রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ১১ জন সম্মানিতা স্ত্রী: বংশ পরিচয় ও বিবাহের প্রেক্ষাপট
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ১১ জন সম্মানিতা স্ত্রী: বংশ পরিচয় ও বিবাহের প্রেক্ষাপট (কোরআন ও হাদীসের আলোকে) – The 11 Honorable Wives of the Prophet Muhammad PBUH (peace and blessings of Allah be upon him)
লেখেছেনঃ মাহবুব ওসমানী – প্রকাশনায়ঃ https://islamidawahcenter.com
ভূমিকা:
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে পবিত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদেরকে “أُمَّهَاتُ الْمُؤْمِنِينَ” তথা “মুমিনদের মায়েরা” বলে ঘোষণা করেছেন:
﴿وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ﴾
“আর তাঁর (নবীর) স্ত্রীগণ তাদের মায়েরা।”
(সূরা আল-আহযাব, 33:6)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বৈবাহিক জীবন ছিল বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ও শিক্ষনীয়তায় ভরপুর, যা কেবল তাঁর ব্যক্তিগত চাহিদা পূরণের জন্য নয়, বরং তা ছিল আল্লাহর হিকমতের অংশ ও মুসলিম উম্মাহর জন্য শিক্ষা ও আদর্শ।
এখানে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মানিত ৯ জন স্ত্রী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
✦ রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সম্মানিত স্ত্রীগণ (أمهات المؤمنين):
নবী করিম ﷺ-এর মোট ১১ জন স্ত্রী ছিলেন, যাঁরা ইসলামের ইতিহাসে “أمهات المؤمنين” অর্থাৎ “মুমিনদের মা” হিসেবে পরিচিত। তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে বিবাহের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক, সামাজিক ও কৌশলগত কারণ ছিল। এদের মধ্যে কেউ কেউ নবী ﷺ-এর ইন্তিকালের পূর্বে ইন্তিকাল করেন, আবার কেউ তাঁর জীবদ্দশায় একসাথে ছিলেন।
✅ স্ত্রীদের নাম ও বিবাহের প্রেক্ষাপট:
১. خديجة بنت خويلد رضي الله عنها
– প্রথম স্ত্রী, তাঁর সঙ্গে বিবাহ হয় নবুয়তের ১৫ বছর আগে। তিনিই ছিলেন একমাত্র স্ত্রী তাঁর জীবনের প্রথম ২৫ বছর।
২. سودة بنت زمعة رضي الله عنها
– প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর নবী ﷺ তাঁকে বিবাহ করেন, যিনি একজন বয়স্কা ও বিদ্বান মহিলা ছিলেন।
৩. عائشة بنت أبي بكر رضي الله عنها
– আবু বকর রা. এর কন্যা। নবী ﷺ তাঁকে স্বপ্নে দেখেন এবং আল্লাহর নির্দেশে তাঁকে বিবাহ করেন।
٤. حفصة بنت عمر رضي الله عنها
– উমর রা. এর কন্যা। তাঁর স্বামী উহুদের যুদ্ধে শহীদ হলে নবী ﷺ তাঁকে বিবাহ করেন।
٥. زينب بنت خزيمة رضي الله عنها
