Smoking-বিড়ি-সিগারেট পান করা ও বিক্রি করা কি কেবলই ‘মাকরূহ’ বা অনুত্তম?

——————————————————————–

বর্তমান বিশ্বে বিড়ি-সিগারেটের ব্যাপক ব্যবহার চলছে। কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, প্রৌঢ়-বৃদ্ধ এবং শিক্ষিত, অশিক্ষিত, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, পেশাজীবী, চাকুরীজীবী, শ্রমজীবী তথা সব বয়স ও শ্রেণী-পেশার লোকেরা এতে লিপ্ত। অনেক ধর্মপ্রাণ লোকও রীতিমতো ধূমপানে অভ্যস্ত। তাদের মাথায় টুপি আছে, গালে দাড়ি আছে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযও পড়েন নিয়মিত; কিন্তু নামায শেষে আবার ধূমপানও করেন। তাদেরকে যখন ধূমপান থেকে বিরত থাকতে বলা হয় তখন তারা অনেক সময় তা মানতে চান না। ধর্মপ্রাণ লোকদেরই যদি এ অবস্থা হয় তাহলে অন্যদের অবস্থা কী- তা সহজেই অনুমেয়।

অনেক বছর আগে যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ততোটা উন্নত হয়নি তখন অনেক ইসলামী বিশেষজ্ঞ বলতেন যে, ধূমপান করা ‘মাকরূহ’ বা অপছন্দনীয়। হাদীস থেকে যেহেতু দুর্গন্ধের কারণে কাঁচা পেঁয়াজ বা কাঁচা রসুন খাওয়া মাকরূহ জানা যায় তাই তার উপর ভিত্তি করে ঐ সকল বিশেষজ্ঞরা উক্ত ফতোয়া দিতেন। বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বহু বিশেষজ্ঞ ধূমপানকে কেবল ‘মাকরূহ’ বলে থাকেন।

এখন বিজ্ঞান অনেক উন্নত হয়েছে। জানা গেছে, ধূমপানের মারাত্মক ক্ষতিকর দিকসমূহ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, ধূমপান মূলত এক ধরনের ধীরগতির বিষ। ধূমপান যেভাবেই করা হোক তাতে এ বিষক্রিয়া রয়ে যায়। আর এ কারণে বর্তমানে আরবের আলেমগণসহ পৃথিবীর বেশির ভাগ ইসলামী বিশেষজ্ঞ বলেন, ধূমপান করা নাজায়েয। শুধু মুসলিম বিশেষজ্ঞই নয় অমুসলিমরাও ধূমপানের বিষক্রিয়ার ব্যাপারটি অকপটে স্বীকার করেন। সিগারেটের প্যাকেটেও এ ব্যাপারে সতর্কীকরণ উল্লেখ করা থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর পৃথিবীতে ৪০ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায় শুধু ধূমপানের কারণে।

যেসব কারণে বর্তমান উলামায়ে কেরাম ধূমপানকে নাজায়েয বলে ফতোয়া দেন তন্মধ্যে নিম্নে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হলো।

১. ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর :

ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এব্যাপারে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের সবাই একমত। তাদের মতে ধূমপানের ফলে মানুষ ফুসফুসের ক্যানসার, হৃদ্‌রোগ, ব্রঙ্কাইটিস, যক্ষ্মা, ডায়াবেটিস, হাঁপানিসহ নানা প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। আর ইসলামের দৃষ্টিতে যে কোনো ধরনের ক্ষতিকর বস্তু সেবন করা নাজায়েয। কেননা মানুষের নিজের শরীরটাও তার নিজের নয়; বরং তা আল্লাহ প্রদত্ত আমানত। এ আমানতের ক্ষতি সাধন করা এক ধরনের খিয়ানাত, যার অধিকার তার নেই।
কুরআন মজিদে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন,

يَأْمُرُهُم بِٱلْمَعْرُوفِ وَيَنْهَىٰهُمْ عَنِ ٱلْمُنكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ ٱلطَّيِّبَٰتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ ٱلْخَبَٰٓئِثَ

‘তিনি (নবী) তাদেরকে নির্দেশ দেন সৎকর্মের, বারণ করেন অসৎকর্ম থেকে। তাদের জন্য উৎকৃষ্ট বস্তু হালাল করেন এবং নিকৃষ্ট বস্তু হারাম করেন।’
[সূরা আল আরাফ : ১৫৭]

বিড়ি-সিগারেট কোনো ভালো ও পবিত্র বস্তু নয়। এটা খারাপ, দুর্গন্ধময় ও নোংরা বস্তু। আর উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা খারাপ বস্তুকে হারাম করেছেন। উক্ত আয়াত থেকে ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞগণ শরীয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি প্রণয়ন করেছেন যে, যেসব বস্তু স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তা ভক্ষণ করা নাজায়েয। আর তামাক ও বিড়ি-সিগারেট সাধারণভাবে একটি ক্ষতিকর দ্রব্য। এর কোনো উপকার বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়। সুতরাং ধূমপান অবৈধ ও নিষিদ্ধ হওয়ার কথা কুরআন-হাদীসে সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও উক্ত মূলনীতির আলোকে তা অবৈধ ও নিষিদ্ধ হবে।

 

২. ধূমপানে উপকারের তুলনায় ক্ষতিই রয়েছে বেশি :

