব্যক্তি থাকলে কুরবানী কয়টি দেয়া লাগবে?

কার উপর কুরবানী ওয়াজিব? 

 

মাসআলা : ১. প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ যিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলঙ্কার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।

উপরের মাসআলা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, এক পরিবারে সামর্থবান একাধিক ব্যক্তি থাকলে সবাই কুরবানী দেয়া লাগবে।

 

হাদীস ও আসারের আলোকে কুরবানীর কিছু জরুরি মাসায়েল

ফজলুদ্দীন মিকদাদ

পুণ্যময় যিলহজ্ব মাস চলছে। পবিত্র এই মাস মুসলমানদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। ইসলামের পাঁচ রুকনের এক রুকন তথা হজ্ব-এর মতো শ্রেষ্ঠ ইবাদত এ মাসেই সংঘটিত হয়। সেইসাথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত কুরবানী- এ মাসেই আদায় করা হয়।

কুরবানী কেবল ইসলামী শরীয়তেরই ইবাদত নয়। বরং পূর্ববর্তী সকল শরীয়তেই কুরবানীর বিধান ছিল, যদিও সকলের পন্থা এক ছিল না। মিল্লাতে ইবরাহীমীর সুন্নত এ কুরবানী ইসলামের শিআর বা অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এতে আছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিঃশর্ত আনুগত্যের শিক্ষা এবং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ ও বিসর্জনের দীক্ষা। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

قُلْ اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَ مَحْیَایَ وَ مَمَاتِیْ لِلهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ  .

অর্থাৎ, বলে দিন, নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার ইবাদত ও আমার জীবন-মরণ সবই আল্লাহর জন্য, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক। -সূরা আনআম (৬) : ১৬২

এই কুরবানী আমাদেরকে শেখায়, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যেভাবে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রিয় জিনিস কুরবানী করতে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছেন, তেমনি আমরাও যেন আপন মনোবাসনা বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করি। এবং সব অবৈধ মনোবৃত্তি ও পাপাসক্ত মনোভাব ঝেড়ে ফেলি।

ইসলামে কুরবানীর গুরুত্ব অনেক। নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক এমন প্রত্যেক ব্যক্তির কুরবানী আদায় করা ওয়াজিব। কেউ ওয়াজিব কুরবানী না করলে তার ব্যাপারে হাদীসে কঠোর ধমকি এসেছে।

মিখনাফ ইবনে সুলাইম রা. বলেন-

كُنّا وُقُوفًا مَعَ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِعَرَفَاتٍ، فَسَمِعْتُهُ يَقُولُ: يَا أَيّهَا النّاسُ، عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِي كُلِّ عَامٍ أُضْحِيّةٌ.

আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আরাফায় অবস্থান করছিলাম, তখন আমি শুনলাম তিনি বলছেন, হে লোকসকল! প্রত্যেক ঘরওয়ালার উপর প্রত্যেক বছর কুরবানী আবশ্যক। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫১৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৮৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৪৭৮৬

যেই ঘরে নেসাবের মালিক একাধিক ব্যক্তি থাকে, সেই ঘরে প্রত্যেক নেসাবওয়ালাকে কুরবানী করতে হবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও প্রত্যেক বছর কুরবানী করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন-

أَقَامَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِالمَدِينَةِ عَشْرَ سِنِينَ يُضَحِّي كُلّ سَنَةٍ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় দশ বছর ছিলেন। প্রতি বছরই কুরবানী করেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫০৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৪৯৫৫

কুরবানী ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও যারা কুরবানী করে না, তাদের ব্যাপারে অন্য এক হাদীসে এসেছে; আবূ হুরায়রা রা. বলেন-

قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ وَجَدَ سَعَةً فَلَمْ يُضَحِّ، فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যার কুরবানীর সামর্থ্য আছে, তবুও সে কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ‘মুসল্লা’ (ঈদগাহ)-এ না আসে। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৫৬৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮২৭৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১২৩

সমস্ত ইবাদতের ক্ষেত্রেই আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়ত যেমন জরুরি, তেমনি সেই ইবাদত শরীয়তসম্মত পথ ও পদ্ধতিতেই করা আবশ্যক। মনগড়া পন্থায় তা আদায় করলে সওয়াবের পরিবর্তে উল্টো গুনাহ হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই খুব ভালোভাবে কুরবানীর মাসআলা-মাসায়েল জেনে নিতে হবে এবং সতর্ক থাকতে হবে, যেন কুরবানী আদায়ে ভুল-ত্রুটি না হয়, অথবা না জানার কারণে ওয়াজিব কুরবানী ছুটে না যায়।

 

অংশীদারিতে কুরবানী

 

উট, গরু বা মহিষে এক থেকে সাত পর্যন্ত যেকোনো ভাগেই কুরবানী করা যায়। আর ভেড়া, দুম্বা বা ছাগলে একের অধিকজনে কুরবানী জায়েয নেই।

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন-

خَرَجْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ مُهِلِّينَ بِالْحَجِّ:فَأَمَرَنَا رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَنْ نَشْتَرِكَ فِي الْإِبِلِ وَالْبَقَرِ، كُلّ سَبْعَةٍ مِنّا فِي بَدَنَةٍ.

আমরা হজ্বের ইহরাম বেঁধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বের হলাম। তিনি আমাদেরকে আদেশ করলেন, যেন আমরা প্রতিটি উট ও গরুতে সাতজন করে শরীক হয়ে কুরবানী করি। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩১৮

অপর এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, একটি গরু সাত জনের পক্ষ থেকে এবং একটি উট সাত জনের পক্ষ থেকে (কুরবানী করা হবে)। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪০০৬; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ২৯০১; জামে তিরমিযী, হাদীস ৯০৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৮০৮

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে কুরবানী করা

হানাশ রাহ. বলেন-

رَأَيْتُ عَلِيّا يُضَحِّي بِكَبْشَيْنِ، فَقُلْتُ مَا هَذَا؟ فَقَالَ: إِنّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَوْصَانِي أَنْ أُضَحِّيَ عَنْهُ فَأَنَا أُضَحِّي عَنْهُ.

আমি আলী রা.-কে দেখলাম, দুটি দুম্বা কুরবানী করছেন। আমি বললাম, দুটি কেন? তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ওসীয়ত করেছেন, তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানী করতে। তাই আমি তাঁর পক্ষ থেকেও কুরবানী করছি। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯০; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৪৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৮৬

আলী রা. প্রত্যেক বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে কুরবানী করতেন। সুতরাং সামর্থ্য থাকলে তাঁর পক্ষ থেকে নফল কুরবানী করা উত্তম।

 

কুরবানীর পশুর বয়সসীমা

কুরবানীর পশু উটের ক্ষেত্রে ৫ বছর বয়সী, গরু বা মহিষের ক্ষেত্রে ২ বছর বয়সী হতে হবে। ভেড়া, দুম্বা বা ছাগলের ক্ষেত্রে অন্তত ১ বছর বয়সী হতে হবে, তবে ছ’মাস বয়সী হৃষ্টপুষ্ট ভেড়া বা দুম্বা হলেও চলবে।

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন

قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: لَا تَذْبَحُوا إِلّا مُسِنّةً، إِلّا أَنْ يَعْسُرَ عَلَيْكُمْ، فَتَذْبَحُوا جَذَعَةً مِنَ الضّأْنِ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা কুরবানীতে ‘মুছিন্না’ ছাড়া যবেহ করবে না। তবে সংকটের অবস্থায় ছ’মাস বয়সী ভেড়া-দুম্বা যবেহ করতে পারবে। (মুছিন্না হল, ৫ বছর বয়সী উট, ২ বছরের গরু, মহিষ এবং ১ বছর বয়সী ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা -শরহুন নববী)। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৭৯

 

কুরবানীর পশু হৃষ্টপুষ্ট হওয়া উত্তম

হাদীসে এসেছে-

أَنّ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ ضَحّى بِكَبْشَيْنِ سَمِينَيْنِ عَظِيمَيْنِ أَمْلَحَيْنِ أَقْرَنَيْنِ مُوْجَيَيْنِ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি বড় শিংবিশিষ্ট সাদা-কালো বর্ণের হৃষ্টপুষ্ট খাসি দুম্বা জবাই করেছেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৫০৪৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৫৯

 

অসুস্থ পশুর কুরবানী

বারা ইবনে আযিব রা. বলেন-

أَشَارَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِيَدِهِ وَيَدِي أَقْصَرُ مِنْ يَدِهِ، فَقَالَ: أَرْبَعٌ لَا يضحى بِهِنّ الْعَوْرَاءُ الْبَيِّنُ عَورُهَا، وَالْمَرِيضَةُ الْبَيِّنُ مَرَضُهَا، وَالْعَرْجَاءُ، الْبَيِّنُ ظَلَعُهَا، وَالْعَجْفَاءُ الّتِي لَا تُنْقِي.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত দিয়ে ইশারা করেছেন -আমার হাত তাঁর হাত থেকে ছোট- তিনি ইশারা করে বলছিলেন, চার ধরনের পশু দ্বারা কুরবানী করা যায় না; যে পশুর চোখের দৃষ্টিহীনতা স্পষ্ট, যে পশু অতি রুগ্ন, যে পশু সম্পূর্ণ খোঁড়া এবং যে পশু এত শীর্ণ যে, তার হাড়ে মগজ নেই। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৯১৯; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৪৯৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৮০২; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৮২

অন্য এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, আলী ইবনে আবী তালিব রা. বলেন-

أَمَرَنَا رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَنْ نَسْتَشْرِفَ العَيْنَ وَالأُذُنَ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে আদেশ করেছেন, আমরা যেন (কুরবানীর পশুর) চোখ ও কান ভালোভাবে লক্ষ করি। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৪৯৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৮০৪; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৭৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৮০

অন্য হাদীসে আছে, আলী রা. বলেন-

نَهَى رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَنْ يُضَحَّي بِأَعْضَبِ القَرْنِ وَالأُذُنِ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে শিং ভাঙ্গা এবং কান কাটা পশু দ্বারা কুরবানী করতে নিষেধ করেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫০৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৮০৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৮৩

কুরবানী প্রকৃতপক্ষে বান্দার পক্ষ থেকে মহান আল্লাহ তাআলার দরবারে নযরানা পেশ করার নাম। দরবারে আযীমের শান রক্ষা করার সাধ্য তো বান্দার নেই। তাই নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী উত্তম ও ভালো পশু নির্বাচন করাই কাম্য। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتّٰی تُنْفِقُوْا مِمَّا تُحِبُّوْنَ،  وَ مَا تُنْفِقُوْا مِنْ شَیْءٍ فَاِنَّ اللهَ بِهٖ عَلِیْمٌ.

তোমরা কিছুতেই পুণ্যের স্তরে উপনীত হতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে। তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৯২

সুতরাং এটা খুবই সঙ্কীর্ণমনার পরিচয় যে, অসুস্থ ও ত্রুটিপূর্ণ পশু কুরবানী করে কোনোমতে দায়মুক্ত হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হবে।

যদিও সব ত্রুটির বিধান এক নয়। কোনো কোনো ত্রুটি এমনও রয়েছে, যা একটি স্তর পর্যন্ত ছাড়যোগ্য। বারা ইবনে আযিব রা. কর্তৃক বর্ণিত উক্ত হাদীসের মধ্যে البين শব্দে যার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে এবং ফিক্হ-ফতোয়ার কিতাবে তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ আছে। সাধারণ পাঠক তা ফিকহে হানাফীর বাংলা ভাষায় রচিত নির্ভরযোগ্য কোনো গ্রন্থে দেখে নিতে পারবেন।

 

আগে ঈদের নামায তারপর কুরবানী

বারা ইবনে আযিব রা. বলেন-

خَطَبَنَا النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَوْمَ النّحْرِ، قَالَ: إِنّ أَوّلَ مَا نَبْدَأُ بِهِ فِي يَوْمِنَا هَذَا أَنْ نُصَلِّيَ، ثُمّ نَرْجِعَ، فَنَنْحَرَ فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَقَدْ أَصَابَ سُنّتَنَا، وَمَنْ ذَبَحَ قَبْلَ أَنْ يُصَلِّيَ، فَإِنّمَا هُوَ لَحْمٌ عَجّلَهُ لِأَهْلِهِ لَيْسَ مِنَ النّسُكِ فِي شَيْءٍ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশে খুতবা দিলেন। তাতে বললেন, এই দিনে আমাদের প্রথম কাজ নামায আদায় করা। এরপর কুরবানী করা। সুতরাং যে এভাবে করেছে তার কাজ আমাদের তরীকা মতো হয়েছে। আর যে আগেই যবেহ করেছে, (তার কাজ তরীকা মতো হয়নি, অতএব) তা তার পরিবারের জন্য সময়ের আগেই পাঠানো গোশত, কুরবানী নয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৬৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬১; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৯০৭

অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে-

قَالَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: مَنْ ذَبَحَ قَبْلَ الصّلاَةِ فَإِنّمَا ذَبَحَ لِنَفْسِهِ، وَمَنْ ذَبَحَ بَعْدَ الصّلاَةِ فَقَدْ تَمّ نُسُكُهُ، وَأَصَابَ سُنّةَ المُسْلِمِينَ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানীর পশু জবাই করবে সেটা তার নিজের জন্য সাধারণ জবাই হবে। আর যে নামাযের (ও খুতবার) পরে জবাই করবে তার কুরবানী পূর্ণ হবে এবং সে-ই মুসলমানদের রীতি অনুসরণ করেছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৫৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬১

হাদীসে আছে, কোনো কোনো সাহাবী ভুলক্রমে ঈদের নামাযের আগেই কুরবানী করে ফেলেছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে পুনরায় কুরবানী করতে আদেশ করেন। (দ্রষ্টব্য. সহীহ বুখারী ২/৮২৭; সহীহ মুসলিম ২/১৫৩; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৯১২, ৫৯১৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৯০; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৯৮)

 

কুরবানীর আগে কিছু না খাওয়া

কুরবানী আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে বান্দার জন্য মেহমানদারী। এজন্য উত্তম হল, এদিন সকাল সকাল ঈদের নামায পড়ে, কুরবানী করে, কুরবানীর গোশতই প্রথমে খাওয়া।

বুরাইদা রা. বলেন-

كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: لَا يَغْدُو يَوْمَ الْفِطْرِ حَتّى يَأْكُلَ، وَلَا يَأْكُلُ يَوْمَ الْأَضْحَى حَتّى يَرْجِعَ فَيَأْكُلَ مِنْ أُضْحِيّتِهِ.

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের জন্য না খেয়ে বের হতেন না। আর ঈদুল আযহাতে নামায থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত কিছু খেতেন না। এরপর প্রথমে কুরবানীর গোশত খেতেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩০৪২; জামে তিরমিযী, হাদীস ৫৪২; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ১৪২৬; সুনানে দারাকুতনী, হাদীস ১৭১৫

 

নিজ হাতে জবাই করা উত্তম

আনাস ইবনে মালিক রা. বলেন-

ضَحّى النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِكَبْشَيْنِ أَمْلَحَيْنِ، فَرَأَيْتُهُ وَاضِعًا قَدَمَهُ عَلَى صِفَاحِهِمَا، يُسَمِّي وَيُكَبِّرُ، فَذَبَحَهُمَا بِيَدِهِ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি সাদা-কালো বর্ণের নর দুম্বা কুরবানী করেছেন। এবং বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবার বলেছেন। আর আমি দেখেছি যে, তিনি দুম্বা দুটির গর্দানে পা রেখে নিজ হাতে সেগুলো জবাই করেছেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৫৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬৬; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৮৭

 

জবাই করার সময় কষ্ট দেওয়া যাবে না

হযরত শাদ্দাদ ইবনে আওস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

إِنّ اللهَ كَتَبَ الْإِحْسَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ، فَإِذَا قَتَلْتُمْ فَأَحْسِنُوا الْقِتْلَةَ، وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأَحْسِنُوا الذّبْحَ، وَلْيُحِدّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَهُ، فَلْيُرِحْ ذَبِيحَتَهُ.

আল্লাহ তাআলা সকল কিছুর উপর অনুগ্রহকে অপরিহার্য করেছেন। এতএব, যখন তোমরা (কাউকে শরীয়ত মুতাবেক হদ বা কিসাস হিসাবে) হত্যা করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে হত্যা কর, যখন যবেহ করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে যবেহ কর। এবং প্রত্যেকে তার ছুরিতে শান দিবে, যেন জবাইয়ের প্রাণির বেশি কষ্ট না হয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৫৫; আবু দাউদ, হাদীস ২৮১৫; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৪০৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৪০৫

অনেকে যবাইয়ের পর পশু ঠা-া হওয়ার পূর্বেই চামড়া ছিলার কাজ শুরু করে দেয়, যা মাকরূহ। এ থেকে বিরত থাকা জরুরি।

 

জবাই করার সময় কী বলবে?

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন দুটি দুম্বা জবাই করেছেন। যখন সেগুলোকে কেবলামুখী করে শোয়ালেন, তখন বললেন-

إِنِّي وَجّهْتُ وَجْهِيَ لِلّذِي فَطَرَ السّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ، إِنّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ، لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوّلُ الْمُسْلِمِينَ، بِسْمِ اللهِ اللهُ أَكْبَرُ، اللّهُمّ مِنْكَ وَلَكَ مِنْ مُحَمّدٍ وَأُمّتِهِ.

এরপর যবেহ করেছেন। -সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ২৮৯৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫০২২; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১৭১৬

আয়েশা রা. থেকে অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিসমিল্লাহ বলে জবাই করেছেন এবং বলেছেন-

اللهُمّ تَقَبّلْ مِنْ مُحَمّدٍ، وَآلِ مُحَمّدٍ، وَمِنْ أُمّةِ مُحَمّدٍ.

হে আল্লাহ! মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে, মুহাম্মাদের পরিবারের পক্ষ থেকে এবং মুহাম্মাদের উম্মতের পক্ষ থেকে কবুল করুন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬৭; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৯১৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯২

আরেক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

بِسْمِ اللهِ مِنْكَ وَلَكَ اللهُمّ تَقَبّلَ مِنْ مُحَمّدٍ.

আল্লাহর নামে। হে আল্লাহ! তোমার নিকট থেকে এবং তোমার উদ্দেশ্যে। হে আল্লাহ! মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। -আল মুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ১১৩২৯

এই হাদীসগুলো থেকে বুঝা গেল, কুরবানীর পশু জবাই করার পর তা কবুলের জন্য আল্লাহর দরবারে উক্ত পদ্ধতিতে দুআ করা মুস্তাহাব। এক্ষেত্রে নিজের নাম উল্লেখ করবে। যাদের জন্য ঈসালে সওয়াব করতে চাচ্ছে, তাদের নামও উল্লেখ করবে।

 

নিজের কুরবানীর গোশত খাওয়া উত্তম

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إِذَا ضَحّى أَحَدُكُمْ فَلْيَأْكُلْ مِنْ أُضْحِيّتِهِ

তোমাদের কেউ যখন কুরবানী করবে সে যেন তার কুরবানীর গোশত খায়। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯০৭৮

 

কুরবানীর পশুর গোশত বিক্রি করা যাবে না

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে বললেন

إِنِّي  كُنْتُ أَمَرْتُكُمْ أَنْ لَا تَأْكُلُوا الْأَضَاحِيّ، فَوْقَ ثَلَاثَةِ أَيّامٍ لِتَسَعَكُمْ، وَإِنِّي أُحِلّهُ لَكُمْ، فَكُلُوا مِنْهُ مَا شِئْتُمْ، وَلَا تَبِيعُوا لُحُومَ الْهَدْيِ، وَالْأَضَاحِيِّ فَكُلُوا، وَتَصَدّقُوا، وَاسْتَمْتِعُوا بِجُلُودِهَا، وَلَا تَبِيعُوهَا، وَإِنْ أُطْعِمْتُمْ مِنْ لَحْمِهَا ، فَكُلُوا  إِنْ شِئْتُمْ.

আমি তোমাদেরকে কুরবানীর গোশত তিন দিনের বেশি খেতে নিষেধ করেছিলাম। যাতে তোমরা সবাই তা পেয়ে যাও। এখন আমি তোমাদেরকে অনুমতি দিচ্ছি। সুতরাং, যতদিন ইচ্ছা তা খেতে পার। আর তোমরা ‘হাদী’ ও কুরবানীর গোশত বিক্রি করো না। নিজেরা খাও এবং অন্যদেরকে দান করো। আর এগুলোর চামড়া নিজেদের কাজে ব্যবহার করো। তা বিক্রি করো না। তোমাদেরকে যদি এর গোশত খেতে দেওয়া হয়, তাহলে তোমরা চাইলে তা খেতে পার। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬২১০

 

কুরবানীর পশুর চামড়া নিজের জন্য বিক্রি করা যাবে না

আবূ হুরায়রা রা. বলেন-

قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ : مَنْ بَاعَ جِلْدَ أُضْحِيّتِهِ فَلاَ أُضْحِيّةَ لَهُ.

هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحٌ مِثْلُ الأَوّلِ وَلَمْ يُخْرِجَاهُ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে তার কুরবানীর চামড়া (নিজের জন্য) বিক্রি করবে, তার কুরবানী শুদ্ধ হবে না। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৩৪৬৮

উল্লেখ্য, কুরবানীর চামড়ার মূল্য সদকা করার নিয়তে তা বিক্রি করতে কোনো অসুবিধা নেই।

 

কুরবানীর পশুর গোশত-চামড়া পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া যাবে না

আলী ইবনে আবী তালিব রা. বলেন-

أَمَرَنِي رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَنْ أَقُومَ عَلَى بُدْنِهِ، وَأَنْ أَتَصَدّقَ بِلَحْمِهَا وَجُلُودِهَا وَأَجِلّتِهَا، وَأَنْ لاَ أُعْطِيَ الْجَزّارَ مِنْهَا، قَالَ: نَحْنُ نُعْطِيهِ مِنْ عِنْدِنَا.

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তার (কুরবানীর উটের) আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করতে বলেছিলেন। তিনি কুরবানীর পশুর গোশত, চামড়া, আচ্ছাদনের কাপড় ছদকা করতে আদেশ করেন এবং এর কোনো অংশ কসাইকে দিতে নিষেধ করেন। তিনি বলেছেন, আমি তাকে (তার পারিশ্রমিক) নিজের পক্ষ থেকে দিব। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩১৭; সহীহ বুখারী, হাদীস ১৭১৬

 

কুরবানীর গোশত জমিয়ে রাখা

মদীনার প্রথম যুগে খাদ্যের সংকট ছিল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে কুরবানীর গোশত তিন দিনের বেশি জমিয়ে রাখতে নিষেধ করেছিলেন। পরে যখন অভাব কমে গেল তখন আবার সংরক্ষণ করে রাখার অনুমতি দিয়েছিলেন। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, জাবির রা. বলেন-

عَنِ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، أَنّهُ نَهَى عَنْ أَكْلِ لُحُومِ الضّحَايَا بَعْدَ ثَلَاثٍ، ثُمّ قَالَ بَعْدُ: كُلُوا، وَتَزَوّدُوا، وَادّخِرُوا.

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন দিনের পর কুরবানীর গোশত খেতে নিষেধ করেছিলেন। এরপর (অবকাশ দিয়ে) বললেন, খাও, পাথেও হিসেবে সঙ্গে নাও এবং সংরক্ষণ করে রাখ। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭২

অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে-

قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عَنْ لُحُومِ الأَضَاحِيِّ فَوْقَ ثَلاَثٍ لِيَتّسِعَ ذُو الطّوْلِ عَلَى مَنْ لاَ طَوْلَ لَهُ، فَكُلُوا مَا بَدَا لَكُمْ، وَأَطْعِمُوا وَادّخِرُوا.

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি তোমাদেরকে তিন দিনের পর কুরবানীর গোশত খেতে নিষেধ করেছিলাম, যেন স্বচ্ছল ব্যক্তিরা অসামর্থ্যদের তা উদারভাবে দিতে পারে। এখন তোমরা যা ইচ্ছা খাও, অন্যকে খাওয়াও এবং সঞ্চয় করে রাখতে পার। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫১০

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সামর্থ্য অনুযায়ী কুরবানী করার তাওফীক দান করুন। ভুল-ত্রুটি থেকে রক্ষা করুন। এবং কেবল তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই কুরবানী করার তাওফীক দান করুন।

পরিশেষে আমাদেরকে আল্লাহ তাআলার সেই বাণী স্মরণে রাখতে হবে, তিনি ইরশাদ করেন-

لَنْ یَّنَالَ اللهَ لُحُوْمُهَا وَ لَا دِمَآؤُهَا وَ لٰكِنْ یَّنَالُهُ التَّقْوٰی مِنْكُمْ،  كَذٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللهَ عَلٰی مَا هَدٰىكُمْ،  وَ بَشِّرِ الْمُحْسِنِیْنَ.

আল্লাহর কাছে না পৌঁছে তাদের গোশত আর না তাদের রক্ত, বরং তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছে। এভাবেই তিনি এসব পশুকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা একারণে আল্লাহর তাকবীর বল যে, তিনি তোমাদেরকে হেদায়েত দান করেছেন। যারা সুচারুরূপে সৎকর্ম করে তাদেরকে সুসংবাদ দিন। -সূরা হজ্ব (২২) : ৩৫

 

একই পশু দিয়ে কোরবানী ও আকিকা দেয়ার বিধান / একই পশু কোরবানী ও আকিকার নিয়তে জবাই করা কি জায়েয হবে?

 

যদি কোরবানী ও আকিকা একত্রে পড়ে এবং কোন ব্যক্তি যদি ঈদের দিন তার সন্তানের আকিকা দিতে চান বা তাশরিকের দিনগুলোতে আকিকা দিতে চান তাহলে কোরবানীর পশু কি আকিকা হিসেবে যথেষ্ট হবে?