– “أم المساكين” নামে পরিচিত। দরিদ্রদের সহায়তার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন।
٦. أم سلمة (هند بنت أبي أمية) رضي الله عنها
– তাঁর স্বামী শহীদ হলে নবী ﷺ তাঁকে আশ্রয় দেন ও বিবাহ করেন।
٧. زينب بنت جحش رضي الله عنها
– তাঁর সঙ্গে বিবাহ হয় আল্লাহর নির্দেশে, যাতে দত্তক পুত্রের (যয়দ রা.) স্ত্রীর সাথে বিবাহ বৈধ হয় বলে প্রমাণিত হয়।
٨. جويرية بنت الحارث رضي الله عنها
– বন্দি হওয়ার পর তাঁকে মুক্ত করে বিবাহ করেন, এতে তাঁর গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে।
٩. أم حبيبة (رملة بنت أبي سفيان) رضي الله عنها
– হাবশায় হিজরতকারী সাহাবী। তার স্বামী খ্রিস্টান হয়ে গেলে তিনি একা হয়ে পড়েন। নবী ﷺ তাঁকে সম্মান দিয়ে বিবাহ করেন।
١٠. صفية بنت حيي رضي الله عنها
– খায়বার বিজয়ের সময় বন্দি হন, পরে নবী ﷺ তাঁকে মুক্ত করে বিবাহ করেন।
١١. ميمونة بنت الحارث رضي الله عنها
– শেষ স্ত্রী। তিনি ছিলেন খুবই দানশীলা ও ধর্মপ্রাণ।
১. খাদিজাহ বিন্তু খুওয়াইলিদ রাদিয়াল্লাহু আনহা
বংশ পরিচয়: কুরাইশ গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত নারী।
বিবাহের প্রেক্ষাপট: ব্যবসায়িক কাজে পরিচয়ের সূত্র ধরে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাঁর চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দেন।
বিবাহকাল: নবুয়তের ১৫ বছর পূর্বে, নবীজির বয়স ২৫ বছর এবং খাদিজার ৪০ বছর।
গুরুত্ব: রাসূল (সা.) এর প্রথম স্ত্রী। জীবদ্দশায় নবীজি অন্য কোনো স্ত্রী বিবাহ করেননি। তিনি ছিলেন রাসূলের সান্ত্বনা ও সাহসের উৎস।
রাসূল (সা.) বলেছেন:
«خَيْرُ نِسَائِهَا مَرْيَمُ، وَخَيْرُ نِسَائِهَا خَدِيجَةُ»
“সর্বশ্রেষ্ঠ নারী মেরিয়াম এবং খাদিজা।”
(সহীহ আল-বুখারী, হাদীস: 3432)
খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ رضي الله عنها
✦ বংশ পরিচয়:
-
পূর্ণ নাম: খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ ইবনে আসাদ
-
কুরাইশ বংশের অভিজাত ও ধনাঢ্য নারী ছিলেন
-
পূর্বে দুইবার বিবাহিত ছিলেন, তারপর বিধবা হন
✦ বিবাহের প্রেক্ষাপট:
-
ব্যবসায়ী ছিলেন এবং রাসূল ﷺ তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন
-
রাসূল ﷺ-এর সততা, চরিত্র ও আমানতের গুণ দেখে তিনি নিজে থেকেই বিবাহের প্রস্তাব দেন
-
বিবাহের সময় নবী ﷺ-এর বয়স ছিল ২৫, আর তাঁর বয়স ছিল ৪০
📌 তিনি ছিলেন রাসূল ﷺ-এর প্রথম স্ত্রী এবং তাঁর জীবদ্দশায় রাসূল ﷺ আর কোনো স্ত্রী গ্রহণ করেননি।
২. সাওদা বিনতে যামআ রাদিয়াল্লাহু আনহা
বংশ পরিচয়: কুরাইশ গোত্রভুক্ত।