অনেকে ধূমপানের মধ্যে বিভিন্ন উপকারিতার কথা তুলে ধরে থাকেন। যেমন, ধূমপান করলে মেজাজ ঠাণ্ডা ও ভালো থাকে, ক্লান্তি ও অবসাদ দূর হয়, শক্তি সঞ্চারিত হয়, মুখ ও গলা সতেজ থাকে, কাশি ও অনিদ্রা উপশম হয়, মাথা ঘোরা বন্ধ হয়, অস্থিরভাব কাটে, মল ত্যাগের কষ্ট দূর হয় ইত্যাদি। তাদের আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত কথাটি মনে রাখা উচিত। আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ ۖ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِن نَّفْعِهِمَا

‘তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দিন, উভয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ। আর তার মধ্যে মানুষের জন্য উপকারিতাও আছে। তবে এগুলোর পাপ উপকারের চেয়ে বড়।’
[সূরা বাক্বারাহ :২১৯]

মদ-জুয়ার বেলায়ও মানুষ ঠিক এধরনের উপকারিতার কথা উল্লেখ করে থাকে। তা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা তা হারাম করেছেন। এ হিসেবে ধূমপানও অবৈধ ও নিষিদ্ধ হবে। কারণ এসব উপকার আল্লাহ তাআলার কাছে স্বীকৃত নয়। আর উপরোক্ত উপকারসমূহ মূলত অভ্যাসের দরুন হয়ে থাকে। অভ্যাস পরিবর্তন করলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

 

৩. ধূমপান নিজেকে হত্যার শামিল :

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَا تَقْتُلُوا أَنفُسَكُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا

‘তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অতি দয়ালু।’
[সূরা আন নিসা : ২৯]

CDC (Center for Disease Control) এর হিসাবে অনুযায়ী প্রতি বছর বার্ধক্যজনিত কারণ, দুর্ঘটনা ও HIV তে যতো মানুষ মারা যায় তার মোট সংখ্যার চেয়ে শুধুমাত্র ধূমপানজনিত কারণে বেশি মানুষ মারা যায়। সিগারেটের প্যাকেটেও বিভিন্ন সতর্কীকরণ উল্লেখ করা থাকে। যেমন: ‘ধূমপানে বিষপান’ বা ‘ধূমপান মৃত্যু ঘটায়’ কিংবা ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ অথবা ‘ধূমপান ক্যান্সারের কারণ’ প্রভৃতি। সঙ্গে সঙ্গে না হলেও সময়ের ব্যবধানে ধূমপান মৃত্যুর জন্য দায়ী। সিগারেটের আগুন যেমন নিজেকে জ্বালিয়ে দেয় তেমনি তা ধূমপায়ীকেও ধীরে ধীরে জ্বালিয়ে শেষ করে দেয়। বর্তমানে ধূমপানজনিত রোগে বিশ্বে প্রতি বছর ৪০ লাখ লোক মারা যাচ্ছে। আর তামাক বিষয়ে বৈশ্বিক প্রকাশনা ‘দ্য টোব্যাকো অ্যাটলাস ২০১৮’–এর তথ্য অনুযায়ী, তামাকের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ৬২ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করছে।

 

৪. ধূমপান করা নিজেকে ধ্বংস করার শামিল :

সাধারণত কেউ জোর করে কাউকে ধূমপান করায় না; বরং ব্যক্তি নিজেই স্বেচ্ছায় তা গ্রহণ করে। আর এতে সে নিজেকেই নিজে ধ্বংস করে। অথচ আল্লাহ নিজেদেরকে ধ্বংস করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ

‘এবং তোমরা নিজ হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসে পতিত করো না।’
[সূরা বাক্বারাহ : ১৯৫]

ধূমপান বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগের কারণ। এগুলো মানুষকে একেবারে ধ্বংস করেই ছাড়ে। তাই সহজেই বুঝা যায়, ধূমপান করা মানে আল্লাহর আদেশ লংঘন করা ও নাজায়েয কাজ করা। সুতরাং ধূমপান কোনো অবস্থায় জায়েয হতে পারে না।

 

৫. ধূমপান মানে বিষাক্ত জিনিস সেবন:

হাদীস শরীফে আছে, হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

ﻭﻣﻦ ﺷﺮﺏ ﺳﻤﺎ ﻓﻘﺘﻞ ﻧﻔﺴﻪ ﻓﻬﻮ ﻳﺘﺤﺴﺎﻩ ﻓﻲ ﻧﺎﺭ ﺟﻬﻨﻢ ﺧﺎﻟﺪا ﻣﺨﻠﺪا ﻓﻴﻬﺎ ﺃﺑﺪا

‘যে ব্যক্তি বিষ পানে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামের আগুনের মধ্যে অনন্তকাল তাই চাটতে থাকবে। সেখানে সে চিরকাল অবস্থান করবে।’
[সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১০৯]

ধূমপান যে বিষপান এটা সবাই একবাক্যে স্বীকার করে। শুধু তাই নয়, খোদ সিগারেটের প্যাকেটেও তা লেখা থাকে। আত্মহত্যা স্বল্প সময়েও করা যায় আবার দীর্ঘমেয়াদীভাবেও করা যায়। ধূমপানের দ্বারা দীর্ঘমেয়াদে মৃত্যুবরণ করাও সরাসরি আত্মহত্যার পর্যায়ভুক্ত। আর আত্মহত্যা করা হারাম। তাই ধূমপান বা অন্য যে কোনো কাজ যা মৃত্যু ঘটায় বা মৃত্যুর ঝুঁকি সৃষ্টি করে তা অবশ্যই অবৈধ ও নিষিদ্ধ হবে।

