‘সুকুক’/Sukuk

শরীয়া নীতিমালার তোয়াক্কা না করেই ‘সুকুক’/Sukuk ছাড়া হয়েছে – মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ
[সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ৮ হাজার কোটি টাকার ‘সুকুক’/Sukuk ছাড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ৪ হাজার কোটি টাকা নিয়েও নেওয়া হয়েছে। ‘সুকুক’/Sukuk প্রোডাক্টটি যেহেতু এদেশে নতুন তাই পাঠকবর্গের রাহনুমায়ীর জন্য আলকাউসারের পক্ষ থেকে আমরা হাজির হয়েছি মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর রঈস, মাসিক আলকাউসারের সম্পাদক মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ-এর কাছে। তিনি এবিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সাক্ষাৎকারটি নিম্নে তুলে ধরা হল।]
আলকাউসার : ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক জনগণকে ‘সুকুক’/Sukuk বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ‘সুকুক’/Sukuk জিনিসটা আসলে কী?
মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ : সুকুক/Sukuk শব্দটি বহুবচন। এর এক বচন হল ‘ছক’। যদিও আরবীতে ব্যবহার হয়, কিন্তু এটি মূলত ফার্সি থেকে এসেছে। ফার্সিতে আগের সময়ে ‘ছক’ শব্দ ব্যবহৃত হত। এটা সাধারণত কোনো ডকুমেন্ট, দলীল, সার্টিফিকেট জাতীয় জিনিসের জন্য ব্যবহৃত হত। রাষ্ট্র থেকে গুণীজনদের কোনো ভাতা দেয়ার জন্য এ ধরনের ডকুমেন্ট দেয়া হত। সেটা দিয়ে সে নির্ধারিত সময় ভাতা বা রেশন উত্তোলন করতে পারত। অর্থাৎ ‘ছক’ ছিল এসব সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার গ্রহণ করবার একটা আইনি দলীল। পরবর্তীতে এটা আরবীতেও ব্যবহার হওয়া শুরু হয়েছে। এরপর বর্তমান সময়ে যেসব অর্থে ছক শব্দ ব্যবহৃত হয়, এসব অর্থে ব্যবহার শুরু হয়েছে আরও বহু বছর পরে এসে।
যাইহোক, সে তো শাব্দিক অর্থের কথা গেল। প্রচলিত অর্থে সুকুক/Sukuk হচ্ছে বর্তমান বিশ্বে সুদভিত্তিক বন্ডের বিকল্প। বন্ডের মাধ্যমে সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও জনগণ থেকে ঋণ নেয়। সেই ঋণ গ্রহণ করতে গিয়ে যে ডকুমেন্ট সরকার দেয় সেটাকে বিভিন্ন ইউনিট বা এককে ভাগ করা হয়। যেমন দশ হাজার টাকার ইউনিট। এক হাজার টাকার ইউনিট। একেকটা ইউনিট একেকটা বন্ড। এই বন্ডেরই সুদবিহীন বিকল্প চালু হয়েছে কয়েক দশক আগেই। সেটা হল বর্তমানের সুকুক। সে নামেই এখন সরকার সুকুক/Sukuk ছেড়েছে। এটা গত মাসে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এবং মানুষ থেকে টাকা নেয়াও শুরু হয়ে গিয়েছে।
প্রশ্ন : যেমন হুজুর বললেন, ইতিমধ্যে সরকার দেশে প্রথমবারের মতো সুকুক/Sukuk ছেড়েছে। গত ২৮ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে নিলামের মাধ্যমে প্রথম দফায় চার হাজার কোটি টাকার বন্ড ছাড়া হয়েছে। নিলামে প্রথম ধাপে এই চার হাজার কোটি টাকার সুকুকের/Sukuk জন্য আবেদন পড়েছে পনের হাজার কোটিরও বেশি টাকার। অর্থাৎ প্রায় চার গুণ বেশি আবেদন। এ সম্পর্কে কিছু বলুন!
উত্তর : বাহ্যিক দৃষ্টিতে এর জন্য সরকার অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কোটি কোটি মুসলমানের দেশে সুদী অর্থব্যবস্থার বিপরীতে ইসলামীকরণের যে কোনো চেষ্টাই মোবারকবাদ পাওয়ার হকদার। কিন্তু সেটা তখনই হতে পারে, যদি তা বাস্তবেও ইসলামী হয়। একথা কে না বোঝে যে, শুধু নাম দিলেই কোনো জিনিস ইসলামী হয় না। উদাহরণস্বরূপ মিউজিকসমৃদ্ধ কোনো গানের আসরকে ‘ইসলামী নাশীদ মাহফিল’ নাম দিয়ে দিলেই সেটা ইসলামী হয়ে যায় না। শরয়ী নিয়মে জবাই না করে প্যাকেটজাত মুরগি/গরুর গোস্তের গায়ে ‘হালাল’ সীল লাগিয়ে দিলেই তা হালাল হয়ে যায় না। তেমনিভাবে কোনো বিনিয়োগ বা কারবারের যাবতীয় টার্ম এন্ড কন্ডিশন তথা শর্তাবলি ও নীতিমালা সুস্পষ্টভাবে ইসলামী বিধিবিধানের মোতাবেক না করে তার নাম ‘ইসলামী’ দিতে পারেন না। দিলে সেটা ইসলামী হয়ে যাবে না।
সেই সূত্রে আমরা বলতে পারি, যে নীতিমালার উপর সরকার সুকুক/Sukuk ছেড়েছে এবং যে নীতিমালার উপর এটা চলবে, সেগুলো ইসলামী ধাঁচে এবং ইসলামী নিয়ম-নীতির আওতায় হলেই কেবল সেটাকে ‘ইসলামী’ ধরা হবে বা ‘ইসলামী’ বলে বিবেচিত হবে; না হয় শুধু একটি আরবী নাম হওয়ার কারণে তাকে ইসলামী মনে করার কোনো অবকাশ নেই।
প্রশ্ন : দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি সম্পূর্ণ সুদনির্ভর। ইসলামী বিধি-বিধানের প্রতি রাষ্ট্র বা সরকারের কোনো আগ্রহ নেই। তারপরও সুদের বিকল্প নাম দিয়ে এই ধরনের ইসলামী প্রোডাক্ট চালু করার ক্ষেত্রে সরকারের উদ্দেশ্য কী বলে মনে হয়?
