Oaz Mahfil – প্রচলিত ওয়াজ-মাহফিল

বর্তমানে প্রচলিত ওয়াজ-মাহফিলের ধারাটি ব্রিটিশ আমল থেকে এদেশে চলমান। ব্রিটিশ মদদপুষ্ট মিশনারীরা সরাসরি ইসলাম, মুসলিম, কুরআন ও রাসুল (সাঃ) উপর আক্রমন করে হেন কোন পন্থা নেই, যে উপায়ে তারা তাদের খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেনি। তৎকালীন যুগের আলেমদের মধ্যে একটা গ্রুপ এব্যাপারে নিস্পৃহ থাকলেও ঈমানদীপ্ত একদল আলেম মিশনারীদের উন্থাপিত প্রতিটি বিষয়ের দাঁতভাঙ্গা জওয়াব দেয়। অন্যদিকে একটা গ্রুপ ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ করে আকিদাগত বিষয়াদীতে প্রয়োজনাতিরিক্ত অহেতুক ঝগড়া-ফাসাদে ব্যস্ত থেকে ইসলাম প্রচারের চেয়ে নিজেদের দলমত, আদর্শ ও ভ্রান্ত মতাদর্শ প্রচারে ব্যস্ত ছিল। একদলের আকিদাগত সমস্যা বলে নিজেদেরটাকে সঠিক হিসেবে প্রচারে ব্যস্ত আলেমদের অভাব বর্তমানেও নেই বললেই চলে। হাল জামানায় ইউটিউব তার বড় প্রমাণ।

যাইহোক, এদেশে বর্তমান প্রচলিত ওয়াজ-মাহফিলকে সমাজবান্ধব ও জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে উনবিংশ শতাব্দীর বহুল আলোচিত যশোরের মুন্সী মেহেরুল্লাহর অবদান অনেক বেশি। তৎকালীন সময় বাংলায় মাহফিলের দুটি ধারার প্রচলন বেশি ছিল। ক) মিশনারীদের সাথে মুসলিম আলেম ও শাস্ত্রীয় পন্ডিতদের তর্ক-বিতর্ক ও খ) মুসলমানদের দুটি গ্রুপের মাঝে আকিদাগত বিষয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে বহাসের আয়োজন করা। কিন্তু মুন্সী মেহেরুল্লাহ প্রচলিত এই ধারার বাইরে এসে ওয়াজ-মাহফিলকে দাওয়াতী কাজের পাশাপাশি সমাজ সংস্কারের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন। তবে বর্তমানে ওয়াজ-মাহফিলের দাওয়াতী ও সমাজ সংস্কারের সে উদ্দেশ্য কতটা অবশিষ্ট আছে, তা চিন্তার বিষয়। যদিও ওয়ায়েযদের একটা গ্রুপ ওয়াজ-মাহফিলের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর কিন্তু অনেকে এটাকে পেশা ও পুঁজিবিহীন ব্যবসায় পর্যবসিত করতে সচেষ্ট। অধিকাংশ ওয়ায়েযদের প্রকাশভঙ্গি, উপস্থাপনা, সম্বোধন ও সমালোচনার মধ্যে দায়ী চরিত্র পরিলক্ষিত হয় না। বিভিন্ন কৌশলে নিজেদের বড়ত্ব প্রকাশ, জবজান্তা ভাব, অন্যকে হেয় করা, জীবনাদর্শ হিসেবে ইসলামের সৌন্দর্য প্রকাশের চেয়ে ইসলামকে আইনী (ফতোয়া) ধারায় প্রকাশের প্রবণতা এবং সমাজ সংস্কারের চেয়ে সমাজে বিশৃংখলা, অরাজকতা, হিংসা-দ্বেষ, অহংকার, আমিত্ব সর্বোপরী ওয়ায়েযদের জীবনাচার ও প্রকাশভঙ্গিতে পুঁজিবাদী মনোভাবের কারণে মাহফিলের আগের সেই আধ্যাত্মিকতা অবশিষ্ট নেই বললে অতুক্তি হবে না।