 

৬. ধূমপানের মধ্যে রয়েছে জাহান্নামী খাদ্যের বৈশিষ্ট্য :

আল্লাহ তাআলা জাহান্নামীদের খাদ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন,

لَّا يُسْمِنُ وَلَا يُغْنِي مِن جُوعٍ

‘এটা তাদের পুষ্টিও যোগাবে না এবং ক্ষুধাও মিটাবে না।’
[সূরা আল গাশিয়াহ : ৭]

ধূমপানের মধ্যে এ বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি বিদ্যমান। কেননা তা ধূমপায়ীর পুষ্টিও যোগায় না, ক্ষুধাও নিবারণ করে না। কাজেই ধূমপানের তুলনা কেবল জাহান্নামের খাবারের সাথেই করা যায়।

 

৭. ধূমপান অন্যের কষ্টের কারণ হয় :

বিড়ি-সিগারেটের বাজে গন্ধ অনেকের সহ্য হয় না। তাদের এতে ভীষণ কষ্ট হয়। নি:শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তদ্রূপ ফেরেশতাদেরও এতে কষ্ট হয় এবং তা তাদেরকে ব্যক্তি থেকে অনেক দূরে ঠেলে দেয়। আর অপরকে কষ্ট দেয়া সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوا فَقَدِ احْتَمَلُوا بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُّبِينًا

‘যারা মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীকে বিনা অপরাধে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’
[সূরা আল আহযাব : ৫৮]

হাদীস শরীফে আছে, হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পিঁয়াজ ও মুলা খেতে নিষেধ করে দিয়েছেন। অতঃপর একবার নিরূপায় হয়ে আমরা তা খেয়ে ফেললাম। তখন তিনি বললেন,

ﻣﻦ ﺃﻛﻞ ﻣﻦ ﻫﺬﻩ اﻟﺸﺠﺮﺓ اﻟﻤﻨﺘﻨﺔ، ﻓﻼ ﻳﻘﺮﺑﻦ ﻣﺴﺠﺪﻧﺎ، ﻓﺈﻥ اﻟﻤﻼﺋﻜﺔ ﺗﺄﺫﻯ، ﻣﻤﺎ ﻳﺘﺄﺫﻯ ﻣﻨﻪ اﻹﻧﺲ

‘যে ব্যক্তি এই দুর্গন্ধময় উদ্ভিদ আহার করবে, সে যেন আমাদের মসজিদের নিকটে না আসে। কেননা মানুষ যাতে কষ্ট অনুভব করে, ফেরেশতাগণও তাতে কষ্ট পান।’
[সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৫৬৩]

অন্য বর্ণনায় আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

ﻣﻦ ﺃﻛﻞ ﺛﻮﻣﺎ ﺃﻭ ﺑﺼﻼ، ﻓﻠﻴﻌﺘﺰﻟﻨﺎ – ﺃﻭ ﻗﺎﻝ: ﻓﻠﻴﻌﺘﺰﻝ ﻣﺴﺠﺪﻧﺎ – ﻭﻟﻴﻘﻌﺪ ﻓﻲ ﺑﻴﺘﻪ

‘যে ব্যক্তি রসুন বা পিঁয়াজ খাবে, সে যেন আমাদের নিকট হতে অথবা বলেছেন, আমাদের মসজিদ হতে দূরে থাকে এবং নিজ ঘরে বসে থাকে।
[সহীহ বুখারী, হাদীস : ৮৫৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৫৬৪]

কাঁচা পেয়াঁজ ও রসুনের ব্যবহার বৈধ হওয়া সত্ত্বেও এতে যেহেতু মুখে দুর্গন্ধ হয়ে থাকে এবং তা অন্য মানুষের কষ্টের কারণ হতে পারে তাই উক্ত হাদীসে এসবের গন্ধ নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। এ হাদীস থেকে ফকীহগণ বলেন, পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ নিয়ে শুধু মসজিদ নয়; বরং যে কোনো মজলিস ও জনসমাগমে যাওয়াও নিষেধ। আর ধূমপানের দুর্গন্ধ কাঁচা পেঁয়াজ-রসুনের চেয়ে বহুগুণ প্রকট, নিকৃষ্ট ও কষ্টদায়ক। অতএব ধূমপানের বিধান কাঁচা পেঁয়াজ ও রসুনের চেয়ে অধিকতর ‘মাকরূহ’ তথা মাকরূহ তাহরীমী বা নাজায়েয হবে।

 

৮. ধূমপান অন্যের ক্ষতি সাধন করে :

যাদের হাঁপানী বা অ্যাজমা আছে বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়া তাদের অনেক ক্ষতি করে। মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) তথ্যমতে, প্রতিবছর পুরুষদের ধূমপানে পরোক্ষভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে অধূমপায়ী এক কোটি নারী। আর ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যের ক্ষতি করা নিষেধ। হাদীস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

ﻻ ﺿﺮﺭ ﻭﻻ ﺿﺮاﺭ.
حديث حسن

‘নিজের ক্ষতি সাধন করা যাবে না এবং অন্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না।’
[মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ২৮৬৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৩৪১; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস : ২৩৪৫; সুনানে বায়হাকী, হাদীস : ১১৩৮৪]