উত্তর : তাঁদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, ধর্মপ্রাণ মুসলিম, যারা কোনোভাবেই সুদের সাথে জড়িত হতে আগ্রহী নন, বরং এর থেকে সর্বোতভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চান, সুদ জঘন্যতম হারাম হওয়ার বিষয়টি যারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, তাঁদের গচ্ছিত ও সঞ্চয়কৃত টাকাগুলোর প্রতিও সরকারের দৃষ্টি পড়েছে। আর সে কারণে সরকার তাদের টাকাও হাতে নিতে চাচ্ছে। এসব টাকা নিয়ে সরকার তার বিভিন্ন কাজ ও প্রকল্পে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। সুকুক/Sukuk চালু করার আগে সরকার যে গাইডলাইন ও প্রসপেক্টাস প্রকাশ করেছে সেখানের বক্তব্যগুলো থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে যে, দেশের যেসমস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও লোকেরা সুুদী বিনিয়োগে আগ্রহী নয়, তাদের জন্য এই বন্ড-পদ্ধতি চালু করা। এতেই বোঝা যায়, ধর্মপ্রাণ শ্রেণির টাকার প্রতি সরকারের নজর পড়েছে।
প্রশ্ন : তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম যে সুকুক/Sukuk-এটি একটি ইসলামী বন্ড।
উত্তর : এমনিতে ইসলামী বন্ড বললে কথাটি সঠিক বা শুদ্ধ হয় না। কারণ বন্ড হল ঋণ। আর ঋণের অতিরিক্ত লাভ, মুনাফা, যে নামেই যা কিছু নেয়া হোক, ইসলামের দৃষ্টিতে তা সুদ হিসেবেই বিবেচিত হয়। কাজেই ‘ইসলামী’ যদি প্রকৃত অর্থে হয় তাহলে সেটা আর বন্ড থাকবে না। কিন্তু আপনি এটা বলতে পারেন যে, বর্তমানে সুকুক/Sukuk নামে যে প্রোডাক্টটি চালু আছে, বিভিন্ন দেশে চালু করা হচ্ছে, এগুলো বন্ড-এর বিকল্প। বন্ড দ্বারা যেরকম সাধারণত সরকারি কর্তৃপক্ষ ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও আমজনতা থেকে অর্থ সংগ্রহ করে, ঠিক এরকমভাবে সুকুক/Sukuk এর মাধ্যমেও অর্থ সংগ্রহ করে। যদিও আধুনিক সুদনির্ভর অর্থব্যবস্থার বিকল্প পন্থা হিসেবে সুকুক-এর ব্যবহার চালু হয়েছে এবং একে একটা প্রোডাক্ট হিসেবে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে, কিন্তু এর সাথে ইসলামের শুরু যুগ ও মধ্যযুগের ‘সুকুক’/Sukuk-এর তেমন কোনো মিল নেই। একটা দিক থেকে কোনোরকম মিল আছে ধরতে পারেন। সেটা হল, দলীল-দস্তাবেজ, নথিপত্র ও ডকুমেন্ট। কারো কাছে আপনি পাওনা আছেন, সে পাওনার জন্য এটা ডকুমেন্ট। এই অর্থে তো ঠিক আছে। কিন্তু ওই অর্থে ঠিক নেই, যেই অর্থে এখন বোঝানো হচ্ছে। কারণ আগে কখনো এটাকে অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হত না। আগের সময় আপনি কাউকে ঋণ দিয়েছেন, বা কারো কাছে বিনিয়োগ করেছেন, তার জন্য কোনো ডকুমেন্ট দেয়া হলে সেটাকে ‘ছক’ বলা হত না; বরং উল্টোটা ছিল। আপনার কোনো পাওনা আছে কারো কাছে বা আপনাকে কোনো কিছু বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যেমন রাষ্ট্রীয় ভাতা, রেশন ইত্যাদি, যেটা আমরা আগেই বলে এসেছি, এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র আপনাকে যে ডকুমেন্ট দেবে তাকে বলা হবে ‘সুকুক’/Sukuk। এখন যেমন রেশন কার্ড, বয়স্ক ভাতা কার্ড থাকে। এই ধরনের ডকুমেন্ট তখন প্রদান করা হত। সেটাকে বলা হত ছক।
যাইহোক, বর্তমান সময়ে অর্থায়নের ক্ষেত্রে সুকুক/Sukuk এর যে ব্যবহার সেটা হল সাধারণত বিভিন্ন সরকার তাদের রাষ্ট্রের খরচাদি নির্বাহের জন্যে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বা জনসাধারণ থেকে বিভিন্নভাবে অর্থ নিয়ে থাকে। আমরা জানি, সরকার ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে আমাদের দেশেও অর্থ সংগ্রহ করে। বিভিন্ন ব্যাংক, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকেও নেয়। সাধারণ জনগণ থেকেও বিভিন্ন বন্ডের মাধ্যমে, সঞ্চয় স্কীমের মাধ্যমে, জাতীয় সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতিতে সরকার অর্থ সংগ্রহ করে। ঠিক এটাও অর্থ সংগ্রহ করার এমনি আরেকটা ব্যবস্থা। কিন্তু যেহেতু এটা একটি ইসলামী প্রোডাক্ট, ইসলামী প্রোডাক্ট মানে এটা কোনো শরয়ী নস-এর ইসলামী প্রোডাক্ট নয় যে, এটা ‘মানসূস আলাইহি’ বা কুরআন-হাদীসে এরকম একটা প্রোডাক্টের কথা বলা হয়েছে; বরং শরীয়তের নীতিমালার আলোকে আলেমগণ এবং ইসলামী বাণিজ্যনীতি সম্পর্কে দক্ষ বিভিন্ন দেশের ব্যক্তিবর্গ, তারা এই প্রোডাক্টের ধারণা দিয়েছেন এবং কয়েক দশক পূর্বে এটা প্রথম জর্ডানে চালু হয়েছে। এরপর আস্তে আস্তে বিভিন্ন দেশে এই সুকুক/Sukuk এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। যারা এই প্রোডাক্টের কথা বলেছেন, তারা এর বিভিন্ন শর্ত ও নীতিমালা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন।