এ মাসয়ালায় আলেমগণের দুইটি অভিমত রয়েছে:

 

প্রথম অভিমত: কোরবানীর পশু আকিকা হিসেবেও যথেষ্ট হবে। এটি হানাফি মাযহাবের অভিমত এবং এক বর্ণনা মতে, এটি ইমাম আহমাদের অভিমত। তাছাড়া এটি হাসান বসরি, মুহাম্মদ বিন সিরিন ও কাতাদা প্রমুখের অভিমত।

এ মতাবলম্বীদের দলিল হচ্ছে­‑

এ দুটো আমলের মাধ্যমে উদ্দেশ্য হচ্ছে পশু জবাই করার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র নৈকট্য হাছিল করা। তাই একটি অপরটির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যেমনিভাবে তাহিয়্যাতুল মাসজিদ (মসিজদে প্রবেশের নামায) ফরয নামাযের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে।

ইবনে আবু শাইবা (রহঃ) “আল-মুসান্নাফ” গ্রন্থে (৫/৫৩৪) বলেন: হাসান থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন: কেউ যদি ছেলের পক্ষ থেকে কোরবানী করে তাহলে সেটা আকিকা হিসেবে যথেষ্ট হবে।

হিশাম ও ইবনে সিরিন থেকে বর্ণিত আছে তারা উভয়ে বলেন: তার পক্ষ থেকে কোরবানী করলে সেটা আকিকা হিসেবে যথেষ্ট হবে।

কাতাদা থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন: আকিকা হিসেবে জবাই করা না হলে সেটা যথেষ্ট হবে না।

আল-বুহুতি (রহঃ) “শারহু মুনতাহাল ইরাদাত” গ্রন্থে (১/৬১৭) বলেন: “যদি আকিকার সময় ও কোরবানীর সময় একত্রে পড়ে; অর্থাৎ কোরবানীর দিনগুলোতে শিশু জন্মের সপ্তম দিন বা অনুরূপ কোন দিন পড়ে এবং তার আকিকা করা হয় তাহলে সেটা কোরবানী হিসেবে যথেষ্ট হবে। কিংবা যদি কোরবানী করা হয় তাহলে সেটা আকিকা হিসেবে যথেষ্ট হবে। যেমনিভাবে যদি ঈদের দিন ও জুমার দিন একই দিনে পড়ে তখন একটার জন্য গোসল করলে অপরটার গোসল হিসেবে যথেষ্ট হবে এবং যেমনিভাবে তামাত্তু হজ্জকারী কিংবা ক্বিরান হজ্জকারী যদি কোরবানীর দিন একটি ভেড়া জবাই করে সেটা হজ্জের ফরয হাদি ও কোরবানী হিসেবে যথেষ্ট হবে।”[সমাপ্ত]

তিনি “কাশ্শাফুল ক্বিনা” গ্রন্থে (৩/৩০) আরও বলেন: “যদি আকিকা ও কোরবানী একই সময়ে পড়ে এবং একটি পশু জবাই করার মাধ্যমে উভয়টির তথা আকিকা ও কোরবানীর নিয়ত করা হয় তাহলে উভয়টি আদায় হয়ে যাবে‑ ইমাম আহমাদের সুস্পষ্ট উক্তির আলোকে।”[সমাপ্ত]

এ অভিমতটি শাইখ মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম (রহঃ)ও মনোনীত করেছেন। তিনি বলেন: যদি কোরবানী ও আকিকা একত্রে পড়ে এবং পরিবারের কর্তার কোরবানী করার দৃঢ় সংকল্প থাকে এবং তিনি পশু জবাই করেন তাহলে এ পশু কোরবানীর পশু এবং এর মধ্যে আকিকাও ঢুকে পড়বে।

এক্ষেত্রে কিছু কিছু আলেমের কথায় পাওয়া যায় যে, উভয় জবাই একই ব্যক্তির পক্ষ থেকে: অর্থাৎ কোরবানী ও আকিকা নবজাতকের পক্ষ থেকে হতে হবে। আর কিছু কিছু আলেমের মতে, তা শর্ত নয়। যদি পিতা কোরবানী করেন তাহলে কোরবানী পিতার পক্ষ থেকে, আর আকিকা ছেলের পক্ষ থেকে।

 

দ্বিতীয় অভিমত: কোরবানীর পশু আকিকা হিসেবে জায়েয হবে না। এটি মালেকী, শাফেয়ি ও এক বর্ণনা মতে, ইমাম আহমাদের অভিমত।

এ মতাবলম্বীদের দলিল হল: আকিকা ও কোরবানী উভয়টি সত্তাগতভাবে উদ্দিষ্ট। এ কারণে একটি অপরটির পক্ষ থেকে জায়েয হবে না। তাছাড়া যেহেতু প্রত্যেকটির বিশেষ কারণ রয়েছে, যে কারণদ্বয় ভিন্ন ভিন্ন। তাই একটি অপরটির স্থলাভিষিক্ত হবে না। যেভাবে ফিদিয়া-র দম (পশু) তামাত্তু-এর দম (পশু) এর স্থলাভিষিক্ত হয় না।

হাইতামি ‘তুহফাতুল মুহতাজ শারহুল মিনহাজ’ গ্রন্থে (৯/৩৭১) বলেন: “আমাদের মাযহাবের আলেমগণের উক্তির বাহ্যিক মর্ম হল, যদি একটি ভেড়া দিয়ে কোরবানী ও আকিকার নিয়ত করা হয় তাহলে দুইটার কোনটা আদায় হবে না। এটি সুস্পষ্ট বিষয়। যেহেতু এ দুটোর প্রত্যেকটি উদ্দিষ্ট সুন্নত।”[সমাপ্ত]

আল-হাত্তাব (রহঃ) ‘মাওয়াহিবুল জালিল’ গ্রন্থে (৩/২৫৯) বলেন: “কেউ যদি তার কোরবানীর পশু কোরবানী হিসেবে ও আকিকা হিসেবে জবাই করে কিংবা ভোজ হিসেবে খাইয়ে দেয়: ‘যাখিরা’ গ্রন্থে বলা হয়েছে: ‘আল-কাবাস’ গ্রন্থাকার বলেন: আমাদের শাইখ আবু বকর আল-ফিহরি বলেন: যদি তার কোরবানীর পশুকে কোরবানী ও আকিকা হিসেবে জবাই করে তাহলে জায়েয হবে না। আর যদি ভোজ হিসেবে খাইয়ে দেয় তাহলে জায়েয হবে। এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য হল­­­­­: প্রথম দুইটির ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য হচ্ছে রক্তপাত করা। তাই দুইটি পশুর রক্তপাতের বদলে একটি পশুর রক্তপাত জায়েয হবে না। আর ভোজের ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য হচ্ছে খাওয়ানো। এটি রক্তপাতের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। তাই দুটো নিয়ত একত্রিত হওয়া সম্ভব।

সারকথা: যদি কোরবানীর পশুকে কোরবানী ও আকিকার নিয়তে জবাই করা হয় তাহলে সেটা জায়েয হবে। [ফাতাওয়াস শাইখ মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম (৬/১৫৯)] আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

 

একটি গরুতে একই ব্যক্তির কুরবানীর সাথে আকীকা বা ঈসালে সাওয়াবের অংশ রাখা – একটি দালীলিক পর্যালোচনা

বরাবর,

ফতোয়া বিভাগমারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা

প্রশ্ন : আমরা জানিএক ব্যক্তি একটি গরুতে নিজের ওয়াজিব কুরবানীর শরীক হওয়ার পাশাপাশি নিজের বা সন্তানের আকীকার অংশ বা পিতামাতার ঈসালে সওয়াবের জন্য ভিন্ন অংশ নিতে পারে। অথবা কেউ যদি পুরো একটি গরুই জবাই করেতবে এর এক অংশে নিজের ওয়াজিব কুরবানীর নিয়ত করেআর বাকি অংশে আকীকা এবং নিজের পিতামাতাদাদাদাদি ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য ঈসালে সওয়াবের নিয়ত করেÑ তবে তা সহীহ আছে। এর দ্বারা নিজের ওয়াজিব কুরবানীআকীকা ও ঈসালে সওয়াবের নিয়তে নফল কুরবানী সবই আদায় হবে। সাধারণত মুফতী সাহেবগণ থেকে আমরা এরকম মাসআলাই শুনেছি এবং এটিকেই সঠিক জানি। কিন্তু আমাদের এদিকে কোনো কোনো আলেমকে বলতে শুনিতারা বলেন যেএভাবে একই পশুতে একজনের একাধিক নিয়তে অংশ নেওয়া সহীহ নয়। একজন যদি একটি পশুতে ওয়াজিব কুরবানীআকীকা ও নফল কুরবানীর নিয়ত করে তবে সবগুলোই তার ওয়াজিব কুরবানী হিসেবে আদায় হবে। এর দ্বারা তার আকীকা ও নফল কুরবানী আদায় হবে না। তাদের কথা মতেÑ একটি গরুতে একাধিক ব্যক্তির জন্যই কেবল ভিন্ন ভিন্ন নিয়তে শরীক হওয়ার সুযোগ আছে। যারা এমনটি বলেনতারা একটি উর্দু ফতোয়া গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। সেখানে নাকি এর দলীলপ্রমাণ রয়েছে।

এখন আমাদের জানার বিষয় হলকোনো উর্দু ফাতাওয়াতে কি বাস্তবেই এমন কথা আছেথেকে থাকলে তা কি সঠিকএবং তাতে কি ফিকহের কোনো কিতাবের উদ্ধৃতি আছেএই মাসআলায় আপনাদের কাছ থেকে দলীলভিত্তিক বিস্তারিত আলোচনা কামনা করছি। এ মাসআলা নিয়ে কোনো কোনো এলাকায় অনেক ঝামেলা হতে দেখা যায়। কিছু কিছু লোক এ নিয়ে অনেক বাড়াবাড়ি করে থাকেন। তাই বিস্তারিত দলীলপ্রমাণসহ এ মাসআলার সমাধান জানতে চাচ্ছি। আল্লাহ তাআলা আপনাদের জাযায়ে খায়ের দান করুনÑআমীন।

নিবেদক

আবুল ফযল

ফেনী

 

بسم الله الرحمن الرحيم

الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على سيد الأنبياء والمرسلين، وعلى آله وأصحابه أجمعين، وعلى من تبعهم بإحسان إلى يوم الدين. أما بعد

কুরবানীর বড় পশু অর্থাৎ উটগরু বা মহিষে যেমনিভাবে সাত শরীকের অংশগ্রহণে সাতটি ওয়াজিব কুরবানী বা নফল কুরবানী বা আকীকা আদায় করা যায়তেমনি এক ব্যক্তির জন্য একটি উট বা গরুতে কাউকে শরীক না করে নিজের ওয়াজিব কুরবানীর সাথে নফল কুরবানীসন্তানের আকীকাপিতামাতা বা অন্য কারো জন্য ঈসালে সওয়াবের নিয়তে পৃথক পৃথক অংশ রাখাও জায়েয। এর দ্বারা কুরবানী ও আকীকা সবই আদায় হয়ে যাবে। এটি মুজতাহিদ ইমাম ও ফকীহগণের নিকট একটি স্বীকৃত মাসআলা। প্রাচীন ফিকহফতোয়ার কিতাবে সুস্পষ্টভাবেই মাসআলাটি লিপিবদ্ধ আছে। উপমহাদেশের ফকীহগণও স্পষ্টভাবেই তাদের ফাতাওয়ায় তা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু একটি উর্দু ফতোয়ার কিতাবে (যেমনটি প্রশ্নে ইঙ্গিত করা হয়েছে) সম্পূর্ণ বিপরীত ফতোয়া প্রদান করা হয়েছে। সেখানে খুব জোরালোভাবে দাবি করা হয়েছে যেএকটি উট গরুতে এক ব্যক্তি একটির বেশি কুরবানী বা একটির বেশি আকীকাতদ্রƒপ কুরবানীর সাথে আকীকা বা ঈসালে সওয়াবের নিয়ত করতে পারবে না। যদি একাধিক কুরবানী বা আকীকার নিয়ত করা হয় তবুও একটি কুরবানীই বা একটি আকীকাই আদায় হবে। একাধিক কুরবানী বা কুরবানীর সাথে আকীকা আদায় হবে না। এ মর্মে উক্ত কিতাব থেকে দুটি প্রশ্নোত্তর উল্লেখ করা হল।

প্রশ্ন : ১. দুই ভাই মিলে একটি পশু কুরবানী করেছে। তিন অংশ এক ভাইয়ের আর তিন অংশ আরেক ভাইয়ের। আর এক অংশ নিজ পিতার জন্য রেখেছে। অর্ধেক মূল্য একজন পরিশোধ করেছেঅর্ধেক মূল্য অপরজন। পিতামাতার পক্ষ থেকে কি কুরবানী সহীহ হবে?

উত্তর : গরুর মালিক যতজন হয় এতে অংশও কেবল ততটাই হতে পারে। প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে গরুর মালিক যেহেতু দুজন তাই পুরো গরুতে অংশও কেবল দুটিই হবে। দুইয়ের অধিক অংশ হতেই পারে না। তাই পিতামাতার পক্ষ থেকে কুরবানী আদায় হয়নি।

প্রশ্ন : ২. একটি গরুতে এক অংশ কুরবানীর আর বাকি ছয় অংশ আকীকার জন্য রাখা যাবে কি?

উত্তর : যে ব্যক্তির কুরবানীর অংশ আছে সে ঐ পশুতে আকীকার অংশ রাখতে পারবে না। যদি আকীকার অংশ রাখে তবে তার সকল অংশ মিলে একটি কুরবানীই আদায় হবে। আকীকা আদায় হবে না। হাঁঅন্য ব্যক্তি আকীকার অংশ রাখতে পারবে। তাও এভাবে যেএকটি গরুতে এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে কেবলমাত্র একটিই আকীকা হতে পারবে।

উক্ত উর্দু কিতাবে এক গরুতে এক ব্যক্তির জন্য কুরবানীর সাথে ঈসালে সাওয়াব অথবা আকীকার অংশ রাখা’ শিরোনামে প্রশ্নোত্তরের আলোকে একটি পুস্তিকাও রয়েছে। তাতে যে দাবিগুলো করা হয়েছে তার সারসংক্ষেপ হলÑ

এক. একটি গরুতে এক ব্যক্তির জন্য একাধিক কুরবানী বা বিভিন্ন নুসুকের নিয়ত গ্রহণযোগ্য নয়। যদি নিয়ত করা হয় তবে একটি কুরবানীই আদায় হবে। কারণ এ সম্পর্কে হাদীস ও ফিকহে স্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই।

দুই. ফিকহের অনেক কিতাবেই একটি পশুতে কুরবানীদমে তামাত্তুদমে কিরানআকীকা ইত্যাদি জায়েয হওয়ার কথা একাধিক ব্যক্তির ক্ষেত্রে উল্লেখ হয়েছে। কিন্তু একটি পশুতে এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে একাধিক কুরবানী বা কুরবানীর সাথে আকীকা আদায় হওয়ার কথা উল্লেখ নেই। এ থেকে বুঝা যায় যেএক ব্যক্তির একটি পশুতে একাধিক নিয়ত গ্রহণযোগ্য নয়।

তিন. ওয়াজিবের সাথে ওয়াজিব যুক্ত হতে পারে কিন্তু ওয়াজিবের সাথে নফল যুক্ত হতে পারে না।

নিজ যামানার সকল ফকীহ ও মুফতী ছাহেবানের বিপরীতে উক্ত ফতোয়া গ্রন্থটির সংকলক বুযুর্গ আলেম কর্তৃক এ মাসআলায় অদ্ভুত ও ভিন্ন মত প্রতিষ্ঠার পেছনে আমাদের জানামতে যেসকল মৌলিক কারণ ও ওজর স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হল১Ñ

১. তৎকালীন সময়ে (১৪০১ হি.) তাঁর কুতুবখানার ফিকহফতোয়া ও হাদীস ব্যাখ্যা গ্রন্থসমূহের প্রাচীন কিতাবের স্বল্পতা। অন্যদিকে ফিক্হফতোয়ার অমুদ্রিত প্রাচীন মাখতূত কিতাব (পাণ্ডুলিপি) বলতে গেলে ছিলই না।

২. মাবসূত সারাখসীর মত এ ধরনের  মৌলিক কিতাবসমূহযা দীর্ঘদিন থেকেই মুদ্রিত হয়ে আছেফতোয়া লেখার সময় সেসব উৎস গ্রন্থাবলিকে নিয়মিত সামনে না রাখা এবং সেগুলোর শরণাপন্ন হওয়ার প্রতি গুরুত্ব না দেয়া।

৩. যেসকল কিতাবের উদ্ধৃতিতে ফতোয়াটি লেখা হয়েছে ঐসকল কিতাবের উৎস গ্রন্থ এবং সেগুলোরও যেসব উৎসমূল আছেতাতে মাসআলা খুঁজে দেখার সুযোগ না পাওয়া। অথবা কোনো ওজরের কারণে এদিকটিতে মনোযোগ না দেয়া।

৪. কোনো মাসআলার আলোচনা না পাওয়াকে সংশ্লিষ্ট বিষয়টি ঢালাওভাবে না জায়েয হওয়ার দলীল মনে করা। (যা আপত্তিজনক)

৫. কোনো বিষয় নিজে খুঁজে না পাওয়াকে ঐ বিষয়ের অস্তিত্বহীনতার দলীল বানিয়ে নেয়া। (এটিও আপত্তিকর)

৬. ভ্রমের শিকার হয়ে কখনওবা নিজের ধারণাকেই দলীল হিসেবে পেশ করে দেওয়া। (এটি আরো বেশি আপত্তিকর)

এই ওজরগুলোর কারণে এই বুযুর্গ আলেমকে অন্যান্য ফকীহগণের বিপরীতে ভিন্নমত পোষণের জন্য আমরা মাজুর মনে করি। কিন্তু বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর এ বিষয়ে উলামায়ে কেরাম তাঁর অনুসরণকে সহীহ মনে করেন না।

উপরোক্ত কারণ ও ওজরগুলোরই ফলাফল হল, ‘এক ব্যক্তির জন্য একটি গরুতে একাধিক ওয়াজিব বা ওয়াজিবের সাথে নফলের নিয়তে অংশ রাখা জায়েয’ হওয়ার স্বপক্ষে ফিক্হফতোয়ার পুরাতন উৎস গ্রন্থসমূহে সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকা সত্ত্বেও এই বুযুর্গ আলেম দৃঢ়তার সাথেই বলছেনহাদীস ও ফিকহের কিতাবের কোথাও এর উল্লেখ নেই! এবং এই কারণ ও ওজরগুলোরই ফলাফল হলতিনি উক্ত কিতাবে এমন বক্তব্যগুলোকে নিজের দলীল আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেনযেগুলো বাস্তবে তার বিপক্ষের দলীল। কেননা এই বক্তব্যগুলোকে মূল উৎসগ্রন্থের সাথে মিলিয়ে সেখান থেকে পূর্বাপরসহ পুরো বক্তব্যটি তাঁর পড়ার সুযোগ হয়নি। উপরোক্ত কারণ ও ওজরগুলোর ফলাফল এও যেযথাযথভাবে প্রাচীন ফিক্হফতোয়ার কিতাবে তথ্য তালাশ না করায় তাঁর এই ধারণা তৈরি হয়েছে যেদুই ওয়াজিব কুরবানী একসাথে জমা হতে পারেকিন্তু একই পশুতে এক ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব কুরাবানীর সাথে নফল কুরবানী একত্রিত হতে পারে না। পরে তিনি নিজের এই ধারণাকেই স্বীকৃত মূলনীতি ও দলীল হিসেবে পেশ করে গেছেন। যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

ফতোয়ার কাজের সাথে সম্পৃক্ত নবীন আলেমগণযাদের কাছে কিতাবের বড় সংগ্রহও নেইআবার রাসেখ ইলমসম্পন্ন মুফতীগণের দীর্ঘ সোহবত ওঠানোর সুযোগ হয়নিতাদের অনেকে যেহেতু একদুটি সংক্ষিপ্ত উর্দু ফতোয়ার কিতাব দেখেই মাসআলা বলে দেন (অথচ কখনো এমন করা উচিত নয়)তাদের ইলমী সহযোগিতার খাতিরে এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকার পর কিছুটা বিস্তারিত আকারে এই মাসআলা সম্পর্কিত শরয়ী উসূল ও দালায়েল এবং ফিক্হফতোয়া ও হাদীসের ব্যাখ্যাগ্রন্থসমূহের কিছু উদ্ধৃতি উল্লেখ করে দেওয়াটা মুনাসিব ও সমীচীন মনে হচ্ছে।

ومن  الله تعالى نرجو التوفيق والنفع والقبول.

কিতাবটিতে দাবি করা হয়েছে যেএক ব্যক্তির জন্য একটি গরুতে একটির বেশি কুরবানীর নিয়ত করা যাবে না। যদি নিয়ত করা হয়তবে একটি কুরবানীই আদায় হবে। কারণ এ ব্যাপারে হাদীস ও ফিকহের কিতাবে কোনো দলীলপ্রমাণ নেই।

বাস্তব কথা হলএই দাবি আদৌ ঠিক নয়বরং তা ভিত্তিহীন একটি দাবি। একটি গরুতে এক ব্যক্তির জন্য একাধিক কুরবানীর নিয়ত করা যায়Ñ তা হাদীস ও আসারের আলোকে প্রমাণিত একটি মাসআলা। হাদীস ও ফিকহের ইমামগণ  থেকে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রমাণিত আছে। নিম্নে প্রথমে ঐসকল হাদীস উপস্থাপন করা হলযার উপর ভিত্তি করে ইমামগণ এক ব্যক্তির জন্য একটি পশুতে একাধিক কুরবানী বা নুসুক আদায়ের কথা বলেছেন।

হাদীস : ১

সহীহ মুসলিমে এসেছেজাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. হতে বর্ণিততিনি বলেনÑ

حَجَجْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فَنَحَرْنَا الْبَعِيرَ عَنْ سَبْعَةٍ، وَالْبَقَرَةَ عَنْ سَبْعَةٍ.

আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হজ্ব করেছি। তখন আমরা সাতজনের পক্ষ থেকে একটি উট কুরবানী করেছি এবং সাতজনের পক্ষ থেকে একটি গরু কুরবানী করেছি। Ñসহীহ মুসলিমহাদীস ১৩১৮

হাদীস  : ২

عن ابن عباس أن النبي  صلى الله عليه وسلم  أتاه رجل فقال: إن علي بدنة وأنا موسر ولا أجدها فأشتريها، فأمره  صلى الله عليه وسلم أن يبتاع سبع شياه فيذبحهن.

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেনএক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললআমার ওপর একটি উট আবশ্যক হয়েছে। আমি স্বচ্ছল। কিন্তু ক্রয়ের জন্য উট খঁুজে পাচ্ছি না।  তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সাতটি ছাগল ক্রয় করে জবাই করতে বললেন। Ñমুসনাদে আহমাদহাদীস ২৮৩৯শরহু মাআনিল আসারতহাবীবর্ণনা ৬২২১

হাদীস : ৩

মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বায় আমর ইবনে আব্দিল্লাহ রাহ. হতে বর্ণিতÑ

أَنّ رَجُلاً نَذَرَ أَنْ يَنْحَرَ بَدَنَةً ، فَأَتَى عَبْدَ اللهِ بْنَ مُحَمّدِ بْنِ عَلِيٍّ، فَقَالَ : الْبُدْنُ مِنَ الإِبِلِ ، وَلاَ تُنْحَرُ إلاّ بِمَكَّةَ ، إلاّ إِنْ نَوَى مَنْحَرًا فَحَيْثُ نَوَى، فَإِنْ لَمْ يَجِدْ فَسَبْعٌ مِنَ الْغَنَمِ، قَالَ : وَسَأَلْت سَالِمًا فَقَالَ مِثْلَ ذَلِكَ .قَالَ : وَسَأَلْت سَعِيدَ بْنَ الْمُسَيّبِ، فَقَالَ : مِثْلَ ذَلِكَ، إلاّ إِنّهُ قَالَ : فَإِنْ لَمْ يَجِدْ فَعَشَرَةٌ مِنَ الْغَنَمِ، قَالَ : وَسَأَلْت خَارِجَةَ بْنَ زَيْدٍ وَأَخْبَرتهُ بِمَا قَالَ الْقَوْمُ، فَقَالَ : مَا أَدْرَكْت أَصْحَابَنَا يَعُدّونَهَا إلاّ سَبْعًا مِنَ الْغَنَمِ.

এক ব্যক্তি একটি বাদানা কুরবানী করার মান্নত করল। এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আলী রাহ.কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেনবাদানা উটের প্রকার থেকে। আর তা মক্কায় জবাই করা হবে। তবে যদি নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় কুরবানী করার নিয়ত করে থাকেসেখানেই করবে। আর যদি বাদানা না পাওয়া যায় তবে সাতটি ছাগল কুরবানী করবে। বর্ণনাকারী বলেনআমি সালেম রাহ.কে মাসআলাটি জিজ্ঞাসা করলে তিনি এমনটিই বললেন। তিনি আরও বলেনআমি সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব রাহ.কে জিজ্ঞাসা করলামতিনি একই উত্তর দিলেন। তবে তিনি বললেনযদি উট না পাওয়া যায় তবে দশটি ছাগল কুরবানী করবে। বর্ণনাকারী বলেনআমি খারিজা ইবনে যায়েদ রাহ.কে জিজ্ঞাসা করলাম এবং এ সম্পর্কে অন্যরা কী বলেছেÑ তাও তাকে জানালাম। তিনি বললেনআমি মাশায়েখদের দেখেছিতারা একটি উটকে সাতটি ছাগলের সমমানের গণ্য করতেন। Ñমুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাবর্ণনা ১২৭৭৯

হাদীস : ৪

শাবী রাহ. বলেনÑ

سَأَلْتُ ابْنَ عُمَرَ، قُلْتُ: الْجَزُورُ وَالْبَقَرَةُ تُجْزِئُ عَنْ سَبْعَةٍ؟ قَالَ: يَا شَعْبِيّ وَلَهَا سَبْعَةُ أَنْفُسٍ؟ قَالَ: قُلْتُ: إِنّ أَصْحَابَ مُحَمّدٍ يَزْعُمُونَ، أَنّ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ سَنّ الْجَزُورَ وَالْبَقَرَةَ عَنْ سَبْعَةٍ، قَالَ: فَقَالَ ابْنُ عُمَرَ لِرَجُلٍ: أَكَذَاكَ يَا فُلَانُ؟ قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: مَا شَعَرْتُ بِهَذَا.

আমি আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা.কে জিজ্ঞাসা করলামউট আর গরু কি সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী করা যায়তিনি বললেনহে শাবী এগুলোতে কি সাতটি প্রাণ আছেতিনি বলেনআমি বললামসাহাবীগণ তো বলেনরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে একটি উট বা একটি গরু কুরবানী করতে বলেছেন। একথা শুনে তিনি এক ব্যক্তিকে বললেনবিষয়টি কি তাইলোকটি বললজী হাঁ! তখন তিনি বললেনআমি এ সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। Ñমুসনাদে আহমাদহাদীস ২৩৪৭৮

আরো দেখুনফাতহুল বারী ৩/৫৩৫

এবার দেখা যাক এ বিষয়ে হাদীস ব্যাখ্যাকার ইমামগণ কী বলেছেন :

এক. ইমাম বাগাবী রাহ. (৫১৬ হি.) 

শরহুস সুন্নাহ’ কিতাবে সহীহ মুসলিমের উপরোক্ত হাদীস উল্লেখ করার পর তিনি বলেনÑ

ولو وجب على رجل سبع شياه هدايا في الحج، بأن تمتع، وحلق، ولبس، وتطيب، فذبح عن الكل بدنة، أو بقرة جاز.

কোনো ব্যক্তির ওপর যদি হজ্ব আদায়ের ক্ষেত্রে সাতটি ছাগল ওয়াজিব হয় যেমনতামাত্তুর দমমাথা মুণ্ডনের কারণে জরিমানা দমসেলাইকৃত পোশাক পরিধানের কারণে জরিমানা দমসুগন্ধি ব্যবহারের কারণে জরিমানা দম। অতঃপর এ সবের জন্য একটি উট বা গরু জবাই করে তবে তা জায়েয আছে। Ñশরহুস সুন্নাহবাগাবী ৪/৩৫৬

দুই. ইমাম নববী রাহ. (৬৭৬ হি.)

তিনি শরহু মুসলিম’-এ জাবের রা.এর হাদীস  (উপরের হাদীস : ১) এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেনÑ

وفي هذه الأحاديث أن البدنة تجزئ عن سبعة، والبقرة عن سبعةـ وتقوم كل واحدة مقام سبع شياه، حتى لو كان على المحرم سبعة دماء بغير جزاء الصيد، وذبح عنها بدنة أو بقرة أجزأه عن الجميع.

এসকল হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যেএকটি উট এবং একটি গরু সাতজনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে। আর প্রত্যেকটি উটগরু সাতটি ছাগলের স্থলাভিষিক্ত। তাই মুহরিম ব্যক্তির ওপর যদি শিকারের কারণে আরোপিত দম ব্যতীত সাতটি দম ওয়াজিব হয় এবং সে ঐ সাতটি দমের জন্য একটি উট বা গরু জবাই করে তাহলে সবগুলোর পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে। Ñশরহু মুসলিমনববী ৯/৬৭

ইমাম বাগাবী রাহ. ও ইমাম নববী রাহ. স্পষ্টই বলেছেন যেএক ব্যক্তি একটি উট বা গরু দ্বারা সাতটি দম আদায় করতে পারবেশিকারের জরিমানা দম ব্যতীত। শিকারের জরিমানা দমের ক্ষেত্রে শাফেয়ী রাহ. ভিন্নমত পোষণ করেন। এছাড়া একটি উট বা গরুতে এক ব্যক্তি এক থেকে নিয়ে (সর্বোচ্চ) সাতটি পর্যন্ত কুরবানী বা সাতটি দম আদায় করতে পারবে। তাঁরা জাবের রা.এর হাদীস থেকেই এ মাসআলা প্রমাণ করেছেন। অথচ উক্ত হাদীস সাত শরীক সম্পর্কিত। তারা কারণ ব্যক্ত করেছেন এই বলে যেউট ও গরু প্রত্যেকটি সাতটি ছাগলের স্থলাভিষিক্ত। সুতরাং সাতটি ছাগল দ্বারা যেমনি করে সাত ব্যক্তি সাতটি কুরবানী আদায় করতে পারে তদ্রƒপ এক ব্যক্তিও একটি উট বা গরু দ্বারা সাত নিয়তে সাতটি কুরবানী আদায় করতে পারবে। জাবের রা.এর হাদীসকেই তাঁরা এ মাসআলার মূল ভিত্তি সাব্যস্ত করেছেন। এখানে কুরবানীদাতা একজননা সাতজনÑ তা লক্ষণীয় কোনো বিষয়ই নয়। ইমাম নববী রাহ. যে বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করেছেন তার সুস্পষ্ট বর্ণনা তো মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বামুসনাদে আহমাদ ও শরহু মাআনিল আসারের উদ্ধৃতিতে উপরে উল্লেখ হয়েছে।

এ মাসআলায় হানাফী মাযহাবের ইমামদেরও কোনো দ্বিমত নেই। বরং শাফেয়ী মাযহাবের যে বক্তব্যএকই বক্তব্য আমাদের মাযহাবের ইমামদেরও। উপরন্তু ইমাম বাগাবী রাহ. ও ইমাম নববী রাহ.এরও আগে ইমাম সারাখসী রাহ. তাঁর কিতাব মাবসূত’-এ সুস্পষ্ট ভাষায় তা ব্যক্ত করেছেন। যা সামনে ফিক্হফতোয়ার উদ্ধৃতি’ শিরোনামের অধীনে উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ। শাফেয়ী মাযহাবের হলেও ইমাম বাগাবী ও ইমাম নববী রাহ. যেহেতু হাদীসের মুতাকাদ্দিমীন ব্যাখ্যাকারদের অন্তর্ভুক্ত তাই তাদের বক্তব্য আগে আনা হয়েছে।

তিন. ইমাম মাজদুদ্দীন ইবনে তাইমিয়া রাহ. (৬৫২ হি.)

