Worlds Richest Hajj /পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনীর হজে যাওয়ার গল্প
Worlds Richest Hajj /পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনীর হজে যাওয়ার গল্প
পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ধনী হিসাবে পরিচিত মালীর মানসা মূসা। বর্তমান বিশ্বের বিল গেটস, অ্যালন মাস্ক বা কার্লোস স্লিমের চেয়েও ধনী ছিলেন আফ্রিকার মানসা মূসা। তিনি ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সোনার (Gold) মূল্যমান নির্ধারণ করতে পারেন; তাঁর কাছে এতো পরিমাণ সোনা ছিলো।
মানসা মূসা জন্মগ্রহণ করেন ১২৮০ সালে। ১৩১২ সালে তাঁর ভাই অভিযানে গেলে তিনি সিংহাসনের দায়িত্ব পান। তাঁর রাজ্যের আশেপাশের ২৪ টি রাজ্য তিনি জয় করেন। বলা হয়ে থাকে, তৎকালীন সময়ে যে ব্যক্তি পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো অঞ্চল শাসন করতেন, তিনি ছিলেন মানসা মূসা। স্বর্ণ এবং লবণ ছিলো তাঁর মূল সম্পদ।
১৩২৪ সালে মানসা মূসা হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তাঁর সাথে ছিলো প্রায় ৬০,০০০ হজ্জযাত্রী। যাদের মধ্যে ১২,০০০ ছিলো সৈন্য এবং দাস। দাসদের প্রত্যেকের কাছে ছিলো ৪ পাউন্ড করে সোনার বার। এছাড়াও তাঁর সাথে ছিলো ৮০টি উট, যাদের প্রত্যেকের পিঠে ৫০ থেকে ৩০০ পাউন্ড করে সোনা ছিলো।
এতো বিপুল পরিমাণে সম্পদ নিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগে এবং এর পরে কেউ কখনো হজ্জে যায়নি। মানসা মূসার বাহিনী যখন হজ্জে যাচ্ছিলো, তখন মনে হচ্ছিলো স্বর্ণের বহর নিয়ে একটি কাফেলা যাচ্ছে।
যাত্রাপথে মানসা মূসা আশেপাশের মানুষদের মধ্যে স্বর্ণ বিতরণ করেন। মিসরে তখন মামলুক সুলতানরা শাসন ক্ষমতায় ছিলো। তিনি মিসরবাসীকে অসংখ্য স্বর্ণ দান করেন। বিখ্যাত পর্যটক আল-উমরী মানসা মূসার মিসর সফরের ১২ বছর পর মিসরে গিয়ে দেখেন এক যুগ পরও মিসরবাসী মানসা মূসার গুণগান গাচ্ছে।
হজ্জে যাবার পথে মানসা মূসা অসংখ্য মসজিদ নির্মাণ করেন। যেসব জায়গায় মসজিদ কম ছিলো, তাঁর সেনাবাহিনীর সাহায্যে সেসব এলাকায় মসজিদ নির্মাণ করা হয়।
১৩২৪ সালে মক্কাবাসী অভূতপূর্ব এক হজ্জযাত্রী দেখে। তখনকার সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা যখন ছিলো নাজুক, তখন আফ্রিকার ৬০,০০০ মানুষ একসাথে হজ্জ করতে এসেছে। আফ্রিকার এতো বিপুল সংখ্যক মানুষ একসাথে ইতোপূর্বে হজ্জ করেছে বলে জানা যায় না। সুদূর আফ্রিকার মানুষ জীবনে প্রথমবারের মতো মক্কা-মদীনা দেখতে পায়। নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শহর দুটো দেখে প্রাণ জুড়ায়।
মানসা মূসার কাছে অঢেল সম্পদ ছিলো। তিনি দেখলেন তাঁর রাজ্যে জ্ঞানের বিস্তার ঐরকম নেই। অথচ মক্কা-মদীনায় অনেক সম্পদ না থাকলেও সেখানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, দার্শনিক, স্থপতিরা আছেন। এতো সম্পদ দিয়ে কী হবে, যদি মানুষের মধ্যে জ্ঞানচর্চা না থাকে?