প্রসঙ্গের টানে বলা যায় আধুনিক সুকুক অর্থ গ্রহণের একটা মাধ্যম। এই অর্থ গ্রহণটা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে হতে পারে। এজন্য বিভিন্ন মোডে সুকুক/Sukuk হয়ে থাকে। মুরাবাহা, ইস্তিসনা‘, ইজারা এরকম বিভিন্ন ভিত্তিতে সুকুক/Sukuk হয়ে থাকে। যেমন সরকার সুকুক/Sukuk এর মাধ্যমে জনগণ থেকে অর্থ গ্রহণ করল, এরপর এই অর্থ থেকে এক হাজার কোটি টাকা দিয়ে কিছু মেশিন কিনল। সুকুকধারী বা সুকুক/Sukuk-হোল্ডারদের টাকা দিয়ে মেশিনটা যে দামে কিনবে, তার থেকে তাদেরকে বেশি টাকা দেবে। যেমন দশ হাজার কোটি টাকায় কিনে সুকুক-হোল্ডারদের থেকে বারো হাজার কোটি টাকা দিয়ে তা কিনে নেয়, তাহলে এই দুই হাজার কোটি টাকা তাদের লাভ হল। এটা তাদেরকে কিস্তিতে বণ্টন করে দেবে। এক্ষেত্রে তখন আমরা এটাকে বলব মুরাবাহা-সুকুক/Sukuk।
এমনিভাবে হতে পারে استصناع (ইস্তিসনা‘-পণ্য তৈরি)-সুকুক। এক্ষেত্রে ধরুন, সরকারি কর্মচারিদের জন্য সরকারকে কোয়ার্টার বানাতে হবে বা সচিবালয় কোথাও স্থানান্তর করবে, সেখানে বড় বড় বিল্ডিং তৈরি করতে হবে, অথবা সরকারকে কোনো কারখানা থেকে বড় কোনা জাহাজ বানিয়ে নিতে হবে, কোথাও রাস্তা-ব্রিজ বানাতে হবে, এই ধরনের ক্ষেত্রে ইসতিসনা‘-সুকুক/Sukuk ও হতে পারে। ইসতিসনা‘-সুকুকের ক্ষেত্রে যেটা হবে, সেটা হল প্রকল্পগুলো সুকুক-হোল্ডারদের টাকায় তৈরি হবে। যত টাকায় এটা তৈরি হবে সে হিসাব লাগিয়ে তার চেয়ে বেশি টাকায় তা সরকারের সাথে বিক্রির চুক্তি হবে। আর এই অতিরিক্ত টাকাটা সুকুকধারী বা সুকুক/Sukuk-হোল্ডারগণ মুনাফা হিসেবে পাবে।
এছাড়াও আরও আছে। ইজারা (ভাড়া)-সুকুক/Sukuk ও হতে পারে। আমাদের দেশে বর্তমানে যে সুকুক/Sukuk চালু করা হয়েছে তাকে ইজারা (ভাড়া)-সুকুক/Sukuk ই বলা হচ্ছে। এর নিয়ম হল, বর্তমানে কোনো সম্পদ আছে, সেই সম্পদটা সুকুক/Sukuk-হোল্ডারদেরকে মালিকানায় দেয়া হল, তারপর এই সম্পদ সরকার তাদের থেকে ভাড়ায় ব্যবহার করল। সুুকুক/Sukuk-হোল্ডারগণ নিয়মিত এর ভাড়া পেতে থাকবে।
এরকম বিভিন্ন মোডে সুকুক/Sukuk হয়ে থাকে। এটাকে আপনি বলতে পারেন মোড অফ ফিনান্স তথা অর্থায়নের বিভিন্ন পদ্ধতি। বিভিন্ন পদ্ধতিতে সুকুক/Sukuk-এর ব্যবহার হতে পারে। যারা বন্ডের বিকল্প হিসেবে সুকুক/Sukuk এর আধুনিক পদ্ধতি পেশ করেছেন, তারা এরকম বিভিন্ন পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছেন।
প্রশ্ন : সরকার কর্তৃক সুকুক/Sukuk ইস্যু করার পর আমরা যেমনিভাবে দেখলাম, এর প্রতি সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক আগ্রহ। এতে তারা যথারীতি অংশগ্রহণ করেছে এবং যত টাকার সুকুক/Sukuk ছাড়া হয়েছে তারা এর চেয়ে অনেক বেশি টাকা জমা করেছে। তাছাড়া আমরা অনেক মানুষকে দেখলাম সরকারকে বিভিন্নভাবে সাধুবাদ জানাতে যে, এতে ইসলামপন্থী বা ধর্মপ্রাণ মানুষের বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে আমরা দেখছি যে, অনেক বিজ্ঞ আলেম সুকুক/Sukuk-এর ইসলামীকরণ নিয়ে বা এটি ইসলামী হওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তাঁরা আপত্তি তুলছেন।
উত্তর : হাঁ, আপত্তিজনক বিষয় তো অনেকগুলোই আছে।
প্রশ্ন : সে আপত্তিগুলোর কিছু যদি একটু বুঝিয়ে বলতেন?
উত্তর : আসলে সুকুক/Sukuk সম্পর্কে যদিও দু-এক বছর আগে থেকেই লেখালেখি বলাবলি হচ্ছিল। সরকারও চিন্তা-ভাবনা করছিল বলে পেপার-পত্রিকার মাধ্যমে জানা গিয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সম্পর্কে জানা যায় বিগত বছর ২০২০ সনের শেষের দিকে। অক্টোবর এবং ডিসেম্বর এই দুই মাসে আমরা প্রথমে দেখলাম যে, সরকার সুকুক/Sukuk-এর একটা গাইডলাইন প্রকাশ করল। কিন্তু বন্ডের বিকল্প হিসেবে আর্থিক বিনিয়োগের জন্য সরকার যে এই ধরনের ডকুমেন্ট চালু করছে, সেটার জন্য প্রয়োজন ছিল প্রসপেক্টাস, যে প্রসপেক্টাসে বিস্তারিত সবকিছুই থাকার কথা। সে প্রসপেক্টাসও কিছুদিন পরে এসে গেল। সেগুলো আমরা পড়ে দেখেছি। পড়াশোনা এবং পর্যালোচনার পর যেটা বুঝলাম সেটা হচ্ছে, সুকুকের প্রস্তাবকারী হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ বিভাগ, যারা সরকারকে অর্থ সংগ্রহ করে দেয়। তারা প্রস্তাব করেছেন যে, তারা জনগণ থেকে সুকুক/Sukuk-এর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করবে। আট হাজার কোটি টাকার বেশি তারা সংগ্রহ করবে। এরপর এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। যেটি আইনগতভাবে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, যদিও সরকারের নিয়ন্ত্রণেই চলে। তাদের দেয়া হয়েছে এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের দায়িত্ব। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের অর্থবিভাগের পক্ষে এই সুকুক/Sukuk চালু করেছে। তারা বলছে, এটা ইজারা সুকুক/Sukuk। অর্থাৎ, যারা সুকুক/Sukuk-এর মাধ্যমে অর্থ বিনিয়োগ করেছে, এর বিনিময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদেরকে সম্পদ দেবে। যেই সম্পদটা দেয়ার কথা, সেই সম্পদটাই সরকার ভাড়া নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। সম্পদটা কী, সেটাও সেখানে বলা আছে। কোন্ প্রকল্পে এটা বিনিয়োগ হবে, সেটাও বলা হয়েছে। তারা বলেছে, সমগ্র বাংলাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহের কাজে এই অর্থ ব্যয় হবে- ‘সেফ ওয়াটার সাপ্লাই টু দ্যা হোল কান্ট্রি’।