CDC এর হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর গড়ে ৪৯৪০০ অধূমপায়ী মারা যায় ধূমপায়ীদের ধোয়ায় আক্রান্ত হয়ে। নিরপরাধ এই মানুষগুলোর মৃত্যুর কারণ সৃষ্টি করে ধূমপায়ীরা। আর বিনা দোষে কারো কোনো ক্ষতি করা বা তার মৃত্যুর কারণ হওয়া সম্পূর্ণ নাজায়েয। তাই বলা যায়, অপরকে কষ্ট দেওয়া বা তার মৃত্যুর কারণ হওয়া যেহেতু নাজায়েয তাই ধূমপান করাও নাজায়েয।

 

৯. ধূমপানে প্রতিবেশীর ক্ষতি হয় :

চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণায় এ কথা প্রমাণিত যে, ধূমপানকারীর ন্যায় ধূমপানকারীর প্রতিবেশীও স্বাস্থ্যগতভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর প্রতিবেশী ও আশপাশের লোকদের ক্ষতি করা ও কষ্ট দেওয়া নাজায়েয। হাদীস শরীফে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

ﻣﻦ ﻛﺎﻥ ﻳﺆﻣﻦ ﺑﺎﻟﻠﻪ ﻭاﻟﻴﻮﻡ اﻵﺧﺮ ﻓﻼ ﻳﺆﺫ ﺟﺎﺭﻩ

‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে সে যেনো তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।’
[সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬০১৮]

ধূমপানকারী তার ধূমপানের দ্বারা স্ত্রী-পরিজন, সহযাত্রী, বন্ধু-বান্ধব ও আশে-পাশের লোকজনকে কষ্ট দিয়ে থাকে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানা গেছে, ধূমপায়ীদের স্ত্রীদের ফুসফুসে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভবনা বেশি। তা ছাড়া কোনো অধূমপায়ী ব্যক্তি যদি ধূমপায়ী ব্যক্তির কাছে অবস্থান করে, তাহলে এমনিতেই এক সপ্তমাংশ সিগারেটের নিকোটিন অধূমপায়ীর শরীরে প্রবেশ করে। এ কারণে পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন অধূমপায়ীদেরকে ধূমপানের ধোয়া থেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট। এজন্যই তাদের অন্যতম একটি শ্লোগান হলো: ‘আমাদেরকে নিরাপদ নি:শ্বাস নেওয়ার সুযোগ দাও।’ সিগারেটের গন্ধ যে কতোটা অসহ্য তা শুধু অধূমপায়ীরাই বুঝে। রাস্তাঘাটে অনেকে ধূমপায়ীর মুখের দুর্গন্ধ নীরবে সহ্য করেন এবং মনে মনে ধূমপানকারীকে অভিশাপ দেন।

 

১০. ধূমপানে সম্পদ নষ্ট হয় :

বিনা কারণে সম্পদ নষ্ট করা নাজায়েয। হাদীস শরীফে আছে, হযরত মুগীরা ইবনে শু‘বা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

ﺇﻥ اﻟﻠﻪ ﻛﺮﻩ ﻟﻜﻢ ﺛﻼﺛﺎ: ﻗﻴﻞ ﻭﻗﺎﻝ، ﻭﺇﺿﺎﻋﺔ اﻟﻤﺎﻝ، ﻭﻛﺜﺮﺓ اﻟﺴﺆاﻝ

‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের তিনটি কাজ অপছন্দ করেন। ১. অনর্থক কথাবার্তা, ২. সম্পদ নষ্ট করা, ৩. অধিকহারে প্রশ্ন করা।’
[সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৪৭৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৫৯৩]

মানুষের অর্জিত ধন-সম্পদে তার একচ্ছত্র ও নিরঙ্কুশ অধিকার নেই। বরং তা তার নিকট আল্লাহ প্রদত্ত এক আমানত। আর আমানতের বস্তু যথেচ্ছা ব্যবহার করা বা নষ্ট করা খিয়ানত। কিয়ামতের দিন তাকে এবিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

ﻻ ﺗﺰﻭﻝ ﻗﺪﻣﺎ ﻋﺒﺪ ﻳﻮﻡ اﻟﻘﻴﺎﻣﺔ ﺣﺘﻰ ﻳﺴﺄﻝ ﻋﻦ ﻋﻤﺮﻩ ﻓﻴﻤﺎ ﺃﻓﻨﺎﻩ، ﻭﻋﻦ ﻋﻠﻤﻪ ﻓﻴﻢ ﻓﻌﻞ، ﻭﻋﻦ ﻣﺎﻟﻪ ﻣﻦ ﺃﻳﻦ اﻛﺘﺴﺒﻪ ﻭﻓﻴﻢ ﺃﻧﻔﻘﻪ، ﻭﻋﻦ ﺟﺴﻤﻪ ﻓﻴﻢ ﺃﺑﻼﻩ.
ﻫﺬا ﺣﺪﻳﺚ ﺣﺴﻦ ﺻﺤﻴﺢ
‘কিয়ামতের দিন কোনো ব্যক্তি অগ্রসর হতে পারবে না যতক্ষণ না তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে তার জীবন সম্পর্কে, সে কোন পথে তা অতিবাহিত করেছে? তার ইলম ও জ্ঞান সম্পর্কে, সে কোন কাজে তা ব্যবহার করেছে? তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে, কোত্থেকে তা উপার্জন করেছে এবং কোথায় তা ব্যয় করেছে? আর তার দেহ সম্পর্কে, সে কোন কাজে তা ব্যবহার করেছে?
[জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৪১৭]

 

১১. ধূমপানে অর্থ-সম্পদের অপব্যয় হয় :