বিবাহের প্রেক্ষাপট: তাঁর প্রথম স্বামী (সাকরান ইবনু আমর) মারা গেলে তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে সহানুভূতি ও কল্যাণের জন্য বিবাহ করেন।
বিবাহকাল: হিজরতের আগে, খাদিজার মৃত্যুর পরে।
বিশেষতা: সাহাবিয়া হিসেবে প্রথমদিকের ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে একজন।
সৌদাহ বিনতে যাম’আ رضي الله عنها
✦ বংশ পরিচয়:
-
পূর্ণ নাম: সৌদাহ বিনতে যাম’আ ইবনে কায়স
-
কুরাইশ বংশের ‘আমের ইবনে লুয়াই’ শাখার নারী ছিলেন
✦ বিবাহের প্রেক্ষাপট:
-
পূর্বের স্বামী মারা গেলে তিনি বিধবা হন
-
খাদিজা রা.-এর ইন্তিকালের পর রাসূল ﷺ তাঁর সন্তানদের দেখাশোনার someone দরকার ছিল, তখন তিনি সৌদাহ রা.-কে বিবাহ করেন
-
তিনি ছিলেন খুবই ধর্মপ্রাণ, দানশীলা ও রসিক নারী
৩. আয়িশা বিনতে আবি বকর রাদিয়াল্লাহু আনহা
বংশ পরিচয়: আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কন্যা।
বিবাহের প্রেক্ষাপট: আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ ছিল। নবীজিকে স্বপ্নে আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে দেখানো হয়।
রাসূল (সা.) বলেন:
«أُرِيتُكِ فِي الْمَنَامِ، يَقُولُ: هَذِهِ امْرَأَتُكَ»
“আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি, বলা হলঃ এ তোমার স্ত্রী।”
(সহীহ আল-বুখারী, হাদীস: 3894)
বিবাহকাল: মক্কী জীবনে আকদ হয়, হিজরতের পরে সহবাস।
বিশেষতা: সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী নারী। ফিকহ ও জ্ঞানেও অগ্রগামী।
আয়িশা বিনতে আবু বকর رضي الله عنها
✦ বংশ পরিচয়:
-
আবু বকর আস-সিদ্দীক رضي الله عنه-এর কন্যা
-
কুরাইশ গোত্রের তায়ম শাখার অন্তর্ভুক্ত
✦ বিবাহের প্রেক্ষাপট:
-
আয়িশা রা. ছিলেন রাসূল ﷺ-এর প্রিয়তমা স্ত্রী
-
তাঁর সঙ্গে বিবাহ হয় নবুয়তের ১০ম বছরে
-
অল্প বয়সে বিবাহ হলেও সহবাস হয় মদিনায় হিজরতের পর
📌 তিনি সবচেয়ে বেশি হাদীস বর্ণনাকারী নারী সাহাবী ছিলেন এবং ইসলামী জ্ঞানে খুবই পারদর্শী ছিলেন।
৪. হাফসা বিনতে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহা
বংশ পরিচয়: উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর কন্যা।
বিবাহের প্রেক্ষাপট: স্বামী শহীদ হওয়ার পর রাসূল (সা.) তাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন।
রাসূল (সা.) বলেন:
«نِعْمَ الرَّجُلُ عَبْدُ اللهِ لَوْ كَانَ يُصَلِّي مِنَ اللَّيْلِ»
(সহীহ আল-বুখারী, হাদীস: 1122)
বিশেষতা: এক রাত্রিতে তালাকের পর আল্লাহর নির্দেশে তাঁকে ফেরত নেয়া হয়। কুরআন সংরক্ষণের অন্যতম সাক্ষী ছিলেন।
হাফসা বিনতে উমর رضي الله عنها
✦ বংশ পরিচয়:
-
খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব رضي الله عنه-এর কন্যা