ওয়ায়েযদের বাজারদর, জনপ্রিয়তা ও আয়োজকদের ওমুক বক্তা চাইই চাই মনোভাবের কারণে হাল জামানায় যোহর ও আসর নামাজের পরে মাহফিলের চল শুরু হয়েছে। যার ফলে নিজেদের জাত চেনানোর জন্য আধুনিক ও দ্রুতগামী যাতায়াত ব্যবস্থা (প্রয়োজন হলে অবশ্যই ব্যবহার যোগ্য) ব্যবহারের প্রবণতা যেমন বাড়ছে সাথে সাথে নিজেদের ইনামও প্রয়োজনের তাগিদে বেড়েছে। যে ওয়াজ-মাহফিলে মুন্সী মেহেরুল্লাহ পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্টীর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তথা ব্যবসা-বানিজ্যের কথা বলতেন সেটা এখন অনেক জায়গায় মুসলমানদের পকেট কাটার মাধ্যম হয়েছে। ওয়ায়েযদের পকেট সমৃদ্ধ হলেও আয়োজকদের জোর-জবরদস্থিমূলক কালেকশান সাধারণ জনগণ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ (তবে অনেক শিল্পপতি আছেন যারা নিজেরা সব খরচ বহন করেন) অনেকের জন্য কষ্টের কারণ। বিগত দশকে সারা দেশে হাজার হাজার ওয়াজ-মাহফিল একটা সিন্ডিকেটের হাজার কোটি টাকা আয়ের অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আয়োজকরা কত বাজারদর ও জনপ্রিয় বক্তা আনলো, দামী স্টেজ ও চোখ ধাধানো সাজগোজ করল ইত্যাকার হাজারো ঘটনার ভিতরে হাজার কোটি টাকার এই হিসেবটা আবেগী জনগনের চোখের আড়ালে থেকে যায়। আগেকার দিনে ওয়াজ-মাহফিলে আধ্যাত্মিকতার যে আবহ ছিল তা অনেকটা লোপ পেয়ে লৌকিকতা ও বিনোদনে পর্যবসিত হয়েছে। নামধারী, দরবারী, কৌতুকী, বিনোদনী, বেদআ’তী ওয়ায়েয ও সুযোগসন্ধানী কিছু আয়োজকদের কল্যাণে ওয়াজ-মাহফিলের সমাজ সংস্কারের সেই ভূমিকা সুদূর পরাহত হচ্ছে।