হজ্জের সফরে মানসা মূসা একটি নতুন পরিকল্পনা আঁটেন। তিনি সেখানকার স্কলারদের তাঁর রাজ্যে নিয়ে যেতে চান। তাঁদেরকে অনেক সম্মানী অফার করেন। আন্দালুসের বিখ্যাত আর্কিটেক্ট আবু ইসহাককে তিনি রাজি করান।
আবু ইসহাককে যে সম্মানী দেয়া হয়, সেটার বর্তমান মূল্যমান ধরা হয় ৮.২ মিলিয়ন ইউএস ডলার। যা বাংলাদেশের বর্তমান বাজেটের শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত টাকার চেয়েও বেশি!
মানসা মূসা সানকৌরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো প্রায় ২৫,০০০ যা হাল আমলের অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজের চেয়েও বেশি। মানসা মূসার উদ্যোগে মালিতে একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়, যে লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা ছিলো প্রায় ১০ লক্ষাধিক; তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী একটি লাইব্রেরি হিসাবে সেটা পরিচিত ছিলো।
মালিকে তিনি এমনভাবে গড়ে তুলেন যে, সেই আফ্রিকার একটি অঞ্চল হয়ে উঠে জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু। পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা সেখানে পড়ালেখা করতে যেতেন। শিক্ষার্থীদেরকে স্কলারশিপ দেয়া হতো।
আব্দুর রহমান আল-তামিমী নামে হিজাজের একজন ফক্বীহ মালিতে যান। তিনি মক্কা-মদীনার স্কলার হওয়া সত্ত্বেও মালির স্কলারদের কাছে জ্ঞানার্জনের পূর্বে তাঁকে ফেজ যেতে হয় প্রাথমিক পড়াশোনার জন্য।
মধ্যযুগে মুসলিম সভ্যতাগুলো যখন পতনের মুখে, তখন মালিতে গড়ে উঠে নতুন করে একটি সভ্যতা। যে সভ্যতার অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট ছিলো মানসা মূসার হজ্জযাত্রা।
Post Credit: আরিফুল ইসলাম- ২২ জুন ২০২১
আরও পড়ুন…
Polashi Tragedy/পলাশী ট্রাজেডির ২৬৩ বছর ও বিশ্বাসঘাতকদের পরিণতি
২৩ জুন, ১৭৫৭ সাল। এদেশের ইতিহাস সম্পর্কে যারা সামান্যও পড়েছেন, তারাও নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা এবং পলাশী যুদ্ধ সম্পর্কে বেশ অবগত আছেন। আমি আজ আবার নতুন করে আজ থেকে ২৬৩ বছর আগে আজকের এই দিনে পলাশীর আম্রকাননে কীভাবে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় এবং পরবর্তীতে কীভাবে উপমহাদেশকে দু’শো বছর সেই গোলামীর গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয়েছে তা নিয়ে আলাপ করবো না।
যুদ্ধের কাহিনী যেহেতু আমাদের সবারই কম বেশি জানা। তাই সেদিকে না গিয়ে আমি কেবল দুইটা বিষয় নিয়ে একটু আলাপ করবো। প্রথমত; নবাব সিরাজকে নাটক উপন্যাসের মাধ্যমে যেভাবে ইতিহাসের ভিলেন বানানো হয়েছে, আসলে তা কতটুকু ঠিক বা যুদ্ধের পর তার পরিবার ও অনুচরদের সাথে কেমন ব্যবহার করা হয়েছে তা নিয়ে সামান্য বলবো। পাশাপাশি যাদের কারণে পলাশীর পরাজয়, পরবর্তিতে তাদের কী করুণ পরিণতি হয়েছিলো তা আলাপে নিয়ে আসবো।