-
কুরাইশের ‘আদি’ গোত্রের সদস্য
✦ বিবাহের প্রেক্ষাপট:
-
স্বামী খুনায়স ইবনে হুযাফা বদর যুদ্ধে শহীদ হলে তিনি বিধবা হন
-
রাসূল ﷺ তাঁর ইমানদারী ও তাকওয়া দেখে তাঁকে বিবাহ করেন
📌 হাফসা রা.-এর ঘরে কুরআনের Mushaf সর্বপ্রথম সংরক্ষিত হয়।
৫. জয়নব বিনতে খুযাইমা রাদিয়াল্লাহু আনহা
বংশ পরিচয়: আমের ইবনে আবদ মানাফের কন্যা।
উপাধি: “أُمُّ المَسَاكِينِ” (গরীবদের মা)।
বিবাহকাল: হিজরতের ৩য় বর্ষে।
বিশেষতা: বিয়ের ২-৩ মাস পরই ইন্তেকাল করেন। খুব দানশীল ছিলেন।
যয়নব বিনতে খুযায়মা رضي الله عنها
✦ বংশ পরিচয়:
-
গোত্র: আমির ইবনে সা’সা’আ
-
উপাধি: “উম্মুল মাসাকীন” (গরিবদের মা) – প্রচুর দান করতেন
✦ বিবাহের প্রেক্ষাপট:
-
পূর্বে দুইবার বিবাহিত ছিলেন এবং দুই স্বামীই যুদ্ধ বা অসুস্থতায় মারা যান
-
রাসূল ﷺ তাঁকে দয়া করে ও সন্মান দিয়ে বিবাহ করেন
📌 বিবাহের কিছু মাস পরেই তিনি ইন্তিকাল করেন। তিনিই প্রথম “উম্মুল মু’মিনীন” যাঁর জানাজা রাসূল ﷺ নিজে পড়ান।
৬. উম্মু সালামাহ (হিন্দ বিনতে আবি উমাইয়া) রাদিয়াল্লাহু আনহা
বংশ পরিচয়: আবি উমাইয়া সুবায়ার ইবনে মুত্তআলিব।
বিবাহের প্রেক্ষাপট: স্বামী আবু সালামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু ইন্তেকাল করলে রাসূল (সা.) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বিবাহ করেন।
তিনি দুআ করেছিলেন:
«اللَّهُمَّ أَجِرْنِي فِي مُصِيبَتِي، وَاخْلُفْ لِي خَيْرًا مِنْهَا»
(সহীহ মুসলিম, হাদীস: 918)
উম্মু সালামা (হিন্দ বিনতে আবি উমাইয়্যা) رضي الله عنها
✦ বংশ পরিচয়:
-
নাম: হিন্দ বিনতে আবি উমাইয়্যা
-
কুরাইশের ‘মাখযূম’ গোত্রের সদস্য
-
পূর্ব স্বামী: আবু সালামা, যিনি প্রথম মুহাজিরদের একজন ছিলেন
✦ বিবাহের প্রেক্ষাপট:
-
স্বামী শহীদ হলে তিনি গভীর কষ্টে ছিলেন
-
রাসূল ﷺ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে এবং তাঁর সন্তানদের লালনের উদ্দেশ্যে বিবাহ করেন
📌 তিনি ছিলেন জ্ঞানী ও বিচক্ষণ; বহু হাদীস তাঁর থেকে বর্ণিত হয়েছে।
৭. জয়নব বিনতে জাহশ রাদিয়াল্লাহু আনহা
বংশ পরিচয়: রাসূলের ফুফু উমাইমার কন্যা।
বিবাহের প্রেক্ষাপট: পূর্বে রাসূলের দত্তকপুত্র জায়দ রাদিয়াল্লাহু আনহুর স্ত্রী ছিলেন। তাঁদের তালাকের পর আল্লাহর নির্দেশে রাসূল (সা.) তাঁকে বিবাহ করেন।
আল্লাহ বলেন:
﴿فَلَمَّا قَضَىٰ زَيْدٌ مِّنْهَا وَطَرًا زَوَّجْنَاكَهَا﴾
“যখন জায়েদ তাঁর প্রয়োজন শেষ করলো, তখন আমি তাকে তোমার সঙ্গে বিবাহ দিলাম।”
(সূরা আল-আহযাব, 33:37)
যয়নব বিনতে জাহশ رضي الله عنها
✦ বংশ পরিচয়:
-
কুরাইশের বনু আসাদ গোত্রের সদস্য