সম্পদের অপব্যয় হারাম। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ

‘আর অর্থ-সম্পদের অপব্যয় করবে না। নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।’
[সূরা বনী ইসরাইল :২৭]

বাংলায় ‘অপচয়’ ও ‘অপব্যয়’ শব্দ দুটি অনেক ক্ষেত্রে সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও উভয়টির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। বৈধ কোনো কাজে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ব্যয় করার নাম ‘অপচয়’, যেটাকে আরবিতে বলা হয় ‘ইসরাফ’। আর অবৈধ কাজে অর্থ ব্যয়কে বলে ‘অপব্যয়’, যাকে আরবিতে ‘তাবযীর’ বলা হয়। ধূমপান করা মানে অর্থের অপব্যয় করা। অনেক অপব্যয় আছে যাতে মানুষের লাভ-ক্ষতি কিছুই নেই। তবু সেগুলো সকলের কাছে অন্যায় ও অপব্যয় বলে গণ্য। কিন্তু ধূমপান এমন একটি অপব্যয় যাতে মানুষের শুধু ক্ষতিই আর ক্ষতি; কোনো লাভ নেই। যদি কেউ টাকা-পয়সা আগুনে জ্বালিয়ে দেয় তবে তাকে সবাই পাগল বলবে। তাহলে শত শত টাকাকে ধূমপানের মাধ্যমে জ্বালিয়ে দেওয়াকে কী বলা যায়? অতএব উপরিউক্ত আয়াত অনুযায়ী ধূমপান করা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও শয়তানের কাজ।

 

১২. ধূমপান মানুষকে পরনির্ভরশীল ও পরমুখাপেক্ষী করে তোলে :

ধূমপানের দরুন বিভিন্ন দেশে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কোনো কোনো দেশে বছরে মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা ৭ থেকে ১২ ভাগ ক্ষতি হয় ধূমপানজনিত কারণে। বাংলাদেশে তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা, অকালমৃত্যু ও পঙ্গুত্বের কারণে প্রতিবছর ক্ষতি হয় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে, এ খাতে সরকারের বার্ষিক আয় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ফলে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

ধূমপানের জন্য যে পরিমান অর্থ সারা পৃথিবীতে ব্যয় হয়, তা দিয়ে কোটি কোটি ক্ষুধার্ত ও দরিদ্র মানুষদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা যেতো। এক কথায়, ধূমপান করায় অপব্যয় হয় বলে তা নাজায়েয। অপচয় ও অপব্যয় মানুষকে ও দেশকে পরনির্ভরশীল করে রাখতে বড় ভূমিকা পালন করে। আজ যে অপচয়কারী, অপব্যয়কারী ও বিলাসী, হতে পারে কাল সে ভিখারী ও পরমুখাপেক্ষী। এটা ব্যক্তি জীবনের মতো রাষ্ট্রীয় জীবনেও সত্য।

 

১৩. ধূমপান নেশা উদ্রেক করে :

মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, মাদকাসক্তের প্রথম স্তরই হচ্ছে বিড়ি-সিগারেট। এজন্য যারা মাদকদ্রব্য সেবন করে তাদের ৯৫%-ই প্রথমে ধূমপানে অভ্যস্ত হয়, তারপর মাদক সেবন শুরু করে। হাদীস শরীফে এসেছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

ﻣﺎ ﺃﺳﻜﺮ ﻛﺜﻴﺮﻩ ﻓﻘﻠﻴﻠﻪ ﺣﺮاﻡ .
ﻫﺬا ﺣﺪﻳﺚ ﺣﺴﻦ ﻏﺮﻳﺐ

‘যে বস্তু অধিক পরিমাণে গ্রহণ করলে নেশা সৃষ্টি হয়, তার সামান্য পরিমাণও হারাম।’
[জামে তিরমিযী, হাদীস : ১৮৬৫]

আর অধিক পরিমাণে নিকোটিন বা তামাক গ্রহণ নেশা সৃষ্টি করে- এটা এক প্রমাণিত সত্য। তাই এ হাদীসের আলোকে অল্প পরিমাণ ধূমপানও নাজায়েয হবে। কারণ এগুলোর অধিক পরিমাণ নেশা সৃষ্টি করে থাকে।

অপর হাদীসে আছে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

ﻭاﻟﺨﻤﺮ ﻣﺎ ﺧﺎﻣﺮ اﻟﻌﻘﻞ

‘মাদকদ্রব্য তাই যা জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ করে।’
[সহীহ বুখারী, হাদীস : ৪৬১৯]
আর ধূমপান জ্ঞান-বুদ্ধি শতভাগ লোপ না করলেও কিছুটা লোপ করে।

 

১৪. ধূমপান অপরাধ প্রবণতা সৃষ্টি করে :

মদপানের কুফলসমূহ ঠিক ধূমপানের দ্বারাও সৃষ্টি হয়। সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ধূমপান ও নেশাদ্রব্য গ্রহণের ফলে মানসিক তীব্র প্রতিক্রিয়া ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, হতাশা, অবসাদ ও দুর্বলতা বাড়ে, অসংলগ্ন আচরণ ও উগ্র মেজাজ সৃষ্টি হয়; এমনকি নেশাগ্রস্ত মায়ের সন্তানও উগ্র স্বভাবের হয়ে থাকে। ধূমপান ও নেশাদ্রব্য গ্রহণের ফলাফল হলো উচ্ছৃংখল আচরণ, চুরি, রাহাজানি ও অন্যান্য অপরাধ। সমাজে যারা বিভিন্ন অপরাধ করে বেড়ায় তাদের প্রায় ৯৮%-ই ধূমপান করে থাকে। এজন্য সর্বপ্রকার মাদকদ্রব্য, বিড়ি-সিগারেট ও তামাকের চর্চা যদি বন্ধ করে দেওয়া যায় তাহলে অর্ধেক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ও অর্ধেক জেলখানা আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে। অতএব মদপান যেমন নিষিদ্ধ তেমনি ধূমপানও নিষিদ্ধ হবে। কেননা মূলত ব্যভিচার হারাম হলেও কুদৃষ্টি নামক সূচনাকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
নেশাদ্রব্য প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ . إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ ۖ فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ

‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তির বেদী এবং ভাগ্য নির্ধারক শর হচ্ছে শয়তানের অপবিত্র কাজ। অতএব তোমরা এগুলো থেকে বেঁচে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হতে পারো। শয়তান তো চায়, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে। অতএব তোমরা কি সাবধান হবে না?’
[সূরা মায়িদাহ : ৯০-৯১]

এছাড়া মদপানের স্বাস্থ্যগত ক্ষতির অনেকগুলোই ধূমপান দ্বারাও হয়ে থাকে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, ধূমপান ও নেশাদ্রব্য গ্রহণের ফলে ক্ষুধা ও হজমশক্তি নষ্ট হয়, চেহারা বিকৃত হয়ে পড়ে, কর্মক্ষমতা কমে যায়, স্থায়ীভাবে জ্ঞানবুদ্ধি হ্রাস পায়, রক্ত দূষণ হয়, স্নায়ু দুর্বল হয়ে আসে, লিভার ও কিডনী বিনষ্ট হয়ে যায়, বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, স্থায়ীভাবে কফ ও কাশি দেখা যায়, যৌনশক্তি হ্রাস পায় ও স্বাভাবিক যৌন স্পৃহা কমে যায়, শ্রবণশক্তি কমে যায়, দাঁতে, মুখে ও ফুসফুসে কালো আবরণ তৈরি হয়, পুরুষত্বহীনতা, ক্যান্সার, এইডস এবং অনিবার্য মৃত্যুর সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

 

১৫. সন্দেহজনক বিষয়ও পরিত্যাজ্য :

হাদীস শরীফে আছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

ﺇﻥ اﻟﺤﻼﻝ ﺑﻴﻦ، ﻭﺇﻥ اﻟﺤﺮاﻡ ﺑﻴﻦ، ﻭﺑﻴﻨﻬﻤﺎ ﻣﺸﺘﺒﻬﺎﺕ ﻻ ﻳﻌﻠﻤﻬﻦ ﻛﺜﻴﺮ ﻣﻦ اﻟﻨﺎﺱ، ﻓﻤﻦ اﺗﻘﻰ اﻟﺸﺒﻬﺎﺕ اﺳﺘﺒﺮﺃ ﻟﺪﻳﻨﻪ، ﻭﻋﺮﺿﻪ، ﻭﻣﻦ ﻭﻗﻊ ﻓﻲ اﻟﺸﺒﻬﺎﺕ ﻭﻗﻊ ﻓﻲ اﻟﺤﺮاﻡ، ﻛﺎﻟﺮاﻋﻲ ﻳﺮﻋﻰ ﺣﻮﻝ اﻟﺤﻤﻰ، ﻳﻮﺷﻚ ﺃﻥ ﻳﺮﺗﻊ ﻓﻴﻪ، ﺃﻻ ﻭﺇﻥ ﻟﻜﻞ ﻣﻠﻚ ﺣﻤﻰ، ﺃﻻ ﻭﺇﻥ ﺣﻤﻰ اﻟﻠﻪ ﻣﺤﺎﺭﻣﻪ

‘হালাল স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট। আর এ দুয়ের মাঝে আছে সন্দেহজনক বিষয়াবলী, যা (হালাল না হারাম) অনেক মানুষই জানে না। যে ব্যক্তি এ সন্দেহজনক বিষয়গুলো পরিহার করল, সে তার দ্বীন ও সম্মান রক্ষা করলো। আর যে এ সন্দেহজনক বিষয়গুলোতে লিপ্ত হল সে প্রকারান্তরে হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ল..।’
[সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫২; সহীহ মুসলিম হাদীস : ১৫৯৯]

ধূমপান সন্দেহাতীতভাবে ক্ষতিকর ও নাজায়েয। তর্কের খাতিরে ধূমপানকে নাজায়েয না মানলেও বলা যায়, যারা ইসলামের দৃষ্টিতে ধূমপান নিষিদ্ধ হওয়ার কোনো প্রমাণ পাচ্ছেন না তারা অন্তত উপরিউক্ত হাদীসটির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারেন। কারণ এ হাদীসের আলোকে ধূমপান হালাল বা হারাম বলে সন্দেহ হলেই তা বর্জন করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

 

১৬. উপকার না থাকলেই বর্জনীয় :

হাদীসের আলোকে কোনো বস্তু বা কাজে মানুষের কোনো উপকারিতা না থাকলে তা বর্জনের নির্দেশনা রয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

ﻣﻦ ﺣﺴﻦ ﺇﺳﻼﻡ اﻟﻤﺮء ﺗﺮﻛﻪ ﻣﺎ ﻻ ﻳﻌﻨﻴﻪ

‘যে সকল কথা ও কাজ মানুষের কোনো উপকারে আসে না, তা পরিহার করা তার ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য।’
[জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৩১৭]