বাংলায় ইসলাম প্রচার ও সমাজ বিনির্মানে ধর্ম প্রচারকদের ও পরবর্তীতে ওয়ায়েযদের ভূমিকা ছিল আকাশচুম্বী। কিন্তু বর্তমান ওয়ায়েযদের অধিকাংশের সমাজ ও মানুষের সাথে কোন সম্পর্ক নেই বললেই চলে। অনেকে সেলিব্রেটি, তারকা ও উপর তবকার মানুষ বনে যায়। ভাবখানা এমন যে তারাই শুধু বলে যাবে, অন্যরা শুনবে কিন্তু মানুষের মনের কথা, সমাজের বোবা কান্না, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রোডম্যাপ মাফিক বিগত দশকে দেশের সমাজ ও মানুষের যে আমূল পরিবর্তন সেগুলো ভ্রুক্ষেপ করার সময় নেই তাদের। আত্মপরিচয় হারানো মুসলিমদের হৃত গৌরব উদ্ধারের উপায়, বৈশ্বিক উঞ্চতার দরুন পরিবেশের বিপর্যয়রোধ, সুদমুক্ত ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, আর্থসামাজিক অবস্থার দরুন মহিলাদের সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন এবং আগামী দশকে ঢাকা শহরসহ প্রধানশহরগুলোতে পাশ্চাত্যের আদলে পোশাকী পরিবর্তন ও তার দরুন আমাদের ধর্মীয় ও দেশীয় মূল্যবোধ রক্ষার পথ বাদলানো তাদের কথায় অনুপস্থিত। মুসলিম সভ্যতার অন্যমত স্তম্ভ পরিবার ব্যবস্থার সংরক্ষণ, একান্নবর্তী পরিবার ব্যবস্থা থেকে আত্মকেন্দ্রীক পরিবার ব্যবস্থার রোধ, শহর কেন্দ্রীক বিশেষ করে ঢাকায় পারিবারিক বন্ধনের ভাঙ্গন ও ব্যাপক মাত্রায় অনৈতিক সম্পর্কের প্রসার, একই ফ্লাটে কয়েকটি পরিবার বসবাসের ফলে ঈমানের অন্যতম অঙ্গ লজ্জার নির্বাসন, ঢাকাইয়া বাবুর শহুরে সংস্কৃতি গ্রামে আমদানী, ফলে গ্রাম-বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতির আত্মহুতি, আত্মীয়তার সম্পর্ক দৃঢ়করণ, কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ববোধ ও আমানদারিতার সংরক্ষণ, রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ইত্যাদি বিষয়ে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও মানুষের করণীয় সংক্রান্ত আলোচনা খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় না। পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায় মসজিদ-মাদ্রাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে দ্বন্দ, এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে বাতিল ফিরকা, কাফির, ফাসিক, মোনাফিক, ভন্ড, মূর্খ, জ্ঞানপাপী ইত্যাকার গালিগালাজ প্রদান এখন নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু নিজেদের ভূল-ত্রুটি দূর করতঃ ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে কোন প্রকার ঐক্যের লক্ষণতো নেই বরং তাদের এই অপরিণামদর্শী ও অপরিপক্কতার কারণে সমাজ প্রতিনিয়ত বড় বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তাদের ওয়াজের মধ্যে হৃদয় বিগলিত সেই আবেদন নেই, মানুষের মনের কথা বলা সেই আকুলতা নেই, শান্তি-সমৃদ্ধি ও আদর্শ সমাজ গঠনের ব্যাকুলতা নেই। যে কারণে তাদের কথা মানুষের হৃদয়ে পৌছে না, সমাজের অন্দরে কাঁপন সৃষ্টি করে না, সমাজপতিদের ভাবাবেগকে আন্দোলিত করে না। অথচ বাংলায় ধর্মপ্রচারক ও ওয়ায়েযরা ছিল সমাজের মাথার মুকুট, অসহায় ও দুর্বলের আশ্রয়স্থল, সমাজপতিদের পুজনীয়।

