বদর যুদ্ধ কবে ও কোথায় হয়েছিল?

Battle of Badr – বদর যুদ্ধ কবে ও কোথায় হয়েছিল?

ছবি : সংগৃহীত

মুসলিম ইতিহাসের প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ বদর। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান মদিনার উপকণ্ঠে বদর নামক স্থানে মুখোমুখি হয় মুসলিম ও কুরাইশ বাহিনী। ঐতিহাসিক এ যুদ্ধ ছিল অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই। ইসলাম ও মুসলিমদের অস্তিত্বের সংগ্রাম।

বদর যুদ্ধে আল্লাহ তাআলা অসম প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীকে বিজয় দান করেন। অস্তিত্বের সংকট থেকে মুসলিম উম্মাহকে মুক্তি দিয়ে অমিত সম্ভাবনার দুয়ারে পৌঁছে দেন। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন আতাউর রহমান খসরু ও মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা।

বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট

 

আজ ১৭ রমজান। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে তথা দ্বিতীয় হিজরির এই দিনে সংঘটিত হয়েছিল ইসলামে চিরস্মরণীয় ও গৌরবময় অধ্যায় বদর যুদ্ধ। এটি ছিল সত্য ও মিথ্যার, হক ও বাতিলের, মুসলিম ও কাফেরদের মধ্যকার ঐতিহাসিক যুদ্ধ। এবং এটি ছিল ইসলামের প্রথম যুদ্ধ। মদিনার অদূরে অবস্থিত একটি কূপের নাম ছিল বদর। সেই সূত্রে এই কূপের নিকটবর্তী আঙিনাকে বলা হতো বদর প্রান্তর। এই বদর প্রান্তরেই মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিব নিরস্ত্র মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সঙ্গীদের বিজয়ী করেছিলেন হাজার সশস্ত্র যোদ্ধার মোকাবেলায়।

ঘটনার সূত্রপাত : মদিনায় বইতে থাকা ইসলামের বসন্তের হাওয়া মক্কার কাফেরদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। না জানি কখন এই হাওয়া দমকা হাওয়ায় রূপ নিয়ে তাদের উড়িয়ে নিয়ে যায়, কিংবা তাদের ব্যবসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই মুসলমানদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য অর্থ জোগান ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ক্রয় করার উদ্দেশ্যে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মক্কার একটি বিশাল বাণিজ্য কাফেলা শামে গিয়েছিল। মক্কার প্রতিটি ঘর থেকে প্রত্যেকের সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ দিয়ে গঠন করা হয়েছিল ৪০ জন সশস্ত্র অশ্বারোহী যোদ্ধার পাহারায় এক হাজার মালবাহী উটের একটি বাণিজ্যিক বহর।

বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছিল মুসলমানরাও। তাই যখন তারা শাম থেকে ব্যবসা শেষে অস্ত্র নিয়ে ঘরে ফিরছিল, তখন তাদের ওপর হামলা করার সিদ্ধান্ত হলো। মুসলমানদের আত্মরক্ষার্থে হামলা করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। বিষয়টি আবু সুফিয়ান টের পেয়ে দ্রুত সাহায্যের জন্য মক্কায় খবর পাঠায়। তবে খবরটি ছিল, মুসলমানরা আবু সুফিয়ানের কাফেলার ওপর হামলা করেছে। খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ আবু জাহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সশস্ত্র যোদ্ধার এক বিশাল বাহিনী মদিনা আক্রমণের জন্য বের হয়। অথচ মুসলমানরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আসেনি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শুধু আবু সুফিয়ানকে আটকানো।

এই যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে যেসব বিষয় প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছিল তা ছিল নাখলার খণ্ডযুদ্ধ, কাফেরদের রণপ্রস্তুতি, আবু সুফিয়ানের অপপ্রচার, যুদ্ধপ্রস্তুতির জন্য ওহি লাভ, মক্কাবাসীর ক্ষোভ ইত্যাদি। আর পরোক্ষ কারণ হিসেবে দেখা হয়, মদিনা শরিফে সাফল্যজনকভাবে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কুরাইশদের হিংসা, আবদুল্লাহ বিন উবাই ও ইহুদিদের ষড়যন্ত্র, কুরাইশদের যুদ্ধের হুমকি, তাদের বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা, কাফেরদের আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা, ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তির ধ্বংসসাধন এবং রাসুল (সা.)-কে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার কাফেরদের অশুভ বাসনা।

যখন উভয় দল মুখোমুখি হলো

 

বদর যুদ্ধের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) পানির উৎস হিসেবে বদরের কূপের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেন। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে গেলেন এবং মধ্যরাতে কূপের কাছে পৌঁছে তাঁবু ফেললেন। সাহাবারা সেখানে হাউস বানালেন এবং বাকি সব জলাশয় বন্ধ করে দিলেন।

এরপর রাসুল (সা.) সেনাবিন্যাস করেন। উভয় বাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি হলো। এ সময় রাসুল (সা.) হাত তুলে আল্লাহর দরবারে বললেন, ‘হে আল্লাহ, কুরাইশরা পরিপূর্ণ অহংকারের সঙ্গে তোমার বিরোধিতায় এবং তোমার রাসুলকে মিথ্যা প্রমাণ করতে এগিয়ে এসেছে। হে আল্লাহ, আজ তোমার প্রতিশ্রুত সাহায্যের বড় বেশি প্রয়োজন। আল্লাহ, তুমি আজ ওদের ছিন্নভিন্ন করে দাও। ’