আর একথা সকলেই স্বীকার করে যে, ধূমপান মানুষের কোনো উপকারে আসে না; বরং ক্ষতিই করে। কাজেই ইসলামের সৌন্দর্য রক্ষার্থে তা বর্জন করাই কর্তব্য।

বিড়ি-সিগারেট বিক্রির হুকুম :

ধূমপানে যেহেতু মানুষের শারীরিক, আর্থিক, মানসিক, চারিত্রিক ও ধর্মীয় মারাত্মক ক্ষতি বিদ্যমান, আবার সাথে সাথে তা অন্যদেরও কষ্ট ও ক্ষতির কারণ হয় তাই ধূমপান করা, এর সামগ্রী উৎপাদন ও বিক্রি করা এবং ধূমপানের বিজ্ঞাপন প্রচার করা সম্পূর্ণ নাজায়েয। কেননা এসবের দ্বারা অবৈধ কাজে মানুষকে উৎসাহ ও সহায়তা করা হয়, যা নাজায়েয। তদ্রূপ বিড়ি-সিগারেট তৈরির কারখানায় কাজ করাও বৈধ নয়। কারণ এটিও নাজায়েয কাজে সহযোগিতার শামিল। তাই এধরনের কোম্পানীর কাজ ছেড়ে দিয়ে বৈধ কোনো কাজ করে জীবিকা উপার্জনের চেষ্টা করা উচিত।
এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَتَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلۡبِرِّ وَٱلتَّقۡوَىٰۖ وَلَا تَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلۡإِثۡمِ وَٱلۡعُدۡوَٰنِۚ

‘তোমরা পূণ্য ও তাকওয়ার কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা কর এবং গুনাহ ও সীমালঙ্ঘণের কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করো না।’
[সূরা মায়িদাহ : ২]

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

ﻣﻦ ﺳﻦ ﻓﻲ اﻹﺳﻼﻡ ﺳﻨﺔ ﺣﺴﻨﺔ، ﻓﻠﻪ ﺃﺟﺮﻫﺎ، ﻭﺃﺟﺮ ﻣﻦ ﻋﻤﻞ ﺑﻬﺎ ﺑﻌﺪﻩ، ﻣﻦ ﻏﻴﺮ ﺃﻥ ﻳﻨﻘﺺ ﻣﻦ ﺃﺟﻮﺭﻫﻢ ﺷﻲء، ﻭﻣﻦ ﺳﻦ ﻓﻲ اﻹﺳﻼﻡ ﺳﻨﺔ ﺳﻴﺌﺔ، ﻛﺎﻥ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺯﺭﻫﺎ ﻭﻭﺯﺭ ﻣﻦ ﻋﻤﻞ ﺑﻬﺎ ﻣﻦ ﺑﻌﺪﻩ، ﻣﻦ ﻏﻴﺮ ﺃﻥ ﻳﻨﻘﺺ ﻣﻦ ﺃﻭﺯاﺭﻫﻢ ﺷﻲء

‘যে ব্যক্তি ইসলামে কোনো ভালো কাজের প্রচলন দান করবে, সে সেটির সওয়াব পাবে এবং সে অনুযায়ী যারা কাজ করবে তাদের সওয়াবও সে পাবে, তাতে তাদের সওয়াবে কোনো কমতি হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোনো খারাপ কাজের প্রবর্তন করবে সে সেটির পাপ বহন করবে এবং যারা সেটির অনুসরণ করবে তাদের পাপও সে বহন করবে, তাতে তাদের পাপের কোনো কমতি হবে না।’
[সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১০১৭]

সুতরাং কাউকে ধূমপান করালে কিংবা কোনোভাবে এতে সহযোগিতা করলে গুনাহ হবে। পক্ষান্তরে ধূমপান হতে মানুষকে বিরত রাখলে আজীবন তার সওয়াব হতে থাকবে। অতএব প্রশাসনের কর্তব্য, বিড়ি-সিগারেট ও অন্যান্য তামাকপণ্য বিক্রি বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া।

 

ধূমপান প্রতিরোধে করণীয় :

 

উপরের আলোচনা দ্বারা একথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, ধূমপান ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সকলের জন্যই ক্ষতিকর। শারীরিক, আর্থিক, মানসিক ও ধর্মীয় সবরকমের ক্ষতিই এতে বিদ্যমান। ধূমপানের এসব ক্ষতি ও কুফলের প্রতি লক্ষ্য করলে এর প্রতিরোধে হেলাফেলার কোনো সুযোগ থাকতে পারে না। মানুষ যাতে ধূমপান ছেড়ে দেয় এবং নতুন করে কেউ আর এতে আকৃষ্ট না হয়, সে জন্য সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। সবাইকে ধূমপানের কুফল সম্পর্কে ব্যাপক ভিত্তিতে প্রচারণা চালাতে হবে।

অভিভাবকগণ সন্তানকে জ্ঞান দান করবেন এবং অসৎ সঙ্গীদের থেকে দূরে রাখবেন। ইমাম-খতীব ও উলামায়ে কেরাম মানুষকে উপদেশ দিবেন। চিকিৎসক ও সমাজকর্মীগণ মানুষকে সতর্ক করবেন। মিডিয়া ধূমপানের কুফল সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালাবে। শিক্ষামন্ত্রণালয় ধূমপানের ক্ষতিকর দিকসমূহ পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করবে। আর সরকার ধূমপান সামগ্রীর উৎপাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি উন্মুক্তভাবে ধূমপান করলে শাস্তির বিধান রেখে মজবুত আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করবে।