এদেশে ইসলাম আগমন ও প্রচারের ক্ষেত্রে ৩টি ধারা- আরব ব্যবসায়ী, মুসলিম বিজিতা ও ধর্মপ্রচারকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে ৬১৮ সালে রাসূল (সাঃ) এর জীবদ্দশায় ৪ জন সাহাবী চট্রগ্রাম আসেন এবং চায়নাতে যাওয়ার প্রাক্কালে ৯ বছর এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়। রাসুল (সাঃ) এর ওফাতের পরে ও ওমর (রাঃ) শাসনামলেও অনেকে আরব থেকে ইসলাম প্রচারে আসেন এদেশে। তবে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে ধর্মপ্রচারকগণ ১১শ শতাব্দী থেকে ১৭শ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম শাসকদের পৃষ্টপোষকতায় নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করেন, যে সময়কালকে বাংলায় ইসলামের স্বর্ণালী যুগ হিসেবে অবহিত করা হয়। ধর্ম প্রচারকদের প্রভাবটা শুরু হয় ১৩শ শতাব্দীর শুরু থেকে। সম্পূর্ণ বৈরি পরিবেশে মানিয়ে নিয়ে ধমর্ প্রচারকগণ নিজেদের চারিত্রিক মাধূর্য, ধর্মপ্রচারের গভীর অনুভূতি এবং ব্যাপক মানবিক (চ্যারিটি) কার্যক্রমের মাধ্যমে অসহায়-দুস্থ ও নিজ ধর্মে চরমভাবে অবহেলিত হিন্দু-বৌদ্ধদেরকে নিজেদের প্রচারিত আদর্শ ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করে। আর এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখে ধর্মপ্রচারকদের খানক্বাহ, যা আধ্যাত্মিক, মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রমের কেন্দ্রস্থল ছিল এবং বাংলায় শক্তিশালী মুসলিম সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখে। নীচু বর্ণের হিন্দু-বৌদ্ধরা যখন নিজ গোত্রের মানুষের কাছে নিগ্রহের শিকার হতো, তাদের পাশে ঘেঁষতে পারতো না, তখন অসহায় ও নিপীড়িত অন্য ধর্মের মানুষদের জন্য সব সময় খোলা থাকতো খানক্বাহ, যা তাদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে আকৃষ্ট করে। খানক্বাহর পাশাপাশি নওমুসলিমদের মাঝে ইসলামের সুমহান বাণী পৌছাতে ধর্ম প্রচারকগণ মসজিদভিত্তিক মক্তব-মাদ্রাসা চালু করেন, সমাজসেবার ব্রত নিয়ে রাস্তা-ঘাট তৈরি, দীঘি খনন, ব্রীজ-কালভার্ট তৈরি করা ও বিভিন্ন স্থাপত্য স্থাপনে অবদান রাখেন। সাহিত্য-সংস্কৃতির উপর গুরুত্বারোপ করে বিভিন্ন সাহিত্য ও সংগীতের ধারা তৈরি করেন তারা।

ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের আগে শাহ সুলতান বালখী (বগুড়া), শাহ সুলতান রুমী (ময়মনসিংহ), শাহ নেয়ামাতুল্লাহ (ঢাকা), শাহ মাখদুম (রাজশাহী), শেখ ফরিদ উদ্দীন (ফরিদপুর), মাখদুম শাহ দৌলাহ (পাবনা) ও আদম শাহ প্রমূখ বিখ্যাত ধর্ম প্রচারকগণ বাংলায় ইসলাম প্রচার করলেও ইসলামের ব্যাপকভিত্তিক প্রচার-প্রসার শুরু হয় ইখতিয়ার উদ্দীনের বিজয়ের পরে। বিশেষ করে গৌরের শাহজালাল তাবরিজী, ঈসমাইল খান গাজী ও শেখ আলাউল হক, সিলেটের শাহজালাল ইয়েমেনী, খুলনার খান জাহান আলী (বাগেরহাট জেলায় তার মাজার অবস্থিত), রাজশাহীর শাহ দৌলাহ, সোনারগাঁয়ের শারফুদ্দীন আবু তাওয়ামা, চট্রগ্রামের বদরুদ্দীন শাহ মাদার ও ফরিদপুরের শাহ ফরিদদের ধর্ম প্রচার, মানুষের চাহিদা পূরন ও সমাজ সংস্কারমূলক কাজ সর্বজন স্বীকৃত। ১৫শ থেকে ১৮শ শতাব্দীকালে সুলতানদের পৃষ্টপোষকতার ফলে ধর্ম প্রচারকগণ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিজেদের স্থায়ী আবাস স্থাপনের পাশাপাশি সমাজে ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করেন। তবে ১৮শ থেকে ১৯শ শতাব্দীতে এসে বর্তমানে প্রচলিত পীর-মুরিদী ধারা প্রচলনের ফলে ধর্মপ্রচারকদের শক্তিশালী আধ্যাত্মিক ও সামাজিক অবস্থান হ্রাস পেতে শুরু করে। বিশেষ করে ধর্মপ্রচারকদের দুনিয়াবিমূখতা, আড়ম্বরপূর্ণ জীবনধারা পরিহার, ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা প্রদান, বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তণ, সাম্য ও সম্প্রীতি স্থাপন, ন্যায়পরায়ণতা ও জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য মানবিক কার্যক্রমের যে ধারা চালু ছিল, ধীরে ধীরে সেগুলোতে শৈথিল্য চলে আসে।