রাসুল (সা.) এ সময় মুসলিম বাহিনীকে কাতারবন্দি করলেন। কাতার সোজা করার পর নবী (সা.) সাহাবিদের বললেন, তাঁর পক্ষ থেকে নির্দেশ না পেয়ে কেউ যেন যুদ্ধ শুরু না করে। তিনি সাহাবিদের সামনে নিজের যুদ্ধ পরিকল্পনা তুলে ধরলেন এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিলেন। তিনি বললেন, পৌত্তলিকরা যখন দলবদ্ধভাবে তোমাদের কাছে আসবে, তখন তাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করবে। তীরের অপচয় যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখবে। তারা তোমাদের ঘিরে না ফেলা পর্যন্ত তরবারি চালাবে না। এরপর নবী (সা.) হজরত আবু বকর (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে অবস্থান কেন্দ্রে চলে গেলেন।

যুদ্ধের প্রথম ইন্ধন ছিল আসওয়াদ ইবনে আবদুল আসাদ মাখজুমি। সে ময়দানে বের হওয়ার সময় বলছিল, আমি আল্লাহর সঙ্গে ওয়াদা করছি যে ওদের হাউসের পানি পান করেই ছাড়ব। যদি তা না পারি, তবে সেই হাউসকে ধ্বংস বা তার জন্য জীবন দেব। অন্যদিকে সাহাবিদের মধ্য থেকে হজরত হামজা ইবনে আবদুল মোত্তালেব এগিয়ে যান এবং আসওয়াদকে হত্যা করেন। তার মৃত্যুর পর যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়ল। কুরাইশ বাহিনীর মধ্য থেকে তিনজন বিশিষ্ট যোদ্ধা বেরিয়ে এলো। তারা হলো রাবিয়ার দুই পুত্র ওতবা ও শায়বা এবং ওতবার পুত্র ওয়ালিদ। তাদের মোকাবেলায় আউফ, মুয়াউয়িজ ও আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা। কুরাইশরা জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের পরিচয় কী? তারা বলল, আমরা মদিনার আনসার। কুরাইশরা বলল, তোমরা অভিজাত প্রতিদ্বন্দ্বী সন্দেহ নেই, কিন্তু তোমাদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। আমরা স্ববংশীয় অর্থাৎ কুরাইশদের সঙ্গে লড়াই করতে চাই। তখন রাসুল (সা.) ওবায়দা ইবনে হারেস, হামজা ও আলী (রা.)-কে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাঁরা তিনজনই নিজ নিজ প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করেন। তবে হজরত হারেস (রা.) ওতবার দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হন। এভাবেই সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই অমুসলিম বাহিনীর ব্যর্থতা ও হতাশার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠল। মুসলমানদের প্রবল আক্রমণে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল। যুদ্ধের পরিণাম হয়ে উঠল সুস্পষ্ট। অন্যদিকে রাসুলে আকরাম (সা.) মুসলিম বাহিনীকে উদ্দীপ্ত করলেন এবং তাদের সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিলেন। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যের সুসংবাদও দিলেন। আল্লাহ তাআলা মুসলিম বাহিনীর সাহায্যে ফেরেশতা প্রেরণ করলেন। আল্লাহর সাহায্য ও মুসলিম বাহিনীর বীরত্বের কাছে দাম্ভিক কুরাইশদের করুণ পতন হলো।

 

তৎকালীন সমাজ ও রাজনীতিতে বদর যুদ্ধের প্রভাব

 

ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। মহান আল্লাহ এই যুদ্ধকে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’—সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য স্পষ্টকারী দিন বলে আখ্যা দিয়েছেন। আল্লাহর এই নামকরণ থেকেই বদর যুদ্ধের প্রভাব ও ফলাফল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মূলত প্রতিষ্ঠিত শক্তি কুরাইশদের বিরুদ্ধে সদ্যঃপ্রসূত মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য বদর ছিল অস্তিত্বের লড়াই। বদর যুদ্ধের বিজয় ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য প্রথম রাজনৈতিক স্বীকৃতি। এ যুদ্ধই ইসলামী রাষ্ট্রের পথচলার গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বদর যুদ্ধের পূর্বাপর অবস্থা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এই যুদ্ধ শুধু মদিনা নয়; বরং সমগ্র আরব উপদ্বীপে মুসলিম উম্মাহর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছিল।

ঐতিহাসিকরা মনে করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের পর মদিনায় যে ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল, তার প্রকৃত প্রতিষ্ঠা বদর প্রান্তে বিজয়ের মাধ্যমেই হয়েছিল। এই বিজয়ের আগে মদিনার মুসলিমরা ছিল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় মাত্র। কিন্তু কুরাইশদের মতো প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিরুদ্ধে সামরিক বিজয় এই ধারণা পাল্টে দেয় এবং আরব উপদ্বীপে মদিনার মুসলিমদের একটি রাজনৈতিক পক্ষের মর্যাদা এনে দেয়। শুধু তা-ই নয়, বদর যুদ্ধ আরবের বহু মানুষের হৃদয়ের সংশয় দূর করে দেয় এবং তারা ইসলাম গ্রহণের সৎসাহস খুঁজে পায়। এ ছাড়া অসম শক্তির বিরুদ্ধে এই অসাধারণ বিজয় মুসলিম উম্মাহর জন্য অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস।