-
রাসূল ﷺ-এর চাচাতো বোন
✦ বিবাহের প্রেক্ষাপট:
-
পূর্বে বিবাহিত ছিলেন জায়েদ ইবনে হারিসা-এর সাথে (যিনি ছিলেন রাসূল ﷺ-এর দত্তকপুত্র)
-
জায়েদ রা.-এর সঙ্গে তালাকের পর আল্লাহর আদেশে রাসূল ﷺ তাঁকে বিবাহ করেন
📖 কুরআনে বর্ণিত:
“فَلَمَّا قَضَىٰ زَيْدٌ مِّنْهَا وَطَرًا زَوَّجْنَاكَهَا”
– “যখন যায়েদ তাঁর থেকে বিচ্ছেদ করলেন, আমি (আল্লাহ) তোমার সাথে তাঁকে বিবাহ দিলাম।”
(সূরা আল আহযাব: ৩৭)
৮. জুয়াইরিয়া বিনতে হারিস রাদিয়াল্লাহু আনহা
বংশ পরিচয়: বনু মুস্তালিক গোত্রের প্রধান হারিস ইবনে আবি দ্রার-এর কন্যা।
বিবাহের প্রেক্ষাপট: মুসলিমদের কাছে বন্দী হওয়ার পর মুক্তির প্রস্তাব দেন, রাসূল (সা.) দয়া করে বিবাহ করেন। এতে তাঁর গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে।
জুয়াইরিয়া বিনতে হারিস رضي الله عنها
✦ বংশ পরিচয়:
-
হারিস ইবনে আবি যারার কন্যা
-
গোত্র: বানু মুসতালিক – কিবলাহ যুদ্ধের পর বন্দি হন
✦ বিবাহের প্রেক্ষাপট:
-
যুদ্ধের পর বন্দি হলে তিনি মুক্তির বিনিময়ে চুক্তি করেন
-
রাসূল ﷺ তাঁকে মুক্ত করে নিজে বিবাহ করেন
📌 তাঁর বিবাহের ফলে গোটা গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে এবং শত শত বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়।
৯. উম্মু হাবীবা (রামলাহ বিনতে আবি সুফিয়ান) রাদিয়াল্লাহু আনহা
বংশ পরিচয়: আবু সুফিয়ান ইবনে হারব-এর কন্যা।
বিবাহের প্রেক্ষাপট: হাবশায় হিজরতকারী মুসলমানদের মধ্যে ছিলেন। স্বামী খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হলে রাসূল (সা.) তাঁকে দূত মারফত বিবাহ করেন।
বিশেষতা: বিবাহটি হাবশার বাদশাহ নাজাশীর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
উম্মু হাবীবা (রামলা বিনতে আবু সুফিয়ান) رضي الله عنها
✦ বংশ পরিচয়:
-
পিতা: আবু সুফিয়ান ইবনে হারব – ইসলামপূর্ব সময়ে কুরাইশের নেতা ছিলেন
-
গোত্র: বনু উমাইয়া
✦ বিবাহের প্রেক্ষাপট:
-
তিনি পূর্বে মুসলমান হয়ে হাবশায় হিজরত করেন স্বামীসহ
-
স্বামী খ্রিষ্টান হয়ে গেলে তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন
-
রাসূল ﷺ তাঁর দুর্দশা দেখে হাবশির বাদশাহ নাজ্জাশির মাধ্যমে দূর থেকেই বিবাহ করেন
📌 তিনি ছিলেন ধৈর্যশীলা ও সাহসী মুসলিম নারী, ইসলামের জন্য কষ্ট স্বীকারে দৃঢ়চিত্ত।
.১০। সফিয়্যাহ বিনতে হুয়াই রাঃ আনহা। – ١٠. صفية بنت حيي رضي الله عنها
✦ বংশ পরিচয়:
-
পুরো নাম: صفية بنت حيي بن أخطب
-
বংশ: ইহুদী গোত্র বনু নাযীর
-
পিতার নাম: حُييّ بن أخطب – বনু নাযীর গোত্রের নেতা ছিলেন
-
জন্ম: মদিনার নিকটবর্তী এলাকায়
-