তবে পীর-মুরিদীর নতুন ধারার মধ্যেও পূর্ববর্তী ধর্ম প্রচারকদের দেখানো পথে বাংলায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন ধারা যেমন “ফুরফুরা শরীফ” কিছুটা হলেও তাদের পদঙ্ক অনুসরণ করে। বিশেষ করে ফুরফুরা শরীফের প্রতিষ্ঠাতা আবু বক্বর ছিদ্দিকী, তার ছেলে আব্দুল হাই ছিদ্দিকী ও আবুল আনছার মুহাম্মাদ আব্দুল কাহ্হার ছিদ্দিকী, তার খলিফা বশিরহাটের মাওলানা রুহুল আমিন, ছারছীনার মাওলানা নেছার উদ্দীন, চরমোনাইয়ের মাওলানা ইসহাক ও সাতক্ষীরার ময়েজ উদ্দীন হামেদী। পরবর্তীতে এ ধারা থেকে ভিন্ন ভিন্ন ধারা তৈরি হয় যা বর্তমানে বিদ্যমান। তবে শুরু থেকে ফুরফুরা ধারা পর্যন্ত আধ্যাত্মিক শিক্ষার পাশাপাশি সমাজ সংস্কারমূলক কাজের জন্য সর্বজন স্বীকৃত। অন্যদিকে একই শতাব্দীতে বর্তমান ধারার ওয়াজ-মাহফিলকে তৎকালীন প্রচলিত বহাসের ধারা থেকে সমাজ সংস্কারের মাধ্যম হিসেবে নতুনরুপে উপস্থাপন করেন যশোরের মুন্সী মেহেরুল্লাহ। পাশাপাশি মুসলমানদের মধ্যে বিবাদমান সমস্যার সমাধান, সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারের মূলোৎপাঠন, মুসলমানদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য ব্যবসা-বানিজ্য করা, শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া অবহেলিত মুসলিম জনগোষ্টীর জন্য মক্তব, স্কুল, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা এবং গরীব ছাত্রদের জন্য ছাত্রাগার ও লজিংয়ের ব্যবস্থা করা, সংস্কৃতির উন্নতি সাধনে লেখক তৈরি ও বিভিন্ন সাহিত্য ও সংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা ছিল তার অন্যতম অবদান। যদিও তিনি খ্রিষ্টান মিশনারীদের সাথে বিতর্কের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।

যাইহোক, ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে ও পাকিস্থানী আমলে ফুরাফুরা শরীফ ও বিভিন্ন খানক্বাহর খলিফাগণ, শামসুল হক ফরিদপুরীসহ কওমী অঙ্গনের অনেকে বাংলায় ইসলাম প্রচার-প্রসারে অবদান রেখেছেন। তাদের দায়ী চরিত্র ও সমাজ সংস্কারমূলক কাজ সমানভাবে চলমান ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে দাওয়াতী কাজ তথা ওয়ায়েয হিসেবে যারা সর্বজন শ্রদ্বেয় ছিলেন বিশেষ করে হাফেজ্জী হুজুর, ক্বারী ওবায়দুল হক্ব, শায়খুল হাদীস আজিজুল হক্ব, মাওলানা দেলওয়ার হোসেন সাঈদী, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ও মাওলানা কামালুদ্দীন জাফরী প্রমূখ। ওয়াজের পাশাপাশি তারা সমাজের মানুষের কথা ভাবতেন, মানুষের উন্নতি সাধনে নিরলস কাজ করে গেছেন। বিগত দশকে এদেশে একজন দায়ী ও সমাজ সংস্কারের বাস্তব নমুনা ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ডঃ খন্দকার মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পাশাপাশি সফল একজন দায়ী, ওয়ায়েয, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক ছিলেন তিনি। জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের অবাধ যাতায়াত ও নির্বিঘ্নে যে কেউ মনের কথাগুলো বলতে পারতেন তাঁর কাছে। মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন সামাজিক কাজের আন্জাম দিতেন তিনি। মিশনারীদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার।