আরবের অমুসলিমদের ওপরও বদর যুদ্ধের প্রভাব ছিল অপরিসীম। বদর যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনীর ৭০ জন নিহত হয়। তাদের বেশির ভাগই ছিল শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ও খ্যাতনামা আরব বীর। আবু জাহেল, উতবা ইবনে রাবিয়া, শায়বা ইবনে রাবিয়া, ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা, নদর বিন হারেস ও উমাইয়া বিন খালাফের মতো কুরাইশ নেতাদের করুণ মৃত্যু  তাদের হৃদয়াত্মাকে কাঁপিয়ে দেয় এবং তাদের চোখ থেকে অহমিকার পর্দা সরে যায়। কারণ সমকালীন ইতিহাসে কুরাইশ গোত্রের এমন বিপর্যয় আরবরা দেখেনি।

এ ছাড়া বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর বিজয় কুরাইশদের অবাধ বাণিজ্য এবং আরবের অন্যান্য গোত্রের ওপর অন্যায় প্রভাব খাটানোর পথ বন্ধ করে দেয়। মদিনার উপকণ্ঠে ডাকাতি ও লুণ্ঠনের যে ধারা যুগ যুগ ধরে চলে আসছিল—যার পেছনে কুরাইশ নেতাদের সহযোগিতা ও প্রশ্রয় ছিল, তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মুসলিম বাহিনীর এই বিজয়ে স্বস্তি প্রকাশ করে মদিনা ও আশপাশের সর্বস্তরের মানুষ। তারা স্বাগত জানায় সত্যপক্ষের এই মহান বিজয়কে।

 

জ্ঞান বিতরণের শর্তে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি

 

বদর যুদ্ধে বিপুলবৈভব কুরাইশদের বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অভাবনীয় বিজয় অর্জিত হয়। এই যুদ্ধে ৭০ জন কুরাইশ যোদ্ধা নিহত হয় এবং সমপরিমাণ ব্যক্তি বন্দি হয়। যুদ্ধ শেষে রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় পৌঁছার পর সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে পরামর্শ করলেন। হজরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, ওরা তো চাচাতো ভাই এবং আমাদের আত্মীয়-স্বজন। আমার মত হলো, ওদের কাছ থেকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হোক। এতে অর্জিত সম্পদ অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে আমাদের শক্তিতে পরিণত হবে। আর এমনও হতে পারে, আল্লাহ তাআলা তাদের হিদায়াত দেবেন এবং তারা একসময় আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে।

হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) ভিন্ন মত দিলেন। তিনি বললেন, কুরাইশ যোদ্ধাদের হত্যা করা হোক, যেন ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের সাহস কেউ না পায়। এ ছাড়া এ যুদ্ধবন্দিরা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তাদের অনুপস্থিতি অবিশ্বাসী শিবিরকে দুর্বল করে দেবে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত আবুবকরের পরামর্শ গ্রহণ করলেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা হজরত ওমরের সিদ্ধান্তটিই অধিক সঠিক ছিল বলে জানিয়ে দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিকটবর্তী একটি গাছের প্রতি ইশারা করে বললেন, আমার কাছে ওদের আজাব এই গাছের চেয়ে নিকটতর করে উপস্থাপন করা হয়েছে। (তারিখে ওমর ইবনে খাত্তাব, ইবনে জওজি, পৃষ্ঠা ৩৬)

তবে আল্লাহ তাআলা ফিদইয়া গ্রহণের সিদ্ধান্তের বৈধতা দেন এবং প্রদেয় মুক্তিপণকে মুসলিমদের জন্য হালাল ঘোষণা করেন। তবে আল্লাহ তাআলা এ জন্য করেছেন যে তারা শুধু যুদ্ধবন্দি ছিল না; বরং তারা ইসলাম, মুসলমান ও মানবতার বিরোধী অনেক অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল।

যুদ্ধবন্দিদের কাছ থেকে নেওয়া মুক্তিপণের পরিমাণ ছিল এক হাজার থেকে চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত। যাদের মুক্তিপণ দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না, তাদের পেশা দক্ষতার বিনিময়ে মুক্তি লাভের সুযোগ দেওয়া হয়। যেমন— মক্কাবাসী লেখাপড়া জানত। পক্ষান্তরে মদিনায় লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। ফলে যাদের মুক্তিপণ প্রদানের সামর্থ্য নেই এবং লেখাপড়া জানে, তাদের সুযোগ দেওয়া হলো যে তারা মদিনায় ১০টি করে শিশুকে লেখাপড়া শেখাবে। শিশুরা ভালোভাবে লেখাপড়া শেখার পর শিক্ষক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) কয়েকজন বন্দিকে বিশেষ দয়া করায় তাদের কাছ থেকে ফিদইয়া গ্রহণ করা হয়নি, এমনিতেই মুক্তি দেওয়া হয়। তারা ছিল মোত্তালিব ইবনে হানতাব, সাঈফি ইবনে আবু রেফায়া ও আবু আযযা জুমাহি। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর জামাতা আবুল আসকে এই শর্তের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন যে তিনি নবীনন্দিনী হজরত জয়নব (রা.)-র পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবেন না।