 

শেষকথা :

এ লেখায় ধূমপান নাজায়েয প্রমাণের জন্য দলীল হিসেবে কোনো আলেম বা ফকীহ’র উক্তি উল্লেখ করা হয়নি। দলীল দেওয়া হয়েছে কুরআন ও হাদীস থেকে। যা নিশ্চিতভাবেই অন্য সকল দলীলের উর্ধ্বে। তাই, এতোদিন না জেনে যারা ধূমপান করেছেন তারা আজ জানার পর সঙ্গে সঙ্গে এই নাজায়েয বস্তু চিরতরে ত্যাগ করার প্রতিজ্ঞা করবেন এবং অন্যদেরকেও ত্যাগ করতে উদ্বুদ্ধ করবেন ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা ভরপুর তাওফীক দান করুন। আমীন।

নিম্নে এবিষয়ে মাসিক আলকাউসারের একটি ফতোয়া উল্লেখ করা হলো :

প্রশ্ন ১৫৯৫: বিড়ি-সিগারেটের ব্যাপারে ইসলামের হুকুম কী? দ্বিতীয়ত বিড়ি-সিগারেট খাওয়া ও বিক্রির ব্যাপারে ইসলামের হুকুম কী?

উত্তর: বিড়ি-সিগারেট পান করা নাজায়েয। কেননা এতে নিজের শারীরিক ক্ষতি তো আছেই, পাশাপাশি অন্যেরও ক্ষতি করা হয়। মুখের দুর্গন্ধের দরুন মানুষ ও ফেরেশতাকে কষ্ট দেওয়া হয়। অপচয়ের বিষয়টিও রয়েছে। তাই তা যেমনিভাবে পান করা যাবে না। তেমনিভাবে তা বিক্রি করাও যাবে না।
[আদ্দররুল মুখতার ৬/৪৫৯; রদ্দুল মুহতার ৫/২৯৫; তাহতাবী আলাদ্দুর ৪/২২৭; ফাতাওয়া ফী শুরবিন দুখান]

লিখেছেন, মুফতী মুহাম্মদ ইমদাদুল্লাহ হফি. মুফতী ও মুহাদ্দিস, জামেআ হাকীমুল উম্মত, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ,ঢাকা।

 

আইডিসির সাথে যোগ দিয়ে উভয় জাহানের জন্য ভালো কিছু করুন!

 

আইডিসি এবং আইডিসি ফাউন্ডেশনের ব্যপারে  জানতে  লিংক০১ ও লিংক০২ ভিজিট করুন।

আইডিসি  মাদরাসার ব্যপারে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। 

আপনি আইডিসি  মাদরাসার একজন স্থায়ী সদস্য /পার্টনার হতে চাইলে এই লিংক দেখুন.

আইডিসি এতীমখানা ও গোরাবা ফান্ডে দান করে  দুনিয়া এবং আখিরাতে সফলতা অর্জন করুন।

কুরআন হাদিসের আলোকে বিভিন্ন কঠিন রোগের চিকিৎসা করাতেআইডিসি ‘র সাথে যোগাযোগ করুন।

ইসলামিক বিষয়ে জানতে এবং জানাতে এই গ্রুপে জয়েন করুন।

 

Islami Dawah Center Cover photo

 

ইসলামী দাওয়াহ সেন্টারকে সচল রাখতে সাহায্য করুন!

 

ইসলামী দাওয়াহ সেন্টার ১টি অলাভজনক দাওয়াহ প্রতিষ্ঠান, এই প্রতিষ্ঠানের ইসলামিক ব্লগটি বর্তমানে ২০,০০০+ মানুষ প্রতিমাসে পড়ে, দিন দিন আরো অনেক বেশি বেড়ে যাবে, ইংশাআল্লাহ।

বর্তমানে মাদরাসা এবং ব্লগ প্রজেক্টের বিভিন্ন খাতে (ওয়েবসাইট হোস্টিং, CDN,কনটেন্ট রাইটিং, প্রুফ রিডিং, ব্লগ পোস্টিং, ডিজাইন এবং মার্কেটিং) মাসে গড়ে ৫০,০০০+ টাকা খরচ হয়, যা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। সেকারনে, এই বিশাল ধর্মীয় কাজকে সামনে এগিয়ে নিতে সর্বপ্রথম আল্লাহর কাছে আপনাদের দোয়া এবং আপনাদের সহযোগিতা প্রয়োজন, এমন কিছু ভাই ও বোন ( ৩১৩ জন ) দরকার, যারা আইডিসিকে নির্দিষ্ট অংকের সাহায্য করবেন, তাহলে এই পথ চলা অনেক সহজ হয়ে যাবে, ইংশাআল্লাহ।

যারা এককালিন, মাসিক অথবা বাৎসরিক সাহায্য করবেন, তারা আইডিসির মুল টিমের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন, ইংশাআল্লাহ।

আইডিসির ঠিকানাঃ খঃ ৬৫/৫, শাহজাদপুর, গুলশান, ঢাকা -১২১২, মোবাইলঃ +88 01609 820 094, +88 01716 988 953 ( নগদ/বিকাশ পার্সোনাল )

ইমেলঃ info@islamidawahcenter.com, info@idcmadrasah.com, ওয়েব: www.islamidawahcenter.com, www.idcmadrasah.com সার্বিক তত্ত্বাবধানেঃ হাঃ মুফতি মাহবুব ওসমানী ( এম. এ. ইন ইংলিশ )