বিগত কয়েক বছর বাংলাদেশে ওয়াজ-মাহফিলে ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। ওয়াজ-মাহফিলকে অনেকে দাওয়াহর পরিবর্তে পেশা হিসেবে নেওয়ায় মানুষ ও সমাজ পরিবর্তনে এর আগের সেই আবেদন অনেকটা ম্লান। মাঠে বিভিন্ন ধরনের ওয়ায়েযরা যেমন এসেছে, তাদের দাবী-দাওয়া ও প্রয়োজন বেড়েছে সময়ের চাহিদানুযায়ী। বক্তাদের চলনে-বলনে, পোশাকে-আশাকে, উপস্থাপনায় যেমন চাকচিক্য এসেছে, কিন্তু মানুষের মন বিগলিত করা, তাদের ভাবাবেগ বোঝা ও সমাজ পরিবর্তনে তেমন কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না। অনেকে যোহর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছেন, অন্যদের সামনে ইসলামে প্রচারে নিজেদের অবদানের ফিরিস্তি তুলে ধরছেন কিন্তু মানুষের মনে তেমন রেখাপাত করছে না। তারা যা বলে বাস্তব জীবনে অনেকে তা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। ওয়াজ-মাহফিলের সিজনে হাজারপতি-লাখপতি-কোটিপতি বনে গেলেও পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর ঔষধ কেনার টাকা নেই, শীতে কম্বল কেনার সক্ষমতা নেই, ছেলের স্কুলে ভর্তির ফি দেওয়ার অবলম্বন নেই সেদিকে লাখপতি ওয়ায়েজীনদের দেখার সুযোগ কোথায়! তবে প্রমোদের জন্য স্ব-পরিবারে ঘুরতে যাওয়ার সহাস্য বদনে সেলফি তোলার অফুরন্ত সুযোগের কমতি নেই তাদের। নিজেদের চোখের সামনে তরুন প্রজন্ম ধ্বংশ হয়ে যাচ্ছে তাদের নিয়ে কোন চিন্তা নেই।

নিজেদের সেলিব্রেটি পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের শরয়ী বোর্ডের সদস্য হওয়া, হজ্ব কাফেলা পরিচালনা, নিজ আদর্শের ও তরিকাপন্থীদের নিয়ে ক্লাব ও সংস্থা সাদৃশ্য সংগঠন করা (ভাল উদ্দেশ্যে করলে দোষের নয়), দাওয়াত দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে সিন্ডেকেট করা যদি ওয়ায়েযদের তথা দায়ীদের কাজ হয়, তাহলে সে দাওয়াতে বক্তার বিত্ত-বৈভব ফুলে-ফেঁপে উঠলেও শ্রোতার মানসজগত ও সমাজের অন্দরে কোন পরিবর্তন আনবে বলে মনে হয় না। এভাবে চলতে থাকলে সাধারণ মানুষ প্রচলিত ধারার ওয়ায়েযদের থেকে কী মুখ ফিরিয়ে নিবে না? ওয়াজ-মাহফিলকে দাওয়াহর পরিবর্তে শুধুমাত্র পেশা হিসেবে নিলে, সমাজ ও মানুষ পরিবর্তনের বিপরীতে সাধারণ মানুষের হৃদয় থেকে কি দূরে সরে যাবে না? বর্তমানে আলেমদের সমাজবিমুখতা ও সামাজিক কাজে নিস্প্রহতা সমাজের বর্তমান অরাজকতা ও বিশৃংখল পরিস্থিতির জন্য কি মোটেও দায়ী নয়? সময় এসেছে চিন্তা করার, ওয়ায়েজরা কী আগেকার ধর্মপ্রচারকদের মত মানুষের মনের কথা, তাদের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হওয়া, সমাজের কথা ও সমাজে সক্রিয় অবদান রাখতে পারছে? দাওয়াতী কাজের অবারিত সম্ভাবাময় ও জনপ্রিয় এই ক্ষেত্রকে ওয়ায়েযরা আদর্শ সমাজ ও মানুষ গঠনের প্লাটফর্ম হিসেবে গ্রহন করবে? নাকি তাদের সমাজ বিমুখতা বৃহৎ জনগোষ্টীর কাছে নিজেদের নিষ্প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করে তাদের অন্তর থেকে দূরে সরে যাবে?