তাহলে আমরা বুঝলাম, সুকুক/Sukuk-হোল্ডারদের এই টাকাগুলো ব্যয়ের খাত হল ‘সেফ ওয়াটার সাপ্লাই’। বাকি এখানে শুধু ব্যয়ের খাত হলে হবে না, যেহেতু এটা ইজারা-সুকুক/Sukuk। সুতরাং সম্পদ আগে সুকুক/Sukuk-হোল্ডাদের হাতে আসবে, এরপর তাদের পক্ষ থেকে এই সম্পদটা ভাড়া দেয়া হবে। সেক্ষেত্রে বলা হয়েছে, অনারশিপ বা মালিকানা দেয়া হবে। কিসের মালিকানা বলা হয়েছে? এক্সেসটিং এ্যান্ড ফিউচার এ্যাসেট। অর্থাৎ বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সম্পদের মালিকানা দেয়া হবে সুকুক/Sukuk-হোল্ডারদেরকে। তারপর সরকার এর বিনিময়ে তাদেরকে প্রতি ছয় মাস অন্তর ভাড়া দেবে। সাড়ে চার পার্সেন্টেরও বেশি। সম্ভবত ৪.৬৯%। তাহলে এখানে ভাড়া নির্ধারণ হয়ে গেল ৪.৬৯% করে। সুকুক/Sukuk-হোল্ডারগণ তাদের বিনিয়োগের বিপরীতে ভাড়া পাবে। কিসের ভাড়া পাবে, তার উত্তরে বলা হচ্ছে, বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পদের। শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে এক্সেসটিং এন্ড ফিউচার এ্যাসেট।
সম্পদ আসলে কী?
আমরা দেখতে পেয়েছি যে, ওই প্রকল্পের মোট টাকাই হল আট হাজার আট শ কোটি টাকার কিছু বেশি। অর্থাৎ পুরো প্রকল্পের অল্প কিছু ছাড়া প্রায় সকল টাকাই সরকার সুকুক-হোল্ডারদের থেকে নেবে। তার মানে হল প্রকল্পের কাজ এখনও হয়নি। এ্যাসেট এখনও তৈরি হয়নি। আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে খবর নিতে চেষ্টা করেছি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চপদস্থ অফিসারদের থেকেও খবর নিয়েছি। জানতে চেয়েছি, আসলে কিছু তৈরি হয়েছে কি না? কেউ-ই কিছু বলতে পারেনি যে, আসলে এখানে তেমন কিছু তৈরি হয়েছে। তার মানে হল এ্যাসেট সবটাই এখনও ফিউচার। ভবিষ্যতে তৈরি হবে।
তাহলে আমরা দেখছি, এখানে সুকুক/Sukuk-হোল্ডারদের বলা হচ্ছে, তাদেরকে সম্পদের মালিকানা দেয়া হচ্ছে তাদের টাকা দিয়ে। কিন্তু সেই সম্পদ এখন পর্যন্ত নেই। হয়তো সম্পদ তৈরি হবে বা হবে না, সেটা সরকারই ভালো জানবে। যে কথার উপর সরকার টাকা নিয়েছে, বাস্তবে যদি সে খাতেই খাটায় তাহলে হয়তো সেখানে সম্পদ তৈরি হবে। কিন্তু বর্তমানে সেখানে সম্পদ নেই।
তাহলে এখানে কয়েকটা অসুবিধা একসাথে দাঁড়াল। প্রথমত ভবিষ্যত সম্পদ বিক্রি। ইসলামে ভবিষ্যত সম্পদ বিক্রির সুযোগ নেই। শরীয়তে এটা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। যদিও বলা হয়েছে, কিছু এক্সেসটিং এ্যাসেট আছে, কিছু ফিউচার এ্যাসেট। মানে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সমন্বয়ে সম্পদের মালিকানা দেয়া হবে এই সুুকুকের দ্বারা। কিন্তু আমরা আগেই বলেছি, এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সুকুক/Sukuk এর জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পদ আছে বলে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি।
আর সেখানে লেখাই আছে, ফিউচার এ্যাসেটের মালিকানা দেয়া হবে। অথচ ফিউচার এ্যাসেট বিক্রির কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। কাজেই এটা একেবারে স্পষ্টভাবে শরীয়ত-পরিপন্থী।
আর এক্সেসটিং সম্পদ বর্তমানে কী আছে? যদি সম্পদ থেকেও থাকে, তাহলে শরীয়তের মাসআলা হল, বিক্রেতা ক্রেতাকে কী সম্পদ দেবে-সেটার বিবরণ সুস্পষ্ট এবং সুনির্ধারিত থাকা জরুরি। ঠিক মূল্য যেমন সুনির্ধারিত থাকতে হয়, পণ্য ও তার পরিমাণ, তার গুণাবলী কী-সেগুলোও নির্ধারিত থাকতে হয়। যেহেতু এখানে সামনাসামনি থেকে পণ্য কেনা হচ্ছে না, বরং বিবরণ শুনে পণ্য কেনা হচ্ছে, সুতরাং বিবরণটা সুস্পষ্ট থাকতে হবে। বিবরণে কোনো ফাঁক-ফোকর থাকা যাবে না। পণ্যটা কোন্ মডেলের হবে, সেটা কী পরিমাণের হবে, ওয়ারেন্টি-গ্যারান্টি কী থাকবে, এভাবে বিস্তারিতভাবে যাবতীয় সবকিছু সেখানে উল্লেখ থাকতে হবে। অথচ সেগুলোর তেমন কিছুই প্রসপেক্টাসের মধ্যে উল্লেখ নেই এবং তা উল্লেখ করা ছাড়াই সুকুক/Sukuk বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তাহলে কী বিক্রি করা হল, সেটা স্পষ্ট করা হল না। যদি ধরেও নেয়া হয় যে, এক্সেসটিং এ্যাসেট-বর্তমানে কোনো সম্পদ আছে, কিন্তু সেটা কী ও কেমন, তারও কোনো সুস্পষ্ট বিবরণ দেয়া হল না। কাজেই এটা শরীয়ার সম্পূর্ণ খেলাফ।