এর কারণ ছিল যে হজরত জয়নব (রা.) আবুল ইবনে আসের ফিদইয়া হিসেবে কিছু সম্পদ পাঠিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি হারও ছিল। হারটি হজরত খাদিজা (রা.) হজরত জয়নব (রা.)-কে আবুল আসের ঘরে পাঠানোর সময় উপহারস্বরূপ দিয়েছিলেন। মহানবী (সা.) তা দেখে অশ্রুসজল হয়ে ওঠেন এবং আবেগে তাঁর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে। তিনি আবুল আসকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে সাহাবাদের মতামত চান। সাহাবারা প্রিয় নবী (সা.)-এর এই প্রস্তাব সশ্রদ্ধভাবে অনুমোদন করেন। অতঃপর মহানবী (সা.) তাঁর জামাতা আবুল আসকে এই শর্তে ছেড়ে দেন যে তিনি হজরত জয়নব (রা.)-কে মদিনায় আসার সুযোগ করে দেবেন। স্বামীর অনুমতি পেয়ে জয়নব (রা.) মদিনায় হিজরত করেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত জায়েদ ইবনে হারেসা এবং অন্য একজন আনসারী সাহাবিকে মক্কায় প্রেরণ করেন। তাদের বলা হয়, তোমরা মক্কার উপকণ্ঠ অথবা জাজ নামক জায়গায় থাকবে। হজরত জয়নব (রা.) তোমাদের কাছ দিয়ে যখন যেতে থাকবেন, তখন তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আসবে। এই দুজন সাহাবি মক্কায় গিয়ে হজরত জয়নব (রা.)-কে মদিনায় নিয়ে আসেন। হজরত জয়নব (রা.)-এর হিজরতের ঘটনা অনেক দীর্ঘ এবং মর্মস্পর্শী।

 

আল-কোরআনে বদর যুদ্ধ

 

বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল এক অধ্যায়, যা অসত্যের বিরুদ্ধে আজন্ম সংগ্রামের অনন্ত অনুপ্রেরণা। শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয়, বরং মানবজাতির ইতিহাসে এটা অনন্য এক ঘটনা। মহান আল্লাহও পবিত্র কোরআনে এই দিনের স্বীকৃতি দিয়েছেন নানাভাবে। তিনি কোরআনে উভয় পক্ষের শক্তির পার্থক্য, মুসলিম উম্মাহর প্রতি তাঁর অনুগ্রহ এবং কম্পমান একটি অবস্থা থেকে মুসলিম বাহিনীর ঘুরে দাঁড়ানোর চিত্র তুলে ধরেছেন। সাহসিকতা এই সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী দিন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনের সুরা আলে ইমরান ও সুরা আনফালে বদর যুদ্ধের সবিস্তার বর্ণনা এসেছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর মতে, সুরা আনফাল বদর যুদ্ধ সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। এ সুরায় যুদ্ধলব্ধ সম্পদ, যুদ্ধবন্দি, ফেরেশতাদের অংশগ্রহণসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর আলোচনা রয়েছে। আর সুরা আলে ইমরানে মুসলমানদের অবস্থা, আল্লাহর সাহায্য ও তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এ সুরায় আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ভবিষ্যতেও সাহায্যের ধারা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।

বদর যুদ্ধের অবস্থা তুলে ধরে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের বদরে সাহায্য করেছেন। অথচ তোমরা ক্ষীণশক্তি। ’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১২৩)

এই সাহায্যের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, ‘আর আল্লাহ এটা করেছেন, তোমাদেরকে সুসংবাদ দেওয়ার জন্য এবং যাতে এর দ্বারা তোমাদের অন্তর প্রশান্ত হয়। সাহায্য শুধু মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর পক্ষ থেকে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১২৬)

শুধু বদর নয়, বরং ভবিষ্যতেও আল্লাহ আসমানি এই সাহায্যের ধারা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বরং তোমরা যদি ধৈর্যধারণ করো, আল্লাহকে ভয় করো এবং তারা দ্রুতগতিতে তোমাদের ওপর আক্রমণ করে তবে আল্লাহ তাআলা তোমাদের পাঁচ হাজার ফেরেশতার সুবিন্যস্ত বাহিনী দ্বারা সাহায্য করবেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১২৫)

সুরা আনফালের ৬৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ মুমিনদের অনুরূপ সাহায্যের অঙ্গীকার করেছেন।

সুরা আনফালে আল্লাহ তাআলা বদর প্রান্তে মুসলিম বাহিনীর অবস্থানের প্রসংশা করে বলেছেন, ‘স্মরণ করো, যখন তোমরা ছিলে নিকট প্রান্তে এবং তারা ছিল দূর প্রান্তে। উষ্ট্রারোহী দল ছিল তোমাদের চেয়ে নিম্নভূমিতে।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৪২)

এর পরের আয়াতেই আল্লাহ মুমিনদের সাহস জোগানোর একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করো! যখন আল্লাহ তোমাকে স্বপ্নে দেখিয়েছিলেন, তারা সংখ্যায় অল্প। যদি তিনি তাদের সংখ্যায় বেশি দেখাতেন তবে তোমরা সাহস হারাতে এবং যুদ্ধের ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি করতে। কিন্তু আল্লাহ রক্ষা করেছেন। নিশ্চয় তিনি অন্তরের খবর জানেন। ’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৪৩)