আইডিসির সাথে যোগ দিয়ে উভয় জাহানের জন্য ভালো কিছু করুন।

 

আইডিসি এবং আইডিসি ফাউন্ডেশনের ব্যপারে বিস্তারিত জানতে  লিংক০১ ও লিংক০২ ভিজিট করুন।

আইডিসি  মাদরাসার ব্যপারে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। 

আপনি আইডিসি  মাদরাসার একজন স্থায়ী সদস্য /পার্টনার হতে চাইলে এই লিংক দেখুন.

আইডিসি এতীমখানা ও গোরাবা ফান্ডে দান করে  দুনিয়া এবং আখিরাতে সফলতা অর্জন করুন।

কুরআন হাদিসের আলোকে বিভিন্ন কঠিন রোগের চিকিৎসা করাতেআইডিসি ‘র সাথে যোগাযোগ করুন।

ইসলামিক বিষয়ে জানতে এবং জানাতে এই গ্রুপে জয়েন করুন।

Islami Dawah Center Cover photo

ইসলামী দাওয়াহ সেন্টারকে সচল রাখতে সাহায্য করুন!

 

ইসলামী দাওয়াহ সেন্টার ১টি অলাভজনক দাওয়াহ প্রতিষ্ঠান, এই প্রতিষ্ঠানের ইসলামিক ব্লগটি বর্তমানে ২০,০০০+ মানুষ প্রতিমাসে পড়ে, দিন দিন আরো অনেক বেশি বেড়ে যাবে, ইংশাআল্লাহ।

বর্তমানে মাদরাসা এবং ব্লগ প্রজেক্টের বিভিন্ন খাতে (ওয়েবসাইট হোস্টিং, CDN,কনটেন্ট রাইটিং, প্রুফ রিডিং, ব্লগ পোস্টিং, ডিজাইন এবং মার্কেটিং) মাসে গড়ে ৫০,০০০+ টাকা খরচ হয়, যা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। সেকারনে, এই বিশাল ধর্মীয় কাজকে সামনে এগিয়ে নিতে সর্বপ্রথম আল্লাহর কাছে আপনাদের দোয়া এবং আপনাদের সহযোগিতা প্রয়োজন, এমন কিছু ভাই ও বোন ( ৩১৩ জন ) দরকার, যারা আইডিসিকে নির্দিষ্ট অংকের সাহায্য করবেন, তাহলে এই পথ চলা অনেক সহজ হয়ে যাবে, ইংশাআল্লাহ। যারা এককালিন, মাসিক অথবা বাৎসরিক সাহায্য করবেন, তারা আইডিসির মুল টিমের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন, ইংশাআল্লাহ।

আইডিসির ঠিকানাঃ খঃ ৬৫/৫, শাহজাদপুর, গুলশান, ঢাকা -১২১২, মোবাইলঃ +88 01609 820 094, +88 01716 988 953 (নগদ/বিকাশ পার্সোনাল) ইমেলঃ info@islamidawahcenter.com, info@idcmadrasah.com, ওয়েব: www.islamidawahcenter.com, www.idcmadrasah.com সার্বিক তত্ত্বাবধানেঃ হাঃ মুফতি মাহবুব ওসমানী ( এম. এ. ইন ইংলিশ )

 

 

IDC Partner