এরপর আমরা দেখছি, এখানে কতগুলো জিনিসকে হযবরল করে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ শরীয়তের বিধানমতে একটা মৌলিক কারবারকে আরেকটা মৌলিক কারবারের সাথে জড়িয়ে ফেলার অবকাশ নেই। বরং প্রত্যেকটিকে পৃথক পৃথকভাবেই করতে হয়। একটার সাথে আরেকটাকে শর্তযুক্ত করার সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা আলোচিত সুকুক/Sukuk, যেটা বাংলাদেশে চালু হয়েছে, সেটাতে দেখলাম ভিন্ন কিছু। সেখানে দেখা যাচ্ছে, কয়েকটা বিষয়কে একসাথে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। একটা হচ্ছে, আমরা দেখলাম, একই গোষ্ঠী তথা সরকারের প্রতিনিধি বাংলাদেশ ব্যাংক তারা সুকুক/Sukuk চালু করল। তারাই আবার সুকুক/Sukuk-হোল্ডারদের কাছে সুকুক/Sukuk এর বিপরীতে যে সম্পদ-সেটা বিক্রি করছে! বিক্রি করে সেটাকে আবার নিজেরা ভাড়ায় নিয়ে নিচ্ছে। তাহলে এই বিক্রি করা এবং ভাড়ায় গ্রহণ করা-দুটো একই চুক্তিতে সম্পাদিত হল। দুটোই একই চুক্তিতে নিয়ে নেয়া হচ্ছে। অথচ দরকার ছিল প্রথমে সুকুক-হোল্ডারগণ এর মালিকানা পাবে। তারপর সেটি ভাড়া গ্রহণের কথা আসবে। ভিন্ন প্রসপেক্টাসে সেটা ভিন্নভাবে আলোচনায় আসতে পারত। কিন্তু এখানে এ দুটোকে মিলিয়ে দেয়া হয়েছে।
আরও কিছু বিষয়কে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে, যেমন যারা ভাড়া গ্রহীতা তাদেরকেই আবার সার্ভিসিং এজেন্ট করা হয়েছে! সার্ভিসিং এজেন্ট মানে হল, যেহেতু এগুলো ভাড়ার পণ্য, এগুলোর মধ্যে মাঝেমাঝে কোনো সমস্যা হতে পারে। মেরামত ও ঠিকঠাক করার প্রয়োজন হতে পারে। শরীয়তের দৃষ্টিতে যে ভাড়াদাতা, মেরামত ও ঠিকঠাক করার দায়িত্ব তার উপরই বর্তায়। স্বাভাবিকভাবে যদি কোনোকিছু নষ্ট হয়ে যায় তাহলে সেটা ঠিক করার দায়িত্ব ভাড়াদাতার। আর যদি ইচ্ছা করে নষ্ট করে ফেলা হয়, ভাড়া গ্রহীতার নিজ গাফলতির কারণে বা অন্য কোনোভাবে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে, তখন সেটার দায় ভাড়া গ্রহীতার উপর বর্তাবে। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, ঢালাওভাবে সবকিছুই ভাড়া গ্রহীতার উপর বর্তাচ্ছে! এবং তাকে এজেন্ট বানিয়ে দেয়া হচ্ছে এসব করার জন্য! এভাবে শর্তযুক্ত করে ভাড়া গ্রহীতাকে এজেন্ট বানিয়ে দেয়া-এটাও একটা কারবারকে আরেকটা কারবারের সাথে গুলিয়ে ফেলা, যা শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়।
আর এরও আগের কথা হল, শরীয়তের ইজারার মৌলিক একটি নীতি হল, যে জিনিস ভাড়া দেয়া হবে তা সম্পূর্ণ ব্যবহার উপযোগী হতে হবে। না হয় এর ভাড়া গ্রহণ করা যাবে না। অথচ সুকুক/Sukuk এর ক্ষেত্রে টাকা নগদ অবস্থায় রেখেই ভাড়ার নামে অতিরিক্ত দেয়া হচ্ছে।
এখানে আরেকটা বিষয়ও শরীয়ার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, যদি সুকুক/Sukuk টা গোড়া থেকে সঠিকভাবে হত; (কিন্তু এখন তো গোড়া থেকেই শুদ্ধ হচ্ছে না। যেহেতু বর্তমান-সম্পদ এখানে নেই। যদি অল্প-স্বল্প থেকেও থাকে, তারও বিবরণ নেই। ভবিষ্যত-সম্পদ বিক্রি হচ্ছে, সেটার সুযোগ ইসলামে নেই) যদি এই সমস্যাগুলি না থাকত এবং কারবারটি যথানিয়মে হত, তারপরও এখানে আরেকটা বিষয় আছে। সেটা হল, নিরাপত্তা বা নিশ্চয়তা প্রদান। অর্থাৎ যে সম্পদ সুকুক/Sukuk-হোল্ডারগণ কিনেছে, সেটা ভাড়াগ্রহীতারা আবার সুকুক/Sukuk-হোল্ডারদের থেকে মেয়াদান্তে কিনে নেবে। এখানে সম্ভবত আট বছরের মেয়াদ ঠিক করা হয়েছে। আট বছর পরে সরকার এই সুকুক/Sukukvগুলো সুকুক/Sukuk-হোল্ডারদের থেকে তার গায়ের দামে কিনে নেবে। এতদিন পর্যন্ত তারা বছরে দুই বার করে ভাড়া পেতে থাকবে। আর আট বছর পর সরকার এটাকে তার গায়ের দামে কিনে নেবে। এটাকে বলা হয়-আন্ডার টেকিং, ‘আন্ডার টেকিং টু দ্যা পার্সেজ’ অর্থাৎ মেয়াদান্তে কিনে নেয়ার নিশ্চয়তা প্রদান।
এখন সুস্পষ্ট কথা হল, এই যে আন্ডার টেকিং দেয়া হয়েছে, এটা কিন্তু সম্পূর্ণ শরীয়াহ-পরিপন্থী। কারণ আপনি যখন আপনার পণ্যের ভাড়া দিচ্ছেন, তার একটা ঝুঁকিও আপনার থাকতে হবে। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, আপনি নিরাপদে ভাড়া দিচ্ছেন, আপনার কোনো ঝুঁকি নেই, রীতিমতো ভাড়া পাবেন, আট বছর পর আবার আপনি এই সম্পদ যে মূল্যে কিনেছিলেন সেটা পেয়ে যাচ্ছেন।
কে না জানে, আট বছরে পণ্যের দামের মধ্যে পরিবর্তন আসতে পারে। কিছুটা কমবেশি হতে পারে। সাধারণত কমে যাওয়ার কথা। আগের দামে না থাকার কথা। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, এখন যে দামে কেনা হয়েছে, আট বছর পর সুকুক/Sukuk-হোল্ডারদের থেকে সরকার আবার সেই দামেই কিনে নেবে। শরীয়তের দৃষ্টিতে এরকম আন্ডার টেকিং দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে এখানে একসাথে আমরা শরীয়ার এতগুলো লঙ্ঘন দেখতে পেলাম।
এখানে যে কয়েকটি চুক্তি একসাথে করা হয়েছে সেটা আগেই আমরা বলেছি। সংক্ষেপে বললে প্রথমে সুকুক/Sukuk-হোল্ডারদেরকে সম্পদের মালিকানা দেয়া হবে। দ্বিতীয়ত অর্জিনিটর-অর্থাৎ যারা টাকা চায় তারা এটাকে ভাড়ায় গ্রহণ করছে, এরপর আবার তার সার্ভিসিং ও মেরামতের দায়িত্বও তারা নিচ্ছে। এরপর আবার বলা হচ্ছে, আট বছর পর ভাড়াটিয়া কর্তৃক এই সম্পদ বর্তমান দামেই ক্রয় করা হবে। এ সবগুলো চুক্তিকে একত্রে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। শরীয়ার দৃষ্টিতে যা অগ্রহণযোগ্য।