সুরা আনফালের ৫০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ফেরেশতাদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে বলেছেন, ‘যদি তুমি দেখতে ফেরেশতারা অবিশ্বাসীদের মুখে ও পিঠে আঘাত করে জীবন কেড়ে নিচ্ছে এবং বলছে, তোমরা দহনযন্ত্রণা ভোগ করো।’

একই সুরার ৬৭ থেকে ৭১ নম্বর আয়াত পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা যুদ্ধবন্দিদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এই আয়াতে অর্থের বিনিময়ে বন্দিদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করা হয়। তবে পরের আয়াতে এই সিদ্ধান্তের বৈধতাও দেওয়া হয়। যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে বলা হয়, যদি তাদের উদ্দেশ্য ভালো হয় তবে আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দেবেন। আর যদি তাদের উদ্দেশ্য মন্দ হয় তবে আল্লাহ মুমিনদের মাধ্যমে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেবেন।

সর্বোপরি বলা যায়, এ দুই সুরায় আল্লাহ তাআলা বদর যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরেছেন।

 

বদরে অংশগ্রহণকারী সাহাবিদের অনন্য মর্যাদা

 

ইসলামের ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধ বদর, যা নানাভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই যুদ্ধের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা প্রথম সত্য-মিথ্যার বিভাজন স্পষ্ট করেছিলেন। ইসলামকে সম্মানিত ও কুফরি শক্তিকে অপদস্থ করেছিলেন। ইসলামের প্রধান শত্রুদেরও আল্লাহ বিনাশ করেছিলেন বদরের প্রান্তে। মানব ইতিহাসের নজিরবিহীন এই ঘটনাকে বলা হয় মুসলিম উম্মাহর সাফল্যের প্রবেশপথ, যা যুগ যুগ ধরে এই জাতিকে সত্যের পথে সংগ্রামের অনুপ্রেরণা জুগিয়ে আসছে।

কিন্তু বিজয় নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ মৃত্যু ও ধ্বংসের মুখে নিজেকে ঠেলে দেওয়া। কেননা এই যুদ্ধ ছিল দুটি অসম প্রতিপক্ষের লড়াই। একদিকে ছিল আধুনিক অস্ত্র ও বাহনে সমৃদ্ধ সহস্র সৈনিকের কুরাইশ বাহিনী, অন্যদিকে ছিল সামান্য অস্ত্র ও রিক্তহস্ত মুসলিম বাহিনী। পৃথিবীর সব পরিসংখ্যানে এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর পরাজয় ছিল অবধারিত। কিন্তু আল্লাহ মুসলিম বাহিনীকে বিজয়ী করেছিলেন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষায় যারা নিজেদের নিশ্চিত পরাজয় ও মৃত্যুর মুখে সমর্পণ করেছিল আল্লাহ তাআলা তাদের দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত করেন।

পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াত দ্বারা বদর যুদ্ধের এবং অসংখ্য হাদিস দ্বারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মর্যাদা প্রমাণিত। হজরত রাফায়া ইবনে রাফে তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। জিবরাঈল (আ.) নবী (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন, আপনারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের কিভাবে মূল্যায়ন করেন? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, সর্বোত্তম মুসলিম হিসেবে অথবা অনুরূপ কিছু। হজরত জিবরাঈল (আ.) বলেন, অনুরূপ ফেরেশতাদের মধ্যেও যারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। (সহিহ বুখারি,  হাদিস : ৩৭৭১)

আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, অপর হাদিসে রাসুলে আকরাম (সা.) বদর যুদ্ধে শহীদ একজন সাহাবিকে জান্নাতের সুসংবাদ দান করেন।
আবু হুরায়রা (রা.) হাদিসে মহানবী (সা.) বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ক্ষমার সুসংবাদ দান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ব্যাপারে অবগত আছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের যা ইচ্ছা করো। আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। ’ হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, ‘এমন মহান সুসংবাদ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ছাড়া আর কেউ পায়নি। ’ (ফাতহুল বারি, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা ৩০৫)

একইভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের জাহান্নাম থেকে মুক্তির সুসংবাদ দিয়েছেন। জাবের (রা.) বর্ণিত, হাতেব (রা.)-এর একজন দাস রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে তার বিরুদ্ধে নালিশ করল এবং সে বলল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), নিশ্চয় হাতেব জাহান্নামে যাবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুমি মিথ্যা বলেছ। সে জাহান্নামে যাবে না। কেননা সে বদর ও হুদাইবিয়ায় অংশগ্রহণ করেছিল। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৪৯৫)

বদর যুদ্ধের অংশগ্রহণকারীদের এই অপরিমেয় সম্মান ও মর্যাদার কারণ ব্যাখ্যা করে আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, এটা নিছক কোনো যুদ্ধ ছিল না। এটা ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। এর প্রকৃত রূপ ছিল অকল্পনীয় রকম কঠিন এবং প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এ জন্য শরিয়ত প্রণেতা [রাসুলুল্লাহ (সা.)] তাদের মর্যাদাপূর্ণ জান্নাত ফেরদাউসের উচ্চ স্তর লাভের ঘোষণা দিয়েছেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা ২৫৮)