প্রথমে ইহুদী ধর্মাবলম্বী ছিলেন, পরে ইসলাম গ্রহণ করেন
✦ বিবাহের প্রেক্ষাপট:
-
খাইবার যুদ্ধে (৭ হিজরিতে) মুসলিমদের বিজয়ের পর صفية رضي الله عنها বন্দি হন।
-
তিনি ছিলেন খাইবারের নেতা কানানা ইবন আবিল হুকাইকের স্ত্রী।
-
তাঁর স্বামী ও পিতা উভয়েই মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত হন।
রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর সৌন্দর্য, মর্যাদা ও ভদ্র আচরণ দেখে তাঁকে দাসীদের তালিকা থেকে বের করে আনেন এবং তাঁকে মুক্ত করে বিবাহ করেন।
📌 বিবাহের পর তাঁর মর্যাদা বাড়ানো হয় এবং তাঁকে “أُمُّ المؤمنين (মুমিনদের মা)” উপাধি দেওয়া হয়।
📚 হাদীস সূত্র:
عَنْ أَنَسٍ: “أَنَّ صَفِيَّةَ بِنْتَ حُيَيٍّ صَارَتْ إِلَى النَّبِيِّ ﷺ فَخَيَّرَهَا بَيْنَ الْعِتْقِ وَالتَّزْوِيجِ فَاخْتَارَتِ التَّزْوِيجَ”
– আনাস রা. বলেন: “নবী ﷺ সফিয়া রা.-কে মুক্ত করে তাকে বিবাহ অথবা অন্যত্র যাওয়ার বিকল্প দিলেন। তিনি বিবাহকেই বেছে নিলেন।”
(সহীহ বুখারী: ৩৭১)
১১। মাইমূনা বিনতে হারিস রাঃ আনহা – ١١. ميمونة بنت الحارث رضي الله عنها
✦ বংশ পরিচয়:
-
পুরো নাম: ميمونة بنت الحارث الهلالية
-
বংশ: হিলাল গোত্র (قبیلة بني هلال)
-
পিতার নাম: الحارث بن حزن الهلالي
-
পূর্ব নাম ছিল: برّة (বাররাহ) – পরে রাসূল ﷺ তাঁর নাম পরিবর্তন করে “ميمونة” রাখেন, যার অর্থ “বরকতময়ী”।
✦ বিবাহের প্রেক্ষাপট:
-
তিনি ছিলেন বিধবা। পূর্বের স্বামীর নাম ছিল أبو رُهم بن عبد العزى।
-
৭ হিজরিতে নবী ﷺ যখন উমরাহ কাযা (প্রতিশোধমূলক উমরাহ) করতে মক্কা যান, তখন তাঁর সঙ্গে মিমূনার বোন أم الفضل (আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিবের স্ত্রী) ছিলেন।
-
ميمونة رضي الله عنها রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নিজেকে হিবাহ (উপহার) করেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
রাসূল ﷺ তাঁর এই নিবেদনকে আন্তরিকতা ও ঈমানের নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তাঁকে বিবাহ করেন।
বিবাহের সময় রাসূল ﷺ হুদাইবিয়ার চুক্তির আলোকে মক্কা ত্যাগের আগের দিন তাঁকে বিবাহ করেন।
📌 ميمونة رضي الله عنها-কে বলা হয় নবী ﷺ-এর শেষ স্ত্রী, যাঁর সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
📚 হাদীস সূত্র:
عن ابن عباس رضي الله عنهما: “أن النبي ﷺ تزوج ميمونة وهو محرم”
– অর্থ: “নবী ﷺ মিমূনা রা.-কে তখন বিবাহ করেন, যখন তিনি ইহরামে ছিলেন।”
(সহীহ মুসলিম: ১৪১০)
※ তবে অধিকাংশ আলিম বলেন, বিবাহ ইহরাম খোলার পর সম্পন্ন হয়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জীবদ্দশায় একসাথে কতজন স্ত্রী ছিলেন?