এছাড়া আরও সমস্যা আমরা দেখতে পাচ্ছি। সেটা হল, এখানে একটা কথা এটাও বলা হয়েছে যে, এটা পুনঃবিক্রয়যোগ্য। তার মানে, সেকেন্ডারি মার্কেটে এর বিক্রয়ের সুযোগ করে দেয়া হবে। অর্থাৎ আমরা দেখব হয়তো শেয়ারবাজারে এর বেচাকেনা হবে। এটা যদি হয় তাহলে সেখানে নতুন নতুন ঝামেলা আরও সৃষ্টি হবে। কারণ শেয়ারবাজারে একটা শেয়ার বা একটা ডকুমেন্ট যখন বিক্রি হয় সেখানে সাধারণত তার গায়ের দামে বেচা-কেনা হয় না। কমবেশি দামেই বিক্রি হয়ে থাকে। আর সুকুক/Sukuk এর পিছনে যে এ্যাসেট, সেই সম্পদটা কি নগদে আছে, নাকি ফিক্সড্ এ্যাসেট আকারে আছে-সেটা দেখার বিষয়। তো ফিক্সড্ এ্যাসেট আকারে থাকলে যদি কমপক্ষে এর ৫১% না থাকে তাহলে সেটা কমবেশি দামে বিক্রি করবার সুযোগ নেই; বরং গায়ের দামেই বিক্রি করতে হবে। অথচ এই বিষয়গুলোও এখানে ব্যাখ্যা করা হয়নি। ব্যাখ্যা না করেই বলে দেয়া হয়েছে, এটা পুনঃবিক্রয়যোগ্য। কীভাবে পুনঃবিক্রয়যোগ্য, তারও কোনো ব্যাখ্যা নেই। আসলে শরীয়াহ কোনোক্রমেই এ ধরনের কাজকারবার অনুমোদন করে না।
এভাবে লম্বা করতে গেলে অনেক বিষয়াদি আছে। আমরা দেখছি যদিও ‘সুকুক’/Sukuk নামের একটা ইসলামী প্রোডাক্টের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু কার্যত শরীয়াহ্ পরিপালন এখানে একেবারেই উপেক্ষিত। শরীয়াহ পরিপালনের বিষয়টি নিশ্চত করা হয়নি। নিশ্চিত না করেই শরীয়াহ নাম দিয়ে দেয়া হয়েছে এবং মৌলিকভাবেই এখানে বহু খুঁত ও অসংগতি রেখে দেয়া হয়েছে।
অনেকসময় দেখা যায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রসপেক্টাসে বা কাগজে-কলমে অনেকটা ভালো বিষয়াদি থাকে। যেমন ইসলামী ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে আমরা দেখি যে, তারা কাগজপত্র এখন অনেক ক্ষেত্রে মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছে। (যদিও সেখানেও এখনও অনেক ঝামেলা থেকে গেছে অনেক ব্যাংকের ক্ষেত্রে) কিন্তু আমলী ক্ষেত্রে অর্থাৎ ইসলামাইজেশনের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। কাগজে লেখা অনেককিছুই ঠিকমতো তারা করে না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের অফিসার ও লোকজনের গাফলতি থাকে। অনেকসময় তাদের মালিকপক্ষের অনিচ্ছা ও ক্লায়েন্টদের গাফলতি থাকে; ইসলামাইজেশন হয় না। কিন্তু আলোচিত সুকুক/Sukuk এর ব্যাপার কেবল এতটুকুই নয়, এরচে অনেক অনেক বাড়তি। কারণ এখানে প্রসপেক্টাস বা দলীল-দস্তাবেজ-যেটা প্রথমে দেয়া হয়েছে সেটাতেই আমরা দেখছি অনেক ঘাপলা এবং অনেক অসংগতি। যদিও নাম ‘ইসলামী’ ব্যবহার করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এর প্রয়োগ কীভাবে হবে-সে তো অনেক পরের প্রশ্ন। মাত্র ইস্যু হল, এতেই এত ঘাটতি। ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক! কারণ এ কাজটি করে কর্তৃপক্ষ ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশ্বাস এবং আস্থার সাথে কোনো ইনসাফ করেননি। সম্পূর্ণ না-ইনসাফি করেছেন বলে আমরা মনে করি।
প্রশ্ন : এখানে আমরা একটা জিনিস দেখতে পাচ্ছি, সেটা হল সুকুক/Sukuk এর ইস্যুকারী এবং ট্রাস্টি প্রায় একই গোষ্ঠীর। কারণ এর ইস্যুকারী বানানো হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনা বিভাগকে। আর ট্রাস্টির মধ্যেও অধিকাংশকে রাখা হয়েছে ঋণ ব্যবস্থাপনা বিভাগের বড় বড় অফিসারদেরকে। বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
উত্তর : এই ধরনের বিষয় যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ফিকহের একটা মূলনীতি আছে- ‘শাখছুন ওয়াহিদুন লা ইয়াতাওয়াল্লা তরফাইল আকদ’। এখানে একই লোকদেরকে ট্রাস্টি ও ইস্যুকারী বানিয়ে ফেলার কারণে অনেক সমস্যাও তৈরি হবে। ট্রাস্টির কাজ তো এর সার্বিক তত্ত্বাবধান ও দেখাশোনা করা। কিন্তু সে যদি হয় একপক্ষীয়, তাহলে সেখানে যে ঝামেলা তৈরি হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। দরকার ছিল, ট্রাস্টিতে বাইরের নিরপেক্ষ লোকদেরকে রাখা। সেখানে যোগ্য আলেমও থাকার দরকার ছিল। একই ব্যক্তি হওয়ার কারণে ঝামেলা তৈরি হবে এবং এটা যে শরীয়ারও বরখেলাফ, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রশ্ন : এ তো দেখছি ইসলাম ও শরীয়তের নামে জঘন্যতম…! কিন্তু আমরা তো শুনেছি তাদের শরীয়াহ কাউন্সিলও আছে। এজন্য শরীয়াহ এ্যাডভাইজরি বোর্ডও আছে।