 

বদর দিবস থেকে যা কিছু শিক্ষণীয় ।

 

১৭ রমজান। ঐতিহাসিক বদর দিবস। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে তথা দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজানে বদর প্রান্তরে সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক যুদ্ধ। প্রতিপক্ষ ছিল মক্কার মুশরিক ও মদিনার মুসলিম।

এতে মুসলমানদের সেনা সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩। এই যুদ্ধে মুসলমানরা সংখ্যায় কম হয়েও কাফিরদের বিশাল বাহিনীর ওপর বিজয় লাভ করেছে। কোরআন কারিমে এই যুদ্ধকে সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী যুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়েছে।ইসলামের ইতিহাসে এই যুদ্ধের অসামান্য গুরুত্ব রয়েছে। নিম্নে এই যুদ্ধের কিছু শিক্ষণীয় দিক তুলে ধরা হলো—

 

এক. পরামর্শ করে কাজ করা

রাসুল (সা.)-এর সব কাজকর্ম ওহি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ সব কাজে সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। বদর যুদ্ধের সময় রাসুল (সা.) গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। রাসুল (সা.) মূলত মদিনা থেকে বের হয়েছিলেন আবু সুফিয়ানের ব্যাবসায়িক কাফেলাকে পাকড়াও করার জন্য। পথিমধ্যে তিনি জানতে পারলেন কুরাইশরা তাদের কাফেলাকে রক্ষা করার জন্য সদলবলে যাত্রা করছে। তখন তিনি সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন—এ মুহূর্তে কী করা উচিত। মুসলমানরা কি যুদ্ধ করবে, নাকি মদিনায় ফিরে যাবে। তখন রাসুল (সা.) মুহাজির ও আনসারদের পরামর্শে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই যুদ্ধে রাসুল (সা.) হাব্বাব ইবনে মুনজিরের পরামর্শে যুদ্ধের অবস্থানস্থল পরিবর্তন করেন। অনুরূপভাবে রাসুল (সা.) বদরের বন্দিদের ব্যাপারেও সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ করেন।

দুই. উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা

যেকোনো কাজে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা রাসুল (সা.)-এর সুন্নত। উপযুক্ত ব্যবস্থা কিংবা উপকরণ গ্রহণ করা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয়। বদর যুদ্ধের সময় দেখা রাসুল (সা.) সাধ্যমতো যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। রাসুল (সা.) তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ ও সাঈদ ইবনে জায়েদকে পাঠিয়েছিলেন আবু সুফিয়ানের ব্যাবসায়িক কাফেলার খবর নিতে। অনুরূপভাবে রাসুল (সা.) আদি ইবনে জাবা ও বাসবাস ইবনে আমরকে বদরপ্রান্তে পানি খোঁজ করার জন্য প্ররণ করেন।

তিন. আল্লাহর কাছে দোয়া করা

দোয়া মুমিনের হাতিয়ার। দোয়া বিজয় ও সাফল্যের চাবিকাঠি। রাসুল (সা.) যেকোনো বিপদের সময় দোয়ার প্রতি খুব গুরুত্ব দিতেন। বদর  যুদ্ধের সময় রাসুল (সা.) আল্লাহর কাছে বিনয়াবনত হয়ে রোনাজারি করেছেন এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য তলব করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করো যখন তোমরা নিজ প্রতিপালকের কাছে ফরিয়াদ করেছিলে, তখন তিনি ফরিয়াদের সাড়া দিয়ে বললেন, আমি তোমাদের সাহায্যার্থে এক হাজার ফেরেশতার একটি বাহিনী পাঠাচ্ছি, যারা একের পর এক আসবে।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৯)

চার. সাহায্য একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে

মুমিনদের বৈশিষ্ট্য হলো বিপদ কিংবা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মনোবল হারায় না, বিচলিত হয় না। তারা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করে আল্লাহর ওপর ভরসা করবে। বদর যুদ্ধে দেখা যায়, মুসলমানদের সেনা সংখ্যা অবিশ্বাসীদের তুলায় অনেক কম ছিল। মুসলমানদের যুদ্ধ সরঞ্জাম ও  বাহন বলতে ছিল ৭০টি উট, দুটি ঘোড়া এবং ৬০টি বর্ম। এ যুদ্ধ প্রমাণ করে যে বিজয় কিংবা সাফল্যের ওপর সেনা সংখ্যাধিক্যের কোনো প্রভাব নেই।

পাঁচ. মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র

যুগ যুগ ধরে মুনাফিকদের উপস্থিতি আছে। তারা ইসলামের লেবাস পরে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। বদর যুদ্ধের দিনেও তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। মুমিনরা যখন সম্পূূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় কাফিরদের বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার সিদ্ধন্ত নিল, তখন মুনাফিকরা বলল, মুসলিমরা নিজেদের দ্বিনের ব্যাপারে ধোঁকার মধ্যে রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করো মুনাফিক ও যাদের অন্তরে ব্যাধি ছিল, তারা যখন বলেছিল, তাদের (মুমিনদের) দ্বিন তাদের বিভ্রান্ত করেছে। অথচ কেউ আল্লাহর ওপর ভরসা করলে মহান আল্লাহ তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৪৯)