তিনি মুনতাকাল আখবারএ এসংক্রান্ত একটি অধ্যায় রচনা করেছেন। অধ্যায়ের শিরোনাম হলÑ

باب أن البدنة من الإبل والبقر عن سبع شياه وبالعكس

অধ্যায় : বাদানা উটগরুর প্রকার থেকে। আর উটগরু প্রত্যেকটি সাতটি ছাগলের স্থলাভিষিক্ত। অনুরূপ বিপরীত দিক থেকেও (অর্থাৎ সাতটি ছাগলও একটি উট বা গরুর স্থলাভিষিক্ত)। [মুনতাকাল আখবার ৫/১১৯ (নাইলুল আওতার)]

শিরোনামটির অর্থ পরিষ্কার। সাতটি ছাগল দ্বারা যেমনি সাতটি কুরবানী আদায় করা যায় তেমনি সাতটি ছাগল কুরবানী না করে এর পরিবর্তে একটি উট বা গরু দ্বারাও সাতটি কুরবানী আদায় করা যায়।  অনুরূপ একটি উট বা গরু দ্বারা সাতটি কুরবানী বা নুসুক আদায়ের নিয়ত করার পর উট বা গরু কুরবানী করার পরিবর্তে সাতটি ছাগলও কুরবানী করতে পারবে।

শিরোনামটিতে তিনি এক বা একাধিক ব্যক্তির উল্লেখই করেননি। বরং তিনি উট বা গরু কয়টি ছাগলের স্থলাভিষিক্তÑ তা ব্যক্ত করেছেন। যখন একটি উট বা গরু সাতটি ছাগলের স্থলাভিষিক্ত প্রমাণিত হয়ে গেল তো এটা স্বাভাবিক বিষয় যেসাতটি ছাগল দ্বারা যেমনি এক ব্যক্তি সাতটি কুরবানী আদায় করতে পারেতেমনি একটি উট বা গরু দ্বারাও সাতটি কুরবানী আদায় করতে পারবে। শিরোনামটির অধীনে তিনি যে রেওয়ায়েতগুলো এনেছেন তার দিকে লক্ষ করলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে আসে।

শিরোনামটির দলীল হিসাবে তিনি সহীহ মুসলিমমুসনাদে আহমাদসহ একাধিক হাদীস গ্রন্থ থেকে পাঁচটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছেন। এখানে কেবল তিনটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করা হল :

ক.

عن ابن عباس أن النبي  صلى الله عليه وسلم  أتاه رجل فقال: إن علي بدنة وأنا موسر ولا أجدها فأشتريها، فأمره  صلى الله عليه وسلم  أن يبتاع سبع شياه فيذبحهن.

খ.

وعن جابر قال: أمرنا رسول الله  صلى الله عليه وسلم أن نشترك في الإبل والبقر كل سبعة منا في بدنة. متفق عليه.

গ.

وعن حذيفة قال: شرك رسول الله  صلى الله عليه وسلم في حجته بين المسلمين في البقرة عن سبعة. رواه أحمد.

উল্লিখিত তিনটি বর্ণনার মধ্যে প্রথম বর্ণনাটিতে এক ব্যক্তির ওপর একটি উট জবাই করা আবশ্যক হওয়ার পর তার পক্ষে উট ব্যবস্থা করা সম্ভব না হওয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে এর পরিবর্তে সাতটি ছাগল জবাই করতে নির্দেশ করেছেন।

আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ণনা হলসাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে একটি উট বা গরু কুরবানী করা সংক্রান্ত। উল্লিখিত তিনটি রেওয়ায়েত থেকে তিনি  প্রমাণ করেছেন যেএকটি উটের পরিবর্তে যেমনি সাতটি ছাগল কুরবানী করা যায় তদ্রƒপ সাতটি ছাগলের পরিবর্তেও একটি উট কুরবানী করা যাবে।

ফিক্হফতোয়ার উদ্ধৃতি

মাবসূতসারাখসী

হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত ফকীহ ইমাম শামসুল আইম্মাহ সারাখসী রাহ.’ (মৃত্যু ৪৮৩ হি.) শরীকানা দম বা কুরবানী সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন যেএক ব্যক্তি একটি উট দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন নিয়তে বিভিন্ন দম বা কুরবানী আদায় করতে পারবে। এতে আমাদের ইমামদের কারো কোনো দ্বিমত নেই।

এ মাসআলাটি ব্যক্ত করতে গিয়ে প্রথমে তিনি শরীকানা কুরবানী বিষয়ক এমন একটি মাসআলা উল্লেখ করেনযাতে ইমাম যুফার রাহ.এর সাথে ইমাম আবু হানীফা রাহ.ইমাম আবু ইউসুফ রাহ. ও ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.এর ইখতিলাফ রয়েছে। মাসআলাটি উল্লেখ করার পর তিনি ইমাম যুফার রাহ.এর মত খণ্ডন করতে গিয়ে বলেনÑ

(قال): فأما إذا نووا القربة، ولكن اختلف جهات قصدهم فعلى قول زفر رحمه الله تعالى لا يجوز أيضا؛ لأن إراقة الدم لا يتبعض فلا تسع فيها الجهات المختلفة، ولكنا نقول قصد الكل التقرب فكانت الإراقة لله خالصا فلا يعتبر فيه اختلاف الجهات بعد ذلك، ألا ترى أن الواحد إذا وجبت عليه دماء من جهات مختلفة فنحر بدنة ينوي عن ذلك كله أجزأه فكذلك الشركاء.

সকল শরীক যদি আল্লাহ্র সন্তুষ্টির নিয়তে কুরবানী করেকিন্তু তাদের নিয়ত থাকে বিভিন্ন প্রকারের (যেমনঈদুল আযহার কুরবানীহজ্বের কুরবানীজরিমানা দম ইত্যাদি) তাহলে ইমাম যুফার রাহ.এর নিকট তা জায়েয হবে না। কারণ হলজবাই যেহেতু একটিই হয় (ভিন্ন ভিন্ন হয় না)তাই এখানে বিভিন্ন প্রকারের নিয়ত হতে পারে না।

কিন্তু এর উত্তরে আমরা বলবশরীকদের সকলেরই নিয়ত যেহেতু আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনতাই জবাইটা একমাত্র আল্লাহ্র জন্যই নির্ধারিত। সুতরাং উক্ত উদ্দেশ্যের পর শরীকদের বিভিন্ন প্রকারের নিয়ত এক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না। আপনি কি লক্ষ করেননি কোনো ব্যক্তিযার ওপর বিভিন্ন ধরনের দম (পশু জবাই) আবশ্যক হয়েছে। সে যদি এ সবগুলোর জন্য একটি উট জবাই করে তাহলে একটি উট দ্বারা সবগুলো দম আদায় হয়ে যায়। অনুরূপভাবে শরীকরাও একটি উট বা গরুতে বিভিন্ন প্রকার কুরবানীর নিয়ত করলেও তা আদায় হবে।’ Ñমাবসূত সারাখসী৪/১৪৪

উপরোক্ত মাসআলাটি তিনি হজ্বের অধ্যায়েÑ

ساق بدنة لا ينوي بها الهدي.

Ñশিরোনামের অধীনে উল্লেখ করেছেন।

ইমাম সারাখসী রাহ.এর উক্ত বক্তব্য আলোচিত মাসআলার ক্ষেত্রে এতটাই স্পষ্ট যেতা আর ব্যাখ্যা করে বুঝানোর প্রয়োজন নেই। এতে স্পষ্টই উল্লেখ আছে যেএক ব্যক্তির জন্য একটি উট দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন নিয়তে একাধিক দম আদায় বা কুরবানী করা জায়েয এবং এর দ্বারা তার নিয়ত অনুযায়ী সবগুলো কুরবানীই আদায় হয়ে যাবে। এটি মাযহাবের ইমামদের সর্বসম্মত মত। এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই। খোদ ইমাম যুফার রাহ.এরও নয়।           

ইমাম সারাখসী রাহ.এর উপস্থাপন ভঙ্গি থেকে আরও যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে আসে তা হলএ মাসআলাটি মাযহাবের স্বতঃসিদ্ধ ও স্বীকৃত এবং মুত্তাফাক আলাইহি’ মাসআলা। মাযহাবের ইমামদের কারও এ ব্যাপারে দ্বিমত নেই। ইমাম সারাখসী রাহ. এ মাসআলার মাধ্যমে ইমাম যুফার রাহ.এর বক্তব্য খণ্ডন করে বলেছেন যেআপনি তো এ মাসআলায় Ñঅর্থাৎ এক ব্যক্তি একটি বড় পশুতে ভিন্ন ভিন্ন নিয়তে কুরবানী করা’Ñ সহমত পোষণ করেনকিন্তু শরীকের মাসআলায় ভিন্নমত পোষণ করেনএর কারণ কীঅথচ এ দুয়ের মাঝে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই।

ইমাম সারাখসী রাহ.এর ينوي عن ذلك كله বক্তব্য থেকে আরো যে বিষয়টি পরিষ্কার হয় তা হলএকটি বড় পশু অর্থাৎ উট বা গরুতে কুরবানীদাতা এক থেকে নিয়ে সাত পর্যন্ত قربةএর (অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনমূলক) যা নিয়ত করবে সে অনুযায়ী তার কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। পশুর মালিকের নিয়তটাই এখানে মূল বিষয়। এর বিপরীতে ফকীহগণ থেকে এমন কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় নাযাতে বলা হয়েছে যেএক ব্যক্তি একাধিক নিয়ত করলেও নিয়ত ধর্তব্য হবে না। সুতরাং উক্ত উর্দু ফাতাওয়ায় যে দাবি করা হয়েছেÑ ‘হাদীস ও ফিকহে এর কোনোই দলীলপ্রমাণ নেই’Ñ তা যে সম্পূর্ণ খণ্ডিত মুতালাআ ও অনুমাননির্ভর কথাÑ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইমাম সারাখসী রাহ. (৪৮৩ হি.) মাজদুদ্দীন ইবনে তাইমিয়া রাহ.ইমাম বাগাবী রাহ. ও নববী রাহ.এরও আগের মানুষ এবং হানাফী মাযহাবের গোড়ার দিকের ইমাম। যার আলমাবসূত কিতাবটি পরবর্তী ফিকহী কিতাবগুলোর مرجع তথা ভিত্তিও বটে। এ মাসআলা অন্যদের আগেই তিনি আলোচনা করেছেন। মূলত এ মাসআলার ইশারা তো জাহিরুর রিওয়ায়েত থেকেই পাওয়া যায়। যেমন ইমাম হাকেম শহীদ রাহ.এর কাফী’, যা মূলত কিতাবুল আছল’-এর মুখাতাসার। তাতে উল্লেখ হয়েছেÑ

وإذا بلغ الصيد جزورا فهو أحب إلي من أن يشتري بقيمته أغناما و إن اشترى أغناما و ذبحها و تصدق بها أجزأه.

যখন ইহরাম অবস্থায় শিকার করা প্রাণীর মূল্য উট পর্যন্ত পেঁৗছে যায় তখন আমার নিকট (সাতটি) ছাগল ক্রয় করার পরিবর্তে একটি উট ক্রয় করা উত্তম। আর যদি (সাতটি) ছাগল ক্রয় করে এবং তা জবাই করে সদকা করে দেয় তবে তাতেও হয়ে যাবে। [আলকাফীহাকেম শহীদ রাহ.পৃ ৪৯ (মাখতুত)]

একটি উটের পরিবর্তে যখন সাতটি ছাগল দেয়া যায় তাহলে এটা সহজেই অনুমেয় যে সাতটি ছাগল ওয়াজিব হলে একটি উট বা গরুও কুরবানী করা যাবে। এ দুয়ের মাঝে কোনোই পার্থক্য নেই।

ومن ادعى الفرق فعليه البرهان.

উদ্দাতুল মুফতী (عدة المفتي)ইমাম সদরুশ শহীদ রাহ. (৫৩৬ হি.)

ইমাম সদরুশ শহীদ রাহ. হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত ফকীহ ও ইমাম। ফিকহে হানাফীর ওপর তার সুপ্রসিদ্ধ বহু রচনা আছে। যেমন শরহুল জামিইস সগীরশরহু আদাবিল কাযী লিল খাসসাফউমদাতুল ফাতাওয়া প্রভৃতি। তাঁর আরেকটি কিতাব হল উদ্দাতুল মুফতী। যার আলোচনা বিনায়া শরহুল হিদায়াতেহাশিয়াতুশ শিলবীতে এবং আলবাহরুর রায়েক প্রভৃতি কিতাবে রয়েছে। কিতাবটি প্রকাশিত নয়বরং তা পাণ্ডুলিপি আকারে বিভিন্ন মাকতাবায় সংরক্ষিত আছে। আমরা এখানে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের ফয়যুল্লাহ আফেন্দীর’ নুসখা থেকে আলোচ্য বিষয়ের সুস্পষ্ট একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি। ইমাম সদরুশ শহীদ রাহ. উদ্দাতুল মুফতী’-এর কিতাবুল উযহিয়্যাহ্য় বলেনÑ

رجل وجب عليه جزاء الصيد ودم الكفارة و دم الإحصار ودم المتعة ودم القران والأضحية فنحر جزورا أو ذبح بقرة بنية الكل جاز والله أعلم.

এক ব্যক্তির উপর (ইহরাম অবস্থায় শিকারের কারণে) শিকারের দমকাফফারার দমইহসারের দমতামাত্তুর দমকিরানের দম এবং কুরবানী আবশ্যক হয়েছে। এ সবগুলোর জন্য নিয়ত করে সে একটি উট বা গরু জবাই করেছেতা জায়েয আছে। আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক জ্ঞাত। [উদ্দাতুল মুফতীপৃষ্ঠা ২৮ (মাখতুত)]

ইমাম সদরুশ শহীদ রাহ.এর বক্তব্য মাবসূতের বক্তব্য থেকেও পরিষ্কার। এখানে তিনি প্রত্যেকটা দম ও নুসুকের পৃথক পৃথক নামও স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন এবং উযহিয়্যাহ অর্থাৎ দশ যিলহজ্বের কুরবানীর কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। সদরুশ শহীদ রাহ. পরিষ্কার ভাষায়ই  বলেছেন যেএক ব্যক্তির একটি উটে কুরবানীসহ বিভিন্ন ধরনের দমের নিয়ত করা যায় এবং এর দ্বারা সবগুলো কুরবানী ও দম  আদায় হয়ে যায়। পশুর মালিকের নিয়তই মূল বিষয়। সদরুশ শহীদ রাহ.এর উপরোক্ত বক্তব্য থেকেও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, ‘একটি পশুতে এক ব্যক্তির জন্য একের অধিক নিয়ত গ্রহণযোগ্য হবে না’Ñ এ ধরনের কথা ঠিক নয়।

খিযানাতুল মুফতীন

হিজরী অষ্টম শতাব্দীর বিখ্যাত ফকীহ হুসাইন ইবনে মুহাম্মাদ সামানকানী রাহ.। তার রচিত কিতাব  খিযানাতুল মুফতীন। ফিকহে হানাফীর নির্ভরযোগ্য কিতাব। পরবতীর্ প্রায় সকল কিতাবেই খিযানাতুল মুফতীনের হাওয়ালা পাওয়া যায়। আল্লামা শামী রাহ. তো ব্যাপকভাবে কিতাবটি থেকে মাসআলা উল্লেখ করতে থাকেন। এ কিতাবটিও মুদ্রিত নয়। তবে এর পাণ্ডুলিপি বিভিন্ন মাকতাবায় সংরক্ষিত আছে। কিতাবটিতে কুরবানীর অধ্যায়ে লেখা হয়েছেÑ

ولو نذر بشاة يجزئه البقر والشاة أفضل من سبع البقرة إن استويا في اللحم والقيمة والبقرة أفضل من ست شياه إذا استويا وإذا وجب سبع شياه فهي أفضل من البقرة و إن ضحى البقرة عنها جاز،والشاة السمينة جدا أفضل من شاتين وإن ساوتا في القيمة

যদি কোনো ব্যক্তি একটি ছাগল কুরবানীর মান্নত করে তবে একটি গরু কুরবানী করাও যথেষ্ট হবে। আর একটি ছাগল একটি গরুর সপ্তমাংশ হতে উত্তমযদি উভয়টি গোশত ও মূল্যের দিক থেকে সমান হয়। আর একটি গরু ছয়টি ছাগল হতে উত্তমযদি উভয়টি গোশত ও মূল্যের দিক থেকে সমান হয়। আর যখন সাতটি ছাগল ওয়াজিব হবে তখন একটি গরু কুরবানী করার চেয়ে সাতটি ছাগল কুরবানী করা উত্তমঅবশ্য যদি এর পরিবর্তে কেউ একটি গরু কুরবানী করে তবে তাও জায়েয হবে। আর একটি হৃষ্টপুষ্ট ছাগল দুটি ছাগল হতে উত্তম হবেযদি উভয়টির মূল্য বরাবর হয়। Ñখিযানাতুল মুফতীনপৃষ্ঠা ৫৯০ (মাখতূত)

খিযানাতুল মুফতীনের আলোচনা থেকেও প্রমাণিত যেএকজন ব্যক্তি একটি উট বা গরুতে সাত নিয়তে সাতটি কুরবানী বা অন্য যে কোনো দম আদায় করতে পারবে। এতে কোনো অসুবিধা নেই।

এক ব্যক্তি একটি উট বা গরুতে যে একাধিক অংশ রাখতে পারে এবং এর দ্বারা প্রতিটি অংশের ভিন্ন ভিন্ন কুরবানী আদায় হতে পারে তার আরেকটি নযীর হলকুরবানীর পশু কেনার পর তাতে শরীক নেয়ার বিশেষ একটি মাসআলা।

মাসআলাটি হলকোনো ব্যক্তি একটি গরু ক্রয় করেছেÑ তা দ্বারা সে নিজের ওয়াজিব কুরবানী আদায় করবে। কিন্তু পরবর্তীতে সে তাতে ছয়জন শরীক নেয়। এক্ষেত্রে মাসআলা হলনিজে কুরবানী করার নিয়তে গরু কেনার পর ঐ গরুতে শরীক নেয়া ঠিক নয়। তথাপি শরীক নিলেও তার ঐ এক অংশ দ্বারা ওয়াজিব কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু এক্ষেত্রে যেহেতু সে কেনার সময় পুরো গরু দ্বারা নিজে কুরবানী করার নিয়ত করেছিল তাই তাকে কি বাকি ছয় অংশের কুরবানী করতে হবেকারণ একটি গরু তো সাতটি ছাগলের স্থলাভিষিক্ত।

এ ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম খাহার যাদাহ রাহ. বলখের মাশায়েখের বরাতে উল্লেখ করেছেন যেএক্ষেত্রে এ ব্যক্তি অন্য কারো সাথে মিলে প্রথমটির মূল্যমান অনুযায়ী একটি গরু ক্রয় করবে এবং এতে সে ছয় ভাগ নেবে এবং ঐ গরু কুরবানী করবে। অথবা ছয়টি ছাগল ক্রয় করবে এবং কুরবানী করবে।

এ সম্পর্কিত আলমুহীতুল বুরহানীর বক্তব্য লক্ষ করুনÑ

وإذا اشترى الرجل بقرة أو بعيراً يريد أن يضحي بها عن نفسه، ثم أشرك فيها ستة بعد ذلك، القياس: أن لا يجزئهم، ويصير الكل لحماً، وفي الاستحسان: يجزئهم؛ لأن البقرة قائمة مقام سبع شياه، وكذلك البدنة فصار شراؤها بنية الأضحية كشراء سبع شياه، ومن اشترى سبع شياه بنية الأضحية، ثم باع ستاً منها، وضحى بالسابعة، وضحى المشترون بالست جاز عن الكل؛ كذا ههنا، فإذا جاز عنه، وعن شركائه هل يلزمه الذبح بستة الأسباع التي باعها ما بقي الوقت، والتصدق بقيمتها بعد فوات الوقت؟ لم يذكر هذا الفصل في الكتاب .

قال شيخ الإسلام المعروف بخواهر زاده: حكي عن مشايخ بلخ أنهم قالوا: عليه الذبح بستة أسباع بقرة مثل الأولى في القيمة يشتري مع غيره، فيذبح أو يشتري ست شياه، ويذبح إن كانت قيمته ست أسباع البقرة غنياً كان أو فقيراً، وهذا لما ذكر بأن شراء البقرة بمنزلة شراء سبع شياه.

Ñআল মুহীতুল বুুরহানী ৮/৪৭৭

মুহীতের বক্তব্যÑ

عليه الذبح بستة أسباع بقرة مثل الأولى في القيمة يشتري مع غيره، فيذبح أو يشتري ست شياه ويذبح.

এ ব্যক্তির উপর কর্তব্য হলপ্রথম গরুর মূল্যমান অনুযায়ী একটি গরু অন্যের সাথে মিলে ক্রয় করা অতঃপর তাতে ছয় ভাগ নিয়ে জবাই করা। অথবা ছয়টি ছাগল ক্রয় করে জবাই করা।

এবং শেষোক্ত কথা أن شراء البقرة بمنزلة شراء سبع شياه. (একটি গরু ক্রয় করা মানে সাতটি ছাগল ক্রয় করা) এক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। এতে তিনি ঐ ব্যক্তির জন্য একটি গরুতে ছয়টি অংশ রাখার কথা বলেছেন। আবার তার এ সুযোগও রয়েছে যেসে গরুর ছয় অংশের মূল্যমানের ছয়টি ছাগল ক্রয় করে জবাই করবে। শাইখুল ইসলাম খাহার যাদাহ রাহ.এর মতে এত বড় ফকীহ তিনি একটি গরুতে এক ব্যক্তির জন্য ছয়টি অংশ রাখার কথা মাশায়েখে বলখ থেকে উদ্ধৃত করছেন। অতঃপর ছাহেবে মুহীত বুরহানুদ্দীন ইবনে মাযাহ রাহ. এ মাসআলার ইল্লত তথা কারণ ব্যক্ত করছেন এই বলে যেএকটি গরু ক্রয় করা সাতটি ছাগল ক্রয়তুল্য। এত স্পষ্ট ও যুক্তিযুক্ত বক্তব্য থাকার পরও একথা বলা যে, ‘এক ব্যক্তির জন্য একটি পশুতে একাধিক নিয়ত গ্রহণযোগ্য নয়’ এবং ফিক্হফতোয়ার কিতাবে এর কোনোই প্রমাণ নেই’Ñ সম্পূর্ণ বাতিল কথা। (আরও দ্রষ্টব্য: আল বিনায়াআইনী ১৪/৩৫৯)

এ মাসআলা অর্থাৎ সাতটি ছাগলের পরিবর্তে একটি গরু বা উট কুরবানী করা জায়েয শুধু হানাফী মাযহাবেই আলোচিত হয়েছে তা নয়বরং অন্যান্য মাযহাবেও সুস্পষ্টভাবে আলোচিত হয়েছে। যেমনÑ

হাম্বলী মাযহাব

হাম্বলী মাযহাবের বিখ্যাত ফকীহ ইমাম ইবনে কুদামা রাহ. আলকাফী ফী ফিকহিল ইমাম আহমাদ’ গ্রন্থে লেখেনÑ

ومن وجب عليه بدنة بنذر، أو قتل نعامة، أو وطء أجزأه بسبع من الغنم؛ لأنها معدولة بسبع… فأما من وجب عليه سبع من الغنم، فإنه يجزئه بدنة، أو بقرة؛ لأنها تجزئ عن سبع في حق سبعة، ففي حق واحد أولى

فصل: ومن وجبت عليه بقرة، أجزأته بدنة: لأنها أكثر لحما وأوفر. ويجزئه سبع من الغنم؛ لأنها تجزئ عن البدنة، فعن البقرة أولى.

যে ব্যক্তির ওপর মান্নতের কারণে বা পাখি হত্যার কারণে অথবা স্ত্রী সহবাসের কারণে একটি উট কুরবানী করা আবশ্যক হয় তার জন্য এর পরিবর্তে সাতটি ছাগল কুরবানী করাও যথেষ্ট হবে। কেননা একটি উট সাতটি ছাগলের স্থলাভিষিক্ত।… পক্ষান্তরে যার ওপর সাতটি ছাগল আবশ্যক হয় তার জন্য একটি উট বা গরু কুরবানী করাও যথেষ্ট হবে। কারণ উট বা গরু যখন সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে সাতটি দম আদায়ের ক্ষেত্রে যথেষ্ট হয় তাহলে এক ব্যক্তির ক্ষেত্রে যথেষ্ট হওয়াটা অধিক যুক্তিযুক্তÑ তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। (আলকাফী ফী ফিকহিল ইমাম আহমাদইবনে কুদামা ১/৫৪২৫৪৩)

হাম্বলী মাযহাবের প্রসিদ্ধ বহু  কিতাবেই এ মাসআলা আলোচিত হয়েছে।

শাফেয়ী মাযহাব

শাফেয়ী মাযহাবে এ মাসআলাটি একাধিক কিতাবে সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ হয়েছে। ইমাম নববী রাহ. আলমাজমূ শরহুল মুহাযযাবে লেখেনÑ

ويجوز أن ينحر الواحد بدنة أو بقرة عن سبع شياه لزمته بأسباب مختلفة كتمتع وقران وفوات ومباشرة ومحظورات في الإحرام ونذر التصدق بشاة مذبوحة والتضحية بشاة.

যে ব্যক্তির উপর বিভিন্ন কারণে সাতটি ছাগল ওয়াজিব হয়েছিলতার জন্য সাতটি ছাগলের পরিবর্তে একটি উট বা গরু কুরবানী করা জায়েয আছে। যেমন তামাত্তুর দমকিরানের দমহজ¦ ছুটে যাওয়ার কারণে দমস্ত্রী সহবাসের কারণেইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ করার কারণেছাগল জবাই করে তা সদকা করে দেয়ার মান্নতরে কারণেছাগল দ্বারা কুরবানী করার মান্নতের কারণে। Ñআলমাজমূ শরহুল মুহাযযাব ৮/৩৭০

খতীব শিরবীনী রাহ. এ কথাটি আরো স্পষ্টভাবে মুগনিল মুহতাজ’-এ উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনÑ

تنبيه: لا يختص إجزاء البعير والبقرة عن سبعة بالتضحية، بل لو لزمت شخصا سبع شياه بأسباب مختلفة كالتمتع والقران والفوات ومباشرة محظورات الإحرام جاز عن ذلك بعير أو بقرة.

বিশেষভাবে লক্ষণীয় : একটি উট এবং একটি গরু সাতজনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হওয়াÑ এটা কেবল কুরবানীর সাথে সীমাবদ্ধ নয়বরং কোনো ব্যক্তির ওপর যদি বিভিন্ন কারণে সাতটি ছাগল আবশ্যক হয়যেমন তামাত্তুকিরানহজ্বের ইহরাম করার পর হজ্ব ছুটে যাওয়াইহরামপরিপন্থী কাজ করাÑ এসবের পরিবর্তে একটি উট বা গরু জবাই করাও জায়েয। Ñমুগনিল মুহতাজ ৪/৩৫৯

উপরোক্ত হাদীস ও ফিক্হবিদগণের বক্তব্যের আলোকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলযেমনিভাবে একটি উট বা গরু দ্বারা সাত শরীকের সাতটি কুরবানী আদায় করা যায় তেমনি এক ব্যক্তিরও একটি উট বা গরু দ্বারা এক থেকে নিয়ে সাতটি পর্যন্ত কুরবানী আদায় করা জায়েয। এতে মাযহাবের ইমামদের কোনোও দ্বিমত নেই। মূল বিষয় হলকুরবানীদাতার নিয়ত। সে যে নিয়ত করবেসে অনুযায়ী আদায় হবে।

একটি উট বা গরুতে ওয়াজিব কুরবানীর সাথে নফল কুরবানীআকীকাঈসালে সওয়াবের অংশ রাখা

আলআজনাসনাতিফী

পঞ্চম শতাব্দীর বিখ্যাত ফকীহ ইমাম আবুল আব্বাস নাতিফী রাহ. (৪৪৬ হি.) একটি গরুতে নিজের ওয়াজিব কুরবানীর সাথে নফল অংশ রাখা যায়Ñ তা সুস্পষ্টভাবেই ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেনÑ

فإذا اشترى رجل أضحيته ثم أشرك فيها ستة أجزأت عنهم وصار كأنه أوجب سبعها و ستة أسباعها يتطوع به.