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জীবদ্দশায় একসময় সর্বোচ্চ ৯ জন স্ত্রী একসাথে জীবিত ছিলেন এবং তিনি তাঁদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে রাত ভাগ করতেন।
📚 সহীহ হাদীস অনুযায়ী:
عن عائشة رضي الله عنها قالت:
“كان رسولُ اللهِ صلَّى اللهُ عليهِ وسلَّمَ يقسمُ بين نسائِه فيعدلُ، ثم يقولُ: اللهمَّ هذا قسمي فيما أملكُ، فلا تلُمني فيما تملكُ ولا أملكُ”
“রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর স্ত্রীদের মাঝে ন্যায়ভিত্তিকভাবে বিভাজন করতেন এবং বলতেন: হে আল্লাহ! যা আমার নিয়ন্ত্রণে আছে, তাতে আমি ইনসাফ করেছি। তবে যা তুমি নিয়ন্ত্রণ করো (অর্থাৎ হৃদয়), তাতে আমাকে দোষারোপ করো না।”
(سنن أبي داود، رقم: ٢١٣٤)
📋 রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর ১১ জন স্ত্রীদের সংক্ষিপ্ত বিবরণী
ক্রম | নাম رضي الله عنها | বংশ ও পরিচয় | বিবাহের প্রেক্ষাপট |
---|---|---|---|
১ | খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ | কুরাইশের অভিজাত নারী, ধনী ব্যবসায়ী | রাসূল ﷺ-এর চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে নিজে প্রস্তাব দেন; জীবদ্দশায় নবী ﷺ অন্য কাউকে বিবাহ করেননি |
২ | সৌদাহ বিনতে যাম’আ | কুরাইশের ‘আমের’ গোত্রের বিধবা নারী | খাদিজা রা.-এর ইন্তিকালের পর সন্তানদের দেখভালের জন্য বিবাহ |
৩ | আয়িশা বিনতে আবু বকর | আবু বকর রা.-এর কন্যা, কুরাইশের তায়ম গোত্র | আল্লাহর নির্দেশে বিবাহ; অল্প বয়সে বিবাহ, জ্ঞান ও হাদীসে পারদর্শী |
৪ | হাফসা বিনতে উমর | উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর কন্যা | স্বামী শহীদ হওয়ার পর বিধবা হন; তাকওয়ার কারণে বিবাহ |
৫ | যয়নব বিনতে খুযায়মা | আমির গোত্র; “উম্মুল মাসাকীন” নামে পরিচিত | বারবার বিধবা হন; রাসূল ﷺ দয়া ও স্নেহের কারণে বিবাহ করেন |
৬ | উম্মু সালামা (হিন্দ বিনতে আবি উমাইয়্যা) | কুরাইশের মাখযূম গোত্র, বিচক্ষণ ও ধৈর্যশীলা | স্বামী শহীদ হলে সন্তানসহ কষ্টে ছিলেন; রাসূল ﷺ তাঁকে সান্ত্বনা দেন ও বিবাহ করেন |
৭ | যয়নব বিনতে জাহশ | রাসূল ﷺ-এর চাচাতো বোন, কুরাইশের আসাদ গোত্র | জায়েদ রা.-এর সাথে বিবাহবিচ্ছেদ হলে আল্লাহর নির্দেশে রাসূল ﷺ বিবাহ করেন (সূরা আহযাব: ৩৭) |
৮ | জুয়াইরিয়া বিনতে হারিস | বানু মুসতালিক গোত্র; গোত্রপতির কন্যা | যুদ্ধবন্দি হন; রাসূল ﷺ মুক্ত করে বিবাহ করেন; গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে |
৯ | উম্মু হাবীবা (রামলা বিনতে আবু সুফিয়ান) | কুরাইশের বনু উমাইয়া গোত্র, আবু সুফিয়ানের কন্যা | হাবশায় হিজরত করেন; স্বামী ধর্মত্যাগ করলে রাসূল ﷺ দূর থেকে নাজ্জাশির মাধ্যমে বিবাহ করেন |
১০ | সফিয়্যাহ বিনতে হুয়াই | বনু নাযীর (ইহুদি গোত্র); হুয়াই ইবনে আখতব-এর কন্যা | খায়বার বিজয়ে বন্দি হন; নবী ﷺ মুক্ত করে নিজে বিবাহ করেন |
১১ | মাইমূনা বিনতে হারিস | হিলালী গোত্র; খুবই ধর্মপ্রাণ ও দানশীলা নারী | রাসূল ﷺ-এর শেষ স্ত্রী; হজের সময় বিবাহ করেন |
✦ রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দাসীগণ:
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কিছু দাসী ছিলেন, যাঁরা বন্দি হিসেবে অথবা উপহার স্বরূপ এসেছিলেন।
✅ উল্লেখযোগ্য দুইজন:
১. مارية القبطية رضي الله عنها
– মিশরের শাসক ‘মুকাওকিস’ তাঁকে নবী ﷺ-কে উপহার দেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাঁর গর্ভে নবী ﷺ-এর পুত্র ইব্রাহীম জন্মগ্রহণ করেন।
২. ريْحانة بنت زيد رضي الله عنها
– বনু কুরাইযাহ গোত্রের ইহুদি বন্দি ছিলেন। তিনি পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং নবী ﷺ তাঁকে ঘনিষ্ঠতা দেন।
✦ রাসূলুল্লাহ ﷺ কি দাসীদের সাথে সহবাস করতেন?