ছয়. অহংকার পতনের মূল

মক্কার কাফিররা নিজেকে খুব ক্ষমতাবান মনে করত। আত্ম-অহমিকা ও অহংকারের কারণে কেউ তাদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারত না। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তারা মক্কায় মুসলমানদের ওপর বর্ণনাতীত নির্যাতন করেছিল। যুদ্ধের দিনও মুসলমানদের তুলনায় তাদের সেনা সংখ্যা ও যুদ্ধ সুরঞ্জাম অনেক বেশি ছিল। এ নিয়ে তারা অহংকারও করেছিল। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাদের অহংকার ও ক্ষমতার দাপট মাটিতে মিশিয়ে দিলেন। বদর যুদ্ধে আবু জাহেল, উতবা, শাইবা ও উমাইয়ার মতো কুরাইশদের বড় বড় সর্দার নিহত হয়।

 

১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদর দিবস

 

পবিত্র ১৭ রমজান। ঐতিহাসিক বদর দিবস। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে আজকের দিনে সংঘটিত হয়েছিল বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের লড়াই। মাহে রমজানে যে বছর মদিনায় প্রথম সিয়াম পালিত হয়, সেই দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে ইসলামী ইতিহাসের প্রথম আত্মরক্ষামূলক সশস্ত্র যুদ্ধ ‘গায্ওয়ায়ে বদরে’ ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়েছিল।

 

ইসলামের ইতিহাসে ‘বদর যুদ্ধ’ বিশেষভাবে স্মরণীয়। এ যুদ্ধে মুসলমানদের ‘চূড়ান্ত মীমাংসা’ হয়েছিল। ৩১৩ জন মুসলমানের দল তৎকালীন রণকৌশলে পারদর্শী অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত কাফের বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে ইসলামের বিজয় ছিনিয়ে আনে। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘বদরের যুদ্ধে যখন তোমরা হীনবল ছিলে, আল্লাহ তো তোমাদের সাহায্য করেছিলেন। সুতরাং, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১২৩)

 

মক্কার কুরাইশরা যখন দেখল— নবী করিম (সা.) মদিনায় হিজরত করে পৌত্তলিক, ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের সমন্বয়ে পৃথিবীর প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র ‘মদিনা সনদ’-এর ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করেছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও দলমতনির্বিশেষে তার নেতৃত্বে মদিনাবাসী বিনা প্রতিবন্ধকতায় নিঃশঙ্কচ জীবনযাপন করছেন। ইসলামের মর্মবাণী ধীরে ধীরে আরব উপদ্বীপ ছেড়ে বহির্বিশ্বে প্রচারিত হচ্ছিল, তখন মক্কার কাফের সম্প্রদায় ও মদিনার ষড়যন্ত্রকারী মুনাফিকরা চক্রান্ত করে নবী করিম (সা.) ও ইসলামকে দুনিয়া থেকে চিরতরে উৎখাত করতে যুদ্ধের রণপ্রস্তুতি গ্রহণ করে।

 

একদল কুরাইশ ব্যবসায়ী আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে যুদ্ধাস্ত্র কিনে মদিনা হয়ে সিরিয়া থেকে মক্কায় ফিরছিল। পথে সরঞ্জামাদি হারানোর আশঙ্কায় মক্কায় বিপদসংকেত পাঠানো হয়। তখনই কুরাইশ নেতা আবু জেহেল এক হাজার অশ্বারোহী সশস্ত্র যোদ্ধাসহ মদিনা অভিমুখে ছুটে আসেন। এ খবর পেয়ে মহানবী (সা.) রোজাদার সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ সভায় বসেন।

 

সাহাবায়ে কিরামের সুদৃঢ় ইমানি চেতনার মনোবল দেখে নবি করিম (সা.) অত্যন্ত খুশি হলেন। আবু জেহেলের যাত্রার খবর শুনে রমজানের ১২ তারিখে নিখিল বিশ্বের ত্রাণকর্তা স্বয়ং সেনাপতি রাসুলুল্লাহও (সা.) প্রাণোৎসর্গে প্রস্তুত ৬০ জন মুহাজির ও ২৫৩ জন আনসারসহ মোট ৩১৩ জন সাহাবি নিয়ে শত্রু বাহিনীকে বাধা ও ইসলামের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় মদিনা থেকে যাত্রা শুরু বদর প্রান্তরে উপস্থিত হলেন।

 

মুসলমানদের অস্ত্র মাত্র তিনটি ঘোড়া, ৭০টি উট, ছয়টি বর্ম ও আটটি তলোয়ার হলেও বিজয়লাভের প্রধান উপকরণ ছিল ইমানের বল। অস্ত্রবল ও সংখ্যা নয়। নবি করিম (সা.) মুসলমানদের জিহাদ সম্বন্ধে উপদেশ ও উৎসাহ প্রদান করলেন। তিনি বদর প্রান্তরে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেছিলেন। তার দোয়া কবুল করে আল্লাহ তা’আলা বদর যুদ্ধে ফেরেশতা দিয়ে মুজাহিদদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্য করেছিলেন।

 

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে— যখন তুমি মুমিনদের বলছিলে, ‘এটা কি তোমাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, তোমাদের প্রতিপালক প্রেরিত তিন সহস্র ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সহায়তা করবেন?’ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যদি তোমরা ধৈর্যধারণ করো এবং সাবধান হয়ে চলো, তবে তারা দ্রুতগতিতে তোমাদের ওপর আক্রমণ করলে আল্লাহ পাঁচ সহস্র চিহ্নিত ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সাহায্য করবেন।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১২৪-১২৫)