যখন এক ব্যক্তি তার কুরবানীর পশু ক্রয় করে অতঃপর এতে ছয় ব্যক্তিকে শরীক করে সেক্ষেত্রে সকলের কুরবানী আদায় হয়ে যায়। এটি যেন এমন যেকোনও ব্যক্তি একটি গরু ক্রয় করে তার এক সপ্তমাংশ দ্বারা ওয়াজিব কুরবানী  আদায়ের নিয়ত করেছে আর বাকি ছয় ভাগ দ্বারা নফল আদায়ের নিয়ত করেছে। Ñআল আজনাসনাতিফী ১/৫২০

নাতিফী রাহ.এর বক্তব্যÑ

وصار كأنه أوجب سبعها و ستة أسباعها يتطوع به.

(এটি যেন এমন যেকোনও ব্যক্তি একটি গরুতে এক সপ্তমাংশ দ্বারা ওয়াজিব কুরবানী আদায়ের নিয়ত করেছে আর বাকি ছয় ভাগ দ্বারা নফল আদায়ের নিয়ত করেছে।) একদমই পরিষ্কার। এতে স্পষ্ট ভাষায়ই বলা হয়েছে যেএক ব্যক্তির জন্য (একটি উট বা গরুতে) ওয়াজিব কুরবানীর সাথে নফল কুরবানীর নিয়ত করা যায় এবং এর দ্বারা ওয়াজিব নফল সবই আদায় হয়ে যায়।

নাতিফী রাহ.এর উপস্থাপনভঙ্গি থেকেও সহজে বুুঝে আসেএ মাসআলাও ফিক্হবিদগণের নিকট এতটাই স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত যেতাঁরা তা পৃথক কোনো শিরোনামে বা  পৃথকভাবে উল্লেখ করার প্রয়োজনই বোধ করেননি। যেমনটি এখানেই দেখা গেল। নাতিফী রাহ. ওয়াজিবের সাথে নফল অংশ রাখার মাসআলাটি প্রসঙ্গক্রমে অন্য মাসআলার নযীর হিসাবে উল্লেখ করেছেন।

আর যখন ওয়াজিবের সাথে নফল অংশ রাখা প্রমাণিত হয়ে গেল তাহলে ওয়াজিব কুরবানীর সাথে আকীকার অংশ রাখা জায়েযÑ তাও আবশ্যিকভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল। কেননা আকীকাও এক প্রকার কুরবানী। হাদীস শরীফে আকীকার উপর নুসুক’ শব্দের প্রয়োগ  হয়েছে। যেমন নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত মুসনাদে আহমাদের একটি দীর্ঘ হাদীসে এসেছেÑ একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আকীকা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেনÑ

مَنْ أَحَبَّ أَنْ يَنْسُكَ عَنْ وَلَدِهِ، فَلْيَنْسُكْ عَنْهُ عَنِ الْغُلَامِ شَاتَانِ مُكَافَأَتَانِ، وَعَنِ الْجَارِيَةِ شَاةٌ.

যে ব্যক্তি তার সন্তানের পক্ষ থেকে নুসুক আদায় করতে চায় সে যেন তা করে। ছেলের পক্ষ থেকে দুটি ছাগল আর মেয়ের পক্ষ থেকে একটি ছাগল। Ñমুসনাদে আহমাদহাদীস ৬৭১৩

আর এখানে নুসুক অর্থ কুরবানী। সুতরাং আকীকা যখন এক প্রকারের কুরবানীতাই যেমনিভাবে একাধিক কুরবানী পৃথক পৃথক পশু দ্বারা আদায় করা যায় আবার তা একটি উট বা গরু দ্বারাও  আদায় করা যায়তেমনি আকীকাও পৃথক পৃথক পশু দ্বারা আদায় করা যাবে আবার একটি উট বা গরু দ্বারাও আদায় করা যাবে।

সুতরাং একথা বলার কোনোই সুযোগ নেই যেএক পশুতে একই ব্যক্তির  জন্য ওয়াজিব কুরবানীর সাথে আকীকা বা ঈসালে সওয়াবের অংশ রাখা যাবে না।

(এ সম্পর্কে জানার জন্য আরও দেখুন : মাসিক আলকাউসারজানুয়ারি ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত দুটি প্রশ্ন ও তার উত্তর : ইয়াওমে আরাফার রোযা ও কুরবানীর সাথে আকীকা’ শিরোনামে মাওলানা যাকারিয়া আব্দুল্লাহ ছাহেবের প্রবন্ধটি)

আলআশবাহ ওয়ান নাযাইর

আল্লামা ইবনে নুজাইম রাহ. (৯৭০ হি.) সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে আলআশবাহ ওয়ান নাযাইরএ আলোচনা করেছেন। তিনি তাতে প্রমাণ করেছেন যেএক ব্যক্তির জন্য একটি গরুতে ওয়াজিব অংশের সাথে নফলের নিয়ত করা যাবে এবং তার নিয়ত অনুযায়ী তা আদায় হবে। আলআশবাহ ওয়ান নাযাইরএ الفن الثالث: الجمع و الفرق –এর অধীনে الفروق অধ্যায়ে তিনি বলেনÑ

قاعدة: إذا أتى بالواجب وزاد عليه هل يقع الكل واجبا أم لا؟

قال أصحابنا رحمهم الله تعالى: لو قرأ القرآن كله في الصلاة وقع فرضا ولو أطال الركوع والسجود فيها وقع فرضا. واختلفوا فيما إذا مسح جميع رأسه. فقيل: يقع الكل فرضا، والمعتمد وقوع الربع فرضا والباقي سنة، واختلفوا في تكرار الغسل. فقيل: يقع الكل فرضا، والمعتمد أن الأولى فرض والثانية مع الثالثة سنة مؤكدة. ولم أر الآن ما إذا أخرج بعيرا عن خمسة من الإبل. هل يقع فرضا أو خُمُسَه

وأما إذا نذر ذبح شاة فذبح بدنة، ولعل فائدته في النية: هل ينوي في الكل الوجوب أو لا؟ وفي الثواب هل يثاب على الكل ثواب الواجب أو ثواب النفل فيما زاد؟

ثم رأيتهم قالوا في الأضحية كما ذكره ابن وهبان معزيا إلى الخلاصة: الغني إذا ضحى بشاتين وقعت واحدة منهما فرضا والأخرى تطوع؛ وقيل الأخرى لحما (انتهى)

যখন কোনো ব্যক্তি ওয়াজিব (পরিমাণ) আদায় করল এবং সাথে আরও অতিরিক্ত আদায় করল সেক্ষেত্রে পুরোটাই কি ওয়াজিব হিসাবে আদায় হবেনাকি আদায় হবে না?

আমাদের ফকীহগণ বলেনযদি কেউ নামাযে পুরো কুরআন মাজীদ পাঠ করে তাহলে পুরোটাই ফরয হিসেবে গণ্য হবে। আর যদি রুকুসিজদা (ফরয পরিমাণের চেয়ে) দীর্ঘ করে তবে রুকুসিজদা পুরোটাই ফরয হিসাবে আদায় হবে। আর ফুকাহায়ে কেরাম দ্বিমত পোষণ করেনযখন কোনো ব্যক্তি পুরো মাথা মাসেহ করে নেয়। কেউ বলেছেন পুরোটাই ফরয হবে। কিন্তু নির্ভরযোগ্য মত হলমাথার চার ভাগের এক ভাগ ফরয হিসাবে আদায় হবে আর বাকিটা সুন্নত হবে। অনুরূপ তারা দ্বিমত পোষণ করেন অযুর অঙ্গ তিনবার ধোয়ার ক্ষেত্রেও। কেউ বলেনপুরোটাই ফরয হবেকিন্তু নির্ভরযোগ্য কথা হলপ্রথম বারের ধোয়া ফরয হিসাবে আদায় হবে আর দ্বিতীয়তৃতীয় বার ধোয়া সুন্নাতে মুআক্কাদা হবে।

(ইবনে নুজাইম রাহ. বলেন,) আমি এখনও পর্যন্ত কিতাবে পাইনি যেকোনো ব্যক্তি যখন পাঁচটি উটের যাকাত হিসাবে একটি উট আদায় করবে তখন কি পুরোটাই ফরয গণ্য হবেনাকি তার এক পঞ্চমাংশ ফরয হিসাবে গণ্য হবে।

আর (এটিও পাইনি)যে ব্যক্তি একটি ছাগল জবাই করার মান্নত করল অতঃপর সে একটি উট জবাই করল (পুরোটা কি ওয়াজিব হিসাবে আদায় হবেনাকি এক সপ্তমাংশ)। (তিনি বলেন,) সম্ভবত ওয়াজিবের অতিরিক্ত জবাই করার ফায়েদা প্রকাশ পাবে নিয়তের ক্ষেত্রে। সে কি পুরোটার মধ্যে ওয়াজিবের নিয়ত করবেনাকি করবে না। অনুরূপ সাওয়াবের ক্ষেত্রেও উক্ত বিশ্লেষণ কার্যকর হবে। (অর্থাৎ পুরোটার মধ্যে কি ওয়াজিবের সাওয়াব প্রাপ্ত হবেনাকি ওয়াজিবের অতিরিক্ত অংশে নফলের সাওয়াব প্রাপ্ত হবে)?… অতঃপর ফকীহগণকে দেখতে পেলামতারা কুরবানীর ক্ষেত্রে বলেছেনধনী ব্যক্তি যখন দুটি ছাগল কুরবানী করবে সেক্ষেত্রে একটি ওয়াজিব হিসাবে আদায় হবে অপরটি নফল হিসাবে আদায় হবে। আর কেউ বলেছেন দ্বিতীয়টি কুরবানী হবে নাবরং গোশতের জন্য সাধারণ জবাই হবে। Ñআলআশবাহ ওয়ান নাযাইরপৃষ্ঠা ৪৪৯৪৫০

ইবনে নুজাইম রাহ.এর উপরোক্ত বক্তব্যের সারকথা হলএকটি বড় পশুতে কুরবানীদাতা ওয়াজিব অংশের অতিরিক্ত অংশের ক্ষেত্রে যে নিয়ত করবে সে অনুযায়ীই আদায় হবে। সুতরাং তিনি যদি নফলের নিয়ত করেন তাহলে অতিরিক্ত অংশ দ্বারা নফল আদায় হবে।

লক্ষ করার বিষয় হলতিনি তার উক্ত বক্তব্যের সমর্থনে এক ব্যক্তির দুটি ছাগল কুরবানী করা সংক্রান্ত ইবারত পেশ করেছেনযে ইবারতে একটি ছাগল ওয়াজিব কুরবানী হিসাবে এবং অপরটি  নফল হিসাবে আদায় হওয়ার কথা ব্যক্ত হয়েছে। তিনি একটি বড় পশুতে একই ব্যক্তির দুটি অংশের এক অংশ ওয়াজিব আর অপর অংশ নফল গণ্য হওয়ার দলীল পেশ করেছেন এক ব্যক্তির দুটি ছাগল কুরবানী করা সংক্রান্ত বক্তব্য দ্বারা। অথচ তাঁর নিকট যদি আজনাসের উক্ত বক্তব্য সামনে থাকত তবে তো আর এ কসরত করার দরকারই হতো না। তিনি সরাসরিই বলে দিতেন যেএক অংশ ওয়াজিব হবে আর বাকি অংশ নফল হবে।

এখানে প্রশ্ন হলউটের এক সপ্তমাংশের অতিরিক্ত অংশ নফল হবে কি নাÑ তিনি এখানে এ আলোচনার অবতারণা কেন করলেন?

এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে যদি একটি বড় পশু জবাই করার দ্বারা একটি মাত্রই কুরবানী হওয়া চূড়ান্ত কথা হয় যেমনটি উক্ত উর্দু ফতোয়া গ্রন্থে বলা হয়েছেতাহলে এ আলোচনা তো এখানে  ওঠারই কথা নয়।

মূলত এর কারণ হলসে তো মান্নত করেছে একটি ছাগলের আর আদায় করছে এমন একটি পশু দিয়েযা সাতটি ছাগলের স্থলাভিষিক্ত।  সুতরাং বাকি ছয় অংশের কী হবেপুরোটা কি ওয়াজিব গণ্য হবেনাকি এক অংশ ওয়াজিব হবে আর বাকিটা নফল।

তিনি উক্ত বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন এবং বলেছেন বাকি অংশে সে যে নিয়ত করবে সে অনুযায়ী আদায় হবে।

লক্ষ করার বিষয় হলইবনে নুুজাইম রাহ. একই ব্যক্তির একটি বড় পশু কুরবানীর করার ক্ষেত্রে এ হিসাব ধর্তব্য করেছেন এবং এর ওপর ভিত্তি করে শাখা মাসআলাও বের করেছেন। অন্যদিকে উর্দু ফতোয়া গ্রন্থটিতে দলীল খুঁজে না পাওয়ার অজুহাতে গ্রন্থকার বিপরীত মাসআলা আবিষ্কার করে বসে আছেন।

ফকীহগণ একটি পশুতে এক ব্যক্তির একাধিক অংশ রাখার মাসআলাকে সাধারণ একটি মাসআলা হিসাবেই আলোচনা করেছেন এমন নয়বরং তারা একে বিভিন্ন শাখা মাসআলায়ও প্রয়োগ করেছেন। এর প্রমাণ ফিকহের কিতাবাদিতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। যেমন :

এক. একটি বড় পশুতে নিজের ওয়াজিব কুরবানীর সাথে নাবালেগ সন্তানের অংশ রাখার মাসআলা

নাবালেগ সন্তানের পক্ষ থেকে পিতার জন্য কুরবানী আদায় করা মুস্তাহাব।

কিতাবুল আছলএ উদ্ধৃত হয়েছেÑ

قلت: فهل على الرجل إذا كان موسرا أن يضحي عن نفسه وعن ولده وهم صغار؟ قال: هو أحب إلي وأفضل من تركه.

আমি প্রশ্ন করলামব্যক্তি যদি ধনী হয় সে কি নিজের পক্ষ থেকে এবং তার শিশু সন্তানের পক্ষ থেকে কুরবানী করবেতিনি বললেনআমার নিকট তার পক্ষ থেকে কুরবানী না করার চেয়ে বরং করাটাই ভালো। Ñকিতাবুল আছল৫/৪০৭

ইমাম কাযী খান রাহ. বলেনÑ

وفي الولد الصغير عن أبي حنيفة رحمه الله تعالى روايتان، في ظاهر الرواية يستحب.

শিশু সন্তানের ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা রাহ. থেকে দুটি বর্ণনা রয়েছে। জাহিরুর রিওয়ায়াতএ শিশু সন্তানের পক্ষ হতে পিতার কুরবানী করা মুস্তাহাব। Ñফাতাওয়া কাযী খান ৩/৩৪৫

সন্তানের পক্ষ থেকে পিতা যে নফল কুরবানীদাতা ইমাম কাযী খান রাহ. তা কিতাবুল বুয়ূএ بيع الوصي وشراءه পরিচ্ছদে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনÑ

ولا يضحي عن الصبي في ظاهر الرواية وكذا الأب لا يضحي عن الصغير من مال الصغير فإن ضحى من مال نفسه يكون متبرعا.

জাহিরুর রিওয়ায়াতের ভাষ্যমতে শিশু সন্তানের পক্ষ থেকে পিতার কুরবানী করা লাগবে না। অনুরূপ পিতা শিশুর সম্পদ থেকে শিশুর পক্ষ থেকেও কুরবানী করবে না। যদি সে নিজের সম্পদ থেকে তার পক্ষ থেকে কুরবানী করেতবে সে নফল আদায়কারী হিসাবে গণ্য হবে। Ñফাতাওয়া কাযী খান ২/২৮৯

পিতার নিজ সম্পদ থেকে শিশু সন্তানের পক্ষ থেকে কুরবানী করা নফল দায়িত্ব। জাহিরুর রিওয়ায়াতের ভাষ্য অনুযায়ী ওয়াজিব নয়। এর ওপরই ফতোয়া। এ কুরবানীর মালিক পিতা নিজেই এবং তা নফল হিসাবেই আদায় হবে। এর গোশত পিতার মালিকানাধীন। হাঁসন্তান এর সওয়াব পাবে। যেমনিভাবে মৃতের পক্ষ থেকে তার ওসিয়ত ব্যতীত যদি কুরবানী করেঐ অংশের মালিক কুরবানীদাতাই হয় আর সওয়াব মৃতের নিকট পেঁৗছে।

ইবনুশ শিহনাহ রাহ. বলেনÑ

سئل نصير عن رجل ضحى عن الميت ماذا يصنع به قال يأكل منه ويصنع به ما يصنع بأضحيته. فقيل له: أيصير عن الميت؟ فقال: الأجر له والملك لهذا، فقيل له: فإن ضحى عن الصبي؟ فقال: الأجر له والملك لهذا الرجل.

وقال محمد بن سلمة مثل هذا، وقال محمد بن مقاتل مثل ذلك، وأبو مطيع مثله. وقال عصام بن يوسف: يتصدق بالكل.

ফকীহ নুসাইর ইবনে ইয়াহইয়া রাহ. (২৬৮ হি.)কে জিজ্ঞাসা করা হলএক ব্যক্তি মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করেছে। এ পশু কী করা হবেতিনি বললেনতা হতে খাওয়া হবে এবং নিজের কুরবানীর পশুর ক্ষেত্রে যা যা করা হতো এতেও তাই করা হবে। তাকে তখন প্রশ্ন করা হলকুরবানী কি মৃতের পক্ষ হতে ধরা হবেতিনি বললেনমৃত ব্যক্তি সওয়াবপ্রাপ্ত হবে আর মালিকানা কুরবানীদাতার থাকবে।

তাঁকে আবার প্রশ্ন করা হলযদি এ ব্যক্তি শিশুর পক্ষ হতে কুরবানী করেতিনি বললেনশিশু তার সওয়াব পাবে আর মালিকানা কুরবানীদাতার। মুহাম্মাদ ইবনে সালামাহ রাহ. এমনটিই বলেছেন। মুহাম্মাদ ইবনে মুকাতিল রাহ.ও এমনটিই বলেছেন। আবু মুতী‘ রাহ.ও এমনটিই বলেছেন। আর ইসাম ইবনে ইউসুফ রাহ. বলেছেনপুরোটা সদকা করে দিতে হবে। Ñলিসানুল হুককাম৩৮৯

উল্লিখিত ফকীহগণের মধ্যে আবু মুতী‘ রাহ. হলেন ইমাম আবু হানীফা রাহ.এর শাগরিদমুহাম্মাদ ইবনে মুকাতিল রাহ. হলেন ইমাম মুহাম্মাদ রাহএর শাগরিদ আর নুসাইর ইবনে ইয়াহইয়া রাহ. ও মুহাম্মাদ ইবনে সালামাহ রাহ. হলেন ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.এর বিশিষ্ট ছাত্র আবু সুলাইমান জুযাজানীর শাগরিদ। তাঁরা দ্ব্যর্থহীনভাবেই বলেছেননাবালেগ সন্তানের পক্ষ থেকে পিতার কুরবানী করা মুস্তাহাব। এ কুরবানীর মালিক পিতা নিজেই।

এখন আমরা প্রত্যক্ষ করবÑ একটি পশুতে পিতা নিজ ওয়াজিব কুরবানীর সাথে শিশু সন্তানের পক্ষ থেকে কুরবানীর অংশ রাখা সম্পর্কিত ফিকহী বক্তব্য।

একটি উট দ্বারা পিতার ওয়াজিব কুরবানী এবং শিশু সন্তানের পক্ষ থেকে নফল কুরবানী

ইমাম কাযী খান রাহ. বলেনÑ

و لو ضحى غني بدنة عن نفسه و عن ستة من أولاده ليس هذا في ظاهر الرواية، و قال الحسن بن زياد رحمه الله تعالى في كتاب الأضحية له: إن كان أولاده صغارا، جاز عنه وعنهم جميعا في قول أبي حنيفة و أبي يوسف رحمهما الله تعالى.

ধনী ব্যক্তি যদি একটি উট নিজের ও তার ছয় সন্তানের পক্ষ থেকে কুরবানী করে তার বিধান জাহিরুর রিওয়ায়াতে উল্লেখ হয়নি। হাসান বিন যিয়াদ রাহ. কিতাবুল উযহিয়্যাহএ বলেনযদি তার সন্তান ছোট হয় তাহলে পিতা ও সন্তান সকলের পক্ষ থেকে কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। Ñফাতাওয়া খানিয়া ৩/৩৫০

জামেউর রুমূযএ কাযী খানের উপরোক্ত বক্তব্য এভাবে এসেছেÑ

وفي الكلام إشعار بأنه لو ضحى عنه و عن ستة من أولاده وجعل لكل سبعا جاز، إلا أنه غير ظاهر الرواية.

আর উপরোক্ত কথা (অর্থাৎ একটি উট বা গরু এক ব্যক্তি থেকে নিয়ে সাত পর্যন্ত হতে পারে) এ কথার ইঙ্গিত বহন করে যেকোনো ব্যক্তি যদি (একটি উট বা গরু) নিজের পক্ষ থেকে এবং তার ছয় সন্তানের পক্ষ থেকে কুরবানী করে এবং প্রত্যেকের জন্য এক সপ্তমাংশ নির্ধারণ করেÑ তা জায়েয হবে। অবশ্য এটি জাহিরুর রিওয়ায়াতে উল্লেখ নেই। Ñজামেউর রুমূয ৩/৩৫৪

কুহেস্তানী রাহ. আরও বলেনÑ

وإن ضحى من مال نفسه فهو كأضحيته.

আর পিতা যদি নিজ সম্পদ থেকে কুরবানী করে তবে তা নিজ কুরবানীর মতই। Ñজামেউর রুমূয ৩/৩৫৬

ফখরুদ্দীন আফেন্দী রাহ. কুহেস্তানী রাহ.এর উল্লিখিত বক্তব্যের ব্যাখ্যায় লেখেনÑ

وإن ضحى أي الأب من مال نفسه للطفل فهو كأضحيته أي الأب مثلا.

আর যদি পিতা নিজ সম্পদ হতে শিশু সন্তানের জন্য কুরবানী করে তবে তা নিজের অর্থাৎ পিতার কুরবানীর মতই। Ñগাওয়াসুল বাহরাইন ৩/৩৫৬

এ মাসআলাটি ফিকহে হানাফীর অনেক কিতাবেই উল্লেখ হয়েছে। তাতে ফিক্হবিদগণ স্পষ্টতই বলেছেন যেপিতা নিজ কুরবানীর পশুতে শিশু সন্তানের পক্ষ থেকে অংশ রাখতে পারবে। আর পূর্বে ফকীহদের বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যেশিশু সন্তানের কুরবানীর অংশের মালিক পিতাই। সন্তান কেবল এ কুরবানীর সওয়াব পায়। যেহেতু এ কুরবানীর মালিক পিতা এবং এ অংশের কুরবানী শিশু সন্তানের পক্ষ থেকে পিতারই নফল কুরবানীতাই এ থেকে প্রমাণিত হয়ে যায় যেএক ব্যক্তির জন্য একটি বড় পশুতে নিজের ওয়াজিব কুরবানীর পাশাপাশি নফলের অংশ রাখা যায় এবং এর দ্বারা ওয়াজিব নফল সবটাই আদায় হয়ে যাবে।

শিশু সন্তানের পক্ষ থেকে পিতার কুরবানী করা সংক্রান্ত  কাযীখানের উল্লেখিত বক্তব্য যে ওয়াজিবের সাথে নফল কুরবানী সংক্রান্তÑ তা ইমদাদুল ফাতাওয়াতে সুস্পষ্টভাবেই বিবৃত হয়েছে। ইমদাদুল ফাতাওয়ার নিম্নের প্রশ্নোত্তর লক্ষ করুন।

ইমদাদুল ফাতাওয়া

سوال۔ احقر نے گذشتہ عیدالاضحیٰ کے موقع پر قربانی کے گائے میں ایک حصہ حضرت کی طرف سے لیا تھا اس وقت اس کی اطلاع حضور کو نہیں کی تھی اس کی بابت اس وقت مسئلہ بھی معلوم نہیں تھا کہ اطلاع کرنی چاہئے تھا یا نہیں  اب بہشتی زیور سے یہ مسئلہ معلوم ہوا کہ اگر کوئی شخص یہاں موجود نہیں اور دوسرے شخص نے اس کی طرف سے بغیر اس کے امر کے قربانی کر دی تو یہ قربانی نہیں ہوئی اور اگر کسی غائب کا حصہ کسی جانورمیں بدون اس کے امر کے تجویز کر لیا تو اور حصہ داروں کی قربانی بھی صحیح نہ ہوگی۔

الجواب۔ بہشتی زیور میں جو مسئلہ مذکور ہے وہ اضحیہ واجبہ کے متعلق ہے، اضحیہ تطوع کے متعلق نہیں، اور اسکی دلیل عالمگیری کا یہ جزئیہ ہے۔

প্রশ্ন : (৬৭৪) অধম গত কুরবানীর গরুতে হযরতের পক্ষ থেকে একটি অংশ রেখেছিলাম। কিন্তু হযরতকে তা জানাতে পারিনি। সে সময় এ মাসআলা জানা ছিল না যেএক্ষেত্রে জানানো দরকার ছিল। কিন্তু এখন বেহেশতী যেওর থেকে মাসআলা জানতে পারলাম যেকোনো ব্যক্তি যদি অপরের পক্ষ থেকে তার সম্মতি গ্রহণ ব্যতীত কুরবানী করেতবে কুরবানী সহীহ হয় না। আর অনুপস্থিত কোনো ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার সম্মতি ব্যতীত যদি কোনো পশুতে অংশ রাখা হয় তাহলে শরীকদের কুরবানীও সহীহ হয় না।

উত্তর : বেহেশতী যেওরএ যে মাসআলাটি উল্লেখ হয়েছে সেটা ওয়াজিব কুরবানীর প্রসঙ্গেনফল কুরবানী প্রসঙ্গে নয়। তার প্রমাণ হল ফাতাওয়া আলমগীরীর এ ইবারতÑ

ولو ضحى ببدنة عن نفسه وعرسه وأولاده ليس هذا في ظاهر الرواية. وقال الحسن بن زياد في كتاب الأضحية: إن كان أولاده صغارا جاز عنه وعنهم جميعا في قول أبي حنيفة وأبي يوسف رحمهما الله تعالى.

Ñইমদাদুল ফাতাওয়া ৩/৬০৯

দুই. একটি বড় পশুতে নিজের কুরবানীর সাথে নফল অংশ রাখতে পারে তার আরেকটি ক্ষেত্র হলক্রীতদাসের পক্ষ থেকে মনিবের কুরবানী করা। ফিকহের কিতাবে দাসদাসীর পক্ষ থেকে কুরবানী করা মনিবের জন্য মুস্তাহাব বলা হয়েছে। যেমন আত্তাবী রাহ. বলেনÑ

ويستحب عن أولاده الصغار وعن مماليكه، و يكون قربة ولا يجب عنهم.

শিশু সন্তানের পক্ষ থেকে এবং ক্রীতদাসের পক্ষ থেকে কুরবানী করা মুস্তাহাব। তাদের পক্ষ থেকে কুরবানী করা ওয়াজিব নয়। Ñজাওয়ামিউল ফিকহ লিল আত্তাবীপৃ. ২০৫ (মাখতূত)

আরো দেখুনরদ্দুল মুহতার ৬/৩১৫

ফাতাওয়া হিন্দিয়াএ এসেছেÑ

ويستحب أن يضحي عن مماليكه هكذا في التتارخانية.

আর ক্রীতদাসের পক্ষ থেকে কুরবানী করা মুস্তাহাব। Ñফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৩

উট বা গরুতে ক্রীতদাসের পক্ষ থেকে অংশ রাখা

ইমাম সারাখসী রাহ. বলেনÑ

ولا خلاف أنه ليس على المولى أن يضحي عن أحد من مماليكه، فإن تبرع بذلك جاز. وإذا جعله شريكا في البدنة ففيه قياس واستحسان لما بينا.