উত্তর : হাঁ, লেখা তো ওভাবেই আছে যে, ওখানে একটা শরীয়াহ এ্যাডভাইজরি বোর্ড আছে। কিন্তু তারা কী কাজ করেছেন, শরীয়াহ এ্যাডভাইজরি বোর্ডকে আস্থায় নিয়ে এটা প্রকাশ হয়েছে কি না বা শরীয়াহ এ্যাডভাইজরি বোর্ডের ব্যক্তিবর্গ -তাঁদের প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান রেখেই আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে-তাঁরা আগে শরীয়ার সুকুক/Sukuk বিষয়গুলো স্টাডি করে নিয়েছেন কি না? এই সুকুক/Sukuk চালুর জন্য নিশ্চয়ই তারা পরামর্শ দিয়েছেন, যেহেতু তাদের নাম আছে। আমাদের মনে হচ্ছে যে, তাদেরকে জিজ্ঞেস করে বা দেখিয়েই হয়েছে বা ফর্মুলা তাদের থেকেই নেয়া হয়েছে। তো তারা হয়তো ‘মা‘আইর’ দেখে বা বিভিন্ন জায়গায় দেখে এটা নিয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হল যে, তাঁরা এটা আগে স্টাডি করেছেন কি না? তাঁদের ব্যক্তিত্ব ও তাঁদের প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান রেখেই এই কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, তাঁরা এ বিষয়ে ভালোভাবে পড়াশোনা করেছেন কি না? যে ইজারা-ভিত্তিক সুকুক/Sukuk তাঁরা চালু করেছেন, এখানে কী কী করণীয়, কী কী বর্জনীয়, কী কী বিষয় এখানে সুনিশ্চিত করতে হবে? কিন্তু সেটা আমরা পাইনি। এটা তো খুবই স্পষ্ট যে, এখানে কাগজে-কলমে এখন পর্যন্ত অনেকগুলো গ্যাপ ও কমতি থেকে গেছে, যেগুলো মূলেই জিনিসটাকে বৈধ হতে বাধা দেয়। পরবর্তীতে এটা কীভাবে চলবে, সেটা পরের কথা।
দ্বিতীয় হল যে, একটা জিনিস আমরা ব্যাপকভাবে লক্ষ করছি, বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে। সবগুলো ব্যাংক না হলেও অনেকগুলো ইসলামী ব্যাংকের ব্যাপারে বলতে পারি। আর ইসলামী ব্যাংক যেহেতু এখন দিন দিন বাড়ছে, নতুন নতুন করে ইসলামী ব্যাংক আরও হচ্ছে। ইতিমধ্যে আরো দুটো ব্যাংক নিজেদেরকে ইসলামী ঘোষণা করেছে।
যাহোক বিভিন্ন ব্যাংকেও আমরা এ প্রবণতা দেখেছি। আর এই সুকুক/Sukuk এর ক্ষেত্রেও দেখছি। যেটা দেখলাম এবং এটা কেবল আমি নয়, অন্যান্য আলেমরাও বলেছেন যে, এখানে যারা সরাসরি দ্বীনী লাইনে লেখা-পড়া করেছেন, মৌলিক পড়াশুনা যাদের দ্বীনী, এই ধরনের মাত্র দুইজন ব্যক্তি আছেন এই বোর্ডের মধ্যে। অর্থাৎ তাঁরা সংখ্যালঘু। আমরা এরকমভাবে কিন্তু অন্যান্য জায়গায়ও লক্ষ করেছি। বিভিন্ন ব্যাংকের শরীয়াহ কাউন্সিলও এখন দেখা যাচ্ছে যে, সেখানে একে তো সরাসরি দ্বীনী লেখাপড়া করনেওয়ালা লোক অনেক ক্ষেত্রে নেওয়া হচ্ছে না। নিলে এক-আধজন নেওয়া হচ্ছে। অথচ কোনোকিছু ইসলামী হতে হলে সে বিষয়ে বিজ্ঞ ও দক্ষ লোকের নেগরানী থাকা তো অপরিহার্য।
প্রয়োজন হল ফিকহুল মুআমালাত এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সাধারণ বিষয়গুলো জানাশোনা থাকা। এই ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শরীয়াহ কাউন্সিলে থাকার জন্যে দুটো বিষয়ের যোগ্যতাই তো আবশ্যকীয়। আর এই প্রশ্নগুলো কিন্তু জনগণ বারবারই আমাদেরকে এসে করে থাকে। অন্যান্য দারুল ইফতাগুলোতে গিয়ে জিজ্ঞেস করে যে, তারা যাদেরকে রাখছেন উনারা কতটুকুন কী?
আমরা বিপদে পড়ি, কারণ ব্যক্তি নিয়ে কথা বলা উচিত না, কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো যাদেরকে বাছাই করে, সেখানে দেখার বিষয় থাকে। আর একটা বিষয় বলব, অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শরীয়া বোর্ডের ধর্মীয় বিষয়ে পড়ুয়াগণ এখন সংখ্যালঘু। আপনি বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংকের শরীয়াহ কাউন্সিলের তালিকা খুললেই দেখতে পাবেন যে, সেখানে ব্যাংকের বিভিন্ন অফিসারদেরকে দিয়ে তারা নিজেদের কোরাম বানিয়ে ফেলেন। অর্থাৎ ব্যাংকের এমডি সাহেব, ব্যাংকের একজন হয়তো দাড়িওয়ালা বড় অফিসার আছেন। হয়তো কোনো না কোনোভাবে তাঁর ধর্মীয় একটা পরিচয় আছে। এরকম কয়েকজন ব্যক্তি রাখা হয়। মানে শরীয়াহ কাউন্সিলে ব্যাংকের নিজস্ব লোকজন বেশি রেখে তাদের দল ভারী করে ফেলা হচ্ছে! অর্থাৎ কারো কারো ক্ষেত্রে এটা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, কোনো ক্ষেত্রে যদি শরীয়াহ বোর্ডে থাকা লোকেরা ভিন্ন কোনো কথা বলেন, ভিন্ন কোনো মত দেন, তাহলে দেখা যাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তারা তা রদ করে দেবে।
বিভিন্ন ব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে তাদের শরীয়াহ কাউন্সিলের তালিকা দেখলে অনেকের নজরে বিষয়গুলো আসবে। কেন এটা করা হচ্ছে? এতে কী উদ্দেশ্য, সেটা তো আসলেই লম্বা করে ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই।
আর সাথে এটাও দেখার বিষয় যে, মূলধারার আলেমগণ; মৌলিকভাবে দেশের মানুষ যাদেরকে ইসলামী বিষয়াদির মূলচর্চাকারী হিসেবে জানেন, তাঁদের খুব সামান্যসংখ্যক লোকই ইসলামী ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শরীয়াহ কাউন্সিলে যোগ দিয়েছেন। কেন তাদের অনাস্থা? এছাড়া যারা আছেন তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন কি না?