ভূমিকা না বাড়িয়ে শুরু করি- ইতিহাস সম্পর্কে যারা সচেতন তারা সবাই জানেন ইংরেজদের সাথে পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সময় নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বাহিনী ছিল ৫০,০০০ হাজার আর রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী ছিল মাত্র ৩৫০০ এর কাছাকাছি।
নবাবের হাতে যে বিপুল সৈন্যসংখ্যা ছিল তা দিয়ে ইংরেজদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করা অসম্ভব কাজ ছিল না। এমনকি মীরজাফরের অধীনস্ত যে ১৬০০০ সৈন্য ছিলো, তারাও যদি যুদ্ধে অবতীর্ণ হতো তাহলে নবাবের বিজয় অর্জন একেবারেই স্বাভাবিক ছিল। মীর জাফর থেকে শুরু করে পরাজয়ের জন্য আরও যারা বিশ্বাসঘাতকতা করে পিছনে কলকাটি নেড়েছে তাদের নিয়ে পরে আলাপ করবো।
এখন একটা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠে সৈন্য সংখ্যা, অস্ত্রভান্ডার, রসদ ও বাহন বিদেশিদের তুলনায় অনেক বেশি, তাছাড়া আপন প্রকৃতি, পরিবেশ সবই ছিল নিজেদের অনুকুলে তথাপি এই ঐতিহাসিক পরাজয় কেন হয়েছিলো?
জাতির মধ্যে অনৈক্য এবং ক্ষমতালোভী স্বার্থান্বেষী বিশ্বাসঘাতক গোষ্ঠীদের ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি একটা মহল বিশেষ করে নাটক-সিনেমায় নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে অত্যাচারী, নারী লোভী, মাতাল এবং আরো অনেক দোষে দোষী সাব্যস্ত করে। এবং এটাও একটা কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়।
তরুণ যুবক সিরাজের কিছু দোষ ত্রুটি থাকাই স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক কিছু নয়। সত্যিকারভাবে ইতিহাসের বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এগুলো অতিরঞ্জিত। চলুন, আমরা একটু ইতিহাসে চোখ বুলাই- সিরাজের নানা আলীবর্দী খান ইন্তেকাল করেন ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ৯ এপ্রিল, নানার মৃত্যুর পরই তো সিরাজ উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতায় আসে। আর পলাশী যুদ্ধে সিরাজের পতন ঘটে ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন, অর্থাৎ ১৪ মাস ১৪ দিন পর।
এই ১৪ মাস ১৪ দিন, তাকে চর্তুদিকে ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয়েছে। কিশোর সিরাজউদ্দৌলা ক্ষমতায় বসেই এই ১৪ মাসে কমপক্ষে ১২০০ মাইল দুর্গম পথ তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে। সে সময়ে ছিলো না কোনো উন্নত যানবাহন। করতে হয়েছে পাঁচ, পাঁচটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। চর্তুদিকে অসংখ্য ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করতে হয়েছে। তাকে তো আলেকজান্ডারের চেয়েও দ্রুত গতিতে পথ চলতে হয়েছে। রাত কাটাতে হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে ও অশ্বপৃষ্ঠে। দিন কাটাতে হয়েছে ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে।
নানাজীর উদ্যোগে সেই অল্প বয়সে বিবাহিত সিরাজের তখন আপন স্ত্রী লুৎফা, শিশু কন্যা জোহরারও প্রতি ফিরে তাকাবারও তো ফুরসত ছিল না। নাটকে আলেয়া নামের আর্য সুন্দরীদের মোহাবিষ্ট জালে রূপাকৃষ্ট পতঙ্গের মতো লাম্পট্য লীলায় সময় কাটাবার সুযোগ তিনি পেলেন কোথায়?