এতে কোনো দ্বিমত নেই যেমনিবের ওপর ক্রীতদাসের পক্ষ থেকে কুরবানী করা আবশ্যক নয়। অবশ্য সে যদি নিজ থেকে তার পক্ষ থেকে কুরবানী করে তবে তা জায়েয আছে। আর যখন তাকে উটের কুরবানীতে শরীক করে নেবে সেক্ষেত্রে এ মাসআলায় কিয়াস ও ইস্তিহসান দুটি দিকই রয়েছেযেমনটি আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। (অর্থাৎ কিয়াসের দাবি হল তা জায়েয হবে না। আর ইস্তিহসানের ভিত্তিতে তা জায়েয হবে। এবং এর উপরই ফতোয়া।) Ñমাবসূতসারাখসী ১২/১২

একথা অজানা নয় যেক্রীতদাসের পক্ষ থেকে কুরবানী করা মনিবের ওপর ওয়াজিব নয় এবং মনিব যদি ক্রীতদাসের পক্ষ থেকে কুরবানী করেতবে তা নফল গণ্য হবে এবং এ কুরবানীর মালিক মূলত মনিবই। কেননা গোলাম কোনো সম্পদ অর্জন করলে তাতেই তার মালিকানা সাব্যস্ত হয় নাবরং ঐ সম্পদের মালিকানাও মনিবের থাকে। আর মনিব যখন নিজ সম্পদ হতে তার পক্ষ থেকে কুরবানী করবে তাতে যে তার মালিকানা থাকবে নাতা বলাই বাহুল্য। হাঁগোলামের পক্ষ থেকে আদায়ের নিয়তের কারণে গোলাম কুরবানীর সওয়াব পাবে। যেমনটি শিশু সন্তানের পক্ষ থেকে পিতা নিজ সম্পদ থেকে কুরবানী করলে সন্তানের কুরবানীর সওয়াব অর্জন হয় এবং মূল কুরবানী পিতারই থাকে। আর এ অংশ নফল হিসাবে আদায় হয়।

উপরোক্ত দুটি সূরত অর্থাৎ শিশু সন্তান এবং গোলামের পক্ষ থেকে একই পশুতে কুরবানী জায়েয হওয়ার দ্বারা প্রমাণিত হয় যেএক ব্যক্তির জন্য একটি বড় পশুতে নিজের কুরবানীর সাথে ঈসালে সওয়াবের অংশ রাখা জায়েয।

এক ব্যক্তির জন্য একটি বড় পশুতে ওয়াজিবের সাথে নফল অংশ রাখা জায়েযÑ এটি শুধু হানাফী মাযহাবে আলোচিত হয়েছে এমন নয়বরং অন্য মাযহাবেও তা সুস্পষ্টভাবে আলোচিত হয়েছে। যেমন,

আল্লামা মুনাভী রাহ. জাবের রা.এর হাদীসÑ

البقرة عن سبعة والجزور عن سبعة.

(গরু সাত জনের পক্ষ থেকে আর উট সাতজনের পক্ষ থেকে)এর ব্যাখ্যায় লেখেনÑ

أي تجزئ كل واحدة منهما عن سبعة، فلو ضحى ببقرة أو جزور كان الزائد على السبع تطوعا، يصرفه إلى أنواع التطوع إن شاء.

অর্থাৎ গরু ও উটের প্রতিটি সাতজনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে। অতএবযদি কোনো ব্যক্তি একটি গরু বা উট কুরবানী করে তবে এক সপ্তমাংশের অতিরিক্তটা নফল হবে। সে যে কোনো প্রকার নফলের নিয়ত করতে পারে। Ñফায়যুল কাদীরমুনাভী ৩/২২২

ইবনে হাজার হাইতামী রাহ. উক্ত মাসআলাকে অধিক সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনÑ

أما لو ذبح بدنة أو بقرة عن سبعة أسباب، منها ضحية وعقيقة والباقي كفارات في نحو الحلق في النسك فيجزئ ذلك، وليس هو من باب التداخل في شيء، لأن كل سبع يقع مجزيا عما نوى به.

কোনো ব্যক্তি যদি একটি উট বা গরু জবাই করে সাতটি নুসুক আদায়ের উদ্দেশ্যেআর তন্মধ্যে একটি অংশ হল কুরবানী এবং আকীকা আর বাকিগুলো হল বিভিন্ন কাফফারার উদ্দেশ্যেÑ যেমনহজ্বে (সময়ের পূর্বে) মাথা মুণ্ডন করে নেয়ার কারণেÑ তবে তা যথেষ্ট হবে। আর এ মাসআলাটি কোনোভাবেই তাদাখুল’-এর অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ প্রতিটি সপ্তমাংশ তার এক একটি নিয়তের জন্য যথেষ্ট। Ñআলফাতাওয়াল কুবরাহাইতামী ৪/২৫৬

ইবনে হাজার হাইতামী রাহ.এর উপরোক্ত বক্তব্যে কুরবানীর সাথে আকীকার কথা স্পষ্টই উল্লেখ হয়েছে। তিনি উক্ত বক্তব্যে আরও একটি বিষয় ব্যক্ত করেছেন। তা হলএকটি উট বা গরুতে সাতটি অংশ রাখা এ অর্থে নয় যেএতে মূল কুরবানী একটিই আদায় হল আর বাকিগুলো একটির অধীন হয়ে আদায় হয়েছে ধরে নেয়া হবেবরং প্রত্যেকটি কুরবানী পৃথক পৃথক অংশেই আদায় হবে। কেননা উটগরুর প্রতিটি এক সপ্তমাংশ দ্বারা কুরবানীদাতার নিয়ত অনুযায়ী স্বতন্ত্র কুরবানী আদায় হয়।

উটগরুতে এক ব্যক্তির যদি এক সপ্তমাংশের বেশি অংশ থাকে আর অতিরিক্ত অংশটি দ্বারা যদি কোনো ওয়াজিব আদায়ের নিয়ত না করে সেক্ষেত্রেও ঐ অংশটি যে নফল গণ্য হয়Ñ তা মুজতাহিদ ইমামদের নিকট একটি স্বীকৃত মাসআলা।

ইমাম শাফেয়ী রাহ. কিতাবুল উম্মএ বলেনÑ

وإذا كانوا أقل من سبعة أجزأت عنهم وهم متطوعون بالفضل، كما تجزئ الجزور عمن لزمته شاة، ويكون متطوعا بفضلها عن الشاة، وإذا لم توجد البدنة كان عدلها سبعة من الغنم قياسا على هذا الحديث، وكذلك البقرة.

যদি একটি বড় পশুতে সাতজনের কম শরীক থাকে তবে তাও ঠিক আছে। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত অংশটি তাদের জন্য নফল গণ্য হবে। যেমন এক ব্যক্তির ওপর একটি ছাগল আবশ্যক হওয়ার পর সে যদি একটি উট জবাই করে তবে তা তার জন্য যথেষ্ট হবে এবং ছাগলের অতিরিক্ত অংশ নফল সাব্যস্ত হবে। আর যখন উট পাওয়া না যাবেএ হাদীসের উপর কিয়াস করে তার পরিবর্তে সাতটি ছাগল যথেষ্ট হবে। গরুর ক্ষেত্রেও একই কথা। Ñকিতাবুল উম্ম ২/২৪৪

ইমাম শাফেয়ী রাহ. যে হাদীসের উপর কিয়াস করেছেন সে হাদীস হল জাবের রা.এর হাদীসযা আমরা ইতিপূর্বে একাধিক বার উল্লেখ করেছি। আর এটি কোনো মতবিরোধপূর্ণ মাসআলা নয়বরং আমাদের ফকীহদের থেকেও একই কথা বর্ণিত হয়েছে।

যেমন ইমাম সারাখসী রাহ. বলেনÑ

وإن قال: لله علي أن أهدي شاة فأهدى جزورا يجزئه وهو محسن في ذلك؛ لأنه أدى الواجب عليه وزيادة، فإن الجزور قائم مقام سبع من الغنم، حتى يجزئ عن سبعة نفر، ففيه وفاء بالواجب وزيادة.

কেউ যদি বলেআল্লাহ্র জন্য আমি একটি ছাগল হাদী হিসাবে পাঠাবো। এরপর সে একটি উট প্রেরণ করলতা তার জন্য যথেষ্ট হবে। সে এক্ষেত্রে উত্তম কাজ করেছে। কেননা সে তার ওয়াজিব আদায় করেছে এবং অতিরিক্ত আদায় করেছে। কেননা উট সাতটি ছাগলের স্থলাভিষিক্ত। একারণেই একটি উট সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে যথেষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং লোকটি এক্ষেত্রে ওয়াজিব তো আদায় করেছেই সাথে বেশি আদায় করেছে। Ñমাবসূতসারাখসী ৪/১৪৭

উক্ত উর্দু ফাতাওয়ার বক্তব্য সঠিক ধরে নেয়া হলে এ বিশ্লেষণের কোনোই সুযোগ নেই। কেননা এটির ভাষ্য মতে এক ব্যক্তি যখন একটি উট বা গরু দ্বারা মান্নত বা কুরবানী আদায় করবে তখন তো পুরো উট বা গরু দ্বারা একটি ওয়াজিবই আদায় হবে। সেখানে অতিরিক্ত অংশের আলোচনা আসার প্রশ্নই তো থাকে না। অথচ ইমাম সারাখসী রাহ. ওয়াজিব অংশের পাশাপাশি অতিরিক্ত অংশের কথা বলেছেন। সাথে এর কারণও ব্যক্ত করেছেন এই বলে যেএকটি উট সাতটি ছাগলের স্থলাভিষিক্ত। যে কারণে একটি উট সাত ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট হয়।

ইমাম সারাখসী রাহ.এর বক্তব্য দ্বারা দুটি বিষয় প্রমাণিত হয় :

এক. এক ব্যক্তির জন্য একটি উট বা গরুতে ওয়াজিব অংশের সাথে নফলের অংশ রাখা জায়েয।

দুই. ওয়াজিবের অতিরিক্ত অংশ নফল হওয়ার কারণ হলএকটি উট বা গরু এক ব্যক্তির জন্যও সাতটি ছাগলের স্থলাভিষিক্ত।

সুতরাং লোকটি যখন একটি ছাগলের মান্নত করে এর পরিবর্তে উট আদায় করল সে এক্ষেত্রে ছয় অংশ অতিরিক্ত আদায় করল।

তিনি এ মাসআলাকে একটি উটগরুতে ভিন্ন ভিন্ন সাত ব্যক্তির শরীক হওয়ার মাসআলার সাথে মিলিয়েছেন। এ থেকে একদমই পরিষ্কার হয়ে যায় যেএকটি উট বা গরুতে সাত ব্যক্তির জন্য যেমনিভাবে সাতটি ওয়াজিব কুরবানী বা সাতটি নফল কুরবানী অথবা ওয়াজিবের সাথে নফল কুরবানী আদায় করা যায় ঠিক তেমনি এক ব্যক্তির জন্য একটি বড় পশুতে একাধিক ওয়াজিব কুরবানী বা ওয়াজিবের সাথে নফল কুরবানী আদায় হবে সন্দেহাতীতভাবে।

কিন্তু এর বিপরীতে ফিক্হবিদগণ থেকে এমন একটি বক্তব্যও পাওয়া যায় নাযাতে তারা ওয়াজিব অংশের সাথে নফল অংশ রাখা যাবে নাÑ বলে মত ব্যক্ত করেছেন।

একটি বড় পশুতে একাধিক আকীকার অংশ রাখা

একটি বড় পশুতে একাধিক আকীকার যে অংশ রাখা জায়েয তা তো উপরের আলোচনা থেকেই সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষত নাতিফী রাহ.এর বক্তব্যে আমরা দেখে এসেছি যে,  একটি গরুতে এক ব্যক্তির জন্য ছয়টি নফল অংশ রাখা যায়।

এখানে আমরা আকীকা সম্পর্কিত স্পষ্ট ফিকহী বক্তব্য উদ্ধৃত করছি।

মূল আলোচনার পূর্বে একটি বিষয় জানা দরকার যেআকীকার মাসআলামাসায়েল ফিকহে হানাফীতে তেমন আলোচিত হয়নি। তার কারণও ফিকহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নিকট অজানা নয়। এজন্য ফিকহে হানাফীর কিতাবাদিতে আকীকার আলোচনা সাধারণত ফিকহে শাফেয়ী থেকে উদ্ধৃত করা হয়ে থাকে। কারণ মৌলিকভাবে ফিকহে শাফেয়ীর আকীকা সংক্রান্ত মাসআলামাসায়েল বিস্তৃত এবং আমাদের মাযহাবের উসূলের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ।

তাই প্রথমে ফিকহে শাফেয়ী থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের হাওয়ালা উল্লেখ করা গেল। এরপর এ আলোকে হানাফী  ফকীহ ও আলেমগণের বক্তব্য উল্লেখ করা হবে।

ইমাম নববী রাহ. বলেনÑ

ولو ولد له ولدان، فذبح عنهما شاة لم تحصل العقيقة، ولو ذبح بقرة أو بدنة عن سبعة أولاد أو اشترك فيها جماعة جاز.

যদি কারো দুটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় আর তাদের পক্ষ থেকে একটি ছাগল জবাই করা হয় তাহলে আকীকা আদায় হবে না। আর যদি কোনো ব্যক্তি তার সাতটি সন্তানের আকীকার উদ্দেশ্যে একটি গরু বা উট জবাই করে অথবা উট বা গরুতে একাধিক ব্যক্তি শরীক হয় তবে তা জায়েয হবে। Ñআল মাজমূ ৮/৪০৯

ইমাম নববী রাহ.এর উপরোক্ত বক্তব্য ফিকহে শাফেয়ীর একাধিক কিতাবে উদ্ধৃত হয়েছে। এতে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে যেএকটি বড় পশুতে এক ব্যক্তির জন্য সাত সন্তানের পক্ষ থেকে আকীকা করা জায়েয এবং এতে সাতজনের আকীকাই আদায় হয়ে যাবে।

ইলাউস সুনান

আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রাহ. ইমাম নববী রাহ.এর উপরোক্ত বক্তব্য হুবহু ইলাউস সুনান গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি আকীকার অধ্যায়ে একাধিক ফায়েদা ইমাম নববী রাহ.এর আলমাজমূ’ গ্রন্থ থেকে উল্লেখ করেছেন। একটি ফায়েদার অধীনে তিনি উক্ত মাসআলাÑ অর্থাৎ এক ব্যক্তির জন্য একটি উট বা গরুতে একাধিক আকীকার অংশ রাখা জায়েযÑ তা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনÑ

ولو ولد له ولدان، فذبح عنهما شاة لم تحصل العقيقة، ولو ذبح بقرة أو بدنة عن سبعة أولاد، أو اشترك فيها جماعة جاز.

যদি কারো দুটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় আর তাদের পক্ষ থেকে একটি ছাগল জবাই করা হয় তাহলে আকীকা আদায় হবে না। আর যদি কোনো ব্যক্তি তার সাতটি সন্তানের আকীকার উদ্দেশ্যে একটি গরু বা উট জবাই করে অথবা উট বা গরুতে একাধিক ব্যক্তি শরীক হয় তবে তা জায়েয হবে। Ñইলাউস সুনান ১৭/১১৯

ইলাউস সুনানে শরহুল মুহাযযাবএর উল্লিখিত বক্তব্য উদ্ধৃত করা একথার সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে যেফিকহে হানাফীতেও একটি বড় পশু দ্বারা এক ব্যক্তি তার সাত সন্তানের পক্ষ থেকে আকীকা আদায় করতে পারবে। তিনি এ মাসআলায় শাফেয়ী মাযহাবের সাথে কোনো ইখতিলাফ উল্লেখ করেননি।

হাঁবড় পশুতে যদি একাধিক ব্যক্তি শরীক হয় আর কোনো শরীক আকীকার নিয়ত করেআবার কেউ গোশত সংগ্রহের জন্য অংশ রাখেসেক্ষেত্রে এ মাসআলায় তিনি শাফেয়ী মাযহাবের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন। কারণ আমাদের মাযহাবের মত হলশরীকদের সাথে কুরবানী দেয়ার ক্ষেত্রে সকল শরীকের কুরবত’-এর নিয়ত থাকা শর্ত। কোনো এক শরীক যদি পার্থিব উদ্দেশ্য রাখে তবে কারও কুরবানী সহীহ হবে না। যেমন তিনি বলেনÑ

قلت: مذهبنا في الأضحية بطلانها بإرادة بعض اللحم، فليكن كذلك في العقيقة.

আমি বলবআমাদের মাযহাব হলকুরবানীর ক্ষেত্রে কোনো শরীক যদি গোশত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে শরীক হয় তাহলে সকল শরীকদের কুরবানী বাতিল হয়ে যাবে। আকীকার ক্ষেত্রেও তাই হওয়া উচিত। Ñইলাউস সুনান ১৭/১২০

ইমদাদুল ফাতাওয়া

একটি উট বা গরুতে যে এক ব্যক্তির জন্য সাতটি আকীকার অংশ রাখা জায়েয তা হাকীমুল উম্মত হযরত থানবী রাহ.এর আকীকা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তর থেকেও বুঝে আসে।

প্রশ্ন :

گزارش یہ ہے کہ جناب شاہ صاحب ہمارے یہاں ایک مولوی صاحب فرماتے ہیں کہ عقیقہ گائے کا بھی درست ہے یہ بات اور کبھی کسی عالم نے نہیں کہی اب عرض کرتا ہوں اگر لڑکا پیدا ہوئے تو دو بکری ذبح نہ کرے ایک گائے ذبح کرے تو عقیقہ درست ہوگا یا نہیں تحریر فرما کر تسلی فرماویں .

জনাব আমাদের এখানে এক মৌলবী সাহেব বলেন যেগরু দ্বারাও আকীকা করা জায়েয। এ ধরনের কথা কোনো আলেম থেকে শুনিনি। আমার প্রশ্ন হলযদি পুত্র সন্তান জন্ম নেয় আর তার আকীকার জন্য দুটি বকরি জবাই না করে যদি একটি গরু জবাই করা হয় তবে কি আকীকা আদায় হবে?

উত্তর :

گائے کا عقيقہ کہ آثار میں تو منقول دیکھا نہیں گیا ۔ البتہ فقہاء نے گائے میں عقیقہ کا  حصہ لینے کو لکھا ہے  تو اس کے جواز کا قائل ہونا بھی ضروری ہے کہ گائے کا حصہ بدل ہے شاة  کا لیکن پوری گائے سے عقیقہ کرنا اس سے فقہاء نے بھی تعرض نہیں کیا ۔ مگر قواعد سے یہ ایسا ہے جیسی سات بکریوں سے عقیقہ کرنا جو ظاہرا سنت سے تجاوز ہے  جیسے ظہر کی پانچ رکعت پڑھنا بہتر یہ ہے کہ اور کسی عالم سے بھی تحقیق کر لیا جاوے.

গরু দ্বারা আকীকা করা হাদীস আসারে বর্ণিত পাইনি। তবে ফকীহগণ গরুতে আকীকার অংশ রাখার কথা লিখেছেন। তাই গরু দ্বারা আকীকা করা জায়েয এ কথা বলতে কোনো বাধা নেই। কেননা গরুর (সাতটি অংশের) প্রত্যেকটি অংশ একটি ছাগলের স্থলাভিষিক্ত। তবে গোটা একটি গরু আকীকা করা সম্পর্কে ফকীহগণ কিছু বলেননি। তবে মৌলনীতির আলোকে একটি গরু দ্বারা একজনের পক্ষ থেকে আকীকা করা সাতটি ছাগল দ্বারা আকীকা করার নামান্তরযা বাহ্যত সুন্নাহ থেকে সীমালঙ্ঘন১। এটি কেমন যেন যোহরের নামায পাঁচ রাকাত পড়া সদৃশ। বিষয়টি অন্য আলেম থেকেও তাহকীক করে নেয়া সমীচীন হবে। Ñইমদাদুল ফাতাওয়া ৩/৬২০

হযরত থানবী রাহ. একটি গরু দ্বারা আকীকা করাকে সাতটি ছাগল দ্বারা আকীকা করা গণ্য করেছেন। এ থেকে সহজেই অনুমেয় যেএকটি গরু দ্বারা একাধিক আকীকা করা জায়েয হবে।

ইমদাদুল আহকাম

السؤال  :عقیقہ میں بیل بکری وغیرہ ما یکفی للواحد  چند بچوں کے لیے بھی کافی ہو سکتا ہے؟

الف۔ خواہ ایک ہی دن میں سب پیدا ہوئے ہوں یا آگے پیچھے۔ ..

ب۔ یہ بچے ایک ہی شخص کے ہو یا دو تین اشخاص کے۔

الجواب۔ بکری میں تو ایک بچہ سے زائد کا عقیقہ نہیں ہو سکتا اور گائے بیل میں سات بچوں تک کا ہو سکتا ہے  خواہ سب ایک ہی شخص کے ہوں یا مختلف لوگوں کے اور ساتھ پیدا ہوئے ہوں یا آگے پیچھے کیونکہ تاریخ کا لحاظ مستحب ہے ضروری نہیں۔

প্রশ্ন : আকীকার মধ্যে গরুছাগল ইত্যাদিযা একজনের জন্য যথেষ্টতা কি কয়েকজন বাচ্চার আকীকার জন্য হতে পারেচাই সকলে একই দিনে জন্ম লাভ করুক অথবা আগেপরে?.. তারা এক ব্যক্তির সন্তান হোক বা দুই তিন ব্যক্তির?

উত্তর : ছাগল দ্বারা তো একাধিক শিশুর আকীকা হতে পারে না। আর গরুমহিষে সাত সাত বাচ্চার আকীকা হতে পারে। চাই সকল শিশু এক ব্যক্তির হোক বা ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির। চাই একসঙ্গে জন্মগ্রহণ করুক বা আগেপরে। কেননা দিনতারিখের প্রতি লক্ষ রাখা মুস্তাহাবজরুরি নয়। Ñইমদাদুল আহকাম ৪/২২৮

একটি গরু বা উট দ্বারা একই ব্যক্তির জন্য একাধিক সন্তানের পক্ষ থেকে আকীকা করা যে জায়েযÑ তা প্রায় সকল উর্দু ফতোয়ার কিতাবে উদ্ধৃত হয়েছে। প্রয়োজনে তা দেখে নেয়া যেতে পারে।

উপরের পুরো আলোচনায় হাদীস ও ফিক্হের মুজতাহিদ ইমাম ও ফকীহগণের বক্তব্যের আলোকে আমরা দেখলাম যেএকটি উট বা গরু দ্বারা এক ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব বা নফল কুরবানীআকীকা বা মান্নত সবগুলোই আদায় করা যাবে। এটি একটি স্বীকৃত ও সুপ্রমাণিত বিষয়। পক্ষান্তরে আমাদের তালাশ ও অনুসন্ধান অনুযায়ী এমন কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নিযাতে বলা হয়েছে যেএক ব্যক্তির জন্য একটি পশুতে কেবল একটিই অংশ রাখা যাবেএকাধিক অংশ রাখা যাবে না। আর একাধিক অংশ রাখার নিয়ত করলেও তার এ নিয়ত বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। যেমনটি দাবি করা হয়েছে উর্দু ফতোয়ার কিতাবটিতে।

এ পর্যায়ে আমরা প্রশ্নে ইঙ্গিতকৃত উক্ত উর্দু ফাতাওয়ার কিতাবের দাবি ও দলীলের উপর সংক্ষিপ্ত একটি পর্যালোচনা পেশ করবযাতে এর দাবি ও দলীলের অসারতা স্পষ্ট হয়ে যায়।

ফতোয়া গ্রন্থটির দাবিদলীল এবং পর্যালোচনা

বক্তব্য১ : একটি পশুতে এক ব্যক্তির জন্য বিভিন্ন কুরবত’ বা দমের নিয়ত গ্রহণযোগ্য নয়। যদি নিয়ত করা হয় তবে একটি কুরবানীই আদায় হবে। কারণ এ সম্পর্কে হাদীস ও ফিকহে স্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই।

বক্তব্য২ : একটি পশুতে একাধিক কুরবত’ বা নুসুক’ আদায় হওয়ার মতটি দুর্বল বা মারজূহ। এখন পর্যন্ত এক ব্যক্তির জন্য একাধিক কুরবানী আদায় করা সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

বক্তব্য৩ : ওয়াজিবের সাথে ওয়াজিব তাযাহুম’ হতে পারেকিন্তু ওয়াজিবের সাথে নফল তাযাহুম’ হতে পারে না।

পর্যালোচনা

ফতোয়া গ্রন্থটির দাবি ও দলীলের পর্যালোচনার পূর্বে বলে রাখা দরকার যেইতিপূর্বে হাদীস ও ফিক্হফতোয়ার কিতাবের একাধিক বক্তব্য দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই আমরা দেখে এসেছি যেএক ব্যক্তির জন্য একটি উট বা গরুতে একাধিক ওয়াজিবএকাধিক নফল এবং একাধিক ওয়াজিব ও নফল সর্বপ্রকারেরই অংশ রাখা জায়েয এবং এর দ্বারা তার নিয়ত অনুযায়ী সবগুলো কুরবানীই আদায় হয়ে যাবে। আর ফিক্হবিদগণের নিকট এটি একটি স্বীকৃত মাসআলা। এত স্পষ্ট বক্তব্য থাকার পর বিচ্ছিন্ন ও শায কথার পর্যালোচনার আর দরকার মনে হয় না। তথাপি প্রশ্নে যেহেতু ফতোয়া গ্রন্থটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে তাই এখানে সংক্ষেপে তা পর্যালোচনা করা হল।

পর্যালোচনা (১২) : তিনি বলেছেন,  একটি পশুতে এক ব্যক্তির জন্য একাধিক কুরবানী বা দমের নিয়ত গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ হাদীস ও ফিকহের কিতাবে এর কোনো প্রমাণ নেই।

এর উত্তরে আমরা বলবউক্ত দাবি যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অনুমাননির্ভর তা তো হাদীস ও ফিকহের নির্ভরযোগ্য কিতাবাদির উদ্ধৃতিতে বিস্তারিত পেশ করা হয়েছে।

হাদীসের ব্যাখ্যাগ্রন্থে ও ফিকহের কিতাবে এত সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকার পর একথা বলা যেহাদীস ও ফিকহের কিতাবে কোনো প্রমাণ নেই বা সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য নেইÑ খুবই দুঃখজনক বিষয়। হাদীসের একাধিক ব্যাখ্যাগ্রন্থে এবং মাবসূতসহ ফিক্হফতোয়ার প্রাচীন এত কিতাবে এ ধরনের স্পষ্ট বক্তব্য থাকার পর নিজের মত প্রতিষ্ঠার জন্য ঐ উর্দু ফতোয়া গ্রন্থটিতে যেসব ইবারত উল্লেখ করা হয়েছে তার উত্তর প্রদানের কোনো দরকার মনে হয় না। কেননা সেখানে যেগুলোকে দলীল হিসাবে পেশ করা হয়েছেতা ঐ মাসআলার দলীলই নয়।

উদাহরণস্বরূপ ফতোয়া গ্রন্থটিতে মূল দলীল বানানো হয়েছে যাহিদী রাহ.এর কিতাব মুজতাবা’-এর একটি বক্তব্যকেযা আল্লামা হাছকাফী রাহ. আদ্দুররুল মুখতারএ উদ্ধৃত করেছেন। ইবারতটি হলÑ

ولو ضحى بالكل فالكل فرض كأركان الصلاة، فإن الفرض منها ما ينطلق الاسم عليه، فإذا طولها يقع الكل فرضا مجتبى.