 

আরবের তৎকালীন যুদ্ধরীতি অনুযায়ী প্রথমে সংঘটিত মল্লযুদ্ধে মুসলিমদের হাতে কাফের বাহিনী পরাজিত হয়। মুসলিম বাহিনী বীরবিক্রমে লড়াই করে ইসলামের বিজয় কেতন ছিনিয়ে আনেন। বদর যুদ্ধে ৭০ জন কাফের নিহত ও ৭০ জন বন্দী হয়। অন্যদিকে মাত্র ১৪ জন মুসলিম বীর সেনা শহীদ হন; কাফেরদের বহু অস্ত্র ও রসদপত্র মুসলমানদের হস্তগত হলো।

 

বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, ‘আজ যে ব্যক্তি কাফিরদের বিরুদ্ধে ধৈর্যের সঙ্গে সওয়াবের প্রত্যাশায় যুদ্ধ করবে, শহীদ হবে, আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন।’ (বায়হাকি)

 

১৭ রমজান বদর যুদ্ধ থেকেই শুরু হয় ইসলামের যাত্রা। তওহিদ ও ইমান যে এক অজেয় শক্তি, এর সামনে দুনিয়ার সব শক্তিই মাথা নত করতে বাধ্য, এ কথা মুসলমানরা পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারেন। বস্তুত, বদর যুদ্ধ ছিল ইমানের মহাপরীক্ষা। এতে রোজাদার সাহাবিরা যেভাবে সফলকাম হতে সক্ষম হয়েছেন, ইতিহাসে তার তুলনা নেই। সাফল্যের অপূর্ব বিজয়গাথা ইসলামের ত্যাগের শিক্ষায় সত্য ও ন্যায়ের পথে মুসলমানদের যুগ যুগ ধরে প্রাণশক্তি জুগিয়ে আসছে।

 

IDC Partner

আইডিসির সাথে যোগ দিয়ে উভয় জাহানের জন্য ভালো কিছু করুন।

 

আইডিসি এবং আইডিসি ফাউন্ডেশনের ব্যপারে বিস্তারিত জানতে  লিংক০১ ও লিংক০২ ভিজিট করুন।

আইডিসি  মাদরাসার ব্যপারে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। 

আপনি আইডিসি  মাদরাসার একজন স্থায়ী সদস্য /পার্টনার হতে চাইলে এই লিংক দেখুন.

আইডিসি এতীমখানা ও গোরাবা ফান্ডে দান করে  দুনিয়া এবং আখিরাতে সফলতা অর্জন করুন।

কুরআন হাদিসের আলোকে বিভিন্ন কঠিন রোগের চিকিৎসা করাতেআইডিসি ‘র সাথে যোগাযোগ করুন।

ইসলামিক বিষয়ে জানতে এবং জানাতে এই গ্রুপে জয়েন করুন।

Islami Dawah Center Cover photo

ইসলামী দাওয়াহ সেন্টারকে সচল রাখতে সাহায্য করুন!

 

ইসলামী দাওয়াহ সেন্টার ১টি অলাভজনক দাওয়াহ প্রতিষ্ঠান, এই প্রতিষ্ঠানের ইসলামিক ব্লগটি বর্তমানে ২০,০০০+ মানুষ প্রতিমাসে পড়ে, দিন দিন আরো অনেক বেশি বেড়ে যাবে, ইংশাআল্লাহ।

বর্তমানে মাদরাসা এবং ব্লগ প্রজেক্টের বিভিন্ন খাতে (ওয়েবসাইট হোস্টিং, CDN,কনটেন্ট রাইটিং, প্রুফ রিডিং, ব্লগ পোস্টিং, ডিজাইন এবং মার্কেটিং) মাসে গড়ে ৫০,০০০+ টাকা খরচ হয়, যা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। সেকারনে, এই বিশাল ধর্মীয় কাজকে সামনে এগিয়ে নিতে সর্বপ্রথম আল্লাহর কাছে আপনাদের দোয়া এবং আপনাদের সহযোগিতা প্রয়োজন, এমন কিছু ভাই ও বোন ( ৩১৩ জন ) দরকার, যারা আইডিসিকে নির্দিষ্ট অংকের সাহায্য করবেন, তাহলে এই পথ চলা অনেক সহজ হয়ে যাবে, ইংশাআল্লাহ। যারা এককালিন, মাসিক অথবা বাৎসরিক সাহায্য করবেন, তারা আইডিসির মুল টিমের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন, ইংশাআল্লাহ।

আইডিসির ঠিকানাঃ খঃ ৬৫/৫, শাহজাদপুর, গুলশান, ঢাকা -১২১২, মোবাইলঃ +88 01609 820 094, +88 01716 988 953 (নগদ/বিকাশ পার্সোনাল) ইমেলঃ info@islamidawahcenter.com, info@idcmadrasah.com, ওয়েব: www.islamidawahcenter.com, www.idcmadrasah.com সার্বিক তত্ত্বাবধানেঃ হাঃ মুফতি মাহবুব ওসমানী ( এম. এ. ইন ইংলিশ )