এগুলো আমরা একটু গভীরভাবে উপলব্ধি করলেই তো বুঝতে পারার কথা। কেবলমাত্র সিরাজের প্রতি নিষ্ঠুরতাকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য হতভাগ্য নবাবের চরিত্রহনন করা হয়। নানা ধরনের মিথ্যাচারের মাধ্যমে কলঙ্কিত করা হয় তরুণ নবাবকে। নিষ্ঠুরতা কত ভয়াবহ ছিলো সামান্য করে বলি।
মোহাম্মদী বেগ, মীরনের নির্দেশে সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি। সিরাজকে হত্যার পর তার পত্নী লুৎফুন্নেসাকে চরমভাবে লাঞ্ছিত করে সে। নবাব সিরাজের সঙ্গে তিনিও ধরা পড়েছিলেন তার একমাত্র কন্যা উম্মে জোহরাসহ ১৭৫৭ সালের ২৪ জুন।
ধরা পড়ার পর লুৎফুন্নেসার ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। মুর্শিদাবাদের জেলখানায় ধারাবাহিক নির্যাতনে তিনি মৃত প্রায় হয়ে যান। ১৭৫৮ সালে কন্যাসহ বন্দি বেগম লুৎফুন্নেসাকে ঢাকায় পাঠিয়ে বন্দি করে রাখা হয় জিঞ্জিরা প্রাসাদে। এখানে মা ও মেয়ে প্রায় আট বছর বন্দি থাকেন।
নির্লজ্জভাবে পিতা মীরজাফর ও পুত্র মীরন উভয়েই লুৎফুন্নেসাকে বিয়ে করার জন্য জোরজবরদস্তি করতে থাকে। কিন্তু এই মহীয়সী নারী উভয়ের প্রস্তাব ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেন।
১৭৬৫ সালে তিনি মুক্তি পেয়ে কন্যাসহ মুর্শিদাবাদ ফিরে আসেন। এবং অতি দীনহীন ভাবে জীবন কাটাতে থাকেন। ১৭৯০ সালের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি স্বামী নবাব সিরাজের কবরগাহে তসবিহ, তাহলিল, তেলাওয়াত, দোয়া, দরুদ পাঠ করেই কাটান। মুর্শিদাবাদের তৎকালীন অধিবাসীরা একজন বেগমের প্রতি নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা অশ্রুসিক্ত নয়নে অবলোকন করছে।
সিরাজের অনুগত, দেশপ্রেমিক সেনাপতি ও আমত্যদেরও একে একে হত্যা-নির্যাতনের শিকারে পরিণত করা হয়। ষড়যন্ত্রকারী রায়দুর্লভ বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন অকৃত্রিম সিরাজভক্ত মোহনলালকে। খাজা আবদুল হাদি খানকে মীরজাফর মেরে ফেলেন বিশ্বাসঘাতকতা করে। সিরাজ অনুগত ঢাকার ভূতপূর্ব নায়েব রায় বল্লভ সেনকে গঙ্গার জলে ডুবিয়ে মারা হয়। পাটনার নায়েব, আরেক সিরাজ সুহৃদ, রামনারায়ণকেও খুবই নিষ্ঠুরভাবে খুন করা হয়। মোটের ওপর, পলাশীর যুদ্ধের ২০ বছরের মধ্যে প্রায় সকল সিরাজ অনুগত সেনাপতি, আমীর-ওমরাহকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করা হয়।
একটা কথা বার বার উচ্চারিত হয়, পলাশীর ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নিই নাই। শিক্ষা নেয়া আর না নেয়া নিয়ে আমার কিছু বলার নেই, কারণ ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়া বাঙালির মজ্জাগত ব্যাপার। তাই আমি কেবল এত নির্যাতন, নিপীড়ন চালানোর কুশলীব যারা ছিলেন, তাদের কি পরিণতি হয়েছিলো তা তুলে ধরছি, এতে যদি কেউ শিক্ষা নিই আর কি। বর্তমান ও ভবিষ্যতে পর্দার আড়ালে এমন কিছু করার আগে যেন হাজার বার ভাবতে হয়।
প্রকৃতির যে একটা বিচার আছে তা আমরা পলাশীর প্রেক্ষাপট তৈরির খলনায়কদের নির্মম পরিণতি দেখে কিছুটা হলেও বুঝতে করতে পারি। সিরাজের হত্যাকারী মোহাম্মদী বেগ উন্মাদ অবস্থায় দাম্পত্য কলহে এক কূপে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। মীরনের মৃত্যু ঘটেছিল বজ্রপাতে। তার আগে সিরাজের খালা ষড়যন্ত্রকারী ঘসেটি বেগমকে মীরণ প্রবল খরস্রোতা বুড়িগঙ্গায় নৌকা ডুবিয়ে মেরে ফেলে। মীর জাফর ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে দু’দুবার বাংলার মসনদে বসেছিলেন। কিন্তু শেষ বয়সে মারাত্মক কুষ্ঠ ব্যাধিতে তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়।