কোনো ব্যক্তি যদি একটি উট বা গরুর পুরোটা দ্বারা কুরবানী করে তবে পুরোটা ওয়াজিব হিসাবে আদায় হবে।

প্রথম কথা হলউক্ত বক্তব্যে কোথায় বলা আছে যেএকটি উট বা গরুতে কুরবানীর সাথে অন্য নিয়ত গ্রহণযোগ্য নয়! এই ইবারত থেকে কিছুতেই এ দাবি প্রমাণিত হয় না। একটু লক্ষ করা হলে বরং বিপরীত দিকটাই সহজে প্রমাণিত হয়। কেননা উক্ত বক্তব্যে বলা হয়েছেএক ব্যক্তি যদি একটি গরু দ্বারা কুরবানী করে তবে পুরোটাই ওয়াজিব কুরবানী হিসাবে আদায় হবে। এক্ষেত্রে এক অংশ ওয়াজিব আর ছয় অংশ নফল হবে না। কারণ কুরবানীদাতা পুরোটাকেই ওয়াজিব করে নিয়েছেতাই তার নিয়ত অনুযায়ী পুরোটাই ওয়াজিব গণ্য হবে। কিন্তু যদি গরুর পুরো সাত অংশ দ্বারা ওয়াজিব কুরবানী আদায়ের নিয়ত না করেতবে পুরো অংশ ওয়াজিব গণ্য হবে নাÑ তা যাহিদী রাহ.এর উক্ত বক্তব্য থেকেই তো বুঝে আসে। এর সাথে মুজতাবার ইবারতের পূর্বাপর  মিলিয়ে দেখা হলে তো আর কোনোই অস্পষ্টতা থাকে না। নিম্নে লক্ষ করুনÑ

قال الخوميني …والبقرة أفضل من ست شياه إذا استويا قيمة ولحما، لأنها أكثر دما، لكنه ذكر بعد هذا ما ينافي هذا، فقال: الشاة أفضل من البقرة إذا استويا قيمة، لأن بعض أجزاء البقرة يقع تطوعا، فلو ضحى أحدهم بشاة بسبعين، والثاني بقرة بسبعين، والثالث تصدق بالسبعين، فالأول أفضل منهما، والثاني من الثالث، والأول أصح لأن التضحية يقع بسبع البقرة إذا اقتصر عليه، وإن ضحى الكل يقع الكل فرضا، كأركان الصلاة، فإن الفرض منها ما ينطلق الاسم عليه، فإذا طولها يقع الكل فرضا كذا هذا.

যাহিদী রাহ.এর বক্তব্যÑ

لأن التضحية يقع بسبع البقرة إذا اقتصر عليه

(কারণ গরু দ্বারা কুরবানী করার ক্ষেত্রে তখনই এক সপ্তমাংশ শুধু কুরবানী গণ্য হবেযখন কোনো ব্যক্তি একটি গরুর এক সপ্তমাংশ শুধু কুরবানীর জন্য সীমাবদ্ধ করে নেবে।)Ñ লক্ষ করা হলে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যেএকটি গরুর পুরোটা দ্বারা যদি কেউ ওয়াজিব কুরবানী আদায়ের নিয়ত না করেবরং এক সপ্তমাংশ দ্বারা ওয়াজিব আর বাকি ছয় অংশ দ্বারা নফল আদায়ের নিয়ত করেতাহলে তার নিয়ত অনুযায়ী এক অংশ দ্বারা ওয়াজিব কুরবানী আদায় হবে এবং বাকি ছয় অংশ দ্বারা নফল কুরবানী আদায় হবে।

যাহিদী রাহ.এর যে ইবারত দ্বারা তিনি নিজের মত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন পুরো ইবারত সামনে এসে যাওয়ার পর তার স্বপক্ষে তা দলীল হওয়ার তো প্রশ্নই আসে নাবরং তার বিপরীত দিকটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।

মূলত এখানে মাসআলা হল দুটো। এক হলএকটি উট বা গরুতে এক ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন নিয়তে একাধিক দম বা কুরবানীর নিয়ত করা। আর দ্বিতীয় হলএকটি গরুর পুরোটা দ্বারা একটি কুরবানীর নিয়ত করা। ঐ গ্রন্থকার একটির সাথে আরেকটিকে মিলিয়ে একাকার করে ফেলেছেন।

উক্ত ফতোয়াগ্রন্থে যে বিষয়কে খুব বড় করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে তা হলওয়াজিব কুরবানীর সাথে নফল কুরবানী বা আকীকার অংশ রাখার কোনো একটি দলীলও নেই।

এ দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি এমন সব ফিকহী ইবারতকে দলীল বানানোর চেষ্টা করেছেনযা আদৌ দলীল হওয়ার যোগ্য নয়। পক্ষান্তরে যেসব ইবারত থেকে ওয়াজিব কুরবানীর সাথে নফল অংশ রাখা জায়েয হওয়া স্পষ্ট বুঝা যায়সেগুলোকে তিনি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। অথচ আমরা পূর্বে সুস্পষ্ট ফিকহী বক্তব্য দ্বারা প্রমাণ করে এসেছি যেএকটি বড় পশুতে এক ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব কুরবানীর সাথে নফল অংশ রাখা জায়েয। পাঠকের সুবিধার্থে ঐসকল হাওয়ালাগুলো এক নজরে এখানে উল্লেখ করে দেয়া হল :

আলআজনাস লিননাতিফী

فإذا اشترى رجل أضحيته، ثم أشرك فيها ستة، أجزأت عنهم، وصار كأنه أوجب سبعها، وستة أسباعها يتطوع به.

আলআশবাহ ওয়ান নাযাইরইবনে নুজাইম

ولم أر الآن ما إذا أخرج بعيرا عن خمسة من الإبل. هل يقع فرضا أو خُمُسَهُ؟

وأما إذا نذر ذبح شاة فذبح بدنة، ولعل فائدته في النية: هل ينوي في الكل الوجوب أو لا؟ وفي الثواب: هل يثاب على الكل ثواب الواجب أو ثواب النفل فيما زاد؟

ثم رأيتهم قالوا في الأضحية كما ذكره ابن وهبان معزيا إلى الخلاصة: الغني إذا ضحى بشاتين وقعت واحدة منهما فرضا والأخرى تطوع؛ وقيل الأخرى لحما، انتهى

একটি উট দ্বারা পিতা ও শিশু সন্তানের পক্ষ থেকে নফল কুরবানী

 ইমাম কাযী খান রাহ. বলেনÑ

و لو ضحى غني بدنة عن نفسه و عن ستة من أولاده ليس هذا في ظاهر الرواية. و قال الحسن بن زياد رحمه الله تعالى في كتاب الأضحية له: إن كان أولاده صغارا جاز عنه وعنهم جميعا في قول أبي حنيفة و أبي يوسف رحمهما الله تعالى.

জামেউর রুমূযÑ

وفي الكلام إشعار بأنه لو ضحى عنه و عن ستة من أولاده وجعل لكل سبعا جاز إلا أنه غير ظاهر الرواية …..وإن ضحى من مال نفسه فهو كأضحيته.

ফখরুদ্দীন আফেন্দী রাহ.Ñ

وإن ضحى أي الأب من مال نفسه للطفل فهو كأضحيته أي الأب مثلا.

ইমদাদুল ফাতাওয়াÑ

سوال۔ ..احقر نے گذشتہ عیدالاضحیٰ کے موقع پر قربانی کے گائے میں ایک حصہ حضرت کی طرف سے لیا تھا اس وقت اس کی اطلاع حضور کو نہیں کی تھی اس کی بابت اس وقت مسئلہ بھی معلوم نہیں تھا کہ اطلاع کرنی چاہئے تھا یا نہیں  اب بہشتی زیور سے یہ مسئلہ معلوم ہوا کہ اگر کوئی شخص یہاں موجود نہیں اور دوسرے شخص نے اس کی طرف سے بغیر اس کے امر کے قربانی کر دی تو یہ قربانی نہیں ہوئی اور اگر کسی غائب کا حصہ کسی جانورمیں بدون اس کے امر کے تجویز کر لیا تو اور حصہ داروں کی قربانی بھی صحیح نہ ہوگی

الجواب۔ بہشتی زیور میں جو مسئلہ مذکور ہے وہ اضحیہ واجبہ کے متعلق ہے، اضحیہ تطوع کے متعلق نہیں، اور اسکی دلیل عالمگیری کا یہ جزئیہ ہے

ولو ضحى ببدنة عن نفسه وعرسه وأولاده ليس هذا في ظاهر الرواية وقال الحسن بن زياد في كتاب الأضحية: إن كان أولاده صغارا جاز عنه وعنهم جميعا في قول أبي حنيفة وأبي يوسف – رحمهما الله تعالى .

জাওয়ামিউল ফিকহ লিলআত্তাবীÑ

ويستحب عن أولاده الصغار وعن مماليكه و يكون قربة ولا يجب عنهم.

মাবসুতসারাখসী

ولا خلاف أنه ليس على المولى أن يضحي عن أحد من مماليكه فإن تبرع بذلك جاز. وإذا جعله شريكا في البدنة ففيه قياس واستحسان لما بينا.

ফয়যুল কাদীরমুনাভী রাহ.Ñ

تجزئ كل واحدة منهما عن سبعة، فلو ضحى ببقرة أو جزور كان الزائد على السبع تطوعا، يصرفه إلى أنواع التطوع إن شاء.

আলফাতাওয়াল কুবরাহাইতামীÑ

أما لو ذبح بدنة أو بقرة عن سبعة أسباب، منها ضحية وعقيقة والباقي كفارات في نحو الحلق في النسك فيجزئ ذلك، وليس هو من باب التداخل في شيء، لأن كل سبع يقع مجزيا عما نوي به.

وإذا كانوا أقل من سبعة أجزأت عنهم وهم متطوعون بالفضل كما تجزي الجزور عمن لزمته شاة ويكون متطوعا بفضلها عن الشاة وإذا لم توجد البدنة كان عدلها سبعة من الغنم قياسا على هذا الحديث، وكذلك البقرة.

শরহুল মুহাযযাবনববীÑ

ولو ولد له ولدان فذبح عنهما شاة لم تحصل العقيقة، ولو ذبح بقرة أو بدنة عن سبعة أولاد أو اشترك فيها جماعة جاز.

ইলাউস সুনান

ولو ولد له ولدان فذبح عنهما شاة لم تحصل العقيقة، ولو ذبح بقرة أو بدنة عن سبعة أولاد، أو اشترك فيها جماعة جاز.

ইমদাদুল ফাতাওয়া

گائے کا عقيقہ کہ آثار میں تو منقول دیکھا نہیں گیا ۔ البتہ فقہاء نے گائے میں عقیقہ کا  حصہ لینے کو لکھا ہے  تو اس کے جواز کا قائل ہونا بھی ضروری ہے کہ گائے کا حصہ بدل ہے شاة  کا لیکن پوری گائے سے عقیقہ کرنا اس سے فقہاء نے بھی تعرض نہیں کیا ۔ مگر قواعد سے یہ ایسا ہے جیسی سات بکریوں سے عقیقہ کرنا جو ظاہرا سنت سے تجاوز ہے  جیسے ظہر کی پانچ رکعت پڑھنا بہتر یہ ہے کہ اور کسی عالم سے بھی تحقیق کر لیا جاوے.

ইমদাদুল আহকাম

الجواب۔ بکری میں تو ایک بچہ سے زائد کا عقیقہ نہیں ہو سکتا اور گائے بیل میں سات بچوں تک کا ہو سکتا ہے  خواہ سب ایک ہی شخص کے ہوں یا مختلف لوگوں کے.

উপরোক্ত বক্তব্যগুলো ওয়াজিবের সাথে নফল অংশ বা আকীকার অংশ রাখা সংক্রান্ত। এসব বক্তব্যে সুস্পষ্টই বলা হয়েছেএকই ব্যক্তির জন্য একটি উট বা গরুতে কুরবানীর সাথে আকীকা বা সর্বোচ্চ সাতটি পর্যন্ত আকীকা করা জায়েয। এক ব্যক্তির জন্য একটি উট বা গরুতে ওয়াজিবের সাথে নফল অংশ রাখা যাবে নাÑ এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কথা।

পর্যালোচনা৩ : ‘ওয়াজিব কুরবানীর সাথে নফল অংশ রাখা যাবে না’ ফতোয়া গ্রন্থটির এ দাবির আরেকটি অদ্ভুত দলীল হলওয়াজিবের সাথে ওয়াজিবের তাযাহুম’ (অর্থাৎ একসঙ্গে যুক্ত) হতে পারে। কিন্তু ওয়াজিবের সাথে নফলের তাযাহুম হতে পারে না। তাই ওয়াজিবের সাথে নফলের নিয়ত করলেও পুরোটাই ওয়াজিব হিসাবে আদায় হবে। নফল অংশ আদায় হবে না।

এ বক্তব্যের ব্যাপারে প্রথম কথা হলতাযাহুম বলতে তিনি কী বুঝাতে চাচ্ছেনতাযাহুম শব্দ থেকে স্বাভাবিকভাবে যে অর্থ বুঝে আসে তা হলএকই অংশে দুই ওয়াজিব বা এক ওয়াজিব ও এক নফলের নিয়ত করা। এ ধরনের তাযাহুমকে না কেউ জায়েয বলেছে আর না তা আমাদের আলোচ্য মাসআলায় পাওয়া যাচ্ছে। বুঝা গেলএখানে তাযাহুম দ্বারা উদ্দেশ্যÑ একই পশুর ভিন্ন ভিন্ন হিস্যায় একই ব্যক্তির পক্ষ থেকে ওয়াজিব এবং নফলের নিয়ত করা। এ তাযাহুমকে যে নাজায়েয বা অসম্ভব বলা হচ্ছেÑ তা নিছক একটি ধারণা। কিন্তু এ ধারণাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছেযেন এটি ফিক্হফতোয়ার একটি স্বীকৃত মাসআলা। অথচ এ ধারণার পক্ষে ফিক্হফতোয়ার একটি উদ্ধৃতিও নেই। পক্ষান্তরে ফুকাহায়ে কেরাম যে এটিকে স্পষ্ট ভাষায় জায়েয বলেছেনÑ তা তো ইতিপূর্বে আমরা তাদের বক্তব্যে দেখে এসেছি।

আলোচ্য বিষয়ে তাযাহুম সংক্রান্ত তাঁর বক্তব্য যে আগাগোড়া ভুলÑ তা বুঝতে উল্লিখিত উদ্ধৃতিগুলো ছাড়াও নিম্নে আলমুহীতুর রেযাবীর একটি বক্তব্য লক্ষ করুনÑ

المحيط الرضوي : وإن كان معهم صبي ضحى عنه أبوه جاز استحسانا لا قياسا، لأن الإراقة لا تتجزى ونصيب الصغير يقع نفلا فينقلب الكل تطوعا، وجه الاستحسان أن الإراقة قد يتجزى حكما، لأن الشرع لما جوز البقرة من السبعة فقد أقامها مقام سبع شياه و سبع إراقات.

যদি শরীকদের কেউ তার শিশু সন্তানের পক্ষ থেকে কুরবানী করে তবে তা জায়েয। আর শিশুর অংশটি নফল হবে। এক্ষেত্রে যুক্তির দাবি হলপুরো উট বা গরুই নফল গণ্য হবে। হাঁইস্তিহসানের ভিত্তিতে অন্যদের ওয়াজিব কুরবানীও আদায় হয়ে যাবে। কেননা একটি গরু সাতটি ছাগলের স্থলাভিষিক্ত। আর একটি গরু জবাই করা মানে সাতটি ছাগল জবাই করা।

মুহীতের উপরোক্ত বক্তব্য থেকে যে বিষয় জানা গেল তা হলশিশু সন্তানের অংশটি নফল হিসাবে আদায় হবে আর কিয়াসের দাবি হলপুরো গরুই নফল গণ্য হবে। হাঁইস্তিহসানের ভিত্তিতে সকলের কুরবানীই আদায় হয়ে যাবে। কারণ একটি গরু সাতটি ছাগলের স্থলাভিষিক্ত। তাই একটি গরুতে বিভিন্ন প্রকারের সাতটি পর্যন্ত কুরবানীর নিয়ত করা যাবে। সুতরাং এক্ষেত্রে ওয়াজিবের সাথে নফলের তাযাহুম’-এর প্রসঙ্গ টেনে আনাটাই অবান্তর।

আকমালুদ্দীন বাবারতী রাহ.এর বক্তব্য আরো স্পষ্ট। যেমনÑ

وفي القياس لا يجوز، لأن الإراقة لا تتجزأ، وبعض الإراقة وقع نفلا أو لحما فصار الكل كذلك، ولم يعكس، لأن الواجب قد ينقلب تطوعا بخلاف العكس، والإراقة قد تصير للحم مع نية القربة إذا لم تصادف محلها، أو كانت في غير وقت الأضحية، والإراقة للحم لا تصير قربة بحال.

বাবারতী রাহ. সুস্পষ্টভাবেই বলে দিয়েছেন যেশরীকদের মধ্যে শিশুর অংশটি নফল হবেতাই পুরো গরুই নফল গণ্য হবে। এর বিপরীত হবে না। কেননা ওয়াজিব কখনও নফল গণ্য হয়কিন্তু নফল ওয়াজিব গণ্য হয় না।

ইমাম রযীউদ্দীন সারাখসী রাহ. ও আকমালুদ্দীন বাবারতী রাহ.এর বক্তব্য দ্বারা একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যেফতোয়া গ্রন্থটিতে সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলা হয়েছে।

একটি অস্পষ্টতার নিরসন

গ্রন্থটিতে মুলতাকাল আবহুর’-এর ইবারত وكذا لو ذبح بدنة عن أضحية ومتعة وقرانএর ওপর দুটি আপত্তি করা হয়েছে। একটি হলউক্ত বক্তব্যে ذبح মাজহুলের সীগা ধরা হলে এটি এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী হওয়ার দলীলযোগ্য থাকে না।

দুই. এক ব্যক্তির যেহেতু একসাথে তামাত্তু এবং কিরান হজ¦ করা সম্ভব নয় তাই মুলতাকাল আবহুর’-এর উপরোক্ত বক্তব্য অবশ্যই একাধিক ব্যক্তির সাথে প্রযোজ্য।

এক্ষেত্রে আমরা বলবফতোয়া গ্রন্থটির উপরোক্ত প্রশ্নই যে ঠিক নয়Ñ তা বোঝার জন্য সদরুশ শহীদ রাহ. (যিনি ইমাম কাযী খান রাহ. ও ছাহেবে হেদায়ার বিশিষ্ট উস্তায ও অনেক উঁচু স্তরের হানাফী ফকীহ) ও ইমাম নববী রাহ.এর ইবারত উল্লেখ করে দেয়াই যথেষ্ট মনে করছি। লক্ষ করা যাকসদরুশ শহীদ রাহ.এর উদ্দাতুল মুফতীনএর ইবারতÑ

رجل وجب عليه جزاء الصيد و دم الكفارة و دم الإحصار ودم المتعة ودم القران والأضحية فنحر جزورا أو ذبح بقرة بنية الكل جاز، والله أعلم.

এক ব্যক্তির ওপর (ইহরাম অবস্থায় শিকারের কারণে) শিকারের দমকাফফারার দমইহসারের দমতামাত্তুর দমকিরানের দম এবং কুরবানী আবশ্যক হয়েছে। সে যদি এসব কিছু আদায়ের নিয়তে একটি উট বা গরু জবাই করল তবে তা জায়েয আছে। আল্লাহ তাআলা সর্বাধিক জ্ঞাত। Ñউদ্দাতুল মুফতীপৃষ্ঠা ২৮

ইমাম নববী রাহ. আলমাজমূ শরহুল মুহাযযাবে লেখেনÑ

ويجوز أن ينحر الواحد بدنة أو بقرة عن سبع شياه لزمته بأسباب مختلفة كتمتع وقران وفوات ومباشرة ومحظورات في الإحرام ونذر التصدق بشاة مذبوحة والتضحية بشاة.

এক ব্যক্তির জন্য সাতটি ছাগলের পরিবর্তে একটি উট বা গরু কুরবানী করা জায়েয আছেযে সাতটি ছাগল  তার উপর বিভিন্ন কারণে আবশ্যক হয়েছিল। যেমন তামাত্তুর দমকিরানের দমহজ¦ ছুটে যাওয়ার কারণে দমস্ত্রী সহবাসের কারণেইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ করার কারণেছাগল জবাই করে তা সদকা করে দেয়ার মান্নতরে কারণেছাগল দ্বারা কুরবানী করার মান্নতের কারণে। Ñআলমাজমূ শরহুল মুহাযযাব৮/৩৭০

যদি ধরেও নেয়া হয় যেমুলতাকাল আবহুরের ইবারত অস্পষ্টকিন্তু সদরুশ শহীদ রাহ. ও ইমাম নববী রাহ.এর ইবারত তো দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। উভয়ের বক্তব্যে মারূফ’-এর ছিগা ব্যবহার করা হয়েছে এবং একই ব্যক্তির কথা স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের উক্ত বক্তব্যকে কি ভুল আখ্যা দেয়ার কোনো সুযোগ আছেআসলে মুলতাকাল আবহুরের ইবারতের ব্যাপারে যে প্রশ্ন তুলেছেন এখানে এ প্রশ্নের সুযোগই নেই। কারণ তিনি উক্ত ইবারতের প্রয়োগক্ষেত্র ধরে নিয়েছেন একই বছরে এক ব্যক্তির কিরান ও তামাত্তু হজ¦ করা প্রসঙ্গে। অথচ সদরুশ শহীদ রাহ. ও ইমাম নববী রাহ.এর যে ইবারততা এক সফরের বিষয়েই নয়বরং সেখানে দেখানো হয়েছেÑ একটি উট বা গরুতে সাতটি ভিন্ন ভিন্ন দমের নিয়তে কুরবানী করা যাবে কি না। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়একটি পশুতে কিরান ও তামাত্তু জমা হয় কীভাবে?

উত্তর হলএক্ষেত্রে এক ব্যক্তির জন্য একটি পশুতে কিরান ও তামাত্তু একত্রিত হওয়া অসম্ভব কোনো বিষয় নয়। আর তা এভাবে যেআমরা জানিতামাত্তু হজ¦ আদায়কারীর উপর একটি দমে শোকর’ আদায় করা ওয়াজিব। দমের পশু ব্যবস্থা করতে না পারলে তার জন্য দশটি রোযা রাখা আবশ্যক। তিনটি রোযা নয় তারিখ আরাফার দিন পর্যন্ত আর বাকি সাতটি রোযা হজে¦র পর যে কোনো সময়। আরাফার দিন পর্যন্ত তিনটি রোযা কেউ যদি না রাখতে পারে তবে তার ওপর দম আদায় করা আবশ্যক। এক্ষেত্রে সে হজের বাকি কাজ সেরে হালাল হয়ে যাবে। আর উক্ত দম সে যখন ব্যবস্থা করতে পারবে তখন আদায় করে দেবে। এ দম সে আগামী বছরও আদায় করতে পারবে নিঃসন্দেহে। এখন এ ব্যক্তি আগামী বছর উদাহরণস্বরূপ কিরান হজে¦র ইহরাম করে হজ¦ করতে গেল অতঃপর হজে¦র কাজ সম্পাদন করার পর কিরানের দমে শুকর আদায়ের উদ্দেশ্যে সে উট বা গরু ক্রয় করল এবং সাথে সাথে এ পশুতে সে বিগত বছরের তামাত্তু হজে¦র দম আদায়েরও নিয়ত করল তাহলে তার উভয় দমই এ পশু দ্বারা আদায় হয়ে যাবে। এভাবে একটি পশুতে একই ব্যক্তির দমে তামাত্তু এবং দমে কিরান আদায় হওয়া খুবই সম্ভব বিষয়। এ বিশ্লেষণ অনুযায়ী মুলতাকাল আবহুর’-এর বক্তব্যও একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রজোয্য হতে কোনো বাধা নেই।

তিনি নিজের মত প্রতিষ্ঠার জন্য কাযী খান রাহ.এর ইবারতÑ

و لو ضحى غني بدنة عن نفسه و عن ستة من أولاده، ليس هذا في ظاهر الرواية. و قال الحسن بن زياد رحمه الله تعالى في كتاب الأضحية له : إن كان أولاده صغارا جاز عنه وعنهم جميعا في قول أبي حنيفة و أبي يوسف رحمهما الله تعالى.

Ñএর ব্যাপারে বলেছেন যেউক্ত বক্তব্যে শিশুর অংশের মালিক শিশু নিজেইপিতা নয়। এবং উক্ত ইবারত শিশুর পক্ষ থেকে ওয়াজিব কুরবানী সম্পর্কিত। তাই এক্ষেত্রে পিতা যেহেতু ঐ অংশের মালিক নয় সুতরাং ঐ গরুতে পিতার একাধিক অংশ নেই। তাই কাযী খানের এ বক্তব্য দ্বারা একটি পশুতে এক ব্যক্তির একাধিক অংশ রাখা জায়েযÑ তা দলীল হিসাবে উপস্থাপনযোগ্য নয়।

হযরত রাহ.এর উক্ত কথা যে সঠিক নয় তা তো বিখ্যাত ফকীহ ও ইমাম নুসাইর ইবনে ইয়াহইয়া রাহ.মুহাম্মাদ ইবনে মুকাতিল রাহ.মুহাম্মাদ ইবনে সালামা রাহ.আবু মুতী‘ রাহ.এর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট। তাঁরা সুস্পষ্টই বলেছেন যেশিশুর অংশের মালিক পিতা। শিশু সন্তান কুরবানীর সওয়াব পাবে। শিশুর অংশের মালিক সে নিজে তখনই হবেযদি তার  সম্পদ হতে পিতা কুরবানী করে। এ মাসআলা সুস্পষ্টভাবেই ফিকহের কিতাবে উল্লেখ আছে। আর সেক্ষেত্রে শিশুই যেহেতু এ গোশতের মালিকতাই এ গোশত কী করা হবেÑ তারও আলোচনা ফিক্হবিদগণ পৃথকভাবে করেছেন। কিন্তু এ মাসআলায় ফিক্হবিদগণ এ আলোচনা করেননি। কারণ সে তো এ গোশতের মালিকই নয়। আর উক্ত এবারত শিশুর পক্ষ থেকে পিতার নফল কুরবানী সংক্রান্ত তাতো ইমদাদুল ফাতাওয়ায় সুস্পষ্টই বিবৃত হয়েছে। তাই উক্ত বক্তব্যকে ওয়াজিবের উপর প্রয়োগ করা ভ্রম বৈ কিছু নয়।

দ্বিতীয় কথা হলশিশু সন্তানের পক্ষ থেকে কুরবানী করা জাহিরুর রিওয়ায়াতে মুস্তাহাব বলা হয়েছে আর নাদিরুর রিওয়ায়াতে ওয়াজিব বলা হয়েছে। প্রশ্ন হলএ হুকুম বা বিধানটা কার ওপরনিঃসন্দেহে পিতার ওপর। যেমন আকীকা করা পিতার দায়িত্ব। আকীকার গোশতের মালিকও পিতা। তিনি তাতে নিজ ইচ্ছানুযায়ী হস্তক্ষেপ বা ব্যবহার করতে পারেন। কুরবানীর বিষয়টাও অনুরূপ। পিতা যখন নিজ সম্পদ হতে শিশু সন্তানের পক্ষ থেকে কুরবানী করবেন এ কুরবানীর মালিকও তিনিই থাকবেন। একজনের সম্পদ অন্যজন তখনই মালিক হবেযখন তা অন্যকে হেবা বা দান করে দেয়া হবে। সুতরাং উক্ত ফতোয়াগ্রন্থে যে বলা হয়েছেÑ শিশুই ঐ অংশের মালিকÑ ফিক্হবিদগণের বক্তব্যের আলোকে তা সহীহ নয়। এর স্বপক্ষে উক্ত গ্রন্থে ফিক্হবিদগণ থেকে একটি দলীলও পেশ করা সম্ভব হয়নিবরং সম্পূর্ণ অনুমান নির্ভর কথা বলা হয়েছে। শিশু সন্তানের পক্ষ থেকে কুরবানী করা সম্পর্কিত বক্তব্যকে তো ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ক্রিতদাসের পক্ষ থেকে মনিবের কুরবানী করার মাসআলা হয়ত খুঁজে পাননি অথবা তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কারণ ক্রিতদাসের পক্ষ থেকে মনিবের কুরবানী করার মাসআলায় ঐ ধরনের কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর সুযোগই নেই।

এরপর তিনি ফতোয়া কাযীখান (৩/৩৪৯) এর আরেকটি ইবারত দ্বারা নিজের বিচ্ছিন্ন মতটি প্রমাণ করতে চেয়েছেন। অথচ সে ইবারতেরও তাঁর দাবির সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। বিষয়টি এতটাই স্পষ্ট যেএ নিয়ে আলাদাভাবে পর্যালোচনার প্রয়োজন বোধ করছি না। আসলে পূর্ববর্তী ফকীহগগণের উপরে বর্ণিত স্পষ্ট ফতোয়াগুলো যদি তাঁর দেখার সুযোগ হতো তাহলে তিনি কাযীখানের এসব বক্তব্য উদ্ধৃত করার কসরতই করতেন না।

কুরবানীর সাথে আকীকাঈসালে সওয়াবের অংশ রাখা সম্পর্কিত  ভারত পাকিস্তানের মুফতীগণের  ফতোয়া

ইমদাদুল ফাতাওয়া

سوال۔ گائے یا اونٹ کی قربانی میں دو تین آدمی شریک ہوں ان میں سے ایک نے یا ایک سے زائد نے یہ خیال کیا کہ جب سات آدمی تک گائے یا اونٹ کی قربانی میں شریک ہو سکتے ہیں تو میں رسول اللہ صلوسلم عل          یا اور کسی بزرگ کی طرف سے یا اور کسی اپنے عزیز قریب دوست کی طرف سے خواہ وہ زندہ ہیں یا ان کا انتقال ہوچکا ہے شریک ہو جاؤں اور سات حصہ پورے کر لوں اور ان کی طرف سے بقدر حصہ قیمت ادا کروں یہ جائز ہے یا نہیں؟

الجواب۔جائز ہے  کیونکہ حی اور میت کی طرف سے قربانی کا یکساں حکم ہے في الدر المختار وإن مات أحد السبعة وقال الورثة اذبحوا عنه وعنكم صح، إلى قوله لقصد القربة من الكل. اه‍ والله أعلم

গরু অথবা উটের কুরবানীতে দুই/তিন ব্যক্তি শরীক হয়েছে। তাদের মধ্যে এক বা একাধিক ব্যক্তি এমন চিন্তা করলযখন একটি গরু বা উটে সাত ব্যক্তি পর্যন্ত শরীক হতে পারেতাহলে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে অথবা জীবিত বা মৃত কোনো বুযুর্গ বা কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধুর পক্ষ থেকে অংশ নেব এবং সাত অংশ পূর্ণ করব এবং তাদের ঐ অংশের মূল্য পরিশোধ করে দেব। এটা কি জায়েয হবে?