হ্যাঁ, এটি ইসলামে তখন বৈধ ছিল এবং কুরআন দ্বারা অনুমোদিত।
📖 আল্লাহ تعالى বলেন:
وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ إِلَّا عَلَىٰ أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ
“আর তারা নিজেদের লজ্জাস্থান হেফাজত করে, তবে নিজেদের স্ত্রী অথবা মালিকানাভুক্ত দাসীদের ব্যতীত, এসবের ক্ষেত্রে তারা নিন্দনীয় নয়।”
(سورة المؤمنون: ٥-٦)
সারসংক্ষেপ:
বিষয় | সংখ্যা | মন্তব্য |
---|---|---|
মোট সম্মানিত স্ত্রী | ১১ জন | খাদিজা রা. ইন্তিকালের পর একাধিক বিবাহ |
একসাথে জীবিত স্ত্রী | সর্বোচ্চ ৯ জন | হিজরতের পর সময়ে |
সম্মানিত দাসী | কমপক্ষে ২ জন | মারিয়া ক্বিবতিয়া ও রেহানা রা. |
দাসীর সাথে সহবাস | বৈধ | কুরআন দ্বারা অনুমোদিত |
উপসংহার:
এই সম্মানিত স্ত্রীগণের প্রতি আমাদের সর্বোচ্চ সম্মান ও ভালোবাসা থাকা উচিত। তাঁদের জীবন থেকে আমরা শুদ্ধতা, ত্যাগ, ধৈর্য, ইলম ও দাওয়াহর শিক্ষা নিতে পারি।
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বিবাহগুলো ছিল শুধুমাত্র পারিবারিক চাহিদা পূরণ নয়; বরং প্রত্যেকটি বিবাহই ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ, শিষ্টাচার প্রচার, গোত্রভিত্তিক শত্রুতা নিরসন এবং নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এক অসাধারণ কৌশল ছিল। তাঁর দাসীদের সঙ্গেও সহবাস বৈধ ছিল, যা সে যুগে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য এবং ধর্মীয়ভাবে অনুমোদিত ছিল।
🔗 এই লেখাটি আপনার ইসলামী সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হলে, শেয়ার করুন ও IslamiDawahCenter.com – এর সাথেই থাকুন।
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَىٰ مُحَمَّدٍ وَعَلَىٰ آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَعَلَىٰ آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ
(সহীহ আল-বুখারী, হাদীস: 3370)
✍️ লিখেছেন:মাহবুব ওসমানী
মাহবুব ওসমানী — একজন ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক এবং IslamiDawahCenter.com এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি কুরআন ও সহীহ হাদীসভিত্তিক বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
To learn more, comment below or message us on wa.me/+966549485900 or wa.me/+8801716988953 or call us at +44-73801-27019. Email at hi@islamidawahcenter.com
আইডিসির সাথে যোগ দিয়ে উভয় জাহানের জন্য ভালো কিছু করুন।
- আইডিসি এবং আইডিসি ফাউন্ডেশনের ব্যপারে বিস্তারিত জানতে লিংক০১ ও লিংক০২ ভিজিট করুন।
- আইডিসি মাদরাসার ব্যপারে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- আইডিসি এতীমখানা ও গোরাবা ফান্ডে দান করে দুনিয়া এবং আখিরাতে সফলতা অর্জন করুন।
- কুরআন হাদিসের আলোকে বিভিন্ন কঠিন রোগের চিকিৎসা করাতেআইডিসি ‘র সাথে যোগাযোগ করুন।
- ইসলামিক বিষয়ে জানতে এবং জানাতে এই গ্রুপে জয়েন করুন।