মীর কাশিম আলী খান পরবর্তীতে বাঙলার নবাব হয়েছিলেন; কিন্তু শুরুতেই তিনি ছিলেন বাংলার মুসিলম শাসন অবসানের মূল ষড়যন্ত্রের অন্যতম সহযোগী। ভগবান গোলায় নবাবকে তিনি সর্বপ্রথম ধরিয়ে দেন তার শ্যালক মীরনের হাতে। শেষ পর্যায়ে এসে মীর কাশিম অনুধাবন করলেন একদা এই চক্রের সাথে হাত মিলিয়ে তিনি বাঙলার মুসলমানদের স্বার্থের চরম ক্ষতি সাধন করেছেন, এখন আর কোনো উপায় নেই।
মীর কাশিম বুঝলেন ঠিকই, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু মূল ষড়যন্ত্রকারীরা কি চিরকালই পর্দার অন্তরালে থেকে যাবে?
মুঙ্গেরের দুর্গশীর্ষ থেকে বস্তায় ভরে গঙ্গার বুকে তিনি নিক্ষেপ করেন জগৎশেঠ আর রায়দুর্লভের জীবন্ত দেহ। অপর এক অপঘাতে নিহত হলো রাজা রাজ বল্লভ। পরবর্তীকালে তার সব কীর্তি পদ্মা নদী গ্রাস করে কীর্তিনাশা নামধারণ করলো।
কিন্তু এত করেও মীর কাশিম তার শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর ইংরেজ কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে বনে জঙ্গলে আত্মগোপন করেই রইলেন। জঙ্গলেই তার দুই ছেলে নিহত হন। নির্বংশ মীর কাশিম আলী খান এরপর কোথায় উধাও হয়ে যান ইতিহাস সে সম্পর্কে নীরব। দীর্ঘ দিন পর তার লাশ পাওয়া যায় দিল্লির আজমেরি গেটের কাছে রাস্তার ওপরে।
ষড়যন্ত্রকারীদের ইংরেজরা প্রায়ই প্রচুর অর্থবিত্ত এবং পদক, পদবি দিয়ে তুষ্ট করত বলে জানা যায়। এ রকম এক পদক বিতরণী অনুষ্ঠানে হাজির হয়েও পদক প্রাপ্ত হিসেবে ডাক না পাওয়ায় অপমানে, ক্ষোভে সভাস্থলে উমিচাঁদের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। নন্দকুমার ভূষিত ছিল মহারাজা উপাধিতে কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংসের সাজানো মামলায় আসামি হিসেবে তাকে শেষ পর্যন্ত শেওড়া গাছে ঝুলতে হয় ফাঁসি কাষ্ঠে।
ইয়ার লতিফ নিরুদ্দেশ হয়ে গোপনে মৃত্যুবরণ করেন। রায় দুর্লভ ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে কারাগারে ধুকে ধুকে মারা গেছেন। স্ক্র্যাপ্টন বাংলায় লুটপাট করে বিলেতে ফেরার পথে জাহাজ ডুবিতে মারা যায়। ওয়াটসন কোম্পানির চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়ে মনের দুঃখে ও অনুশোচনায় ক্রমাগত অসুস্থ হয়ে কোনো ঔষুধে প্রতিকার না পেয়ে শোচনীয়ভাবে মৃত্যু বরণ করেন।
এভাবেই দেখা যায় বাংলার মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী ভূমিকা পালনকারীদের ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করেনি, চক্রান্তকারীদের ভোগ করতে হয়েছে মর্মান্তিক পরিণতি।
(উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিদের ন্যাক্কারজনক ভূমিকা সম্পর্কে আপনার জানা না থাকলে পলাশীর আগে ও পরের বিস্তারিত ইতিহাস পড়ে নিতে পারেন, লেখার কলেবর আরও করতে চাইনি বলে তাদের বিশ্বাসঘাতকতার খতিয়ান লিখলাম না)
শেষ করি সেই প্রথম দিকের কথা দিয়ে, অবশ্য এটা সবারই জানা কথা। তাহলো, এত সৈন্য, শক্তি-সামর্থ থাকার পরেও কেন পলাশীর প্রান্তরে মুসলিমদের শোচনীয়ভাবে পরাজয় হয়েছিলো?