উত্তর : জায়েয হবে। কেননা জীবিত ও মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানীর একই বিধান। Ñইমদাদুল ফাতাওয়া ৩/৫৩২

দারুল উলুম দেওবন্দএর ফতোয়া

একই পশুতে এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানীআকীকা সংক্রান্ত একটি প্রশ্নের উত্তর :

الجواب (الف- ب) ایک گائے میں قربانی کا حصہ اور عقیقوں کے حصے لے سکتے ہیں ۔ قربانی اور عقیقہ  ادا ہو جاوے گا دوسری صورت میں بھی عقیقہ صحیح ہے ایک گائے میں دو تین چار سات تک عقیقے ہو سکتے ہیں۔فقط

উত্তর : একটি গরুতে কুরবানী এবং আকীকার অংশ রাখতে পারবে। এতে কুরবানী ও আকীকা উভয়টিই আদায় হবে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রেও আকীকা সহীহ। একটি গরুতে দুইতিনচারএভাবে সাত পর্যন্ত আকীকা হতে পারে।

Ñফতোয়া দারুল উলূম দেওবন্দখ. ১৫পৃষ্ঠা ৬১৩

কিফায়াতুল মুফতী

سوال ۔ گائے یا بیل میں تو سات آدمیوں کی قربانی چلتی ہے۔ کیا ایک ہی گائے یا بیل میں سات لڑکوں یا لڑکیوں کا بھی چلتا ہے؟

جواب۔ ایک گائے میں  عقیقہ کے سات حصے ہو سکتے ہیں جس طرح قربانی کے سات حصے ہو سکتے ہیں۔

প্রশ্ন : গরু অথবা ষাঁড় দ্বারা তো সাত ব্যাক্তর পক্ষ থেকে কুরবানী করা যায়। প্রশ্ন হলএকটি গরু বা ষাঁড় দ্বারা কি সাত ছেলে বা মেয়ের আকীকা করা যাবে?

উত্তর : এক গরুতে আকীকার সাত অংশ হতে পারে। যেমনটি কুরবানীর ক্ষেত্রে সাত অংশ হতে পারে। Ñকিফায়াতুল মুফতী ১২/১৬৩

ফাতাওয়া উসমানী

جواب۔  گائے میں عقیقہ ہو جاتا ہے دو حصے لڑکے کی طرف سے اور ایک حصہ لڑکی کی طرف سے کیا جائے اس طرح مذکورہ گائے میں تین لڑکوں اور ایک لڑکی کا عقیقہ ہو جائے گا

উত্তর : গরু দ্বারাও আকীকা করা যায়। দুই অংশ পুত্র সন্তানের পক্ষ থেকে রাখা হবে আর এক অংশ কন্যা সন্তানের পক্ষ থেকে। এতে করে উল্লিখিত গরু দ্বারা তিন ছেলে ও এক মেয়ের আকীকা আদায় হয়ে যাবে। Ñফাতাওয়া উসমানী ৪/১৩৩

জামিআতুল উলূমিল ইসলামিয়াহবিন্নূরী টাউনকরাচীর ফতোয়া

اسی طرح اگر ایک ہی شخص ایک بڑے جانور میں اپنی ہی طرف سے ایک حصہ  قربانی کا اور ایک حصہ کسی اور واجب کا یا کسی نفلی چیز کا رکھتا ہے تو  بھی جمہور اہل علم کے نزدیک   اس ایک شخص کی ان مختلف نیات کا اعتبار ہوگا، اس لیے نصاً بات معلوم ہے کہ بڑے جانور میں سات حصے ہوتے ہیں۔البتہ اس صورت میں مفتی رشید  احمد لدھیانوی صاحب نور اللہ مرقدہ کی رائے یہ تھی  کہ ایک بڑے جانور میں ایک شخص کی مختلف نیات کا اعتبار نہیں ہے، یہ حضرت کا تفرد تھا   جسے دیگر معاصر اہلِ علم نے قبول نہیں کیا تھا، ہمارے دارالافتاء جامعہ علوم اسلامیہ علامہ یوسف بنوری ٹاؤن کے اکابرین نے بھی  دیگر اہلِ علم کی طرح اس رائے کو قبول نہیں کیا تھا، لہذا  ایک بڑے جانور میں خواہ مختلف لوگ یا ایک شخص متعدد عبادات کی نیت کرتا ہے تو اس کا اعتبار ہوگا۔

অনুরূপ এক ব্যক্তি যদি একটি বড় পশুতে নিজের পক্ষ থেকে এক অংশে কুরবানীরএক অংশে তারই অন্য কোনো ওয়াজিবের অথবা কোনো নফলের নিয়ত করল তবে এক্ষেত্রেও জুমহুর আলেমগণের নিকট এক ব্যক্তির এমন ভিন্ন ভিন্ন নিয়ত গ্রহণযোগ্য হবে। কারণ হাদীসে সুস্পষ্ট  আছে যেবড় পশুতে সাতটি অংশ থাকে। তবে এক্ষেত্রে মুফতী রশীদ আহমাদ লুধিয়ানবী ছাহেবের মত ছিলএকটি বড় পশুতে এক ব্যক্তির বিভিন্ন নিয়ত গ্রহণযোগ্য নয়। এটি হযরতের ব্যক্তিগত মত ছিলসমকালীন আলেমগণ তার এ মতকে গ্রহণ করেননি। আমাদের জামিআতুল উলূমিল ইসলামিয়া বিন্নূরী টাউনের দারুল ইফতার আকাবিরগণও অন্যান্য আহলে ইলমের মত তাঁর এ মতকে গ্রহণ করেননি। সুতরাং একটি বড় পশুতে চাই ভিন্ন ভিন্ন শরীক হোক অথবা এক ব্যক্তি বিভিন্ন প্রকার ইবাদতের নিয়ত করুকÑ তা গ্রহণযোগ্য হবে। (দেখুনফতোয়া নং ১৪৩৯০৯২০১৫৭৯)

মুফতী মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী রাহ.এর ফতোয়া

سوال۔ اگر کوئی شخص بڑے جانور میں بنیت عقیقہ شریک ہوجائےۓ تو درست ہوگا یا نہیں ہیں جیسے سات حصے ہیں زید نے اس میں دو حصے سے قربانی کے لئے اور ایک حصہ اسی جانور میں  عقیقہ کا لیا تو اس حالت میں عقیقہ درست ہو گا یا نہیں چاہے  پیدائش سے ساتویں دن پڑے یا نہ پڑے کسی قسم کی کراہت تو نہیں؟

প্রশ্ন : কোনো ব্যক্তি যদি বড় একটি পশুতে আকীকার নিয়তে শরীক হয় তাহলে কি তা সহীহ হবেযেমন একটি বড় পশুর সাতটি অংশ হতে যায়েদ নামের ব্যক্তি দুই অংশ কুরবানীর আর এক অংশ আকীকার জন্য রাখলো। এক্ষেত্রে কি আকীকা আদায় হবেচাই ঐ দিনটি জন্মের সপ্তম দিন হোক অথবা না হোকএতে কি মাকরূহ হবে?

الجواب حامدا ومصلیا۔ اس صورت میں عقیقہ بھی درست ہے قربانی بھی صحیح ہے بہ نیت عقیقہ کے جانور میں حصہ خریدنے سے کچھ خرابی نہیں  ہوتی

প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে আকীকাও আদায় হবে এবং কুরবানীও আদায় হবে। আকীকার নিয়তে কুরবানীর পশুতে অংশ নেয়ার দ্বারা কোনো অসুবিধা হবে না। Ñফাতাওয়া মাহমুদিয়াহ ১৭/৫১৫

তিনি আরেকটি প্রশ্নের উত্তরে চূড়ান্ত ফায়সালা হিসাবে বলেন :

الحاصل : ایک شخص ایک گائے کی  قربانی کرے اور اس میں جہات  متعددہ تقرب کی نیت کرے تو اس کے عدم جواز کی کوئی دلیل نہیں.

মোটকথাএক ব্যক্তি যদি একটি গরু কুরবানী করে আর তাতে ভিন্ন ভিন্ন প্রকার  ‘কুরবতের’ (আল্লাহর নৈকট্য অর্জন) নিয়ত করে তাহলে তা নাজায়েয হওয়ার কোনো দলীল নেই। Ñফাতাওয়া মাহমুদিয়াহ ১৭/৪১৭

কিতাবুল ফাতাওয়া

جواب۔ ایک ہی جانور میں قربانی اور عقیقہ  کا حصہ ملا کر کیا جاسکتا ہے کیونکہ دونوں کا مقصد اللہ تعالی کی قربت اور اجر و ثواب کا حاصل کرنا ہے۔

উত্তর : একই পশুতে কুরবানী ও আকীকার অংশ রাখা যাবে। কেননা উভয়টির উদ্দেশ্যÑ আল্লাহ তাআলার নৈকট্য ও সওয়াব অর্জন। Ñকিতাবুল ফাতাওয়া ৪/১৬৯

কিতাবুন নাওয়াযিল

قربانی اور عقیقہ دونوں میں قربت اور عبادت کی جہت پائی جاتی ہے؛ لہٰذا کسی بڑے جانور میں ایک ہی شخص کی طرف قربانی اور عقیقہ دونوں کا حصہ لینا درست ہے۔

কুরবানী এবং আকীকা উভয়টির মধ্যে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন ও ইবাদত পাওয়া যায়। তাই একটি বড় পশুতে এক ব্যক্তি কুরবানী ও আকীকা উভয়টির জন্য অংশ রাখতে পারবে। Ñকিতাবুন নাওয়াযিল ১৪/৬৮৭

ফাতাওয়া কাসেমিয়া

الجواب وباللہ التوفیق: ایک شخص بڑے جانور میں مختلف جہات کی نیت کرسکتا ہے یا نہیں ؟ اس کو مفتی رشید صاحبؒ نے ناجائز لکھا ہے مگر حضرت فقیہ الامت مفتی محمود صاحبؒ نے اس کو جائز لکھا ہے اور جواز کا قول ہی زیادہ صحیح اور مفتی بہ ہے۔

উত্তর : এক ব্যক্তি বড় একটি পশুতে বিভিন্ন নিয়ত করতে পারবে কি নাÑ এ ব্যাপারে মুফতী রশীদ আহমাদ লুধিয়ানবী রাহ. নাজায়েয বলেন। কিন্তু হযরত ফকীহুল উম্মত মুফতী মাহমূদ ছাহেব রাহ. জায়েয বলেন। আর জায়েযের মতটি অধিক বিশুদ্ধ এবং মুফতা বিহী। Ñফাতাওয়া কাসেমিয়া ২২/৩৪১

هذا، وصلى الله تعالى على سيدنا و مولانا محمد وآله وصحبه وبارك وسلم.

কুরবানীর শরীক সংখ্যা কি বেজোড় হওয়া জরুরি

কিছু লোককে বলতে শোনা গেছে, যে পশুতে সাতজন শরীক হতে পারে তাতে শরীকের সংখ্যা বেজোড় হওয়া জরুরি। সুতরাং একটি গরুতে এক, তিন, পাঁচ বা সাতজন শরীক হতে পারবে। দুই, চার বা ছয়জন শরীক হতে পারবে না।

এটা বিলকুল গলত কথা। একটি গরু যেমন এক ব্যক্তি একা কুরবানী করতে পারে তেমনি দুই থেকে সাত পর্যন্ত যে কোনো সংখ্যক শরীক একত্র হয়েও কুরবানী করতে পারে। এতে কোনো বাধা নেই। তেমনি শরীকের সংখ্যা জোড় না হয়ে বেজোড় হওয়ার মাঝেও এমন আলাদা কোনো ফযীলত নেই, যার কারণে পাঁচ শরীকের স্থলে ছয় শরীক বা ছয় শরীকের স্থলে সাত শরীক একত্র হয়ে কুরবানী করতে উৎসাহ দেওয়া যায়।

 

কুরবানীর গোশত বিতরণ

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

কুরবানীর দিন দুপুরের পর থেকে একটা সাধারণ দৃশ্য সকলেরই চোখে পড়ে। কুরবানীদাতার বাড়ির দরজায় একদল মানুষের ভিড়। তাদের কেউ একা এবং কেউ পরিবারসহ। কেউ পেশাদার ভিক্ষুক এবং কেউ গরীব কর্মজীবি, যার নিজের কুরবানী দেওয়ার সামর্থ্য নেই। আজ তারা সবাই এক কাতারে। কুরবানীর গোশত সংগ্রহের জন্য তারা দলে দলে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। কুরবানীদাতা নিজে বা তার পক্ষ থেকে কোনও লোক তাদের হাতে হাতে এক-দুই টুকরা করে গোশত বিতরণ করছে। হাতে গোশত বিতরণ করছে আর মুখে কাউকে ধমকাচ্ছে, কাউকে বকছে, কাউকে তাড়া করছে এবং কারও উদ্দেশ্যে বিশেষ কোনও মন্তব্য করছে।

এ দৃশ্য কতটা সুখকর? কুরবানী একটি মহান ইবাদত। তার সাথে এ দৃশ্য খাপ খায় কি? কুরবানী করা ওয়াজিব, এর গোশত বিতরণ সুন্নত এবং এর গোশত খাওয়াও সুন্নত। ঈদুল আযহার নামকরণই করা হয়েছে এ মহান ইবাদতটির নামে। আল্লাহ তাআলা এ দিন নামায আদায়ের পাশাপাশি কুরবানী করারও হুকুম দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَ انْحَرْ.

সুতরাং তুমি নিজ প্রতিপালকের (সন্তুষ্টি অর্জনের) জন্য নামায পড় ও কুরবানী দাও। -সূরা কাউসার (১০৮) : ২

প্রথমে নামাযের হুকুম, তারপর কুরবানীর। যেন বলা হচ্ছে- নামাযের মাধ্যমে প্রথমে আল্লাহর সামনে আত্মনিবেদিত হও, তারপর সে আত্মনিবেদনের নিদর্শনস্বরূপ কুরবানী কর। এজন্যই কুরবানী করতে হয় ঈদের নামায আদায়ের পর, তার আগে নয়। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-

مَنْ كَانَ ذَبَحَ قَبْلَ الصّلَاةِ فَلْيُعِدْ.

কেউ নামায আদায়ের আগে যবাহ করলে সে যেন (নামাযের পর) পুনরায় যবাহ করে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৪৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬২; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৯৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৫৩

যেহেতু এ যবাহ কেবলই আল্লাহর উদ্দেশ্যে, সে হিসেবে এর গোশত কারও জন্যই খাওয়া জায়েয হওয়ার কথা ছিল না, কিংবা আর সকলের জন্য খাওয়া জায়েয হলেও কুরবানীদাতার জন্য খাওয়ার অনুমতি থাকার কথা নয়। কিন্তু আল্লাহ তাআলা বড়ই মেহেরবান। তিনি এটা সকলের জন্যই খাওয়া বৈধ করে দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেন-

فَكُلُوْا مِنْهَا وَاَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَ الْمُعْتَرَّ، كَذٰلِكَ سَخَّرْنٰهَا لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ.

তখন তার গোশত থেকে নিজেরাও খাও এবং ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও এবং তাকেও, যে নিজ অভাব প্রকাশ করে। এভাবেই আমি এসব পশুকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। -সূরা হজ্ব (২২) : ১৩৬

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে ইরশাদ করেছেন-

كُلُوْا وَادّخِرُوْا وَتَصَدّقُوْا.

তোমরা খাও, জমা করে রাখ এবং দান-খয়রাত কর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৬৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭২; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ৪৪২৬; মুআত্তা মালিক, হাদীস ২১৩৫

এভাবে কুরবানীর গোশত নিজে খাওয়ার এবং অন্যকে খাওয়ানোর জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এ যেন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আতিথেয়তা। সমস্ত মুসলিম এ দিনগুলোতে আল্লাহর মেহমান। তাঁর জন্য নিবেদিত পশুর গোশত তিনি মুসলিমদের জন্য অবারিত করে দিয়েছেন, যাতে তারা তা খেয়ে খেয়ে তাঁর অনুগ্রহের শুকর আদায় করে। আল্লাহ তাআলার যিয়াফত ও আতিথেয়তা গ্রহণ করার মধ্যেই বন্দেগীর মাহাত্ম্য। কাজেই কুরবানীর গোশত খাওয়া উদরপূর্তিমাত্র নয়; বরং এর মধ্যে রয়েছে ইবাদতের মহিমা। আর এর গোশত বিতরণও নয় গরীবের প্রতি করুণা; বরং এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যিয়াফতের প্রতিনিধিত্ব। কুরবানীদাতা যেন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের মেহমানদারী করছে। তো এটা ইবাদত ছাড়া আর কী? ইবাদত বলেই গোশত বিতরণে এ নিয়মকে মুস্তাহাব করে দেওয়া হয়েছে যে, সবটা গোশত তিন ভাগ করা হবে। তার এক ভাগ নিজেরা খাওয়া হবে, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনদের দেওয়া হবে আর এক ভাগ দেওয়া হবে গরীব-মিসকীনদের।

সুতরাং স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কুরবানীর পশু জবাই, তার গোশত বিতরণ ও গোশত খাওয়া সবটাই ইবাদত। ইবাদত করার দ্বারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভ হয় ও বিপুল ছাওয়াব পাওয়া যায়। কুরবানীর আদ্যোপান্ত যখন ইবাদত, তখন এর দ্বারাও আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও ছাওয়াব অর্জিত হবে বৈ কি। তা হবে কুরবানীর পশু যবাহ করার দ্বারা, তার গোশত খাওয়ার দ্বারা এবং গোশত বিতরণ করার দ্বারা। তা কত এর ছাওয়াব?

হাদীসে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- কুরবানীর দিন আদম সন্তান এমন কোনও আমল করতে পারে না, যা আল্লাহ তাআলার কাছে রক্তপ্রবাহ অপেক্ষা বেশি প্রিয়। কিয়ামতের দিন কুরবানীর পশু তার শিং, তার ক্ষুর ও পশমসহ হাজির হবে। যবাহের পর তার রক্ত মাটিতে পড়ার আগে আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবূল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা এর দ্বারা মনেপ্রাণে খুশি হয়ে যাও। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫৬৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১২৬

(قال الترمذي : هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيب)

অবশ্য এর জন্য শর্ত হচ্ছে ইবাদতটি করা হবে এর জাহিরী ও বাতিনী যাবতীয় রীতি-নীতিসহ। গোশত বিতরণের উল্লিখিত রেওয়াজ ও দৃশ্য সে রীতি-নীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কি?

ইবাদতে বিনয়-নম্রতা কাম্য। মন থাকবে আল্লাহ অভিমুখী, তাঁর ভয়ে কম্পিত, তাঁর ইশক ও মহব্বতে তাড়িত এবং তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা-ভক্তিতে আপ্লুত। মনের এ ভাবাবেগ অব্যাহত থাকা বাঞ্ছনীয় ইবাদতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটা সময়। তবে আমরা দুর্বল। আমাদের আছে নফসের নানারকম উৎপাত। আছে শয়তানের উপর্যুপরি প্ররোচনা। এ অবস্থায় ইবাদতের সঙ্গে মনের গভীর সংযোগ বজায় রাখা আমাদের পক্ষে একটু কঠিনই। অসীম দয়াময় আল্লাহ আমাদের এ দুর্বলতাকে ওযর হিসেবে দেখবেন বলে আমরা আশা করতেই পারি। কিন্তু আমাদের বাহ্যিক ধরন-ধারণও যদি ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়, উপরন্তু আমাদের কর্মপন্থা দ্বারা যদি ইবাদতের মহিমা ক্ষুণ্ন হয় আর এ অবস্থায় প্রকাশ্য কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করে যাই, তবে সত্যিকার অর্থে তা ইবাদত হবে কতটুকু? আমাদের দ্বীন কি এরকম ইবাদতেরই আদেশ আমাদের করেছে? না ইবাদতের নামে এমনসব আচার-অনুষ্ঠান পালন করা বাঞ্ছনীয়?

যে দৃশ্যের কথা বলা হল, কুরবানীর মহান ইবাদতের সঙ্গে তা আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কেননা গোশত বিতরণের প্রচলিত পদ্ধতি বিনয়নিষ্ঠ নয়। এর মধ্যে আছে অহমিকার আভাস। লোকজন আমার বাড়ির দুয়ারে ছুটে এসেছে। আমার হাত থেকে গোশত নেওয়ার জন্য হাত পেতে রেখেছে। আমি বিরক্তির সাথে দুই-এক টুকরা গোশত সেসব হাতে বিলিয়ে যাচ্ছি কিংবা সাগ্রহে বিতরণ করে দুর্বলের প্রতি করুণা করার অহমবোধে আপ্লুত হচ্ছি। এ ভাবধারা আর যাই হোক, মহান ইবাদতের সাথে খাপ খায় না। ইবাদতকালে মনের ভাব কেমন হবে সে সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-

وَ الَّذِیْنَ یُؤْتُوْنَ مَاۤ اٰتَوْا وَّ قُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ اَنَّهُمْ اِلٰی رَبِّهِمْ رٰجِعُوْنَ.

আর যারা যা দেওয়ার তা দেয় ভীত-কম্পিত হৃদয়ে এজন্য যে, তাদেরকে নিজ প্রতিপালকের কাছে ফিরে যেতে হবে -সূরা মু’মিনূন  (২৩) : ৬০

আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে-কোনও ইবাদত ও যে-কোনও দান-বিতরণ এরকম ভীত-কম্পিত মনেই হওয়া উচিত। এটাই ইবাদতের প্রাণশক্তি।

হাঁ, ইবাদতের প্রাণশক্তি হচ্ছে তাকওয়া ও আল্লাহভীতি। নামায, রোযাসহ প্রতিটি ইবাদতের মধ্যে এ প্রাণশক্তি থাকা অপরিহার্য। মূলত এসব ইবাদতের মধ্য দিয়ে আল্লাহ তাআলা বান্দার কাছে যা চান তা কেবল তাকওয়াই। কুরবানী সম্পর্কেও আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

لَنْ یَّنَالَ اللهَ لُحُوْمُهَا وَ لَا دِمَآؤُهَا وَ لٰكِنْ یَّنَالُهُ التَّقْوٰی مِنْكُمْ .

আল্লাহর কাছে তাদের (কুরবানীর পশুর) গোশত পৌঁছে না আর তাদের রক্তও না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া ও আল্লাহভীতিই। -সূরা হজ্ব (২২) : ৩৭

যার অন্তরে আল্লাহর ভয় আছে, সে তার কাছে আল্লাহর বান্দাদের হাত পাতায় খুশি হতে পারে না। হাদীসে প্রকৃত মুমিন তাকেই বলা হয়েছে, যে নিজের জন্য যা পসন্দ করে, অন্য মুমিনের জন্যও তাই পসন্দ করে থাকে আর নিজের জন্য যা অপসন্দ করে, অন্যের জন্যও তা অপসন্দ করে। কোনও আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মুমিন অন্যের কাছে হাত পাতা ও অন্যের দুয়ারে ধরনা দেওয়া পসন্দ করে কি? তাহলে সে অন্যের জন্য কেন তা পসন্দ করবে? কেন সে এতে খুশি হবে যে, কুরবানীর গোশতের জন্য তার মুমিন ভাই-বোনেরা তার দুয়ারে এসে ধরনা দেবে? এতে খুশি হওয়া তখনই সম্ভব, যখন সে নিজেকে তাদের তুলনায় বড় মনে করবে। ইবাদত শিক্ষা দেয় নিজেকে সব মুমিন অপেক্ষা ক্ষুদ্র ভাবতে। বিশেষত কুরবানী তো আত্মত্যাগেরই উদ্বোধক। আমিত্ব ত্যাগ ও অহমিকা বিসর্জনের মাধ্যমে নিজেকে আল্লাহ তা‘আলার সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র বান্দারূপে দেখতে না পেলে কুরবানী দ্বারা বিশেষ কী অর্জিত হল? যদি প্রকাশ্যে পশু যবাই হয় অপরদিকে অন্তরস্থ পাশবিকতা হয় আরও পরিপুষ্ট, তবে সে কুরবানী কেবলই অনুষ্ঠানসর্বস্বতা।

ইসলাম মানুষকে আনুষ্ঠানিক বানাতে আসেনি। তার উদ্দেশ্য আপন শিক্ষায় মানুষের দেহমন বিকশিত করে তোলা। অহমিকা বিলোপ ছাড়া সে বিকাশ কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। বস্তুত কুরবানীর গোশত বিতরণের বর্তমান রেওয়াজ অহমিকার বিলোপ নয়; বরং তার বাড়-বাড়ন্তেই ভূমিকা রাখে। সে কারণে এ রেওয়াজ বিলুপ্ত হওয়া উচিত। তা হবে তখনই, যখন কুরবানীদাতা তার কুরবানীর গোশত মানুষের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেবে।

কুরবানীর গোশত নিয়ে মুসলিম ভাই-বোনদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়ানো বিনয়-ন¤্রতার পরিচায়ক। এটা অহমিকা নিরাময়ের এক কার্যকরী ওষুধও বটে। আপন সামর্থ্য অনুযায়ী এক পোটলা গোশত নিয়ে নিজে মুসলিম ভাইয়ের বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া আর গোশতের আশায় কুরবানীদাতার দুয়ারে সে ভাইয়ের হাজির হওয়া কিছুতেই এক কথা নয়। প্রথম পন্থায় গোশত বিতরণ ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এর দ্বারা আল্লাহর বান্দার ইজ্জত-সম্মান রক্ষা করা হয়, তার সামনে নিজ বিনয়-ন¤্রতা প্রকাশ করা হয় এবং তার প্রতি ভ্রাতৃত্ব ও মমত্বের আচরণ করা হয়। এসবই তাকওয়া ও আল্লাহভীরুতাপূর্ণ কাজ, যা কিনা ইবাদতের সারবস্তু। কুরবানী যখন এক ইবাদত, তখন তার গোশত এভাবেই বিতরণ করা বাঞ্ছনীয়। এর দ্বারা এ কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয় যে, যারা দুয়ারে দুয়ারে হাত পেতে বেড়ায় তাদেরকে কুরবানীর গোশত দেওয়া যাবে না বা দেওয়া জায়েয হবে না। তাদেরকে কুরবানীর গোশত দেওয়া জায়েয হবে বৈ কি, কিন্তু ইসলাম যে বিনয়, সৌন্দর্য এবং ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধের তা‘লীম দেয়, তার যথার্থ অনুশীলনের জন্য মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বিতরণই বাঞ্ছনীয়।