আইডিসির সাথে যোগ দিয়ে উভয় জাহানের জন্য ভালো কিছু করুন!

 

আইডিসি এবং আইডিসি ফাউন্ডেশনের ব্যপারে  জানতে  লিংক০১ ও লিংক০২ ভিজিট করুন।

আইডিসি  মাদরাসার ব্যপারে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। 

আপনি আইডিসি  মাদরাসার একজন স্থায়ী সদস্য /পার্টনার হতে চাইলে এই লিংক দেখুন.

আইডিসি এতীমখানা ও গোরাবা ফান্ডে দান করে  দুনিয়া এবং আখিরাতে সফলতা অর্জন করুন।

কুরআন হাদিসের আলোকে বিভিন্ন কঠিন রোগের চিকিৎসা করাতেআইডিসি ‘র সাথে যোগাযোগ করুন।

ইসলামিক বিষয়ে জানতে এবং জানাতে এই গ্রুপে জয়েন করুন।

 

Islami Dawah Center Cover photo

 

ইসলামী দাওয়াহ সেন্টারকে সচল রাখতে সাহায্য করুন!

 

ইসলামী দাওয়াহ সেন্টার ১টি অলাভজনক দাওয়াহ প্রতিষ্ঠান, এই প্রতিষ্ঠানের ইসলামিক ব্লগটি বর্তমানে ২০,০০০+ মানুষ প্রতিমাসে পড়ে, দিন দিন আরো অনেক বেশি বেড়ে যাবে, ইংশাআল্লাহ।

বর্তমানে মাদরাসা এবং ব্লগ প্রজেক্টের বিভিন্ন খাতে (ওয়েবসাইট হোস্টিং, CDN,কনটেন্ট রাইটিং, প্রুফ রিডিং, ব্লগ পোস্টিং, ডিজাইন এবং মার্কেটিং) মাসে গড়ে ৫০,০০০+ টাকা খরচ হয়, যা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। সেকারনে, এই বিশাল ধর্মীয় কাজকে সামনে এগিয়ে নিতে সর্বপ্রথম আল্লাহর কাছে আপনাদের দোয়া এবং আপনাদের সহযোগিতা প্রয়োজন, এমন কিছু ভাই ও বোন ( ৩১৩ জন ) দরকার, যারা আইডিসিকে নির্দিষ্ট অংকের সাহায্য করবেন, তাহলে এই পথ চলা অনেক সহজ হয়ে যাবে, ইংশাআল্লাহ।

যারা এককালিন, মাসিক অথবা বাৎসরিক সাহায্য করবেন, তারা আইডিসির মুল টিমের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন, ইংশাআল্লাহ।

আইডিসির ঠিকানাঃ খঃ ৬৫/৫, শাহজাদপুর, গুলশান, ঢাকা -১২১২, মোবাইলঃ +88 01609 820 094, +88 01716 988 953 ( নগদ/বিকাশ পার্সোনাল )

ইমেলঃ info@islamidawahcenter.com, info@idcmadrasah.com, ওয়েব: www.islamidawahcenter.com, www.idcmadrasah.com সার্বিক তত্ত্বাবধানেঃ হাঃ মুফতি মাহবুব ওসমানী ( এম. এ. ইন ইংলিশ )