বিস্তারিত কথায় যাচ্ছি না, কেবল দুইটা কারণ বলেই ইতি টানবো-
এক. আমরা শত্রু চিনতে ভুল করি। মীর জাফর বারবার ষড়যন্ত্র করা সত্ত্বেও নবাব সিরাজউদ্দৌলা তাঁর উপর নির্ভরশীল হতে দেখা যায়। হয়তো নবাবের বয়স কম এবং সহজ সরল ছিলেন বলেই। তবুও আমি বলবো এটা বাঙালির মজ্জাগত স্বভাব। আমরা শত্রু চিনতে বার বার ভুল করি। বিশ্বাসঘাতকদের বার বার বিশ্বাস ভঙ্গের সুযোগ করে দিই।
দুই. এই কারণটা ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ড্যালরিম্পল এর মুখেই শুনুন, তার লেখা নতুন বই ‘দ্য অ্যানারকি: দ্য রিলেন্টলেস রাইজ অব দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ এ নিয়ে লিখেন, “অলস বাঙালিদের জন্যই পলাশী যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা হেরে গেছেন”।
এই বিষয়ে রবার্ট ক্লাইভ তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, “সে দিন স্থানীয় অধিবাসীরা ইংরেজদের প্রতিরোধ করতে চাইলে লাঠিসোটা আর হাতের ইটপাটকেল মেরেই তাদের খতম করে দিতে পারতো। কিন্তু এ দেশবাসীরা তা উপলব্ধি করতে পারেনি। যেকোনো কারণেই হোক সে দিন বাংলার মানুষ এগিয়ে যায়নি। তাদের রাজনৈতিক সচেতনতার তখন খুবই অভাব ছিল”।
আসলে আমরা বরাবরই অলস, অসচেতন, স্বার্থপর এবং নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা জাতি। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, পলাশীর ট্র্যাজেডির পরেও বাংলার সাধারণ মানুষ, কৃষক সমাজ দৈনন্দিন জীবন, নিত্যদিনের মতোই মাঠে কৃষি কাজ করেছে। ফসল বুনেছে। অথচ পলাশীর যুদ্ধে গোটা জাতীয় জীবনে কি নিদারুণ ভাগ্য বিপর্যয় ঘটলো, এক ঘণ্টার প্রহসনের যুদ্ধে গোটা জাতির স্বাধীনতা হরণ করে নিয়ে গেল গোটা কয়েক বেনিয়া ইংরেজ অথচ তাদের কারো টনক নড়লো না।
টনক যখন নড়লো, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাদের আর তখন কিছুই করার ছিল না। অবশ্য তার একশো বছর পর প্রথম শক্তভাবে রুখে দাঁড়াতে সক্ষম হয় বাংলার কৃষক সমাজ। যাক সেটা ভিন্ন আলাপ।
সিরাজউদ্দৌলা কখনো তার দেশের প্রজাদের সাথে কোনো অবস্থাতেই বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। কখনো স্বেচ্ছায় স্বদেশকে বিকিয়ে দেননি। তার চরিত্রেও কোনো কালিমা ছিলো না। পলাশীর প্রান্তরে মর্মান্তিক নাট্যমঞ্চে এক মাত্র তিনি ছিলেন মূল নায়ক। সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাঙলার স্বাধীনতার শেষ প্রতীক।
তথ্যসূত্র:
১. 100 Decisive Battles: From Ancient Times to the Present by Paul K. Davis (1999).