তা বাঞ্ছনীয় আরও এক কারণে। কুরবানীর গোশত বিতরণ যখন একটি ইবাদত, তখন এ বিতরণ কিছুতেই ভিক্ষাদানের মত হওয়া উচিত নয় আর এর গ্রহণও হওয়া উচিত নয় ভিক্ষাগ্রহণের মত। কেননা ইবাদত হচ্ছে পুণ্য ও মহত্ব, আর ভিক্ষা করা পাপ ও ক্ষুদ্রতা। ভিক্ষাকে বৃত্তি বানানো ইসলামী শিক্ষার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। প্রচলিত অনেক ধর্মে এটা একটা মহৎ কাজ হলেও আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল ও আত্মনিবেদনের শিক্ষাসম্পন্ন ইসলামে এর বৈধতা অস্বীকৃত। ভিক্ষাবৃত্তির বৈধতা তো দূরের কথা, সাময়িকভাবেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কারও কাছে হাত পাতার ইজাযত দেননি। তিনি বরং সাহাবায়ে কিরামের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন, যেন তারা কখনও কারও কাছে হাত না পাতেন। এ প্রতিশ্রুতি তারা অক্ষরে অক্ষরে রক্ষা করেছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে উটের পিঠে থাকা অবস্থায় হাত থেকে লাঠিটি পড়ে গেলে তাও তুলে দেওয়ার জন্য কাউকে অনুরোধ করেননি। নিজের কাজ নিজে করা হবে, নিজ অন্ন-বস্ত্র সংস্থানের জন্য নিজেকেই চেষ্টা করতে হবে, কোনওক্রমেই অন্যের গলগ্রহ হওয়া যাবে না এবং অলস সময় কাটানো নয়, সদা কর্মব্যস্ত থাকা হবে- এ শিক্ষাই ইসলাম আমাদের দিয়েছে।

যে ভিক্ষাবৃত্তিকে ইসলাম জায়েয রাখেনি এবং সাময়িকভাবে হলেও যে হাত পাতাকে ইসলাম পসন্দ করেনি, একজন মুসলিম নিজে তো কোনওক্রমে তা করবেই না; বরং অন্য কেউ তা করুক তাও তার কাছে কাম্য হতে পারে না। সুতরাং এ জাতীয় কর্মকা-কে একজন প্রকৃত মুসলিম আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে না, তাই তো স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এ কি অবস্থা যে, আমাদের সমাজে ভিক্ষাবৃত্তি ও মওসুমী হাত পাতার ব্যাপারটা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেল! আবার সে রেওয়াজ পবিত্র ইবাদতের অনুষঙ্গ হয়ে উঠল। ইবাদতের মওসুমে এখন ভিক্ষাদান ও ভিক্ষাগ্রহণের বাড়তি শোরগোল। ইবাদতের কেন্দ্রসমূহ বা কেন্দ্রের চত্বরগুলো আজ ভিক্ষা লেনদেনের জমজমাট বাজারে পরিণত।

আজ মসজিদের দরজায় ভিক্ষুকের ভিড়। জুমু‘আ, শবে বরাত এবং রমযান ও শবে কদরে তাদের বাড়তি দৌড়ঝাঁপ। তারাই যাকাত, ফিতরার অর্থ ও কুরবানীর গোশত বিতরণের ক্ষেত্র। যাকাতদাতা ঢাকঢোল পিটিয়ে ফকীর জড়ো করছে। ফিতরাদাতা তার দুয়ারে বা মসজিদের দরজায় ফকীর খুঁজছে। কুরবানীদাতার দুয়ারে কুরবানীর গোশত নিয়ে কাড়াকাড়ি হচ্ছে। অথচ যাকাত-দান ইসলামের প্রধান চার ইবাদতের একটি। ফিতরাও একটি অবশ্যপালনীয় ইবাদত। কুরবানী সম্পর্কে সকলের জানা যে, এটি একটি মহান ইবাদত এবং আমাদের মহান পিতা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস-সালামের আল্লাহপ্রেম ও অকল্পনীয় ত্যাগের স্মারক। এর প্রত্যেকটি পালন করার কথা গভীর শ্রদ্ধা-ভক্তি ও পরম আল্লাহভীতির সঙ্গে। সে শ্রদ্ধাভক্তি ও আল্লাহভীতির সঙ্গে কোনওরকম ভিক্ষাবৃত্তির কলঙ্ক যুক্ত হবে কেন? কেনই বা হাত পাতার মলিনতায় তা আচ্ছন্ন হবে? কথা তো ছিল যাকাতদাতা নিজে খুঁজে বেড়াবে, কোথায় আছে ধনীর পাঁচশ’ বছর আগে জান্নাতে যাওয়ার সুসংবাদপ্রাপ্ত সেই গরীব মুসলিম, যার হাতে সে গভীর শ্রদ্ধা-ভক্তির সঙ্গে যাকাতের অর্থ তুলে দেবে এবং এভাবে তা তুলে দিতে পেরে নিজেকে একজন সৌভাগ্যবান গণ্য করবে। ফিতরাদাতা পৌঁছে যাবে তার অসচ্ছল মুসলিম ভাইয়ের দুয়ারে আর তার হাতে ফিতরার অর্থ আদায় করে আল্লাহর কাছে কবূলিয়াতের আশাবাদী হবে। কুরবানীদাতা কুরবানীর গোশত যেমন মহব্বত ও আন্তরিকতার সাথে নিজ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে পৌঁছায়, তেমনি অভাবগ্রস্তদের বাড়িতেও গুরুত্বের সঙ্গে তা পৌঁছিয়ে দেবে আর মনে ভয় রাখবে, পাছে তার কোনও ত্রুটির কারণে এ বিতরণ আল্লাহ তাআলার কাছে অগ্রাহ্য হয়ে যায়।

কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ যে গরীবদের দিতে বলা হয়েছে, আমরা যেন তার অর্থ করে নিয়েছি প্রচলিত অর্থে যারা ফকীর-মিসকীন তাদেরকে দেওয়া। অর্থাৎ যারা মানুষের দুয়ারে হাত পেতে বেড়ায় তাদেরকে। অস্বীকার করব না যে, তারাও একটি খাত। কিন্তু আপত্তি হয় তখনই, যখন দুয়ারে ধরনা না দেওয়া গরীব নর-নারীর কোনও খবর নেওয়া হয় না আর তাদের বাড়িতে গোশত পৌঁছানোর চেষ্টা না থাকায় কুরবানীর দিন হয় তারা কুরবানীর গোশত খাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকে, নয়তো ফকীর-মিসকীনদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে নিজ ছেলেমেয়েদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে। প্রকৃতপক্ষে সেটা তো কুরবানীর গোশত খাওয়া হল না। এটা অন্য সময়ের বাজার থেকে কেনা গোশতের মতই হল। এটা আমাদের অবহেলারই অনিবার্য ফল যে, একদিকে প্রকৃত গরীবের একাংশ কুরবানীর দিন কুরবানীর গোশত খেতে পায় না আর অপর এক অংশ কুরবানীদাতাদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়ানোর প্ররোচনা পায় আর এভাবে ভিক্ষাকর্মের বাড়-বাড়ন্ত হয়, যা কিছুতেই কাম্য ছিল না।

আজ কুরবানীর গোশত সম্পর্কেও বলতে হচ্ছে যে, তা গরীব ও অভাবগ্রস্তের বাড়িতে পৌঁছিয়ে দেওয়া চাই, যে কুরবানী করাই হয় ত্যাগের মানসিকতায় এবং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও ছাওয়াব লাভের আশায়। অথচ আমাদের ঐতিহ্য ছিল কতই না উচ্চমার্গীয়। একদা আমরা এই মুসলিম উম্মাহ্ সাধারণ দান-অনুদান ও সাহায্য-সহযোগিতাও মানুষের দ্বারে-দ্বারে পৌঁছে দিতাম। এ ঐতিহ্যের উদ্বোধন হয়েছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাতে এবং তাও তাঁর নবুওয়াতপ্রাপ্তির আগেই। নবুওয়াতের গুরুভারে তিনি যখন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত, তখন আম্মাজান খাদীজা রা. তো সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁকে সান্ত¡না যুগিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আল্লাহ তাআলা কিছুতেই আপনাকে নিঃসঙ্গ ছেড়ে দিতে পারেন না, কিছুতেই তিনি আপনাকে লাঞ্ছিত করতে পারেন না। কারণ আপনি আত্মীয়তা রক্ষা করেন, আয়-রোজগারে যারা অক্ষম তাদের ভার বহন করেন, নিঃস্ব ও অভাবগ্রস্তদের রোজগার করে দেন, অতিথির সেবা করেন এবং বিপন্ন মানুষের সাহায্য করেন। নবুওয়াতপ্রাপ্তির পরও তাঁর এ কল্যাণধারা অব্যাহত থেকেছে; বরং তা প্রবাহিত হয়েছে আরও প্রবল বেগে। তাঁর পর তাঁর খলীফাগণও সেবার প্রেরণায় মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রা. ও হযরত উমর ফারূক রা.-এর এ জাতীয় ঘটনাবলী জগৎজোড়া মশহুর। তাঁরা খুঁজে বেড়াতেন কোথায় কার কী সমস্যা, কার কী প্রয়োজন। যার প্রয়োজন এবং যার অভাব, সে কখন তাঁর দুয়ারে এসে হাত পাতবে সে অপেক্ষা তাঁরা করতেন না। এভাবেই চলেছে যুগ যুগ। তাঁদের উত্তরসূরীগণ এ আদর্শের চর্চায় কখনও কসুর করেননি। এমনকি এই অধঃপতন ও অবক্ষয়ের যুগেও অনেকে আছেন, যারা বিপন্ন মানুষের কাছে ছুটে যান এবং সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে অভাবগ্রস্তের বাড়িতে পৌঁছে যান। আজও এরকম লোকের সন্ধান মেলে, যারা কুরবানীর গোশত নিয়ে নিজ বাড়িতে বসে থাকে না; বরং যারা কুরবানী দিতে পারে না, গভীর মমতার সাথে তাদের জীর্ণ কুটিরে তা পৌঁছে দেয়। আমরা তাদের থেকে শিক্ষা নিতে পারি।

এতটুকু কষ্ট আমরা আনন্দের সঙ্গেই করতে পারি যে, আপন এলাকায় কারা কারা কুরবানী দেয় না বা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না তার খোঁজ নেব এবং আগে থেকেই তাদের একটা তালিকা তৈরি করে রাখব। তারপর কুরবানীর দিন সে তালিকা অনুযায়ী কুরবানীর গোশত তাদের বাড়ি পৌঁছে দেব।

দরকার এ ব্যাপারে গণসচেতনতা তৈরির। প্রত্যেক মহল্লার কুরবানীদাতাদের চিন্তা-চেতনায় প্রচলিত পদ্ধতিতে গোশত বিতরণের কী ক্ষতি এবং বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বিতরণের কী ফায়দা তা যদি সঞ্চার করে দেওয়া যায়, তবে আমরা সহজেই আমাদের হারানো ঐতিহ্যে ফিরে যেতে পারি। প্রত্যেক মহল্লার কুরবানীদাতাগণ যদি আগে থেকেই তালিকা তৈরি করে ফেলে এবং সে অনুযায়ী কুরবানীর গোশত মানুষের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেয়, তবে কুরবানীর দিন আঁকা হয়ে যেতে পারে সামাজিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির এক নয়নাভিরাম দৃশ্য, যেখানে থাকবে না কুরবানীদাতার বাড়ির দরজায় ফকীর-মিসকীন ও গরীব-দুঃখীর ভিড়; বরং কুরবানীদাতা বা তার লোকজনকেই দেখা যাবে গরীব-মিসকীনদের বাড়িতে বাড়িতে ছোটাছুটি করছে। সেখানে গোশত বিতরণে ভিক্ষাদানের দৃশ্য পরিলক্ষিত হচ্ছে না; বরং তাতে ইবাদতের মহিমা ভাস্বর হয়ে আছে এবং কুরবানীদাতা অনুভব করছে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অভাবগ্রস্ত ভাইদের যিয়াফত করতে পারার অমলিন আনন্দ।

وصلى الله تعالى على سيدنا ونبينا محمد وعلى آله وصحبه وبارك وسلم.

 

পরিশিষ্ট : হযরত মাওলানা আবুল বাশার ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় কুরবানীর হাকীকত ও রূহ বর্ণনা করেছেন। পাশাপাশি আমাদের সমাজে প্রচলিত অথচ সংশোধনযোগ্য একটি প্রথা চিহ্নিত করে দিয়েছেন।

এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা যে, নিজ নিজ এলাকা ও মহল্লায় যারা কুরবানী দিতে অক্ষম তাদের তালিকা প্রস্তুত করা। যাতে ইকরাম ও সম্মানের সঙ্গে তাদের ঘরে ঘরে গোশত পৌঁছে দেয়া যায়।

আরো সহজতার জন্য এমনও করা যেতে পারে যে, কোনো জায়গায়- উদাহরণস্বরূপ মসজিদের সামনে কুরবানীদাতাগণ যে যে পরিমাণ গোশত অসামর্থ্যবান ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করতে আগ্রহী তা নিজ দায়িত্বে পৌঁছে দেবেন। এরপর সেখান থেকে তালিকা অনুযায়ী প্রত্যেকের ঘরে গোশত পৌঁছে দেয়া হবে। শর্ত হল, এক্ষেত্রে কারো ওপর  কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়া যাবে না। কেউ যদি নিজের অংশ নিজেই প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে চায় সে সুযোগ যেন থাকে; তাকে এখানে জমা করতে বাধ্য করা যাবে না। আর এখানে যারা জমা করবে তাদেরকে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ জমা দিতে বাধ্য করা যাবে না। মোটকথা, যা-ই করা হবে এবং যতটুকুই করা হবে, প্রত্যেকে সন্তুষ্টচিত্তে ও স্বতস্ফূর্তভাবে করবে।

বিভিন্ন এলাকায় কুরবানীর গোশত বিতরণের ক্ষেত্রে আরো কিছু প্রথা চালু আছে, যেগুলো সংশোধনযোগ্য। যেমন :

এক. পুরো সমাজের সব কুরাবনীর পশু নির্ধারিত স্থানে জবাই করা। শুধু এতটুকুতে তো সমস্যা ছিল না। ইনতিজামের খাতিরে এমন করতে কোনো বাধা নেই। সমস্যা হল, প্রত্যেক কুরবানীর একটি অংশ বাধ্যতামূলকভাবে বিতরণের জন্য নিয়ে নেয়া হয়। এরপর সেগুলোকে একত্র করে সমানভাবে ভাগ করে সমাজের প্রত্যেককে অর্থাৎ যারা কুরবানী করেছে আর যারা করেনি সবাইকে একেক অংশ দিয়ে দেওয়া হয়। এটা গলদ তরিকা। যা অবশ্যই সংশোধনযোগ্য। এ সম্পর্কে আলকাউসারে (ডিসেম্বর সংখ্যা, ২০০৭ঈ., পৃষ্ঠা ৩৩-৩৫) বিস্তারিত লেখা হয়েছে। আগ্রহী পাঠকগণ তা মুতালাআ করতে পারেন।

দুই. নিজেদের কুরবানীর বাইরে সমাজের পক্ষ থেকে এক বা একাধিক পশু কুরবানী করা, যাতে সমাজের সকল কুরবানীদাতার অংশগ্রহণ করা জরুরি। এরপর সেগুলোর গোশত সমাজের অসামর্থ্যবান লোকদের ঘরে পৌঁছে দেওয়া।

এই পদ্ধতিও সংশোধনযোগ্য। কারণ যে কোনো আমল, যার বিষয়ে শরীয়ত শুধু তারগীব ও উৎসাহ প্রদান করেছে এবং তা পালন করা মানুষের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়েছে, এমন কাজকে সমাজের পক্ষ থেকে এমনভাবে আবশ্যকীয় বানিয়ে দেওয়া যে, শুধু সামাজিক চাপের কারণে মানুষ তা করতে বাধ্য হয়- শরীয়তের দৃষ্টিতে এমনটা করা বৈধ নয়।

প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, কুরবানীর ক্ষেত্রে অসামর্থ্যবান ব্যক্তিদের খেদমত করার একটি সূরত এটাও যে, যাদের তাওফীক আছে তারা কুরবানীর পশু ক্রয় করে অসামর্থ্যবান ব্যক্তিদের দিয়ে দিবে। তারা নিজেরা কুরবানী করবে। কিংবা তাদেরকে অর্থ দিয়ে দেবে। আর তারা নিজেরা পশু ক্রয় করে কুরবানী করবে।

কেউ কেউ তাদের নফল কুরবানী (পশু কিংবা তার মূল্য) অসামর্থ্যবান ব্যক্তিদের হাতে দিয়ে তাদেরকেই এর গোশত খাওয়ার অনুমতি দিয়ে দেয়। এই সূরতও জায়েয। তবে তার চেয়ে ভালো পদ্ধতি হল, কুরবানীটাই যেন তাদের পক্ষ থেকে হয় সে সুযোগ করে  দেয়া। অর্থাৎ পশু কিংবা তার মূল্য তাদেরকে হাদিয়া বা সদকা দিয়ে দেওয়া।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কুরবানীসহ সকল ইবাদত ইখলাসের মাধ্যমে পবিত্র করার এবং সুন্নতের মাধ্যমে আলোকিত ও বরকতপূর্ণ করার তাওফীক দান করুন- আমীন। – মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক দামাত বারাকাতুহু।

 

লেজ কাটা পশু কুরবানীর মান্নত করা ও তার গোশত খাওয়ার হুকুম কী?

প্রশ্ন

পুরা লেজ কাটা গরু আল্লাহর ওয়াস্তে কোরবানী করার মান্নত করেছে। এখন আমার প্রশ্ন হলো লেজ কাটা গরু দিয়ে কোরবানী হবে কিনা?

না হলে উক্ত গরু কি করবে?  মালিক গোস্ত কি নিজে খেতে পারবে?

বিস্তারিত জানালে ভাল হয়।

 

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

পূর্ণাঙ্গ লেজকাটা পশু দিয়ে নিজের উপর ওয়াজিব কুরবানী আদায় হবে না।

তবে যদি লেজকাটা পশু কুরবানী করার মান্নত করে, তাহলে মান্নতের কুরবানী আদায় হবে।

আর উক্ত মান্নতের পশুর গোশত মান্নতকারী ব্যক্তি  এবং ধনী ব্যক্তিরা খেতে পারবে না, বরং পুরোটাই গরীবদের দান করে দিতে হবে।

উল্লেখ্য যে, মান্নতের কুরবানীর পশু কুরবানী করার দ্বারা নিজের ওয়াজিব কুরবানী আদায় হবে না, বরং আলাদা অন্য পশু দিয়ে নিজের ওয়াজিব কুরবানী আদায় করতে হবে।

 

নিজের ওয়াজিব কুরবানী রেখে পিতার পক্ষ থেকে কুরবানী দিলে কুরবানীর হুকুম কী?

প্রশ্ন

যার উপর কুরবানী ওয়াজিব সে নিজের নামে না দিয়ে অন্যের নামে কুরবানী দিতে পারবে কিনা যেমন সে তার নিজের নামে না দিয়ে তার বাবার নামে দিলো অথচ ওয়াজিব তার উপরে? জাযাকুমুল্লাহু খাইরান

প্রশ্নকারী: ahmad Maymun

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

না। নিজের পক্ষ থেকেই কুরবানী দিতে হবে। নিজের উপর কুরবানী আবশ্যক হলে অন্যের পক্ষ থেকে কুরবানী দিলে নিজের ওয়াজিব কুরবানী আদায় হবে না।

তাই নিজের পক্ষ থেকে আগে আদায় করতে হবে। তারপর আলাদা অংশে অন্য কারো পক্ষ থেকেও আদায় করতে পারবে।

 

ভাগে কুরবানির ক্ষেত্রে পশু জবেহ করার সময় অংশীদারদের নাম পড়া কি জরুরি?

 

❖ ভাগে কুরবানি দেয়ার ক্ষেত্রে জবেহ করার সময় অংশীদারদের নাম পড়তে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ যারা যারা কুরবানির নিয়তে টাকা জমা দিয়েছে আল্লাহ তাআলা তাদের নামেই তা কবুল করবেন ইনশাআল্লাহ।

অন্যের কুরবানী যবাই করার সময় তাঁদের নাম লেখা ও তা কুরবানীর পশু যবাই করার পূর্বে পড়া জরুরি মনে করা একটি প্রচলিত ভুল। যেমন, বলা যে এই গরুতে ৭ জনের নাম দেন। তারপর জবাই করার পূর্বে তাদের নামের লিস্ট পড়া হয়।

মনে রাখা উচিৎ, যে বা যারা কুরবানীর উদ্দেশ্যে পশুটি ক্রয় করেছে এবং যত ভাগ কুরবানী দেয়ার নিয়ত করেছে, তার সেই নিয়ত অনুযায়ী সে বদলা পাবে এবং তার নিয়ত আল্লাহ অবশ্যই জানেন। এখন অন্য কোনো ব্যক্তি যদি তাদের কুরবানীটা যবাই করে দেয়, তাহলে সে শুধু কুরবানীদাতার পক্ষ থেকে যবাই করার কাজের প্রতিনিধি মাত্র। বিদায় হজ্জে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই রকম ষাটাধিক সাহাবীর কুরবানী করেছিলেন, তাতে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের নাম জিজ্ঞেস করেন নি যে, এটা কার কার পক্ষ থেকে, এই উটে তোমরা কতজন শরীক রয়েছো, নাম উল্লেখ কর, ইত্যাদি। বরং তিনি সাধারণ ভাবে যবাই করে গেছেন।

তবে এটাও প্রমাণিত যে, তিনি অনেক ক্ষেত্রে যবাই করার পর বলতেনঃ “এটা আমার পক্ষ থেকে এবং আমার উম্মতের মধ্যে তাদের পক্ষ থেকে যারা কুরবানী দেয় নি”। [আহমদ, আবু দাঊদ, তিরমিযী] তাই যার কুরবানী অন্য যবাই করছে, সে যবাই দেয়ার সময় বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবারের পর তার নাম বলতে পারে যে এটা অমুক বা অমুক অমুকের পক্ষ থেকে। কিন্তু যবাই করার পূর্বে তা বলার নিয়ম নেই।

❖ একই পরিবারে একটি কুরবানি যথেষ্ট-চাই একটি স্বতন্ত্র কুরবানি হোক অথবা গরু বা উটে এক ভাগা হোক।
সুতরাং পরিবারের অভিভাবক কুরবানি করার সময় তার নিজের এবং তার পরিবারের জীবিত ও মৃত সকল ব্যক্তিকে নিয়তে শরীক করবে তাহলে আশা করা যায়, দয়াময় আল্লাহ সকলকে সওয়াব দান করবেন ইনশাআল্লাহ। একই পরিবারে সদস্যদের মধ্য থেকে আলাদা আলাদা কারো নাম দেয়া সঠিক পদ্ধতি নয়।

—————————- উত্তর প্রদানে: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি, জুবাইল, সৌদি আরব

 

কুরবানীর অংশীদার একজনের নিয়ত খারাপ হলে বাকিদের কুরবানী কেন নষ্ট হবে?

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম। আসসালামু আলাইকুম। মোঃ শাহ আলম,বাটাজোর,ভালুকা,ময়মনসিংহ।

আমার প্রশ্ন হলোঃ- “সাতজন মিলে কুরবানী দিলে এদের মধ্যে একজনের নিয়ত যদি সহিহ না হয় তাহলে সকলের কুরবানি বাতিল হয়ে যাবে।” এটা আমরা জানি এবং মানি। কিন্তু আমার এক বন্ধু আমার কাছে এই ফতোয়ার স্বপক্ষে কুরআন ও হাদিসের দলিল চাইলেন। আমি আহলে হক মিডিয়ার অ্যাপ এর ফতোয়া দেখাই। সেখানে শুধু কিছু কিতাবের রেফারেন্স দেওয়া আছে। এখন কুরআন ও হাদিসের দলিল দিয়ে উত্তর জানালে কৃতজ্ঞ থাকবো। ধন্যবাদ।

উত্তরঃ وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

ইবাদত বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য নিয়ত শর্ত। নিয়ত ছাড়া কোন ইবাদতই ইবাদত হিসেবে পরিগণিত হয় না।

হাদীসে আসছে যে, إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى

হযরত উমর বিন খাত্তাব রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, প্রতিটি কাজের হুকুম তার নিয়তের উপর নির্ভরশীল। মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১]

শরীকানা কুরবানীতে এক পশুর অংশে সকলে অংশিদার। তাই একাংশের মালিকের নিয়ত যখন খারাপ হবে, তখন এটি পূর্ণ পশুতেই ছড়িয়ে পড়বে। যেহেতু পশুর কোন নির্দিষ্ট অংশ কারো অংশিদারিত্ব থেকে আলাদা নয়। তাই পুরো পশুর হুকুমই নাজায়েজ হয়ে যাবে।

আমরা বুখারীর হাদীস পেশ করলাম। যদি ঐ লোক না মানে, তাহলে তাকে বলুন, এর বিপরীত এমন কোন আয়াত বা হাদীস পেশ করতে, যাতে আসবে যে, অংশিদার কারো নিয়ত খারাপ থাকলেও বাকিদের কুরবানী হবে। এমন কোন আয়াত ও বা হাদীস কোথাও নেই।

তাই বুঝা গেল যে, অংশিদার একজনের নিয়ত খারাপের কারণে বাকিদের কুরবানীও নষ্ট হয়ে যাবে।

যেমন সাতজন মিলে এক বালতিতে পানি রাখলো, এখন একজন যদি নাপাক পানি রাখে, তাহলে  বাকি

৬ জনের পাক পানিও নাপাক হয়ে যাবে একসাথে হবার কারণে।

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনেঃ লুৎফুর রহমান ফরায়েজী -পরিচালক ও প্রধান মুফতী – মা’হাদুত তালীম ওয়াল  বুহুসিল ইসলামী ঢাকা। উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম আমীনবাজার ঢাকা। উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া ফারূকিয়া দক্ষিণ বনশ্রী ঢাকা।

IDC Partner

আইডিসির সাথে যোগ দিয়ে উভয় জাহানের জন্য ভালো কিছু করুন।

 

আইডিসি এবং আইডিসি ফাউন্ডেশনের ব্যপারে বিস্তারিত জানতে  লিংক০১ ও লিংক০২ ভিজিট করুন।

আইডিসি  মাদরাসার ব্যপারে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। 

আপনি আইডিসি  মাদরাসার একজন স্থায়ী সদস্য /পার্টনার হতে চাইলে এই লিংক দেখুন.

আইডিসি এতীমখানা ও গোরাবা ফান্ডে দান করে  দুনিয়া এবং আখিরাতে সফলতা অর্জন করুন।

কুরআন হাদিসের আলোকে বিভিন্ন কঠিন রোগের চিকিৎসা করাতেআইডিসি ‘র সাথে যোগাযোগ করুন।

ইসলামিক বিষয়ে জানতে এবং জানাতে এই গ্রুপে জয়েন করুন।

Islami Dawah Center Cover photo

ইসলামী দাওয়াহ সেন্টারকে সচল রাখতে সাহায্য করুন!

 

ইসলামী দাওয়াহ সেন্টার ১টি অলাভজনক দাওয়াহ প্রতিষ্ঠান, এই প্রতিষ্ঠানের ইসলামিক ব্লগটি বর্তমানে ২০,০০০+ মানুষ প্রতিমাসে পড়ে, দিন দিন আরো অনেক বেশি বেড়ে যাবে, ইংশাআল্লাহ।

বর্তমানে মাদরাসা এবং ব্লগ প্রজেক্টের বিভিন্ন খাতে (ওয়েবসাইট হোস্টিং, CDN,কনটেন্ট রাইটিং, প্রুফ রিডিং, ব্লগ পোস্টিং, ডিজাইন এবং মার্কেটিং) মাসে গড়ে ৫০,০০০+ টাকা খরচ হয়, যা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। সেকারনে, এই বিশাল ধর্মীয় কাজকে সামনে এগিয়ে নিতে সর্বপ্রথম আল্লাহর কাছে আপনাদের দোয়া এবং আপনাদের সহযোগিতা প্রয়োজন, এমন কিছু ভাই ও বোন ( ৩১৩ জন ) দরকার, যারা আইডিসিকে নির্দিষ্ট অংকের সাহায্য করবেন, তাহলে এই পথ চলা অনেক সহজ হয়ে যাবে, ইংশাআল্লাহ। যারা এককালিন, মাসিক অথবা বাৎসরিক সাহায্য করবেন, তারা আইডিসির মুল টিমের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন, ইংশাআল্লাহ।

আইডিসির ঠিকানাঃ খঃ ৬৫/৫, শাহজাদপুর, গুলশান, ঢাকা -১২১২, মোবাইলঃ +88 01609 820 094, +88 01716 988 953 (নগদ/বিকাশ পার্সোনাল) ইমেলঃ info@islamidawahcenter.com, info@idcmadrasah.com, ওয়েব: www.islamidawahcenter.com, www.idcmadrasah.com সার্বিক তত্ত্বাবধানেঃ হাঃ মুফতি মাহবুব ওসমানী (এম. এ. ইন ইংলিশ)