২. Ali Vardi and His Times by K. K. Datta (1939)
৩. ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতার অবসান এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়সমূহ -ড. মাহফুজ পারভেজ
৪. মোজাফ্ফরনামা: নবাব আলিবর্দি খান থেকে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা
৫. সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে -অমলেন্দু দে
৬. পলাশী থেকে বাংলাদেশ
৭. Sirajuddaula by Sushil Chaudhury and KM Mohsin (2012)
পোস্ট ক্রেডিটঃ Md Sayem Muhaimin
আইডিসির সাথে যোগ দিয়ে উভয় জাহানের জন্য ভালো কিছু করুন!
আইডিসি এবং আইডিসি ফাউন্ডেশনের ব্যপারে জানতে লিংক০১ ও লিংক০২ ভিজিট করুন।
আইডিসি মাদরাসার ব্যপারে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
আপনি আইডিসি মাদরাসার একজন স্থায়ী সদস্য /পার্টনার হতে চাইলে এই লিংক দেখুন.
আইডিসি এতীমখানা ও গোরাবা ফান্ডে দান করে দুনিয়া এবং আখিরাতে সফলতা অর্জন করুন।
কুরআন হাদিসের আলোকে বিভিন্ন কঠিন রোগের চিকিৎসা করাতেআইডিসি ‘র সাথে যোগাযোগ করুন।
ইসলামিক বিষয়ে জানতে এবং জানাতে এই গ্রুপে জয়েন করুন।
ইসলামী দাওয়াহ সেন্টারকে সচল রাখতে সাহায্য করুন!
ইসলামী দাওয়াহ সেন্টার ১টি অলাভজনক দাওয়াহ প্রতিষ্ঠান, এই প্রতিষ্ঠানের ইসলামিক ব্লগটি বর্তমানে ২০,০০০+ মানুষ প্রতিমাসে পড়ে, দিন দিন আরো অনেক বেশি বেড়ে যাবে, ইংশাআল্লাহ।
বর্তমানে মাদরাসা এবং ব্লগ প্রজেক্টের বিভিন্ন খাতে (ওয়েবসাইট হোস্টিং, CDN,কনটেন্ট রাইটিং, প্রুফ রিডিং, ব্লগ পোস্টিং, ডিজাইন এবং মার্কেটিং) মাসে গড়ে ৫০,০০০+ টাকা খরচ হয়, যা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। সেকারনে, এই বিশাল ধর্মীয় কাজকে সামনে এগিয়ে নিতে সর্বপ্রথম আল্লাহর কাছে আপনাদের দোয়া এবং আপনাদের সহযোগিতা প্রয়োজন, এমন কিছু ভাই ও বোন ( ৩১৩ জন ) দরকার, যারা আইডিসিকে নির্দিষ্ট অংকের সাহায্য করবেন, তাহলে এই পথ চলা অনেক সহজ হয়ে যাবে, ইংশাআল্লাহ।
যারা এককালিন, মাসিক অথবা বাৎসরিক সাহায্য করবেন, তারা আইডিসির মুল টিমের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন, ইংশাআল্লাহ।
আইডিসির ঠিকানাঃ খঃ ৬৫/৫, শাহজাদপুর, গুলশান, ঢাকা -১২১২, মোবাইলঃ +88 01609 820 094, +88 01716 988 953 ( নগদ/বিকাশ পার্সোনাল )
ইমেলঃ info@islamidawahcenter.com, info@idcmadrasah.com, ওয়েব: www.islamidawahcenter.com, www.idcmadrasah.com সার্বিক তত্ত্বাবধানেঃ হাঃ মুফতি মাহবুব ওসমানী ( এম. এ. ইন ইংলিশ )